সালাম সালেহ উদদীন, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ছোটগল্প, উপন্যাস ও কলামসহ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪০। সাতাশ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক ছোটকাগজ ‘অরুন্ধতী’। সম্প্রতি কথা বলেছেন ছোটকাগজ সম্পাদনা বিষয়ে। ওই কথোপকথনের উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: ছোটকাগজ সম্পাদনার চিন্তা কিভাবে মাথায় এলো?
সালাম সালেহ উদদীন: লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনার কাজটি আমি আগে থেকেই করে আসছিলাম। আমি যে স্কুলে পড়ালেখা করেছি, ঢাকার দোহারের বাহার হাবিল উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৮৪ সাল থেকে ওই স্কুলের দেয়ালিকা ‘সমকাল’ সম্পাদনা করেছি—যা পরে ম্যাগাজিন আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া, একই বছর দোহার উপজেলা প্রগতি সংঘের স্মরণিকা ‘সূর্যসবুজ’ আমার সম্পাদনায়ই প্রকাশিত হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষ সম্মানে ভর্তি হওয়ার পর ‘অরুণিমা’ নামে একটি দেয়ালিকা নিয়মিত আমার সম্পাদনায় বের হয়, পরে যা লিটল ম্যাগাজিনে রূপ নেয়। বাংলা বিভাগের কতিপয় উদ্যোমী তরুণ লেখক আমার সঙ্গে ছিলেন। ‘অরুণিমা’ই সম্ভবত দেশের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন যা কম্পিউটার কম্পোজে বের হয় এবং অফসেট প্রেসে ছাপা হয়। হুমায়ূন আজাদের বিতর্কিত প্রবচনগুচ্ছ ‘অরুণিমা’র দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। বিভাগীয় কোন্দলের কারণে সেটি বন্ধ হয়ে গেলে আমি নিজ উদ্যোগে ‘অরুন্ধতী’ বের করি। অবশ্য আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা ছিল। ওই সময় ‘অরুন্ধতী’ দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় পাওয়া যেত। দেশব্যাপী ‘অরুন্ধতী’র ব্যাপক প্রভাব ছিল, বিশেষ করে শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে।
প্রশ্ন: ছোটকাগজকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন? সম্পাদনার ক্ষেত্রে কোন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন?
সালাম সালেহ উদদীন: শিল্প সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থেকে প্রথাবিরোধী মানসিকতা নিয়ে নতুন লেখক সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ছোটকাগজ প্রকাশিত হওয়া উচিত। ছোটকাগজের চরিত্রও তেমনটি হওয়া দরকার। যদিও সে চরিত্র ছোটকাগজ সম্পাদকরা ধরে রাখতে পারছেন না। এখনকার বাজারি লেখকরাও লেখক তালিকায় অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে ছোটকাগজের যথার্থ সংজ্ঞা এখন দেওয়া কঠিন। ছোটকাগজ হয়ে গেছে এখন ‘বড়কাগজ’। আমি সম্পাদনার ক্ষেত্রে নতুন লেখক এবং উৎকৃষ্ট ও ব্যতিক্রম লেখাটিকেই প্রাধান্য দিই। যদিও এ ধরনের লেখার বড় আকাল। কারণ লেখকরা এখন বাণিজ্যিক কাগজের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন, খ্যাতি ও অর্থপ্রাপ্তির আশায়। ছোটকাগজকে তারা খুব একটা গুরুত্বে সঙ্গে দেখছেন না। বরং হেয়ালি মানসিকতাই চোখে পড়ে।
প্রশ্ন: ‘অরুন্ধতী’ শুরুর সময়ে ছোটকাগজ আন্দোলনের ধারা বা প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?
সালাম সালেহ উদদীন: আমরা প্রকৃত অর্থে যেটাকে ছোটকাগজ বলতে চাই, ওই সময়ে অর্থাৎ আশির দশকের শেষের দিকে সে ধরনের কাগজেরই আধিক্য ছিল। প্রথাবিরোধী লেখকরা লিখতেন সেখানে, যারা দৈনিক কাগজ-নির্ভর ছিলেন না। তখর ছোটকাগজকে ঘিরে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এর প্রাণকেন্দ্র। এ ছাড়াও রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও নিয়মিত বেশ কয়েকটি কাগজ বের হতো। ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপশি গোষ্ঠীগত উদ্যোগেও তখন ছোটকাগজ বের হতো। সম্পাদকরা ছিলেন নিতান্তই সাহিত্যনিষ্ঠ, নিবেদিতপ্রাণ।
প্রথাগত ধারার বাইরে যে সব লেখক-সম্পাদক নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপন করতে চান, তারাই মূলত ছোটকাগজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। সাহিত্যের নতুন বাঁক নির্মাণ ও নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে ছোটকাগজের ভূমিকা সব সময় অগ্রগণ্য।
প্রশ্ন: ছোটকাগজের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার যোগসূত্র রয়েছে, আবার অনেকে মনে করেন সাহিত্যের নতুন বাঁক নির্মাণের তাগিদ থেকেই ছোটকাগজ চর্চার সূত্রপাত। একজন সম্পাদক হিসেবে বিষয়টি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সালাম সালেহ উদদীন: প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতার মানসিকতা থেকেই মূলত ছোটকাগজের জন্ম। প্রথাগত ধারার বাইরে যে সব লেখক-সম্পাদক নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপন করতে চান, তারাই মূলত ছোটকাগজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। সাহিত্যের নতুন বাঁক নির্মাণ ও নতুন লেখক তৈরির ক্ষেত্রে ছোটকাগজের ভূমিকা সব সময় অগ্রগণ্য। পশ্চিমবঙ্গের ছোটকাগজগুলোর দিকে তাকালে সেটা বেশি চোখে পড়ে।
প্রশ্ন: ‘অরুন্ধতী’র শুরুতে কারা ছিলেন, অর্থাৎ অরুন্ধতীর লেখকদের সম্পর্কে জানতে চাই।
সালাম সালেহ উদদীন: আগেই বলেছি প্রবচনগুচ্ছ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘অরুণিমা’য়। পরে অবশ্য ‘অরুন্ধতী’র তিন সংখ্যায় ১০০ প্রবচন প্রকাশিত হয়েছে। আর ‘অরুণিমা’য় প্রকাশিত হয়েছিল ২৫ প্রবচন। ‘অরুন্ধতী’র শুরুতে যারা লিখেছিলেন, তারা এখন প্রতিষ্ঠিত লেখক। আবুল কাসেম ফজলুল হক, হুমায়ুন আজাদ, কায়েস আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সুশান্ত মজুমদার, আতা সরকার, নাসির আহমেদ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, শহীদ খান, নাসরিন জাহান, শাহীন শওকত, শামসুল আরেফিন, চঞ্চল আশরাফ, হাকিম আরিফ, জাহিদ বকশী, কামরুল আলম কিরণ, জাহানারা কলি, লুবনা আহমেদ, জহির আহমেদসহ অনেকেই নিয়মিত লিখতেন। এছাড়া, প্রবীণদের মধ্যে লিখেছেন শওকত ওসমান, আহমদ শরীফ, আহমদ রফিক, বদরুদ্দীন উমর, নীলিমা ইব্রাহিম, শামসুর রাহমান, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ।
প্রশ্ন: সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনের ধারায় ছোটকাগজ কতটুকু দায় পালন করছে বলে আপনি মনে করেন?
সালাম সালেহ উদদীন: সাহিত্যের বাঁক পরিবর্তনের ধারায় ছোটকাগজ সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে বর্তমানের ছোটকাগজ তার প্রকৃত চরিত্র হারাতে বসেছে। ফলে ছোটকাগজের মূল সুর ও চেতনা ব্যাহত হচ্ছে।
প্রশ্ন: বর্তমানে ছোটকাগজ নামে যা প্রকাশিত হচ্ছে তা কি আদৌ ছোটকাগজের মৌলিক চেতনা সমুন্নত রেখে? বর্তমান ছোটকাগজ চর্চা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সালাম সালেহ উদদীন: এদেশে সবাই চাচ্ছে, লেখক সম্পাদক হতে। কে কত মোটা করে কাগজ বের করতে পারেন এবং তাতে নিজের লেখা প্রকাশ করতে পারেন, সে চেষ্টাতেই লিপ্ত থাকেন। এটা এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যে কারণে মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। ছোটকাগজের নামে যা ইদানিং বের হচ্ছে, তাকে আদৌ ছোটকাগজ বলা যায় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আগে ছোটকাগজে প্রকাশিত হতো সর্বোৎকৃষ্ট লেখাটি, আর এখন হয় নিকৃষ্ট লেখাটি। উৎকৃষ্ট লেখাটি একজন তরুণ লেখকও এখন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ করতে চান, রাতারাতি খ্যাতি পাওয়ার আশায়।
নতুন লেখক সৃষ্টি ও ভিন্নধর্মী সাহিত্যের ধারা সৃষ্টির জন্যই একসময় ‘অরুন্ধতী’ প্রকাশে মনোযোগী হয়েছিলাম। সেই চেষ্টা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি ‘অরুন্ধতী’ অনিয়মিত হয়ে পড়ার কারণে।
প্রশ্ন: ছোটকাগজ সম্পাদনা ও প্রকাশনার প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বলুন। প্রতিবন্ধকতাগুলো কিভাবে অতিক্রম করা সম্ভব?
সালাম সালেহ উদদীন: প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ভালো লেখা পাওয়া। দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বিজ্ঞাপন বা সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া। অনেকেই অবশ্য ছোটকাগজ বের করার নামে বাণিজ্য করছেন, লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছেন। ফলে যারা প্রকৃত অর্থেই ছোটকাগজ করতে চাচ্ছেন, তারা পিছিয়ে পড়ছেন। ছোটকাগজ সম্পাদনার ক্ষেত্রেও এখন মাফিয়াচক্র ঢুকে পড়েছে। ছোটকাগজকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হলে লোভ ও বাণিজ্যিক মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে অসম প্রতিযোগিতা। শিল্পসাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিদেরই ছোটকাগজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা উচিত।
প্রশ্ন: আপনার সম্পাদিত ‘অরুন্ধতী’র আদর্শ কী? বর্তমান সময়ে উল্লেখযোগ্য ছোটকাগজের নাম জানতে চাই।
সালাম সালেহ উদদীন: নতুন লেখক সৃষ্টি ও ভিন্নধর্মী সাহিত্যের ধারা সৃষ্টির জন্যই একসময় ‘অরুন্ধতী’ প্রকাশে মনোযোগী হয়েছিলাম। সেই চেষ্টা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি ‘অরুন্ধতী’ অনিয়মিত হয়ে পড়ার কারণে। পেশাগত ও লেখালেখির ব্যস্ততার কারণে সেভাবে আর সময় দিতে পারছি না। তবে ভবিষ্যতে ইচ্ছে আছে, ‘অরুন্ধতী’কে সঠিক পথে, সঠিক ধারায় নিয়ে আসার। এখন তো অনেক কাগজই বের হচ্ছে বর্ণাঢ্য প্রচ্ছদে, দামি কাগজে, মোটা আকারে। তবে কোনো কোনো কাগজের উদ্দেশ্য এখনো সৎ। আমি কোনোটারই নাম করতে চাচ্ছি না।
প্রশ্ন: ‘অরুন্ধতী’ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ কোনও বিশেষ পরিকল্পনার রয়েছে?
সালাম সালেহ উদদীন: ‘অরুন্ধতী’কে আমি সিকানদার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’, ‘দেশ পত্রিকা’, পাক্ষিক ‘শৈলী’ অথবা ‘কালি ও কলম’-এর আদলে বের করতে চাই— ম্যাগাজিন আকারে। সে কারণেই ডিক্লারেশন নিয়েছিলাম ১৯৯১ সালে। প্রকৃত অর্থেই ‘অরুন্ধতী’ শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশের পত্রিকা। আমার এই স্বপ্ন আজো বাস্তবায়িত হয়নি নিছক অর্থনৈতিক কারণে। তবে আমি আশাবাদী।