পর্ব: ৪
[তপন বাগচী—একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তিনি ১৯৬৮ সালের জন্ম ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তুষ্টচরণ বাগচী; মা জ্যোতির্ময়ী বাগচী। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএ ও পিএইচডি করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ: শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি, কেতকীর প্রতি পক্ষপাত, অন্তহীন ক্ষতের গভীরে, সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল। প্রবন্ধগ্রন্থ: সাহিত্যের এদিক-সেদিক, সাহিত্যের কাছে-দূরে, চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : চন্দ্রাহত অভিমান, নির্বাচন সাংবাদিকতা, নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার, তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ। পুরস্কার ও স্বীকৃতি: সাংস্কৃতিক খবর পদক (কলকাতা, ২০১৩), মাইকেল মধুসূদন পদক (২০১২), লিটল ম্যাগাজিন মঞ্চ সংবর্ধনা (নদীয়া ২০১০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), কবি বাবু ফরিদী সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), মাদারীপুর সুহৃদ পর্ষদ সম্মাননা (২০০৯), ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা (২০০৯), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা ২০০৮), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮), জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)।
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার পর বর্তমানে বাংলা একাডেমির গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের উপপরিচালক। সম্প্রতি সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, দর্শন বিষয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক হামিম কামাল। আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ পর্ব]
হামিম কামাল: একটা প্রশ্ন তপনদা,আপনি বলছেন, যে গানে রবীন্দ্রনাথ যে কাঠামো তৈরি করে গেছেন বা পঞ্চকবি যা গ্রহণ করেছেন, আপনি এর বাইরে যেতে চান না। তো শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে এ রকম কিছুকে ধ্রুব রেখে অনুসরণ করা কত সঙ্গত বা সম্ভব?
তপন বাগচী: না,কোথাও ধ্রুব আটকে থাকে না কিছু। কিন্তু একটা গান তো আমার কথাকে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য—বোঝা যায় যে একটি আস্থায়ী—এটি ঘুরে ফিরে আসবে, এরপর অন্তরার মতো করে এটির বিস্তার ঘটবে, এরপর সঞ্চরণ ঘটবে, এরপর আভোগে এসে তার পুরনো জায়গায় যাবে। এই যে ঘূর্ণন, এই যে জার্নি, সেই জার্নিটা তো একটা ছবির ভেতরে আছে। এখন এই ছবিটা ভেঙে অনেকেই নতুন গান বানাচ্ছে। ভাঙা ছবি কি স্বাভাবিকভাবে আমরা মেনে নেই? কখনো কখনো ভাঙাছবিরও নতুন সৌন্দর্য হতে পারে, তা মানছি। নচিকেতার কথা যদি বলি, সুমনের কথা যদি বলি, আমাদের আযম খানের কথা যদি বলি,গানের চিরায়ত প্রথা ভেঙেও কিন্তু তাঁরা জনপ্রিয় হয়েছেন। কিন্তু এগুলো ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম তো আর নিয়ম নয়।
সবাই তো একদিকে যাবে না। ওদিকটায় আমার মন টানে না। আমি চাইলেই নচিকেতার মতো স্ট্রাকচারে গান লিখতে পারি, সুমনের মতো স্ট্রাকচারে গান লিখতে পারি, কিন্তু আমি তো সুরের মানুষ নই। তাই আমার ওই গান কেউ গাইবে না। আমি সুরের লোক নই বিধায় তারা এগিয়ে থাকবেন কারণ তারা সুরেরও লোক, তাঁদের কণ্ঠে গান আছে। একটি কিশোর কবিতা কিংবা পদ্য, জাস্ট লাইনের পর লাইন, তারা সুর দিয়ে ওটিকে গান বানিয়েছেন। আরে ওটি তো কবিতাই, গানের জন্য একটা আলাদা ফরম্যাট তো আছে আমার ভাষায়। অনেকে ইদানীং গদ্যকবিতারও সুর দেওয়া শুরু করেছেন। গানের জন্য আমি লিরিক না খুঁজে কেন গদ্যকবিতায় সুর দেব? এটি হয়ত একধরনের সাময়িক উত্তেজনা তৈরি করে, আনন্দ তৈরি করে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে। কিন্তু আমি মনে করি দীর্ঘদিনের চর্চায় যে ঐহিত্যটা আমার তৈরি হয়েছে, সেটিই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। আবার যাঁরা গান লেখেননি, মধুসূদন দত্ত বা জীবনানন্দ দাশ, এঁদের কবিতাকে যদি সুরে বন্দি করে ছড়িয়ে দিতে চাই, তাতে আরেকটা আলাদা মাত্রা যুক্ত হতে পারে। তাতে আমার আপত্তি নেই।
হামিম কামাল: বেশ, সুরের প্রসঙ্গে একটু আসি। দেখা যায় পৃথিবীতে ভূখণ্ডভেদে সুরের ধাঁচ-আঁচ বদলে যায়। বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীর আর কোন অংশের সুর আপনাকে টানে?
তপন বাগচী: আমি আগে বাংলাদেশের ভেতরের কথাই বলি, এই যে সুর বদলে যায় বললে। সুরের সঙ্গে ভূগোল যুক্ত, আমার পর্যবেক্ষণ যা বলে, পরিবেশ-প্রতিবেশ যুক্ত। ভাওয়াইয়ার ভাঙা সুর কেন? ওই জনপদে গাড়োয়ান বা কোচোয়ান যাঁরা ছিলেন, তাঁরা যেভাবে দূরযাত্রায় যেতেন, কাঁচা রাস্তায়, ওই গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করতে করতে যেত, সেখানে তার স্বরটা ভেঙে ভেঙে যেত। এই ভাঙা সুরে কুচবিহার-রংপুর অঞ্চলের ভূগোল জড়িত। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে সারারাত ধরে গান গাইত, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি কান পেতে গান শুনত, হাওরের জলে ভেজা বাতাস ওই সুরগুলাকে নিয়ে যেত, ওই সুরগুলো লম্বা। পালাগান ওখানে কেন? রাতভর দীর্ঘ পালাগান কেন? ওই বাড়িতে গান শুনতে গেছে, সেখানেই থাকবে। সারারাত গান শুনে তবেই ফিরবে। ওই সুরগুলো কিন্তু লম্বা সুর, এভাবেই তৈরি হয়েছে। আবার ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর ভাটির টানে টানে যখন মাঝিরা শেষবেলায় আস্তে আস্তে নৌকা বাইতে বাইতে ঘরে ফেরে, সে তখন সারাদিনের ক্লান্তি ঝাড়ার জন্য গানকে অবলম্বন করে, তার সুরটাও কিন্তু টেনে টেনে ভাটির স্রোতের মতো যাচ্ছে।
হামিম কামাল: চমৎকার!
তপন বাগচী: প্রতিটায় কিন্তু ভূগোল যুক্ত। আবার আমি ধামাইল গানে যখন যাব, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে, দেখব সে গানে রিদমটা। এটা কিন্তু নারীদের দ্বারা পরিবেশিত হয়। তারা এটি উৎসব—কারও বিয়ে, কারও বাচ্চা হয়েছে, জামাই প্রথমবার বাড়িতে এসেছে, কিংবা পূজা, নানা লোকাচার উপলক্ষে মেয়েরা উঠোনে ঘুরে ঘুরে পায়ের এক ধরনের নৃত্য-কারুকাজ আছে, হাতে তালি দিয়ে, পায়ে পায়ে নাচে, তাতে আলাদা রিদম তৈরি হয়। এটা ওই অঞ্চলের, বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বাড়ি যখন, হাওর অঞ্চলের, তারা ওই গানগুলো করে। জল আনতে যাচ্ছি, ধাইয়ে-ধাইয়ে যাচ্ছি, ধাবমান একটা প্রক্রিয়া আছে। একসঙ্গে জল আনতে যাচ্ছি, দু’পা দু’পা করে এগোচ্ছি আর গান গাচ্ছি। এগুলোর সঙ্গে ভূগোল যুক্ত, ভূগোলের এই বৈচিত্র্যের কারণে সুরে এই বৈচিত্র্য ঘটে। এটি দেশভেদে নয় শুধু, বলা যায় এক জেলার মধ্যেও হতে পারে। দশ কিলোমিটার দূরে গেলেই কিন্তু মানুষের ভাষা বদলে যায়, সঙ্গে সঙ্গে সুর বদলে যায়, এটা ভাষাতাত্ত্বিকদের গবেষণা। বিদেশের কথা যদি বলি—আমি এতটাই দেশমুখী যে বাইরের গান আমার পরিকল্পনা করে শোনা হয় না। ওয়েস্টার্ন গান সবাই বলে, আমরা ইস্টার্ন গান কিন্তু কেউ বলি না। আমাদের কান বিদেশি বলতে কিছুটা ওয়েস্টার্ন গানের সঙ্গে যুক্ত এবং রবীন্দ্রনাথ সেখান থেকে নিয়ে আমার বাউল সুরের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন একটা সুরধারা তৈরি করেছিলেন। আমি সরাসরি বিদেশি সুরগুলোকে গ্রহণ করতে পারি না। আমার মনে হয় কোথায় যেন আমি প্রাণ পাই না, একটু ফাঁকা থাকে। হয়ত নতুনত্ব আছে, মাঝে মাঝে হৃদয়ে কাঁপায়, কিন্তু এরপরও সবমিলিয়ে আমি প্রাণ পাই না, গ্রহণ করতে পারি না।
হামিম কামাল: আমি এবার এইক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনাকে আমি দুষতে চাই। আপনি মেধাবী, আপনার ভূখণ্ডের মানুষের কাছেই শুধু এটা দায়বদ্ধ? আরও বৃহৎ অর্থে এই মেধার প্রতি দাবি সমগ্র পৃথিবীর মানুষেরও আছে। সেটা না মিটিয়ে আপনি ওদের ঘাটতির কথা বলে মুখ ফেরাচ্ছেন।
তপন বাগচী: আমি কিন্তু ওদের ঘাটতির কথা বলিনি। আমি প্রাণ পাই না,সেটা আমার সীমাবদ্ধতা, সে কথা বলেছি। আর এই সীমাবদ্ধতার দুটি কারণ। এক. আমার সুযোগ হয়নি। যেমন আমি সম্প্রতি গিয়েছিলাম সার্ক সুফি ফেস্টিভ্যালে, সুফিগানের আসর ছিল সেখানে। আমি বাংলাদেশের গানের সুফিবাদ বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। খবিরুদ্দিন দেওয়ানের গানে সুফি-প্রভাব। কেরানীগঞ্জের তিনি। ১৮ তারিখে ওরসে আবার যাব তার গান শুনতে। আলেকচান দেওয়ান, খালেক দেওয়ান, মালেক দেওয়ান, এরপর খবির দেওয়ান। সেই খবিরুদ্দিনের গানের সুফিবাদ নিয়ে বলতে গেলাম। অনুষ্ঠান হলো ভারতের জয়পুরে। জয়পুরে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বক্তারা এবং সুফি গানের গায়করা এলেন। পাকিস্তানের একটি কাওয়ালি দল এসেছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে আমি মিশতে পারছিলাম না, একাত্তরের কথা আমার বারবার মনে পড়ছিল। কিন্তু এও জানি, রাজনৈতিক কারণে প্রতিপক্ষ হিসেবে তৈরি হলেও সমস্ত লোক তো তা ছিলেন না। ভালো লোকও তো ছিলেন। এরপরও কেমন একটা মানসিক দ্বন্দ্ব ছিল। তো ওখানে কাওয়ালি গান যারা পরিবেশন করলেন, আমি খুব মুগ্ধ হলাম। এই কাওয়ালি গানের সুরে আমাদের রুনা লায়লার গাওয়া দমাদম মাসকালান্দার দেশে বিদেশে খুব জনপ্রিয় হলো, এ গানটা ওরা গাইল। অন্য স্বাদ পেলাম। আমি দেখলাম যে ওই পাকিস্তানি কাওয়ালি আমাদের পুরান ঢাকার কাসিদার কাছাকাছি। এই সুর আমাকে খুব টানল যদিও আমি বাণী বুঝিনি। আমি বাঙালি হিসেবে বাংলাগানের ঐতিহ্যকে মনে করি এটি বাণীপ্রধান। সুরপ্রধান নয়। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন যে আমরা সুরটা শোনার পরে বাণীটাও আমাদের কানে লেগে থাকে। হুবহু বাক্যটা এমন নয়। সম্প্রতি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানও এ কথা বলেছেন, আমরা গান শুনে শুধু সুর নিয়েই বাড়ি ফিরি না, কথাও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যায়। তো ওই কাওয়ালির সুর আমাকে টেনেছিল।
একনাগাড়ে প্রায় তিন চার ঘণ্টা ওরা গাইল। অগ্রজ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ছিলেন সঙ্গে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোরের অধ্যাপক ড. মোস্তফা তারিকুল আহসান ছিলেন। এরপর ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকে স্ত্রী রুবানা হকও ছিলেন। আমরা চারজন ওখানে গিয়েছিলাম। সঙ্গে অতিথি ছিলেন হুদা ভাইয়ের স্ত্রী, আমাদের প্রিয় সাঈদা ভাবি। তো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের শুধু সুফিপ্রভাবিত গানগুলো শোনার সুযোগ হলো আমার ওখানে। দুরাত শুনলাম। শুনে আমার যা মনে হলো, আমি যে বাউলদের আখড়ায় যাই তা কিন্তু এর চেয়ে আলাদা নয়। কারণ সঙ্গীতের সাত সুরেই তো সব পড়ে। সপ্তকেই তো পড়ে। উপস্থাপনা আলাদা। সুরের যদি আমি ঠিক দর্শনের জায়গাটায় যাই তাহলে আমার কাছে একরকমই মনে হয়। তাই বাউলের আখড়ায় গেলেও আমার কাছে খুব বেশি পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না।
এটি আমার লিমিটেশন হতে পারে যে আমি এক ধরনের গণ্ডিবদ্ধ। বাইরে বলতে আমি ওই সুফি ফেস্টিভ্যালেই যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। শুধু ইউটিউবে শুনে, টেলিভিশনে দেখে গানের আনন্দটা পাওয়া যায় না। শ্রোতা হয়ে শিল্পীর গান যদি সরাসরি শোনা না হয় তো ওই আনন্দটা থাকে না। বিদেশি শিল্পীর গান সরাসরি শোনার এই সুযোগ খুব বেশি আমার হয়নি। এই সীমাবদ্ধতার কথা আমি স্বীকার করি। রবীন্দ্রনাথের যে সুযোগ হয়েছিল। সেখান থেকে নিয়ে তিনি বাংলা গানকে তিনি নতুন এক মাত্রা দিয়েছেন। কখনো সুযোগ হলেও আমি সে চেষ্টা করব। আরেকটা কথা, নিজের দেশের সুরের এত বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য অনুভব না করে পরমুখী হওয়াটাকে আমার মন সায় দেয় না।
হামিম কামাল: আপনার রচিত সাহিত্যের মধ্যে নিজ বিবেচনায় ম্যাগনাম ওপাস কোনটি বলে মনে করেন।
তপন বাগচী: সেটি যদি বলি—কবিতার চারটি বই বেরোলেও আমি এখনও কবিতার বই হাতে নিয়ে যে বলব আমি কবি তেমন বোধ করিনি। নিজেকে কবি ভাবি, আমার সমস্ত সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু কবিতা, ছড়া লিখেছি, তা কবিতারই সম্প্রসারণ; গান লিখছি, তা কবিতারই অন্য মাত্রা। কিন্তু জনসমক্ষে, তিনজনের সামনে দাঁড়িয়ে ‘আমি কবি’, এই পরিচয় দিতে কুণ্ঠা বোধ করি।
হামিম কামাল: এটা আপনার বিনয়ের জায়গা হতে পারে।
তপন বাগচী: আবার ঔদ্ধত্য করে যদি বলি, আমার সময়ে নব্বইয়ের দশকে নব্বই জন কবির তালিকায় আমার নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। যখন আমার বন্ধুরা তালিকাটা করে ওরা আমাকে বাদ দেয়। ওরা চিন্তা করে যে ও তো ছড়াও লেখে, গল্পও লেখে, ওকে বাদ দিলে কিছু হবে না। দশ বছর যাক, বিশ বছর যাক, যখন বয়স্করা থাকবে না, যখন আমার অনুজরা তালিকা করবে তখন আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, তাদের নজরে আমি থাকব। যে বন্ধুরা আমাকে তালিকায় রাখে না, তারা তো এখনই ঝরে পড়ছে। তালিকাপ্রণেতারাই আজ তালিকার বাইরে, কালের বিচার এমনই কঠোর!
নির্দিষ্ট কোনও বইয়ের নাম যদি বলি কবিতার, আমার ‘অন্তঃহীন স্রোতের গভীরে’ নামে আমার একটি কবিতার বই আছে। যে বইটি প্রচারিত তেমন হয়নি। কারণ প্রকাশনা আর চালু ছিল না বেশিদিন। ওই বইটিতে কিছু ভালো কবিতা আছে।
হামিম কামাল: সৃষ্টকর্মের ভেতর ‘অন্তঃহীন স্রোতের গভীরে’কেই আপনি সবার চেয়ে এগিয়ে রাখছেন, ওটাই সবচেয়ে প্রিয়?
তপন বাগচী: না সবচেয়ে প্রিয় বলব না। প্রবন্ধগ্রন্থের ভেতরে বলব আমি যে গবেষণাটা করেছি বাংলাদেশে যাত্রাগান নিয়ে, ডিগ্রি লাভের জন্যে গবেষণাটা করলেও ওটা আমি এতো মনপ্রাণ দিয়ে করেছি, এই বইটি আমি মনে করি যে গবেষণাসাহিত্য বলি, প্রবন্ধসাহিত্য বলি এটিকে নিয়ে গৌরব করতে পারি। এটি আমি বুকে নিয়ে কাউকে দেখাতে পারি যে এটি আমার রচনা। এই দুটির কথা বলি। আর ছড়ায় যদি বলি—যে বইটি আছে, ‘মঙ্গা আসে ঘরের পাশে’, আমি বলব যে এটিকে কেউ ফেলতে পারবে না। ছড়াসাহিত্যের ইতিহাসে এটি এক কোণে হলেও জায়গা করে নেবে। আর বাচ্চাদের জন্য আমি একটি গল্পের বই লিখেছিলাম শিশু একাডেমি থেকে বেরিয়েছে, ‘সাত দিনের সাতকাহন’ নামে। এটি আমাদের সপ্তাহের সাতটি দিনের নামকরণের লৌকিক ইতিহাস। রবিবার কী করে রবিবার হলো, সোমবার কী করে সোমবার হলো। এ সাতদিনের যে লোককাহিনিগুলো আছে সেখান থেকে আমি মর্মার্থটুকু নিয়ে একেবারে যখন সংলাপ ছন্দবদ্ধভাবে বলা, নতুন করে লিখেছি, এটি আমার মৌলিক চিন্তাপ্রসূত নয়, কিন্তু আমার সৃষ্টিটা একটা নতুন আঙ্গিক নিয়েছে। আমি মনে করি, শিশুসাহিত্যের গল্পের ধারায় এটি আনন্দ পাওয়ার মতো একটি বই। তো, এক জীবনে ছাপ্পান্নখানা বই বাজারে বেরিয়েছে, তো তিন চারটি বইয়ের নাম বলতে পারলাম, বাকি নাম পাঠকেরাই বলবে। আমি মনে করি এটিও কম নয়।
হামিম কামাল: এ যাবত লেখা আপনার গানের সংখ্যা কত হবে তপনদা?
তপন বাগচী: লিখতে লিখতে চারশ বত্রিশটা গান হয়েছে। আমার যখন দু’শ আড়াই শ গান হয়, আমার ক্লাস ফাইভে পড়া মেয়ে বলছে বাবা অতুলপ্রসাদের গান কিন্তু দু’শ আটটা। তুমি কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে গেছ। তখন আমি খুঁজে দেখলাম যে নজরুলের গান সাড়ে চার হাজারের মতো, রবীন্দ্রনাথের গান আড়াই হাজারের মতো। অজয় ভট্টাচার্যের গান ষোলশ’র মতো। আমাদের গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গান তিন হাজারের মতো। কেউ বলে ত্রিশ হাজার। তবে কেউ বলে তিন হাজার ত্রিশ হাজারের এত বিশাল ব্যবধান নিশ্চয়ই সত্য নয়। তিন হাজার হতে পারে বিশ্বাসযোগ্য। তো সব মিলিয়ে দেখলাম আমাদের বড় গীতিকার যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশের গান সব মিলিয়ে পাঁচশ’র কম নেই। লালনের গানও সাড়ে চারশ’র বেশি নয়। কিন্তু বাণিজ্যিক গবেষকরা লালনের গান হিসেবে দেড় হাজার গান বাজারে এনেছে। শাহ আবদুল করিম এখন বেশ জনপ্রিয়, তার গানও সাড়ে চারশ’র মতো। বিজয় সরকারের গান চারশ’র মতো। তো আমার ধারণা সংখ্যার বিচারে আমার গানের সংখ্যা কম নয়। তবে আমার একটা চিন্তা এসেছিল এমন, পাঁচশ গান আমি নিজের উদ্যোগে লিখব।
এরপর কোনও প্রয়োজনে, চাহিদায়, কেউ অনুরোধ করলে, কোনও শিল্পী বা সুরকার চাইলে তখন তাদের প্রয়োজনের কথা ভাবা যাবে। কিন্তু অন্তত পাঁচশ গান আমি নিজের মতো করে লিখব।
হামিম কামাল: গানকেন্দ্রিক প্রকাশনা?
তপন বাগচী: আমার গানের তিনটি বই বেরিয়েছে। আর গান নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ আছে ২খানা। গান নিয়ে প্রবন্ধের বই আছে ৩ খানা।
হামিম কামাল: আর স্বীকৃতি?
তপন বাগচী: রেডিও টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে আমি তালিকাভুক্ত। ডেইলি স্টার পত্রিকা আর স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্কের উদ্যোগে প্রতি বছর গীতিকারদের পুরস্কৃত করা হয়। ২০১৩ ও ১৪ সালে আমি পুরস্কৃত হয়েছিলাম। আর তিনটি বই থেকেও অনেকে সুর করার চেষ্টা করেছেন। এ যাবৎ আমার গান গেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফকির আলমগীর, কিরণচন্দ্র রায়, চন্দনা মজুমদার, সঞ্জয় রায়, অণিমা মুক্তি গমেজ, সুমন রাহাত, এলিটা করিম, নির্ঝর অধিকারী, নূরিতা নুসরাত খন্দকার প্রমুখ। আমার গানে সুর করেছেন বীরেন্দ্রকিশোর তালুকদার, আবুবকর সিদ্দিক, ড. অমিতাভ বিশ্বাস, শাহীন সরদার, অণিমা মুক্তি গমেজ প্রমুখ। ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে বীরেন্দ্রকিশোর তালুকদার, তুষার দেব, ড. অমিতাভ বিশ্বাস, সঞ্জয় মণ্ডল, পল্লব মণ্ডল, অনামিকা মিশ্র প্রমুখ আমার গান গেয়েছেন। আমার গান নিয়ে দুটি অ্যালবাম করার পরিকল্পনার আমার রয়েছে। একটি অ্যালবাম করব আধুনিক গানের, আরেকটি লোকজ সঙ্গীত প্রভাবিত গানের। এগুলোকে ফোকগান আমি বলব না। আমার কাছে ফোকগানের যে সংজ্ঞা তার ভেতর এসব পড়ে না।
লোক পরম্পরায় প্রবাহিত হয়ে আসছে যেসব গান, কে লিখেছে, কে সুর করেছে আমরা জানি না, কে গানটি গেয়েছিল আমরা জানি না, কিন্তু বিকৃত হয়েছে, একেক স্থানে গিয়ে বদলে গেছে, বাক্যবদল ঘটেছে, সুরবদল হয়েছে, এরপর একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এসবই মূলত লোকগান। যখন আমি ব্যক্তিকে আইডেনটিফায়েড করতে পারছি, সেটি লালনের গান হয়ে যাবে, হাসনের গান হয়ে যাবে, তপন বাগচীর গান হয়ে যাবে। তার সুরগুলোও লোকগান প্রভাবিত, কিন্তু পুরোপুরি লোকগান সেগুলো নয়। লোকসংস্কৃতিতে সংজ্ঞা এভাবে আছে এবং আমি এতেই বিশ্বাস করি। যদিও ওই সুরগুলো মনে রেখে লিখেছি আমি, কিন্তু যেহেতু আমি আধুনিক মানুষ, সেগুলোও এক ধরনের আধুনিক গান। আধুনিক গান বলতে যদি আমার আপত্তি থাকে তো আমি সাম্প্রতিক গান বলতে পারি। পরবর্তীকালে ফিল্মের জন্যে গান লিখতে চাই। ফিল্মের গানের প্রচণ্ড দুরবস্থা। যদি সুযোগ হয় তো দুটো ভালো গান যাক। যেমন গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সৈয়দ শামসুল হক, আমজাদ হোসেন, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, মাসুদ করিম, ওয়াদুদ মুনশী এঁরা যেসব গান লিখে গেছেন সে ধারার কিছু গান আবার হোক।
আমাদের চলচ্চিত্রের একটি বড় ব্যর্থতা— দুর্বল বাণী, নকল সুরের নকল গান। চাই নতুন সুরের নতুন গান আসুক, সেখানে কিছু রক্ত সঞ্চালন করতে চাই। কিন্তু সেখানে কাজ শুরু করাটা সহজ নয়। অনেক সময়ের প্রয়োজন। তবে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে আমি রাজি আছি।
হামিম কামাল: গান লেখার ক্ষেত্রে কাকে গুরু মানেন? আছেন এমন কেউ?
তপন বাগচী: গান লেখার ক্ষেত্রে একজনকে আমি একলব্যের মতো গুরু মানি। তার নাম আবিদ আনোয়ার। তিনি আমাকে হাতে কলমে শিক্ষা দেননি বটে, কিন্তু যখন একটি গান তার কাছে পাঠিয়েছি, তিনি যা মন্তব্য করেছিলেন, সেখান থেকে আমি শিখেছি, একলব্য যেভাবে ধনুর্বিদ্যা শিখেছিল। তিনি আমার নেপথ্য শিক্ষাগুরু হলেও আমি তাকে প্রকাশ্যে গুরু হিসেবে ঘোষণা দিতে পারি।
হামিম কামাল: তপনদা, কিছুটা হলেও সংসর্গ যেহেতু পেয়েছেন আপনাকে অর্জুনই বলা চলে।
তপন বাগচী: হতে পারে। আর এমনি গান লেখা শেখা তো মূলত পড়ে পড়ে শেখা। সঙ্গীত যে রকম গুরুমুখী বিদ্যা, লেখার ক্ষেত্রে তেমনই আমরা পূর্বসুরিদের পাঠ করে শিখি। আমি ওভাবেই শিখেছি। কিন্তু মাঝপথে কিছু পথ নির্দেশ পেয়েছি তাঁর।
হামিম কামাল: চমৎকার। সাহিত্যের আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে কাদের এমন বিশেষ স্মরণীয় বলে ব্যক্তিগতভাবে আপনি মনে করেন।
তপন বাগচী: সমস্ত ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ। নাটক, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, গান কোথাও রবীন্দ্রনাথকে ফেলা যাবে না, এখন পর্যন্ত তাকে এড়ানো যাবে না। এখনও যদি আধুনিক কবিতা লিখছি বলে দাবি করি ওরকমটিও তিনি লিখে গেছেন, লিপিকা কাব্যে করে গেছেন। ওনাকে আমরা ছাড়াতে পারিনি।
তারপরও বলবো নতুন স্বাদ নিয়ে কবিতায় জীবনানন্দ দাশ। মানে সব মাধ্যমেই রবীন্দ্রনাথ কমন আছেন। শুধু কবিতায় যদি আলাদা করে উচ্চারণ করি রবীন্দ্রনাথের পর আরও একটি নাম সেটি জীবনানন্দ দাশ। প্রবন্ধসাহিত্যে আমার আদর্শ যদি বলি তো বলব সেটি বুদ্ধদেব বসু। নাট্যসাহিত্যে যদি বলতে চাই তা একটু কঠিন। কারণ নাটকের মাধ্যম তো মঞ্চ, অনেক পারফর্মার তো ভালো এসেছেন। এরপরও কারও নাম যদি বলতে চাই, এমন একজনের নাম আসবে যিনি এখন আর তেমন আলোচিত নন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। আমি যাত্রা গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি যে সবচেয়ে বেশি অভিনীত হয়েছে তাঁর নাটক, তাঁর নাম কল্যাণ মিত্র।
তাঁর সাগরসেঁচা মানিক, জল্লাদের দরবার, টাকা আনা পাই, যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ এ ধরনের বেশ কিছু নাটকের নাম মনে পড়ে। আর ছড়াসাহিত্যে সুকুমার রায়ের ওপর কেউ যেতে পারে নাই। এরপর সুকুমার বড়ুয়া। দুই সুকুমার। উপন্যাসে এক নাম বলা কঠিন। তিন বন্দোপাধ্যায় বললেই হয় আরকি। বুঝলে তো পাঠককে চমকে দেয়ার মতো নাম আমি উচ্চারণ করতে চাই না।
চলবে…