নবীন কথাকারদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন পিন্টু রহমান। এই লেখক ১৯৭৫ সালের ১৩ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গা জেলার কুমারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন ধরে গল্প চর্চা করে আসছেন। মাটিবর্তী মানুষের জীবনের কথা তার গল্পের মূল বিষয়বস্তু। এ পর্যন্ত তার চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি গল্পগ্রন্থ, একটি উপন্যাস। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পাললিক ঘ্রাণ’ ২০১৪ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘কমরেড’ প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটিতে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্থান-পতনের কথা উঠে এসেছে। চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে পিন্টু রহমানের মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ লেখক মোস্তাফিজ ফরায়েজী।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনি লেখালেখিতে এলেন কেন?
পিন্টু রহমান: একটা সময়-পর্যন্ত আমার মনে হতো আমি শখ করে লিখছি। লিখতে ভালো লাগত। কিন্তু একসময় মনে হলো, না, শুধু শখের বশে আমি লিখব না। আমার একটা অ্যাম্বিশন থাকবে। কারণ পরিকল্পনা ছাড়া তো জীবনে কোনো কিছু সম্ভব না। ২০০৫/২০০৬ সাল থেকে আমি চিন্তাভাবনা করলাম, লেখালেখি করব। আমাদের জাতীয় সাহিত্য যে জায়গায় যাচ্ছে, ওই মানদণ্ডকে ছোঁয়ার মানসিকতা নিলাম। ওই ছোঁয়ার তাগিদেও লেখালেখিতে এসেছি, এটা একটা কারণ। এছাড়া যাপিত জীবনের যে দুঃখ, কষ্ট, পাওয়া, না পাওয়ার যন্ত্রণা; তা প্রতিনিয়ত আমাকে তাড়িত করে। সে যন্ত্রণা প্রকাশের তাগিতেই লেখালেখি আসা।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: শখের বশে লেখা আর পরিকল্পনা অনুযায়ী লেখা, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
পিন্টু রহমান: শখের বশে লেখাটা হচ্ছে, আমি যেটা লিখলাম, ওই লেখা কী হবে, আদৌ ওই লেখা কোনো মাত্রায় পৌঁছালো কি না, এসময়ে যারা লিখছেন, তাদের মানদণ্ডের সঙ্গে মিলল কি না, ওসবের সঙ্গে মাপ-পরিমাপের কোনো ব্যাপার নেই। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী লিখতে গিয়ে, একটা গল্প অতীতে কারা কিভাবে লিখেছেন, এখন যারা লিখছেন, তারা কিভাবে লিখছেন, আমার গল্প বা গদ্যের কোন কোন জায়গায় দুর্বলতা আছে, কোন কোন জায়গায় কাজ করতে পারি; সেই জায়গাগুলো খুঁজতে হয়েছে। শখের বশে কাজ করতে গেলে তাড়নাটা থাকে না কিংবা কম থাকে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: বাংলা সাহিত্যচর্চায় লিটলম্যাগের গুরুত্ব অতীতে কতটুকু ছিল, বর্তমানে কতটুকু?
পিন্টু রহমান: আমাদের সাহিত্যের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি, লিটলম্যাগকেন্দ্রিক আর গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চাটা সবসময় ছিল। গোষ্ঠীকেন্দ্রিক না হলে এই চর্চাটা হয় না। যদিও একটা গোষ্ঠী একটা লেখককে তৈরি করে না, একটা লেখককে বানিয়ে দেয় না, তবে সেই জায়গা থেকে অনেক লেখকের কিন্তু উত্তরণের পথটা তৈরি হয়। বাংলা সাহিত্যের কালপর্বে লিটলম্যাগকেন্দ্রিক যে যুগ, সেটার গুরুত্ব আছে। যেমন: কল্লোল যুগ, সবুজপত্র যুগ; এগুলো লিটলম্যাগ বা সাহিত্যপত্রকেন্দ্রিক যুগ। এখনো লিটলম্যাগ আছে। কিন্তু এখন যেটা আছে, সেটা একটা বিক্ষিপ্ত অবস্থার ভেতর দিয়ে চলছে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: এখন কি যুগ সৃষ্টি করার মতো কোনো সাহিত্যপত্র বা লিটলম্যাগ আছে?
পিন্টু রহমান: আমি সে রকম দেখছি না। আমি দেখছি না, এজন্য যে, এই সময়ের প্রতিটি ম্যাগাজিনেরই কিছু রেজিস্টার্ড বা নির্দিষ্ট লেখক আছে। সেখানে নতুন ও প্রতিভাবানদের সুযোগ দেওয়া হয় না।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো নির্দিষ্ট লেখকদের বাইরে কারো লেখা ছাপছে না বা নতুনদের তুলে আনার প্রয়াশ নিচ্ছে না। আপনি কি এই অভিযোগটা করতে চাচ্ছেন?
পিন্টু রহমান: অবশ্যই আমি এই অভিযোগটা করতে চাচ্ছি। এটা আছে এবং বর্তমান সময়ে এই প্রচেষ্টা আরও প্রবল। আমি মনে করি, এটা হওয়া উচিত নয়। লিটলম্যাগ সম্পাদকদের লেখকের প্রোফাইলের দিকে না তাকিয়ে লেখার দিকে তাকানো উচিত। বিশেষ করে একজন তরুণ প্রতিভাবান লেখককে তো সুযোগ দিতেই হবে, তাকে সুযোগ না দিলে সে তো অকালে ঝরে যেতে পারে। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে সম্পাদকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তরুণদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। আমার মতে, একজন সম্পাদকের অনেক দায়িত্ব কিন্তু এখন আমরা সম্পাদনার নামে যেটা করি, সেটা অনেকটা জোচ্চুরি। আমরা লেখকরাও কেউ কেউ এতই আনাড়ি যে, অনেকে আগে থেকেই সম্পাদককে বলে দেই, আমার লেখায় হাত দেওয়া যাবে না। আবার বর্তমান সময়ে কিছু সম্পাদক আছে তারা সম্পাদনা নয়, সংকলকের দায়িত্ব পালন করে। আমরা তাদের বলছি সম্পাদক, কিন্তু তারা মূলত যা করছে, তাতে তাদের সংকলক বলাই শ্রেয়। এই সংকলকের জায়গা থেকে যদি সম্পাদকের জায়গায় আসা যায়, তবে এটা আমাদের সাহিত্যের জন্য উপকারী তো হবেই, আমাদের তরুণদের জন্যও মঙ্গলজনক হবে। আসলে একটা কথা হচ্ছে, আগে সিনিয়রদের একটা দায়িত্ব ছিল জুনিয়রদের ভালো-মন্দ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। এখন আমার সংশয় হয় সিনিয়র লেখকেরা জুনিয়র কোনো লেখকের লেখা পড়েন কি না। পড়লে তো দুটো কথা বলতেন জুনিয়রদের সম্পর্কে। তাদের তো বলতেও দেখি না।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনি গল্পচর্চাতেই বেশি মনোযোগী। আপনার সাহিত্যচর্চার শুরু গল্প দিয়েই?
পিন্টু রহমান: প্রথম কৈশোরেই ১৯৮৯ সালের দিকে আমি যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি, তখন আমি একটা উপন্যাস লেখার প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম। সেটার নাম ছিল আশ্রম। মূলত সেই উপন্যাস লেখার প্রচেষ্টা থেকেই আমার লেখালেখি শুরু। গল্প লেখা শুরু করেছি আরও পরে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনি গল্পকার হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন, কিন্তু আপনার প্রথম উপন্যাস ‘কমরেড’ গতবছর প্রকাশিত হয়েছে। আপনার কি আরও উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা আছে?
পিন্টু রহমান: উপন্যাস নিয়ে আমার ভালো লাগা অনেক আগে থেকেই। বিশেষ করে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, আমি উপন্যাস লিখব। এখন এই গল্পচর্চা করতে গিয়ে আমি জিনিসটা বুঝতে পারছি, আমি এত মেধাবী নই যে, একসঙ্গে এত কাজ করব। আমি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে উপন্যাসে সময় দিতে চাই। আর কমরেড উপন্যাসটা লিখেছি অনেকটা দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। কমরেড শিরোনামের যে উপন্যাসটা, এটা আসলে আমাদের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্থান-পতনের গল্প। এই কাহিনীটা পাঠকের হাতে পৌঁছানো খুব দরকার ছিল। কবে মরে যাব, তা তো জানি না।
____________________________________________
আমরা যারা এই মানসিকতায় আছি যে, আমাকে যদি সবাই চিনে যায়, রাতারাতি যদি পতিতাপল্লীর বিশ্লেষণ দিয়ে সবার নজরে পড়ি, তাহলে বড় লেখক হয়ে গেলাম; আমি মনে করি না এটা ঠিক
____________________________________________
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: উপন্যাসটিতে ঐতিহাসিক উপাদান বর্তমান, আবার রাজনৈতিক উপাদানের প্রাধান্য বেশি। এটাকে আপনি ঐতিহাসিক উপন্যাস বলবেন, না কি রাজনৈতিক উপন্যাস?
পিন্টু রহমান: এটিকে রাজনৈতিক উপন্যাসই বলতে হবে। তবে এখানে আমাদের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসও উঠে এসেছে। এটা তো আমাদের অনেক গৌরবান্বিত অধ্যায়। ঐতিহাসিক কিংবা রাজনৈতিক না বলে আমি বলি, সমকালীন সমাজনীতির চিত্র।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার প্রথম গল্পের নাম কী ? এটি কোথায় প্রকাশিত হয়েছিল?
পিন্টু রহমান: আমার প্রথম প্রকাশিত গল্পের নাম হচ্ছে ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’। এটি প্রকাশিত হয়েছিল কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত আন্দোলনের বাজার নামক একটি পত্রিকার শুক্রবারের সাহিত্যপাতায়। এটা ১৯৯৬ সালের কথা।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: একজন গল্পকার হিসেবে আপনার দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যের সেরা গল্পকার কে?
পিন্টু রহমান: সেরা বলা কঠিন। তবে আমার প্রিয় লেখকদের নাম বলতে পারব। আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয় বা আমি যার থেকে প্রেরণা নেই, তিনি হচ্ছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক আমার প্রথম পছন্দ। আর রবীন্দ্রনাথের কথা আলাদাভাবে বলব না, কেননা আমাদের গল্প সাহিত্য মানেই রবীন্দ্রনাথ অবধারিতভাবে থাকবেন। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখি, আমার অবসর সময়ে যখন কিছু ভালো লাগে না, তখন আমাকে গল্পগুচ্ছের কাছে যেতেই হবে। শুধু আমি নই, যারা গল্পচর্চা করেন, তাদের গল্পগুচ্ছের কাছে কিংবা রবীন্দ্রনাথের কাছে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এছাড়া হাসান আজিজুল হক, রফিকুর রশীদের গল্প আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে বিভূতিভূষণের গল্পও।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: বর্তমান সময়ে যে সব তরুণেরা গল্প লিখছে তাদের ভেতর আপনার কার গল্প সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?
পিন্টু রহমান: এ সময়ে অনেক তরুণ লিখছে। কিন্তু ঠিক ওভাবে আমি কারও নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: ভালো লিখছে? কথাসাহিত্যে বর্তমান সময়ের তরুণদের সম্ভাবনা কতটুকু?
পিন্টু রহমান: কথাসাহিত্যে আশাবাদী। কিন্তু তরুণরা এখন একটা কথা বলছে যে, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: এটা কী গদ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা?
পিন্টু রহমান: ওরা এইটাও বলে না কিসের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আমিও ওদের গল্পগুলো পড়ে খুঁজতে চাই, আসলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোন জায়গায় হচ্ছে। যখন এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমার চোখে আসে না তখন আমি হতাশায় ভুগি, তাহলে কি আমি তাদের থেকে পিছিয়ে আছি। হয়তো তাদের থেকে আমার বোধশক্তি কম।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা কী একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে?
পিন্টু রহমান: এটা বলার ফ্যাশন। আমরা যেমন কেউ কেউ বলি, আমরা ব্লগার, আবার কেউ কেউ নাস্তিক পরিচয় দিতে পছন্দ করি, তেমনিভাবে কমরেড একটা পরিচয়, যে যাই করুক ডেজিগনেশন হিসেবে অনেকে কমরেড শব্দটা এখন ব্যবহার করছে। এখন আমরা গল্প নিয়ে গৎবাঁধা কিছু বলি, আমি গল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। আসলে গল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। গল্প আগেও ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের গল্প বদলে যাচ্ছে, জীবনের গল্প বদলে যাচ্ছে। সেই জায়গায় গল্পের পরিবর্তন আসবেই।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: একটা গল্প আপনার ভেতর কিভাবে আসে, আপনি কিভাবে লেখেন?
পিন্টু রহমান: কোনো কোনো গল্প মাথায় নিয়েই অনেক দিন ঘুরে বেড়াতে হয়। একটা গল্প লেখার আগে আমি ভাবি, যে গল্পটা আমি লিখব, সেটা মানুষের জানার প্রয়োজন আছে কি না।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: একটা গল্প লিখতে আপনার কতদিন সময় লাগে?
পিন্টু রহমান: তিন-চার দিন। এরপর ওই গল্পটা যতদিন আমার কাছে থাকে, ততদিনে গল্পের ভাষা কিংবা পরিধি বদলে যায়।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: একটা গল্প কতবার পুনর্লিখন বা সংশোধন করেন আপনি?
পিন্টু রহমান: পনেরো-বিশ বার করেছি এমনও আছে। তবে সাধারণত পাঁচ-ছয় বার একটা গল্পের পুনর্লিখন আমাকে করতে হয়। এছাড়া ছোটখাটো সংশোধন তো থাকেই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি গল্প লেখার পরে সেটা পাঁচ-ছয় দিন লুকিয়ে রাখি। এরপর গল্পটা আমি আবার পাঠক হিসেবে পড়ে দেখি কেমন হলো। পাঠক হিসেবে বসে পর্যবেক্ষণ করি। এরপর দ্বিতীয় বার গল্পটা আবার লিখি। আসলে এই ক্ষুধা যতক্ষণ একজন লেখকের ভেতর থাকবে, ততক্ষণ বুঝতে হবে সেই লেখক তার সক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে পারেননি, তার ক্যাপাসিটি আরও আছে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: এই ক্ষুধা কি মেটে?
পিন্টু রহমান: আমার ক্ষেত্রে তো মেটে না। তবে অনেক সিনিয়রদের সাক্ষাৎকার পড়েছি। তাদের মুখে শুনেছি এই ক্ষুধা মেটে। আর কিছু কিছু মানুষকে আয়েশ করে বলতে শুনি, আমি আমার সেরা গল্পটি পেয়ে গেছি, আমার আর না লিখলেও চলবে। তবে এদের সংখ্যা খুব কম। তারাও হয়তো বলার জন্যই বলে। কিন্তু আমার মতে, এ ক্ষুধা শেষ হওয়ার নয়।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: একটা গল্পের মানদণ্ড কী হতে পারে, একটা গল্প ভালো নাকি খারাপ এটা কি পরিমাপ করা সম্ভব?
পিন্টু রহমান: তুমি মনে করো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা গল্প লিখছ, তুমি যে বিষয়টা পাঠককে বুঝাতে চাচ্ছো, তোমার বক্তব্যটা বা তোমার গল্পটা আদৌ তার জানার প্রয়োজন আছে কি না, তার আগ্রহ আছে কি না, এটা একটি বিষয়। আর গল্পের কাজ হচ্ছে, পাঠককে অবাক করে দেওয়া। শেষপর্যন্ত পাঠক যেকোনো বিবেচনায় অবাক হবে, আরে! এটা ঘটলো কেন! এই জায়গায় কেউ যদি স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয়, আমি তো অনেক সময় ইচ্ছা করি কিন্তু পারি না, তখন তো আমার মনে হয় আমি ব্যর্থ হলাম।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: অবাক করে দেওয়া না সমাজে যা ঘটছে, তা বর্ণনা করাটাই মূল?
পিন্টু রহমান: আসলে যা ঘটছে,তা বললেই মানুষ অবাক হয়ে যায়। যখন জ্যোতিষীর কাছে আমরা হাত দেখাতে যাই, জ্যোতিষী যদি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে বলে দেয়, তখন কিন্তু আমরা অবাক হয়ে যাই। এ জন্য অবাক হয়ে যাই, তিনি কী করে বললেন? গল্পের ক্ষেত্রেও তাই। এই ঘটনাগুলো লেখক যখন গুছিয়ে বলে দেন, তখন পাঠক অবাক না হয়ে পারেন না। সে তো সমাজেরই কথা, জীবনেরই কথা। তবে গল্পের চিত্রকল্পটাই মূল জিনিস। আমি যে কাহিনী বর্ণনা করছি, তা দিয়ে পাঠকের মনের ভেতর ছবি আঁকতে পারছি কি না, এ বিষয়টা ভাবি।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: বর্তমান সময়ের সাহিত্যচর্চায় মতাদর্শ ও সাহিত্য এই দুটি জিনিস আমরা মিশ্রিত হতে দেখি। মতাদর্শের কারণে কোনো সাহিত্যিককে অপমান করা কিংবা কোনো সাহিত্যিককে নিগৃহীত করা কি লেখকের নৈতিকতার ভেতর পড়ে?
পিন্টু রহমান: প্রকৃতপক্ষে এই মতাদর্শের জায়গাটাতে আমরা এত বেশি বিভ্রান্তিতে পড়েছি যে, তা বলে বোঝানো যাবে না। আমরা খুবই বিভ্রান্তিতে আছি। আমরা কেউ কেউ মনে করি, আমাদের লেখক হতে হলে একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্মের অনুসারী হতে হবে। আমি ধরেই নিলাম, আমি একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী, এখন ওই দলের যে বিধিবিধান তা যদি আমার মধ্যে খেয়াল করি, তবে দেখা যাবে যে, তার পুরোপুরি নেই। অর্ধেক আছে, অর্ধেক নেই। একজন লেখকের জন্য নিজের সত্তাই আসল জিনিস। এর কোনো পরিবর্তন নেই। ওই সত্তার কাছে জবাবদিহিতা প্রয়োজন। তবে এই মতাদর্শের সংঘর্ষের কারণে অনেক তরুণ বিভ্রান্ত হচ্ছে, অনেকে লেবাস ধরছে। আমরা প্রগতিশীল, প্রতিক্রিয়াশীলের মতো কিছু শব্দ ব্যবহার করে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করছি যে, আমরা বুঝতে পারছি না আমরা কী লিখব, কার কথা লিখব, কার পক্ষ নেব! যা লিখছি সেটা বাস্তবিক হলেও সেটা কোন মতাদর্শের পক্ষে যাচ্ছে, কোনটার বিপক্ষে যাচ্ছে, এসব চিন্তা আমাদের করতে হচ্ছে। এতে আমাদের লেখা বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: বর্তমান সময়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করার ক্ষেত্রে অনেক তরুণ লেখককে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখা যায়, অনেকে আবার বিতর্কিত কথাবার্তাও বলেন। এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
পিন্টু রহমান: ওসব করে তো লাভ নেই। বিতর্কিত কথা বলে, টিভি পর্দায় গিয়ে কিংবা অনলাইন পত্রিকার শিরোনাম হয়ে এলে কোনো লাভ নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, এটা সাময়িক। একজন লেখক বাঁচবেন তার লেখায়। লেখকের প্রতিনিধিত্ব করবে তার লেখা। আমরা যারা এই মানসিকতায় আছি যে, আমাকে যদি সবাই চিনে যায়, রাতারাতি আমি যদি পতিতাপল্লীর বিশ্লেষণ দিয়ে সবার নজরে পড়ি; তাহলে বড় লেখক হয়ে গেলাম, আমি মনে করি না এটা ঠিক। আসলে শেষবিচারে পাঠকের কাছেই আমাদের সবাইকে আসতে হবে। পাঠকের ছুরির নিচেই একজন লেখককে পড়তেই হবে। তবে এখন এটা একটা কৌশল হয়ে গেছে যে, বিতর্কিত কিছু বলে কিংবা কিছু সুবিধা নিয়ে রাতারাতি আমার নামধাম ছড়িয়ে দেব। এ রকম প্রচেষ্টা দিন দিন বাড়ছে। এটা আমি সমর্থন করি না।
মোস্তাফিজ ফরায়েজী: আপনার তিনটি গল্পগ্রন্থ আছে। আপনি দীর্ঘ একযুগ সময় ধরে গল্প চর্চা করছেন। এখন যারা গল্প চর্চা করতে আসছেন, তাদের উদ্দেশে কী বলবেন?
পিন্টু রহমান: যারা নতুন আসছেন, তাদের বলব, পূর্বসূরিদের গল্পগুলো পাঠ করতে। তাদের গল্প সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিতে হবে। বাংলা গল্পের ধারণা নেওয়ার পাশাপাশি বিদেশি সাহিত্যের ভালো গল্পগুলো পড়তে হবে।