পঞ্চম পর্ব
[তপন বাগচী—একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তিনি ১৯৬৮ সালের জন্ম ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তুষ্টচরণ বাগচী; মা জ্যোতির্ময়ী বাগচী। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএ ও পিএইচডি করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ: শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি, কেতকীর প্রতি পক্ষপাত, অন্তহীন ক্ষতের গভীরে, সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল। প্রবন্ধগ্রন্থ: সাহিত্যের এদিক-সেদিক, সাহিত্যের কাছে-দূরে, চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : চন্দ্রাহত অভিমান, নির্বাচন সাংবাদিকতা, নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার, তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ। পুরস্কার ও স্বীকৃতি: সাংস্কৃতিক খবর পদক (কলকাতা, ২০১৩), মাইকেল মধুসূদন পদক (২০১২), লিটল ম্যাগাজিন মঞ্চ সংবর্ধনা (নদীয়া ২০১০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), কবি বাবু ফরিদী সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), মাদারীপুর সুহৃদ পর্ষদ সম্মাননা (২০০৯), ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা (২০০৯), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা ২০০৮), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮), জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)।
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার পর বর্তমানে বাংলা একাডেমির গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের উপপরিচালক। সম্প্রতি সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, দর্শন বিষয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক হামিম কামাল। আজ প্রকাশিত হলো পঞ্চম (শেষ) পর্ব]
হামিম কামাল: আর বিদেশি সাহিত্যের মধ্যে? ইংরেজি, ফরাসি, রুশ বা লাতিন সাহিত্যের কারা?
তপন বাগচী: বিশ্বসাহিত্যের পাঠ তো আমাদের অনুবাদের মাধ্যমেই বেশি পড়া। আমি ঠিক একেবারে মূলভাষায় বই কম পড়েছি। অনুবাদের মধ্যে যেসব আমি পড়েছি, একেবারে কমন বইগুলোতেই আমার ভালো লাগা। আর বাংলা সাহিত্যেরই এত বিস্তৃত পাঠ আমার বাকি রয়ে গেছে যে, অনুবাদের দিকে আমি অত সময় দিতে পারিনি। একটা সময় ছিল যখন বিদেশি শব্দ, স্থান থাকলে আমি ঠিক নিজের ভেতর ছবি আঁকতে পারতাম না ওই ছবির। এখনো আমি অনুবাদ খুব কম পড়ি। লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার। অনেক বিতর্কিত একটি বই। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগার বইগুলোর মধ্যে একটি।
প্রবন্ধ যদি বলি, অনুবাদের মাধ্যমে পেয়েছি বটে, ডাস ক্যাপিটাল একসময় খুব পড়েছি। প্রবন্ধ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান বলি সব হিসেবেই ডাস ক্যাপিটাল। আমি মনে করি এটি একটি চিরকালীন সেরা গ্রন্থ। আমার অনুবাদ-পাঠের দুর্বলতার কথা স্বীকার করি। কিন্তু তার জন্যে কোনো আক্ষেপ করি না। কারণ রবীন্দ্রনাথ পড়েও জীবন কাটানো যায়। শুধু জীবনানন্দ দাশ পড়েও। এক বনলতা সেন বারবার পড়েও জীবন কাটানো যায়।
হামিম কামাল: তপনদা। আপনি একটা কথা বলেছেন যে, এখন পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যের সমস্ত ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কমন সর্বোচ্চ শিখর। তো রবীন্দ্রনাথ যে মেধা নিয়ে এসেছিলেন, পরবর্তী সাধকরাও তো সেই একই পরিমাণ মগজ নিয়ে জন্মাচ্ছে। সাধনাও কম করছে না। আপনি আপনার জায়গা থেকে কোনো রহস্য ভেদ করতে কখনো চেষ্টা করেছেন কিনা। রবীন্দ্রনাথকে ছাপিয়ে যাওয়ার কোনো পথ আছে কিনা।
তপন বাগচী: রবীন্দ্রনাথের যে সুবিধাটা ছিল প্রতিষ্ঠার জন্যে শিক্ষা কিংবা চাকরি, ব্যবসার জন্যে তার অতোটা ভাবতে হয়নি। যদিও তিনি কিন্তু ফুলটাইম জমিদারিও করেছেন। তার অর্থনৈতিক চিন্তা ছিল না। জীবিকার জন্যে চিন্তা ছিল না। আরেকটা যেটা বলা যায় সেটি করুণ এরপরও বলতে তার তার এতো বিস্তৃত লেখার পরিমাণের পেছনে কাজ করেছে, তার ব্যক্তিগত পারিবারিক বিয়োগশোক। এতগুলো মৃত্যু তিনি অনুভব করেছেন। সন্তান, পিতা, মাতা, বৌদি, ভাই মানে অনেক মৃত্যুর ভেতর দিয়ে তিনি গেছেন। এই শোক ভোলার জন্য তাঁর খাতাকলম ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এই শোকগুলো তাঁকে ব্যথিত করেছে, কিন্তু সাহিত্যের পাঠককে উপকৃত করেছে।
হামিম কামাল: তাঁকে যদি কেউ উৎরাতে চায় তো শোকসাগরের ভেতর দিয়ে সাঁতরাতে হবে।
তপন বাগচী: এটা বলব না, বললে তা নির্মমতা হবে। আমরা চাই না কেউ তেমন শোকে পড়ুক সাহিত্য রচনার জন্যে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জীবনের যে বিস্ময়টি তা হলো, এখন আমাদের যে জটিল জীবনযাত্রা এর মধ্য দিয়ে এরকম লেখা—সংখ্যার দিক দিয়েই শুধু বলব না, মানের দিক থেকেও বলব, যে ওনার যে বিশ্ববীক্ষা ছিল, কত দেশ ঘুরেছেন, কত মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, কত ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। প্রত্যেক ধর্মের বিষয়ে তাঁর জানাশোনা ছিল। এই যে অধীতবিদ্যা, পারিবারিক ঐতিহ্য–বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের একটা ঐতিহ্য ছিল সে কারণে তার রক্তেই এ জিনিসগুলো তৈরি ছিল, তিনি উৎপাদন করে গেছেন। কিন্তু আমাদের মতো এক প্রজন্ম এটি পারবে না। আমাদের উৎপাদনক্ষমতা অতটা হবে না। আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা দিতেই হবে কেন। কেউ কেউ একটি বই লিখেও বিশেষ খ্যাতি পেতে পারেন। দুটি লিখেও হতে পারেন, সেরকম অনেক লেখকও আসবেন আমাদের মাঝে। আমরা শামসুর রাহমানকেও কম বড় কবি মনে করি না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করলে ঠিক হবে না, দু’জন দুই সময়ের। দু’জন দুই ঘরানার, দুই চিন্তার। বড় কবি অনেকে এসেছেন, বড় ঔপন্যাসিক অনেকে এসেছেন। তবে টোটালটা মিলে যে শক্তি রবিন্দ্রনাথ ধারণ করেন সেটি আরও কারও কাছ থেকে পাব কিনা সন্দেহ।
হামিম কামাল: রবীন্দ্রনাথের ওই জমিদারির কথা এলো। আমার কাছে এটা একটু খোঁড়া যুক্তি মনে হয় এজন্যে যে, জমিদারি তো আরও অনেকেরই ছিল। সবাই তো রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাননি। আর সম্পদরক্ষার প্রচণ্ড চাপ, দায় এসবও কবিগুরুকে ভোগ করতে হয়েছে। এত বৈষয়ীপনার ভেতর দিয়ে যেতে হলে তো সাহিত্যচর্চা আরও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
তপন বাগচী: জমিদারি অনেকেরই ছিল কিন্তু অনেকে তো সেটা কাজে লাগায়নি। ওটাকেই সম্ভোগ করা নিয়ে তারা ব্যস্ত ছিল, উপভোগ করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সুযোগটাকে নিয়ে সাহিত্যচিন্তায় তা কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য নয় শুধু,এই মানুষটি সমাজের জন্যেও কী না করেছেন। আজ যে তত্ত্বের কারণে নোবেল পুরস্কার পেলেন ড. ইউনূস,সেই তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা কিন্তু অনেক আগেই তিনি পতিসরে করে গেছেন। আজকের আইন ও শালিস কেন্দ্র বা এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ চালু করে গেছেন। আজ কমিউনিটি মেডিক্যাল সেন্টারের কথা বলি সেটিও রবীন্দ্রনাথ চালু করে গেছেন। আজকে গোলাঘর- অনেক এনজিও সঞ্চয় থেকে নিয়ে একটি মধ্যবর্তী জায়গায় রাখা, সেটিও রবীন্দ্রনাথ করে গেছেন। অর্থাৎ আরও শত বছর পর আমরা যা চিন্তা করছি অর্থাৎ বিদেশি টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি, রবীন্দ্রনাথ সেগুলোও করে গেছেন। অর্থাৎ সমাজ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর সাহিত্য তো বটেই- সব দিকেই তিনি অনেক অগ্রসর চিন্তার অধিকারী ছিলেন। তার চিন্তা শতবর্ষ পর বাস্তবায়ন করে নোবেল জয় হয়।
হামিম কামাল: তপনদা। অনেকটা পথ আপনি পেরিয়ে এসেছেন। উত্তরপ্রজন্ম যারা শিল্পে নতুন পা রাখতে চলেছে তাদের তপস্যা কোনমুখী হওয়া উচিত?
তপন বাগচী: তাদের একটা কথা বলব—সহজ প্রচারের দিকে না গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যখন গান শিখতে যান তখন তাঁর গুরু তাঁকে বলেছিলেন, বারো বছর শুধু সরগম করো এরপর গান এনো কণ্ঠে। তিনি বারো বছর তাই করেছেন। আমরা তো প্রথম দিনই টেলিভিশনে মুখ দেখাতে চাই, প্রথম দিনই পত্রিকায় লেখা ছাপাতে চাই। সাধনার এমন একটা সময়। হয়ত বারো বছর দরকার নেই। সেটি তিন থেকে চার বছরও হতে পারে, এই সাধনার সময়টুকু আমাদের রাখা উচিৎ। প্রচারের দিকে না গিয়ে, নিজেকে প্রকাশের দিকে না গিয়ে। এটা উচিৎ পরিপক্ব হওয়ার জন্যে, আপন মূলধন তৈরির জন্যে, বিতরণের আগে নিজের মূলধন তৈরির জন্যে।
হামিম কামাল: বাংলাদেশের বিষয়ে স্বপ্ন?
তপন বাগচী: কবিতা লিখি যেহেতু আমি স্বপ্নবান। এখন যে স্থবির অবস্থা আশা করি এটি আগামি কয়েক বছরে কেটে যাবে। এটি থাকবে না, মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে। মানুষ তার অস্তিত্বকে বুঝতে পেরে নিজ অবস্থান ফেরাবে। সমাজের দুই শতাংশ লোকের জন্যে অস্তিরতা তৈরি হয়েছে। এসব থাকবে না। লড়াই করে মায়ের ভাষাকে যেমন প্রতিষ্ঠা করেছি, দেশকে স্বাধীন করেছি, এসবে প্রমাণিত হয় এ জাতি নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করবেই।
হামিম কামাল: তপনদা, কত বছর বয়েস অব্দি বাঁচতে চান?
তপন বাগচী: বয়স নির্ধারণ করতে চাই না। যতদিন বাঁচি সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমি লিখতে চাই বা লেখার ভাবনা যেন থাকে আমার ভেতর। আমি যদি দশ বছর পরও মারা যাই আমার আক্ষেপ নেই। বিশ বছরেও আক্ষেপ নেই। এখন যে ক’দিন বাঁচবো মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েই বাঁচব।
হামিম কামাল: জীবন সম্পর্কে বিশেষ কোনো উপলব্ধি আছে আপনার?
তপন বাগচী: জীবন সম্পর্কে হয় কি, আমাদের কবিতা যাঁরা লেখেন, তাঁরা এক ধরনের বিষয় অনুধাবন করেন। সবসময় নিজের অভিজ্ঞতার কথাই যে কবিতায় আসে তা কিন্তু না। গতকালই আমার এক শিল্পী বন্ধু বলছিলেন যে, বন্ধু তোমার গানে যে জীবন দর্শন দেখি, একেবারে বাস্তব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে না গেলে তোমার এটা লেখার কথা নয়। সত্যি করে বলো তো, তুমি কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছ কিনা? আমি বলি, না। সে বলে, তবে এ গান তো তোমার আসার কথা না। আমি বলি, আমি তো আমার বন্ধুর অনুভূতিও ধার করি। আমি গল্প উপন্যাসের পড়া অনুভূতি নিয়েও গান লিখি। আমি আরেকটি গান শোনার অনুভূতি নিয়েও গান লিখি। কবি যা লেখে সব তার নিজস্ব জীবনদর্শন নয়। যে কারণে প্রচলিত আছে—কবিকে খুঁজো না তার জীবন চরিতে। আমার কবিতা খুঁজলে যে আমার জীবন দর্শন পাওয়া যাবে তা নয়। আমার বন্ধু, বান্ধবী, শিক্ষকের জীবন আছে, আমার অনুজ যারা, অনুসারী যারা তাদের ভাবনাও আমার ভেতরে আছে। জীবন ক্ষণস্থায়ী। যত দিন যাপন করি সুস্থ, সৎভাবে, অপরের ক্ষতি না করে যথাশান্তিতে বাস করতে চাই। জীবন নিয়ে এর বেশি ভাবি না।
হামিম কামাল: আপনার রাজনীতি, ধর্মভাবনা?
তপন বাগচী: আমার রাজনীতি? এটি এখন আর কোনো দলীয় রাজনীতির মধ্যে নেই। এটি সামগ্রিক মানবমুক্তির লক্ষ্যে কাজ করাটাকেই আমি আমার রাজনীতি ভাবি। ধর্ম সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি এরকম, ধর্মের আভিধানিক অর্থ যা ধারণ করা হয়, তাই ধর্ম। আগুনের ধর্ম হলো তার দাহিকা শক্তি। তার ধর্ম, সে পোড়াবেই। জলের ধর্ম সে ভেজাবে, কিংবা নীচের দিকে ধাবিত হবে। মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত মানবতা। পাশবিকতা কিংবা দানবিকতা নয়। মানুষকে ভালোবাসা মানবতার প্রাথমিক কাজ। আমি মানবিকতার ধর্মে বিশ্বাস করি। প্রচলিত যেসব আচারনিষ্ঠ ধর্ম, সেগুলো যারা পালন করে তাদের প্রতি আমার কোনো বিরাগ বা অবজ্ঞা নেই।
শেষ.
দেশপ্রেম একটি সহজাত প্রবণতা-০৪॥ তপন বাগচী
দেশপ্রেম একটি সহজাত প্রবণতা-০৩ ॥ তপন বাগচী
দেশপ্রেম একটি সহজাত প্রবণতা-০২ ॥ তপন বাগচী
দেশপ্রেম একটি সহজাত প্রবণতা-০১ ॥ তপন বাগচী