কবিতার ফর্ম-কনটেন্টে সাজতে হয়
অমিত্রাক্ষর: একটি কবিতাকে কেন কবিতা মনে করেন?
হেনরী স্বপন : একেবারে কম দিন তো নয়? কবিতাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফাঁদে ফেলে, আমি আমার লেখায় সৎ কিংবা অসৎ চরিত্রের যা কিছু একটু প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করছি। তবে, ওগুলো কবিতা হচ্ছে কি-না—তা ওই পাঠরুচির তর্কে লেগে থাক। তবু, আমার মেয়ে কসটিকা চিনতীকে ঘিরে জনশ্রুতির যে মন্তব্যগুলো আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়, ‘ওর চোখ-নাক-মুখ-অবয়ব এমনকি ওর ভাষা-ভঙ্গি-হাঁটার রিদমেও আমার স্টাইল আছে। একেবারেই ডুপ্লিকেট না কি—আমারই মতো।’ মজার এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমার একেকটি কবিতাকে—নিজের কবিতা ভেবেই মনে মনে দুর্গম আবেগ উপভোগ করি। এ-ক্ষেত্রে সন্দেহ আর দুর্ভাগ্য এই যে, নিজের নোটিশ আজ নিজেকেই লিখতে হচ্ছে—ইন্টারভিউর এই আত্মঘাতী সংজ্ঞায়। হায়, তাহলে কবিতাকে পুরোপুরি কেন কবিতা মনে করছি আমি?
অমিত্রাক্ষর: অগ্রজ কবিদের চেয়ে আপনার কবিতা কিভাবে, কতটুকু নতুনত্বের দাবি রাখছে?
হেনরী স্বপন: স্বভাবতই নানা বৈচিত্র্যে কবিতার ভাঙচুর—প্রকরণের ক্ষেত্রে তো অনিবার্যভাবেই ঘটেছে। বিভিন্ন লেবেলে আটকে ফেলে কবিতা ও এর আঙ্গিকের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অসীম সার্থকতার আশ্রয়ের সন্ধানে এগিয়ে চলছে আজও। তথাকথিত ব্রান্ডেডের যুগে কবিতাকেও ব্রান্ডেড করার ধান্ধা নিয়ে প্রতিষ্ঠান এবং পাঠক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে, নিজেদের অক্ষমতাকেই মেলে ধরছে বিকৃত উপাধিতে। এই বিদ্রূপে অগ্রজের ভূমিকাও সক্রিয় হচ্ছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আসলে এই আক্রমণ মূলত তাদের অজ্ঞতা আড়াল করার কৌশল মাত্র। এতে কবি ও কবিতার আধুনিকতার সংকট তৈরির আশঙ্কা নেই মোটেও। কিন্তু, সাময়িক এই বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হওয়ায়, কবিতার কৃত্রিম চাপ হয়তো কিছুটা বেড়ে উঠতে পারে। তবে, এ কথা সত্যি যে, এই প্রতিক্রিয়াই আগের কবিতার সঙ্গে বর্তমান সময়ের কবিতার মৌলিক পার্থক্য ফুটে উঠছে। যদিও স্পেসে বোঝা যাচ্ছে, কবি ও কবিতা থেকে প্রায়শ্চিত্তকরণে—পুনরুজ্জীবনের দিকে। অতীত সূত্রের বীজমন্ত্র থেকে মুছে ফেলছে দাসত্বের দাগ। কবিতা পূর্বপ্রকরণ-প্যানপ্যানে লিরিক-ছন্দ-গীতিময়তাও—স্তরে স্তরে ঘন হচ্ছে। নিজের দিকে ফেরা ইনপ্যাক্ট মেটাফরে। নিজের উপাদানে।
একান্ত নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক মুডগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায়। এখন যে ভাষায় কবিতা এগিয়ে যাচ্ছে—নিজের কাছে জীবন উপলব্ধিতে, সময়ে দাগ টেনে—এগিয়ে যাচ্ছে দাগহীন—সমষ্টিবিহীন কবিতার দিকে, এই বিপরীত টানের ভারসাম্যে এখন যেমন যা কিছুর মিশ্রণ। সিন্ট্যাক্স বিন্যাস-সাবজেক্ট-ক্রিয়ার দূরত্ব-বলার ধরন-প্রকাশের অভিনবত্ব-বহুগামী-সর্বব্যাপী উপাদানে—নানা মিশ্রণে নিজের কবিতার যে স্থাপত্য নির্মাণ হচ্ছে, তা পাঠককে মুগ্ধতায় কতটুকু—নতুনত্বের মধ্যবর্তী হয়ে আক্রমণ করছে—সে দাবিও আমাকেই বুক পেতে বিক্ষেপ ছুড়ে দিতে হচ্ছে রক্তপাত ছিটিয়ে।
হায়! আমাদের কবিতার ভূমিতে অগ্রজের বিচরণ ভূমিকায়—এতটাই- বা অবহেলা কেন? যদিও, বিবর্তনের ফরম্যাট বীক্ষণটি সর্বদাই পেলব হয়—তবু শিল্পের আর্তির নিঃশ্বাসেই বেঁচে থাকে পুনঃবিবর্তনের দূরবিনে দেখা আকাঙ্ক্ষার রোষানল।
অমিত্রাক্ষর: কবিতা লেখার জন্য ছন্দের দায়কেই কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? আপনি ছন্দকে কতটুকু আয়ত্তে এনে নতুন রীতির পথে হাঁটছেন?
হেনরী স্বপন: ছন্দের দায় মুছে সিঁথির সিঁদুর ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, কবিতাকে বৈধব্যের সতিদাহে সাধ্বি রমণী উপাধিতে—আমার বিরোধিতা ষোলোআনাই ছন্দের দায়বদ্ধতাকে মেনে। কবিতার ফর্ম-কনটেন্টকে নানা অলঙ্কারে সাজতে হয়। ভাষা-ছন্দ-উপমা-রূপক-চিত্রকল্প-প্রতীক ইত্যাদি ভাঙনের পক্ষপাতিত্বেই আমার কবিতার স্কাট এবং গরদবস্ত্র বৈধব্যের প্রথা ভেঙে লাল বেনারসি-ই হবে প্রত্যেক রমণী ও বিধবার জন্যও স্বাচ্ছন্দ্য অঙ্গের পরিচ্ছদ। আমার অন্বেষণের ভাষাটা এখন—এমনই ক্ষুদ্ধ-অতীন্দ্রিয়ের।
এখন ছন্দের বহুদল-পর্ব-যতি-পয়ার-নানাবৃত্তের মুক্তক-দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার গদ্য-লঘুগুরু উচ্চারণে-কবিতার নানা কম্পোজিশনে আজ এত-এত বেশি স্বতন্ত্র হয়ে উঠছে, বহুস্বরিক—বহুচিন্তার হাতিয়ার হয়ে। যা আয়ত্তে এনে-আয়ত্তকে এড়িয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যয়ে লিখছি আমার কবিতা হয়ে ওঠার অবয়ব। যেন আমার স্ত্রীর শ্যামামুখে কখন যে, (অক্ষরবৃত্ত-স্বরবৃত্ত-মাত্রাবৃত্ত) এই ত্রিবৃত্তের রাগ-অনুরাগের মিনিং কত পর্ব-মাত্রায় প্রাণের কাছে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে ওঠে সে। সেই আয়ত্তে থেকেই চলছে আমার কবিতা লেখার সংসার। তাই যতোটুকু এ সময়ের কোন একক সত্তার বি-নির্মাণ চিন্তার সরল-তরল পয়ার খেলায়—পর্ব ভাঙার মুক্তকে ও অভিজ্ঞতার পথে পথেই যতটা পথে হাঁটছি আমি। সে-ও অদৃশ্য কোনও এক ছন্দপতন-উত্থানের অগ্নিবলয়ে…।
অমিত্রাক্ষর: ছন্দ না জেনে কি ছন্দ ভাঙা যায়? মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ কি পেরেছিলেন?
হেনরী স্বপন: ভাঙনের উচ্চারণেই ফুটে ওঠে বহু ধরনের রিমিক্স—রিফ্লেক্স। নদীর এ-ভাঙনে না কি? ওকূল গড়ে। টুইনটাওয়ার ভেঙে পড়ে কত মানুষের মৃত্যু রক্তে পতিত লাল হলো। গোলাপের শাখা ভাঙলেই প্রশাখা আরও পল্লবিত পুষ্পমুখর হয়। ভেঙে প্রোথিত হওয়াটাই দুঃসাধ্য—নিঃশেষ প্রণালীর মতো। সম্প্রসারণই ঘূর্ণির! সৃষ্টির চোরাস্রোতে ভেঙে টেনে তোলাই নতুনত্বের সূত্র। জলের অতল জেনেছে যে?—সে তো দূর সাঁতারে ছাপিয়ে উঠবে—আরও আরও চ্যানেল পাড়ি দিতে সাহস খুঁজে নিতে। অজ্ঞানতা দিয়ে বিশৃঙ্খলতার নির্মাণ ছাড়া—শৃঙ্খলার ক্রীড়াসূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় কখনো? ভাঙনের অমৃতধারা, কুয়াশায় আবৃত নীলাকাশ লুকানো থাকে শুভ্র তুলতুলে—সামগ্রিক দর্শনে প্রতিনিয়ত। যা স্পষ্ট হতে হলে, মস্তিষ্কের আক্রমণে রৌদ্র জ্বেলে দিতে হয়। জ্ঞানে-নির্মাণে-ফোস্কা ভেঙে ফেলতে হয়।
মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ তাঁরা হচ্ছেন সেই জ্ঞানের দিকপাল। ফোস্কায় ক্ষত গনগনে করে তুলতে জানে। তুলতুলে মেঘে ঢাকা নক্ষত্র এরা ! ঘনছন্দ মুক্তি নিবিড়—যে ব্যথায়—মেধায় ছন্দবিদ্যুতের ক্রম বিবর্তন হয়েছে। মথিত ইতিহাস রচিত হচ্ছে। তাহলে নিঃসন্দেহে মধুসূদনের হাতেই আধুনিক ছন্দের অপারেশন সাক্সেসফুল হতে শুরু করে। তিনিই প্রথম কাব্যের এনেস্থেসিয়া ভেঙে পয়ারের চালে অমিত্রাক্ষরের চেতনা এনেছেন মুক্তাক্ষরে। সার্থক সনেটের প্রবর্তনা করেছেন—ব্যাপক কাব্য সৃষ্টির উদ্যমে। যুগপ্রবর্তক এই কবির আধুনিক পর্বে তার সমস্ত নির্মাণসূত্রের মূলে, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিফলনও ঘটেছে অনিবার্য রকম। অপর—অনন্য ধারায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, গীতিস্পর্শে স্বতঃস্ফূর্ত। কবির সমগ্র ভাববাদী চিন্তায় ঝড় তুলেছিলেন। সৌন্দর্যের সার্থক রূপায়ণে তিনি যে শৈল্পিক চেতনার পুনরুজ্জীবন এনেছেন কাব্যের বিবর্তনের জন্য। অসাধারণ—সেই গদ্যছন্দের প্রকৃতিকে অনুসরণ—অনুকরণের নিয়ন্ত্রণে আজও আমাদের কাব্যছন্দের আধুনিকতা অটুট অন্বয়-অনুষঙ্গ-বাক্য নির্মাণের ঐতিহ্যে সাহস খুঁজে পায়। যদিও জীবনানন্দের কবিতার বিন্যাসে, এমন সাবলীলতা রয়েছে যেনো তার ভাষা-ছন্দ উভয়ই স্বতোৎসারিত। তবু কবি তার সমস্ত উপলব্ধিকে ক্লান্ত করে—নিসর্গের অনুভবে—খুব বেশি প্রাঞ্জল ছিলেন অক্ষরবৃত্তের পক্ষপাতিত্বে। যদিও গজ-ফিতের মাপে-পরিমাপে মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্তের চাল-চলনেও সর্বত্রই ব্যতিক্রম ছিলেন। পয়ার-মহাপয়ারে স্বার্থক বিয়াল্লিশ মাত্রার দৃষ্টান্ত কিন্তু জীবনানন্দীয় কবিতার সমগ্র ভাবনার মৌলিক সাহস রূপে দেখতে পাই।
বস্তুত বাংলা কবিতার ছন্দ পদ্ধতির প্রকাশ বহু বিবর্তনের। অজস্র রূপের প্রয়োগে এখনো সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে। তাই তো, অমৃতস্য রূপের রজস্বী কবিতা যেনো আজও কুসুমাবৃত নারীর উপমা—ছন্দের সব রকম ইন্দ্রজাল ঘিরে আছে আজও স্বমহিমায়।
অমিত্রাক্ষর: বাংলাদেশের কবিতার নিজস্ব ভূগোল সাতচল্লিশ-উত্তর সময়ে থেকেই সূচিত হয়ে গেছে—তারই ধারাবাহিকতায় ‘কবিতার রূপ’-এর কোনো ধরনের বিশিষ্টতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কবিতা এগোচ্ছে বলে মনে হয় আপনার ?
হেনরী স্বপন: কবিতা বা একজন প্রকৃত কবির নিজস্ব ভূগোল বলতে স্রেফ একটি কমলার ডিসকোর্স পর্যন্তই বুঝেছি আমি। সাতচল্লিশ তো আর্বান কাঁটাতারের বেড়া। পাসপোর্ট-ভিসা তৈরির প্রসেডিং। এইসব পরিবর্তন, যেগুলো সচরাচর ভিজ্যুয়ালি চোখে দেখা হয়েছে। কিন্তু পূর্ব-পশ্চিম এই দুই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিভাজন তো আগে থেকেই বিভক্ত ছিল। তবে দেশভাগের বাগাড় স্যাঁতস্যাত করে যতটুকু পাঁচফোড়ন গর্জেছিল। এর সারাংশে স্রেফ—হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হলো, পার কর আমারে… কিংবা— আল্লা মেঘ দে পানি দে রে.. রেকর্ডের অদল-বদলের মধ্যে দিয়েই সূচিত হয়েছে মাত্র। এ-ক্ষেত্রে কবিতার রূপের তুলনাটা যদি এভাবে বলি: সুচিত্রার চেয়ে দেবশ্রী কিংবা করবীর চেয়ে পূর্ণিমা—ঐশ্বরিয়ার মর্ডানিটির তফাৎ বেশি-বিউটিসিয়াসে একটু বেশি মাত্রায় পাল্টেছে। তাই বলে, বিজ্ঞাপন স্ক্রিন গ্লামারের আকর্ষণটাই প্রকৃত অভিনয়ের শিল্পত্ব নয়। এ ক্ষেত্রে কবিতার রূপের বিষয়টিও—পল্লীকবি-বিদ্রোহী কবি-মার্কসবাদী-প্রগতিবাদী-সাম্যবাদী কবির কবিত্ব থেকেও সব ষড়যন্ত্র মুছে ফেলা যায় না। পশ্চিমবাংলা যখন মার্কসীয় কলোনিয়ালিজম তত্ত্ব সতীত্ব রক্ষায়—ইম্পেরিয়ালিজম চর্চার দিকে ব্যাপক মনোনিবেশ হচ্ছে। পূর্ব বাংলায় তখন উর্দু আগ্রাসন ঠেকানোর ধ্বনি—সর্বত্রই বাঙালিত্ব—বাংলাভাষার ভূখণ্ড অটুটের জন্য অন্তরের টগবগে রক্ত দিতে হচ্ছে—ভাষাআন্দোলনে ভাষাশহীদদের। স্বাধিকারের চাপে ফের বিপ্লবে-বিক্ষোভে ঊনসত্তরের গণঅভুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের খুনে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু উপত্যকায় অজস্র ধর্ষণ আর স্বাধীন পায়রার বুকে পঁচাত্তরের নির্মম পারিবারিক হত্যাকাণ্ড—সামরিক শাসন—একে একে এতসব দ্রোহ উপলব্ধিতে আমাদের কবিতার শানানো শব্দ-বাক্য-রূপের অলঙ্কারে একটু বেশি উচ্চস্বর-বিপ্লব-বিদ্রোহী-দেশব্রতী-শ্লোগান-দুর্মর-দুর্জয়ই থেকে গেল পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশির আগে-পরে পর্যন্ত। তবু, উদ্ভূত এই ফরমায়েশি বৈশিষ্ট্য-বিশিষ্টতার ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে কবিতায় এখন নানা রূপ আরোপের ভাবাবেগ। কবি স্বভাবে-অন্তরঙ্গ শিল্প-সৃষ্টিও উন্মুক্ত জীবনে ফিরে যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ক্ষীণ এপ্রোসে-দর্শনে-ভার্সনে-মেধার বাতানুকূলে কিংবা হৃদয়ের সন্তর্পণে। আবার ভাবনায় গ্রাহ্য কবিতার মধ্যদিয়েই তো আজকের কবিতার-ইথার ভেঙে বেরুচ্ছে সেই পথ—হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি এই পৃথিবীর পথে। কিন্তু, বোরখাবিশিষ্ট আরও এক চক্রান্তের মধ্য দিয়ে—এখনকার কবিতার রূপে এসিড ফ্যাসিজম ছুঁড়ে তৈরি হচ্ছে যে, বিকৃত ভাষা ও সুন্নতের মাহমুদীয় সংশোধন। স্বাধীনতার ধ্বংসে লিপ্ত যাদের যুক্তি ও মনন—এই দাঙ্গাও কবিতার শত্রু সম্পত্তি দখলের প্রক্রিয়ায় প্রসেডিং হচ্ছে এবং—অন্ধকার চষে এগুচ্ছে বলেই মনে হয়। তবু, আপাত দুবোর্ধ্য ধ্বংসস্তূপে ঘেরা এই পথের অলিগলি ফুঁড়েই এগুচ্ছে আমাদের কবিতার দুর্জ্ঞেয়, আকাশের আড়ালে আকাশে.. মঙ্গল-মহাকাশ খুঁজে—চিনে নেওয়ার ভবিষ্যৎ।
কবিরা এখন চরিত্র ও কবিতা হরণে ব্যস্ত
কিছুধ্বনি: কবিতা লেখার উৎসাহ বা প্রেরণা নিশ্চয়ই কারও না কারও মাধ্যমে পেয়েছেন। কোন পরিপ্রেক্ষিতে তা পেয়েছেন?
হেনরী স্বপন: কবিতা লেখার সূচনা পর্বে যে পরিপ্রেক্ষিত আমাকে কবিতার মতো করে ভাবতে শিখিয়েছে, তা মূলত বই-বই এবং লাইব্রেরি। প্রথমত পড়–য়া হয়ে উঠলাম। লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক ছিলাম। সে-সময় কিছু সাহিত্যের কাগজ এবং দৈনিকের সাপ্লিমেন্টগুলোও আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
পৈত্রিক সূত্রে একমাত্র কৃষিকাজের জ্ঞানই হাতে পাওয়া। তবে বই কেনার বিকল্প অন্য কোনো পরিবেশের কথা আমার ক্ষেত্রে চিন্তাই করা যায় না। তখন কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের বই, সাহিত্য-তত্ত্বের কোষভাণ্ডারগুলো ভীষণভাবে পড়তাম। পাশাপাশি অজস্র কবিতার বই তো হামেশাই পড়েছি। বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, মানবেন্দ্র, শঙ্খ ঘোষ আরও অনেকের অনুবাদ গ্রন্থের সমাবেশ, বিভিন্ন লেখকের সাক্ষাৎকার আমাকে লেখালেখির জন্য এই পর্যন্ত উন্মাদ করে এনেছে।
এরপর এক সময়, লিটল ম্যাগাজিনের বিশাল পৃথিবী আমার কবিতা ভাবনা-কবিতা লেখার সাথে যুক্ত হয়ে যায়। ফলে আমি কেবল বুঝি ভাল কিছু লিখতে হলে বই এবং লাইব্রেরির পরিবেশই তাকে অগ্রগামী করে। যদি কারো ভেতর সেই লেখক সত্তা থাকে এবং সে যদি বইয়ের এক পৃথিবীর ঘ্রাণ পায়, তবে তার লেখক হয়ে ওঠা, শুধু সময়ের ব্যবধান মাত্র।
কিছুধ্বনি: কবিতায় উত্তরাধুনিকতা বিষয়ে আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন।
হেনরী স্বপন: পাশ্চাত্যে উত্তরাধুনিকতা এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে—বিভ্রমও। ইন্ডিভিজুয়্যাল রিয়ালিটির কারণে অন্তর্মুখী যাত্রার মাধ্যমে চূড়ান্ত বিচ্ছিন্নতা। যে উন্মক্ততা পাশ্চাত্যের প্রয়োজন হলেও, আমাদের নেই। যেখানে পাশ্চাত্য সব রকম তত্ত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তরাধুনিকতা বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিল, কেবল নতুন করে আইডেনটিটি খুঁজতে হবে বলে। তবে, আমাদের তেমন সমস্যা নেই। পাশ্চাত্যের কাল—ক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতের সাথে, আমাদের ক্রিয়ার পার্থক্য আছে, নানা পরিপার্শ্বে, নানাভাবে।
প্রশ্ন হল, ওরা তত্ত্ব করে ওদের প্রয়োজনে, আমাদেরকে ভোগ্য করে তুলবার জন্য। এ জন্যই আমরা ওদের তত্ত্ব নেব না। আমরাই আমাদের তত্ত্ব তৈরি করব। সে তত্ত্ব ওদের মনে না রেখে। যে তত্ত্ব আমাদের ভুল পথ থেকে তুলে এনে, নিজস্ব পরিচয়ের জায়গায় দাঁড় করাবে। স্থান-কাল-ঐতিহ্য মিশ্রিত আমার যে সত্তা-শেকড়! তার হৃদয় খুঁজে বের করবে। আমাদের মধ্যে তো ইউরোপবিরোধী একই নামের আরও তত্ত্ব আছে। আমি বুঝি না, এই বিভ্রমের কোনো মানে আছে কি-না। যেখানে আধুনিকতার কালনিবিষ্ট ব্যাখ্যার প্রকরণ নিয়ে আজও অনেক প্রশ্ন লেগে আছে। সেখানে উত্তরাধুনিকতা আরও বেশি প্রশ্নবাণে আক্রান্ত, তীরবিদ্ধ তো হবেই।
হয়তো, কেউ কেউ বলেন, আমাদের উত্তরাধুনিকতা কিন্তু এতেই তো পুরোদস্তুর ইউরো অস্বীকার করা হয় না। উত্তরাধুনিকতা ওদের/ আমাদের—এই বিতর্ক ও সমস্যা তো আছেই। তবু, বাংলা কবিতা এই উত্তরাধুনিক তত্ত্বের বিবরে ভেসে—উপাদান মানসিকতায় তার সত্তার দেশ, কাল, লগ্ন হওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও এই প্রবণতার চেষ্টা আধুনিকতার তকমায়-ই হওয়া উচিত ছিল। আজ বহুবছর পর…সমকালীন কবিরা চেষ্টা করছে, আপন হৃদয়ে ফিরে যেতে। এটা কোনো তত্ত্ব নয়—প্রায়শ্চিত্ত। এই প্রায়শ্চিত্ত পর্ব শেষ হলেই, আমরা, আমাদের কবিতার কবিরাই নতুন তত্ত্ব দেবে—পাশ্চাত্যকে মনে না রেখেই।
কিছুধ্বনি: নব্বইয়ের কবিতা সম্পর্কে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। এই যেমন স্বদেশবিচ্ছিন্নতা, রাজনীতিশূন্য, যুগযন্ত্রণাহীন, দর্শনহীন, প্রেক্ষাপটহীন, আত্মজৈবনিকতার যথেচ্ছা ব্যবহার ইত্যাদি। নব্বইয়ের কবি হিসেবে এই অভিযোগগুলো কতটা সঠিক? কতটা মিথ্যা? এবং কেন?
হেনরী স্বপন: জানেন, এই একাডেমিক স্থূলতার প্রতিই যতো রাগ আমার। এ-সবের কোনো মানে নেই। উপরন্তু সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের কারণ খুঁজে বের করা। অর্ভিযোগগুলো সত্যি হলে কবিতা হবে না—মিথ্যা হলে কবিতা হবে। এটা প্রমাণ করতে পারলে, এই উপাদানগুলো থাকা-না থাকায় কবিতার কিছুই ক্ষতি হবে না। কারণ আমরা নিশ্চিত করে দিতে পারি না, কবিতা নামের শিল্পবস্তু হয়ে উঠেছে কি, ওঠেনি? তা অবশ্যই ধরা পড়ে। আর কবিতার স্বার্থকতার বিশ্লেষণে কাব্যের যেকোনো উপাদানই যথেষ্ট। সেখানে এই ঢালাও মন্তব্যের অসারতাই প্রমাণ করে—এক ধরনের অজ্ঞানতা।
এক কথায় বলা যায়, বাজারি এই অভিযোগগুলোর সত্য-মিথ্যার সূচক নির্ধারণ-অর্থহীন এবং অসম্ভব। কারণ অভিযোগগুলো এককথায় এ ভাবেও উড়িয়ে দেওয়া যায়, অনেক কবিতার এই অভিযোগ—উপাদানসমূহের কোনও কোনওটি, বিভিন্ন মাত্রায় ফর্ম এবং টেকনিকে প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। যে ভিশন এবং টেকনিক এবং বাস্তবতার মধ্য দিয়ে কবি গেছেন সুদূর যাত্রায়। পাঠক যেতে পারেন নি—সে মাত্রায়। ফলে পাঠক/ আলোচক বুঝতে পারেন না কবির অভিপ্রায়। তাই, এইসব বুদ্ধিহীন একচেটিয়া অভিযোগ—এক ধরনের মূর্খতাজনিত অতীতমুখীন পাণ্ডুর রোগে আক্রান্ত বাচালতা মাত্র। এর পক্ষে আর তর্ক নয়। বরং নীরবতায় ধ্যানী হয়ে থাকাটাই আধিক শ্রেয়।
কিছুধ্বনি : আপনার কি মনে হয়—এ সময়ের কবিতা নিয়ে কবিরা আশানুরূপ গদ্য লিখছে না বলেই কবিতার দিগন্ত স্পষ্ট হচ্ছে না, এক্ষেত্রে কবিদের করণীয় কী?
হেনরী স্বপন: আমরা কবিরা এখন চরিত্র হনন, কবিতা হরণে এতোটাই ব্যস্ত যে, সত্য উচ্চারণই ভুলে গেছি। এমন মনোবৃত্তিতে এখানকার কবি কতৃক আশানুরূপ গদ্যলেখা সত্যিই দুরাশা। দিগন্ত স্পষ্ট করা তো আরও পক্ষের ঘটনা। যদিও কবিতার দিগন্ত বলে কিছু আছে কিনা—আমার জানা নেই। যদি থেকেও থাকে, তাহলে আমি সে সম্পর্কে এটুকু বুঝি, দিগন্তের কাছাকাছি থেকে কবি অন্যদিগন্ত দেখতে পায় না। কেবল তার পিছনের কবিদের কাছেই এই দিগন্ত স্পষ্ট হওয়ার কথা। হয়তো এক দিগন্তের ভাষায় কবিতা লেখার অক্ষমতা আমাদের মধ্যে রয়েছে এবং এই অক্ষমতাকে ঢেকে রাখার জন্যই, অগ্রজেরা আমাদের দিগন্তের সাদা-কালো স্পষ্ট করেন না। না-কি? তিনিও প্রতিনিয়ত ডায়েটে মিশ্রিত হয়ে টিকে থাকতে চান। অথবা আমাদের অগ্রজেরা মৃত! যা তারা লেখেন। তা মূলত কবি উপাধি টিকিয়ে রাখার জন্য। ফলে অগ্রজের কাছ থেকে আমাদের কবিতার দিগন্ত স্পষ্ট করার আশা তো দূরের কথা। এই কবিরা এতটাই ঈর্ষাকাতর, এতবেশি ব্যক্তি সম্পর্কে জারিত—সত্য উচ্চারণে যেন তারা সর্বত্রই ভয় পান। অথবা সত্যটাই বোঝেন না বা জানেন না। ফলে অবিনশ্বর হওয়ার ইঁদুর দৌড় খেলেন। কিংবা নিজেদের তৈরি মোড়লি সার্কেলে পাক খেতে খুব বেশি ভালবাসেন।
অবশ্য আশ্চর্য লাগে, এরা বাইরের কবিতায় তত্ত্বমুগ্ধ হতে ভালোবাসলেও, এখানকার কোনও সত্যিকার অর্থেই ভালো কবিতা পাঠের স্বাদ নিতে ভুলে যান। মুগ্ধতা, স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়া তো দুরাশা। অবাক লাগে, মেকি অন্তরালে এইসব কবিরাই একজন সাধারণ পাঠকের চেয়েও কত নিম্নমানের গৌণ পাঠক থাকেন— তারা।
এ সময়ের কবিতার দিগন্ত স্পষ্ট করার আশানুরূপ গদ্য হচ্ছে না ? কিন্তু আমরা সেই দিগন্ত স্পষ্ট করা গদ্যের আশা করি। অথচ এই দুর্ভাগা সময়ে সেই গদ্য হবে না। সমকালের কবিরা এই গদ্য লিখতে পারবে না, এটাও নিশ্চিত। সময়ের কবিরা যা করতে পারে। সে তার নির্মাণের মধ্যে দিয়ে, তার কবিতার দিগন্তকে স্পষ্ট করবে। এবং সেই স্পস্টতার পথে যেতে যেতে—আরও দিগন্ত স্পষ্ট করা কবিতা লিখবে। তারপর একটু প্রবীণ হয়ে, আমরাই না হয়,—আমাদের সেই গদ্য ফিরে পাব এবং আমরাই তা লিখে ফেলব কোনও একদিন।
কিছুধ্বনি: আপনার মতে ছোট কাগজের কনসেপ্ট কী?
হেনরী স্বপন: একটি ছোটকাগজ—সত্যিকারের ছোটকাগজ কি না, তা নির্ভর করে ঐ কাগজটির সহ্য ক্ষমতা এবং সম্পাদকের মেধা ও মনন মিশ্রিত দূরদর্শিতার উপর। কাগজটিকে হরেক রকম বানানো তর্কের সাচে ফেলে ‘প্রতিষ্ঠান/ অপ্রতিষ্ঠান বিরোধী…ছোট কাগজের লেখক/ বড় কাগজের লেখক…’ এইসব প্রলাপে প্রবাহিত হয়ে লিটল ম্যাগাজিন করা মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। মেধা ও বোধ কোনো সম্পাদকের নিজস্ব হতে পারে। কিন্তু এর সহ্য ক্ষমতা বলতে, আরও অনেক কিছুকে বোঝায়। আর তা বোঝাতে, ওই কাগজটি শিল্পমান সম্পন্ন হয়ে ওঠার নতুনত্বে এবং অভিনবত্বে— যে কোনো রকমের প্রাণস্পর্শী লেখা প্রকাশের জন্য তার দরজা কতটা খোলা রাখে। কতবেশি লেখককে নয়, লেখাকে আমন্ত্রণ জানায়। ফলে এ-রকম একটি প্লাটফর্ম থেকেই তৈরি হয়, এই সময়ের সাথে সম্মুখ সময়ের সংযোগ এবং এর থেকেই একটি ছোটকাগজের কালস্রোতের ভেসে বপু খুলে দাঁড়ানোর এক চিলতে মাটি পেয়ে যান প্রকৃত লেখকের পরিচয়। তাই তো একজন স্রষ্টা নিয়তই একা। আজকে কেউ কেউ…নিজেকে লেখক/ কবি/ কবিতাকর্মী মনে করে, এক ধরনের গুরুমুখী মৌমাছির চাক তৈরি করে স্থুলতায় নিঃশেষ করে দেয় প্রতিভাকে। সত্যিকার কবি/ লেখককে কেউ ব্যবহার করতে পারে না। না দর্শন, না ঈশ্বর। কেননা, লেখা ছাড়া যে লেখকের আর কোনো শ্লেট থাকতে নেই।
অনেক ছোট কাগজের সম্পাদককে দেখেছি, লেখক/ কবিকে মুখ্য করে, লেখাকে নয়। আমি দীর্ঘদিন যাবৎ ‘জীবনানন্দ’ করছি। ‘জীবনানন্দ’ পুরোপুরি কবিতার কাগজ করেই এর চরিত্র গড়ে নিতে চেষ্টা করেছি। ‘জীবনানন্দ’ : ছোট কাগজ/ বড় কাগজ এই খেলায় মেতে ওঠেনি। যে সকল কবি/ লেখক প্রবল বড় কাগজ বিরোধী, তাদেরই তো আবার বড় কাগজে হজম হতে দেখি। প্রতিষ্ঠান/ অপ্রতিষ্ঠান এই তকমায় বিরোধী হতে হতে সেই কাগজই—মানসিকতায়—প্রতিষ্ঠান হয়ে সীমিত কেন্দ্র, গোষ্ঠীবদ্ধতায়—আত্মকেন্দ্রিক ভূত হয়ে যায়। এই যে নক্ষত্র পতন চলছে, এর মূলে কোনও লিটল ম্যাগাজিন কাউকে নক্ষত্র হতে উসকে দিতে আসেনি।
‘জীবনানন্দ’ কবিতাপত্র। সেই নক্ষত্র নির্দিষ্ট করতে পেরেছে কি, পারেনি, আমাদের জানা নেই। তবে কবিতা হয়ে ওঠার বাইরে কোন রকম খণ্ড দর্শনে শক্তিক্ষয় করতে চায়নি। ‘জীবনানন্দ’ কবিতাপত্র সব কবিকেই আমন্ত্রণ জানায়। বয়স-ব্যক্তি কোনো কিছুই মুখ্য নয় ‘জীবনানন্দ’-এ। এ-করম বহু প্রতিষ্ঠিত কবির লেখা যেমন আমরা মনে রাখিনি। ছাপিওনি, আবার বহু তরুণের কবিতা ছেপে ‘জীবনানন্দ’ কবিতাপত্র নিজেকে সমৃদ্ধ মনে করেছে, আমাদের ডাস্টবিন অনেক বড়। অনেক লেখক, অনেক কবির ভুল লেখা আমরা ছাপিনি। যদিও তরুণদের বেলায় কিছু কিছু ভুল থেকেই যায়।
তাই, আমাদের ছোটকাগজ কনসেপ্ট মানেই : সে লেখকের ভাল লেখাটি ছাপতে চায়। নিজেদের সাথে প্রথম সংযোগের আনন্দ খুঁজে নিতে। যার কোন রুদ্ধতা নেই। মেনিফেস্টোও নেই…। তার মানে লিটল ম্যাগ কেবল বহুগামী নয়। সমৃদ্ধ—বহুগামী!
কিছুধ্বনি: কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ এই দুইজনকে দলবিভক্ত মতে দেশের প্রধান কবি বলা হয়ে থাকে, বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দ্যাখেন ?
হেনরী স্বপন : শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদকে আমাদের প্রয়োজনে ভাগ করে দলের স্বার্থে ব্যবহার করছি। রাহমান কিংবা মাহমুদ দু’জনের কিন্তু কবিতা নামক শিল্প যাত্রায়, কখনোই ভাগ হয়ে যাননি। ধরে ফেলি দু’জনেই প্রধান কবি। কে ছোট কে প্রধান, এরকম কোন মাপকাঠির প্রতিষ্ঠান, সে তো দলবাজি-ই। পাঠকের ভালবাসার মাঝেই তারা বিভিন্নভাবে প্রধান ও বিশিষ্ট হয়ে থাকবেন। কারও কথায় কিংবা দলবাজিতে নয়।
আল মাহমুদকে কোনো এক ধর্মীয় দল ব্যবহার করার ফলে, তার চিন্তায়—কবিতাগুলোর শিল্পগুণ হারিয়ে প্রার্থনা হয়ে উঠছে। এক ধরনের নিম্নমানের ধর্মীয় এই কোরাস হয়তো কবিতা হয়ে উঠছে না। এ কারণে আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’-এর কবিতা মুছে যায় না। আমরা হয়তো আল মাহমুদের এ সময়ের কবিতা মনে রাখতে চাই না। পড়তে চাই না। অন্যভাবে শামসুর রাহমান হয়তো অভিনব কিছু লিখতে পারছেন না। ষাট-সত্তর-আশিতে যা লিখেছেন, সেই মোহনীয় মন্ত্রের উচ্চারণ, হয়তো হচ্ছে না। তবুও তো নিয়ত লিখছেন। হোক রোজনামচা। প্রার্থনাকারীর মতোন তো নয়।
যদিও আল মাহমুদের ধর্মীয় আরোপের শব্দগুলো প্রার্থনার বাইরে এসে মানুষের কাছাকাছি হলে কবিতার আরও অন্যরকম লাভ হতো। আল মাহমুদ মৌলবাদী হলে, জ্ঞানপাপী হলে কবিতা আশ্চর্য হতে পারে। কিন্তু পাঠক যেন আশ্চর্য না হয়।
পাঠক যেদিন কবিতার পিছনের আল মাহমুদ এবং শামসুর রাহমান নাম দুটো ভুলে যেতে পারবে, সেইদিন এ রকম পাঠকরাই ‘দল ও প্রধান’ এই শব্দদু’টো মুছে ফেলবে। অথচ দু’জনেই কবি থাকবেন—কবিতার সাদা দুধভাত হয়ে।
কিছুধ্বনি: আধুনিক বাংলা কবিতার উল্লেখযোগ্য কবি যেমন শহীদ কাদরী, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রমুখের কবিতায় জীবন ও আত্মোপলব্ধি আপনার দৃষ্টিতে কেমন ?
হেনরী স্বপন :
পড়েছে এক ধাঁধায়
এখন তার সামনে সাতটি রাস্তা
কিন্তু কোন পথই রোমের দিকে যায় না
— আধুনিক মানুষ: নিকানোর পারা
এই সময় কবিদের এক অসীম সমস্যা—কে কার সম্পর্কে বলবে। কী বলবে? কতটা বলবে? চলছে ভুল প্রশ্নের ভুল ব্যাখ্যা। এর থেকেও আমিও যে খুব নিরাপদে আছি, তা কিন্তু নয়। একই কালের মধ্যে থেকে অথবা দূরে দাঁড়িয়ে নিস্তার নেই। অস্পষ্টতা কাজ করে। বিভিন্ন অনুষঙ্গ জাপটে ধরে, যা কবি এবং কবিতার ক্ষেত্রে উভয়ই ক্ষতিকর। তাছাড়া আমরা কবিরাও ততটা প্রস্তুত নই। আমাদের সহ্য ক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি, বাঙ্কারের মতোন। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে ‘কোন পথই রোমের দিকে যায় না’—নিকানোর এই পঙ্ক্তির মধ্যে জীবন ও আত্মোলপব্ধির বিষয় রয়েছে। কিন্তু কবির জীবন এবং আত্মোপলব্ধি একজন সাধারণ মানুষের মতো নয়। কবির জীবন অনেক জীবনের মিশ্রণে তৈরি হয়—আত্মোপলব্ধিও। আমাদের কবিকুলের জীবন ও আত্মোপলব্ধি কীভাবে? কতটা মিশ্রিত হয়ে তৈরি হয়েছে, জানিনা। কিন্তু এটুকু বোঝা যায়, মিশ্রণের তারতম্যের কারণেই অনেক কবি, কালের-মহাকালের বীক্ষণ হয়ে উঠতে পারেননি। কেবল তাদের অসম্পূর্ণ জীবন এবং আত্মোপলব্ধিতে জলের উপরে ফেনার বুব্দুদ ছড়িয়ে শেষ করেছেন তার ভ্রমণ।
পঞ্চাশ পরবর্তী কবিতার যে নগরায়ণ শুরু—আমরা ওর থেকে মুক্তি খুঁজছি। শেকড়ে যাবার চেষ্টা করছি। নগরজীবন নিয়ে কবিতা লেখা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নগর নিয়ে লেখা, নাগরিক যন্ত্রণা নিয়ে লেখা আর কবিতার নগরায়ন এক কথা নয়। আমাদের এইসব নাগরিক কবিতার মধ্যে যে শেকড়বিচ্ছিন্নতা, যে বৃহৎ জীবনের অনুপস্থিতি এবং আত্মোপলব্ধির খণ্ডায়ন—কবিতার খণ্ড স্পষ্ট করেনি। বলা যায়, এ একরকম ধস! কারণ এর কোথাও বৃহৎ আমি নেই। যে আমিটি এই জল-হাওয়া কিংবা মাটির অস্তিত্বে জায়মান…
প্রলুব্ধ এই উপাদানকে মনে রেখেই বলা যায়, শহীদ কাদরী এবং আবুল হাসানের মধ্যে জীবন ও আত্মোপলব্ধির বীক্ষণ ছিল। নির্মলেন্দু গুণেও যার ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। শহীদ কাদরী তার জীবন ও আত্মোপলব্ধি প্রসরণে—সম্পর্কের বিশ্বাসকে এলোমেলো করে, নতুন সম্পর্কের বিশ্বাসকে এলোমেলো করে, নতুন সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে অপর ঐতিহ্য এবং দর্শনকে মনে রেখেছেন। কাদরীর কবিতা পাঠে, আত্মোলপব্ধির ক্রোধের মধ্যে অপরের উপস্থিতি টের পাই। বেজে ওঠে মন। আর জীবন ফুলে ওঠে তেজের মাত্রায়। তার উপমা, প্রতি-উপমা, শব্দ এবং বাক্যের বক্রতা আমাদের অনেক দূরের সম্মুখ সময়ে নিক্ষেপ করে।
অন্যপক্ষে আবুল হাসান যেনো তারই ধারাবাহিকতায় রোমান্টিক অপরকে মনে রেখে, দৃশ্য থেকে দৃশ্যের বর্ণনায় মেতে উঠেছিলেন। যদিও তা প্রান্তের কোমল হাওয়ায় মুগ্ধতা বয়ে আনেনি। জীবন ও বোধে নিঃসীম গভীরতা আরোপ না করে—এক ধরনের মূর্ছনা বিক্ষেপ মাত্র। এক্ষেত্রে একজন শহীদ কাদরী যা ছিল, পরবর্তী কাদরী হবার আগে, একজন আবুল হাসান মূলত তাই।
ঐতিহ্যের রিলেটা এ রকমই হয়। জানি না আবুল হাসান কোথায় যেয়ে শেষ করতেন, তার ভ্রমণ পরম্পরা। কিন্তু ‘কোথাও ক্রন্দন নেই’ এর পর শহীদ কাদরী প্রায় চুপ হয়ে গেলেন। আবুল হাসান দগ্ধ হয়ে মুছে ফেললেন নিজেকে। কিন্তু আমার কাছে এই অসম্ভব দু’দুজনের দু’ভাবে চলে যাওয়ার মধ্যে—আমাদের কবিতাও—‘পড়েছে এক ধাঁধায়’ বলে মনে হয়।
প্রশ্নজালে আটকানো অন্যান্য কবি ও কবিতা সম্পর্কে নীরব থাকাই ভালো। কারণ নীরবতার মতো শক্তিশালী অস্বীকারের ভাষা কোন উচ্চারণে অসম্ভব। আমাদের সময়ের অনেক কবি ভোজ্য হবেন। তামসে খেয়ে ফেলবে তাদের। কবিও কবিকে খায়। চেতনে-অবচেতনে। পূর্ববর্তী বহু কবির জীবাশ্ম আমরা দেখতে পাই। তবুও এই কবিদের নামগুলো আমাদের আলোচনায় ঘুরে বেড়াবে।
এক্ষেত্রে আমরা হয়তো একজন মোহাম্মদ রফিককে ভুলে যাই। এই সময়ে মোহাম্মদ রফিকের মতো কবিকে অস্বীকার করে আমরা যেন আমদের মূর্খতাকেই স্পষ্ট করছি। তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, মোহাম্মদ রফিক কি লিখছেন? তাঁর কবিতার উপাদান, জীবন এবং আত্মোপলব্ধির মধ্য দিয়ে আমরা সেই প্রায়শ্চিত্তের পথটিকে দেখতে পাই। মোহাম্মদ রফিকের শব্দ বিন্যাসের অভিনবত্ব, ক্রোধকে কাল ঐত্যিহের মাঠ কেটে কেটে রোপণ করা, প্রান্তের জীবনকে বোঝার লোকশক্তি আমাকে এত বেশি স্পষ্ট করে যে, পূর্ববর্তী জীবনের অন্ধকার ভুলে যাওয়া দেখতে পাই। আমার বিশ্বাস মোহাম্মদ রফিকের কবিতা থেকে শুরু হয়েছে এই পথ। তার থেকেই শুরু হয়েছে এই গসপেল। বাংলা কবিতায় মোহাম্মদ রফিক যা পারেননি, তাই এই সময়ের কবিদের অসম্ভব হয়ে ওঠার পিছনে একান্ত বিষয়।
কিছুধ্বনি : ছোটকাগজ এবং দৈনিক একজন তরুণ লেখকের জন্য কোন মাধ্যম উপযোগী এবং কেন?
হেনরী স্বপন : প্রকৃত লেখকের কাছে দৈনিক অথবা ছোট কাগজ এর ক্ষেত্রে প্রধান বলে কিছু নেই। কখনো কবির কাছে দৈনিক/ ছোট কাগজ উভয়ই গৌণ হয়ে যেতে পারে। প্রশ্ন হল, লেখক লিখতে বসে কোথায় এটা ছাপবেন, সেটা মনে রেখে লিখছেন কিনা। যদিও ছাপার ক্ষেত্রে লেখকের পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। কিন্তু এটাকে ঘিরে কোন তত্ত্ব, আন্দোলন, বিরোধিতা! লেখকের লেখায় কোনো গুরুত্বের মাত্রাযুক্ত হয় বলে আমার মনে হয় না।
লিখতে এসে লেখার জায়গা দখল করবে না—বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ধরনের দখলদারিত্বের কাছে আটকা পড়বে (কখনো কখনো) কেন ? এমন তো হতে পারে, অনেক দৈনিকের সাহস-ই আপনার সেই লেখাটি ছাপাবে। এই সাহসের ক্ষেত্রে যদিও ছোটকাগজ সবসময়ই অগ্রগামী। দৈনিকের সাহস থাকা বা না থাকার পিছনে অবশ্য উদ্দেশ্য থাকা স্বাভাবিক। এ কারণেই তরুণদের নতুন লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে, সবসময়ই ছোট কাগজ, দৈনিককে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়।
দৈনিক কারা প্রকাশ করে? কারা ছোট কাগজ কওে ? এর মধ্যেই এই দুই মিডিয়ার ঐতিহ্য এবং উদ্দেশ্য স্পষ্ট। তরুণদের এটা বুঝতে হবে এবং এটাও মনে রাখা উচিত, দৈনিকে প্রকাশ যেমন কোনো লেখক বা লেখার মাপকাঠি নয়, তেমনি ছোট কাগজও। দৈনিকে প্রকাশ হওয়া মাত্র কোনো তরুণ কবি অহং-এ আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন, যা তার লেখক সত্তার বিশালতাকে থামিয়ে দিয়ে স্থুলতায় আটকে দেয়। আবার ছোট কাগজে প্রকাশ হয়ে তামসিক গোষ্ঠী অহং-এ আটকা পড়েও নিজেকে হারিয়ে ফেলে। মূলকথা—কোথায় ছাপা হবে-না হবে, এটাকে ভুলে নিয়ত লেখা অন্যকে পড়া ও লেখার দিকে সতর্ক চোখ রাখাই একজন তরুণের দায় থাকা সুবিধাজনক। সত্যিকারের লেখা হয়ে উঠলে, ছাপা-ছাপির ক্ষেত্রে কেউ কারোর উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বরং এই ভালো লেখাটি ছেপে উভয় কাগজই প্রধান হয়ে ওঠে। তবুও পছন্দ তো অসীম সূত্র—যা নিয়ে তর্ক চলে না।
কিছুধ্বনি : বলা হয়ে থাকে কবিতার পাঠক বরাবরই কম, এ বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন ?
হেনরী স্বপন : কবিতার পাঠক বরাবরই কম। আমি এটাকে নেতিবাচক জায়গা থেকে দেখি না। আমার কাছে কবিতা এবং কম পাঠক নিকটবর্তী শব্দ বলেই মনে হয়। কবিতার ব্যাপক পাঠক হলো কী হলো না, এতে শুদ্ধ কবিতার কিছু যায় আসে না। কবিতার চর্চাও থমকে দাঁড়ায় না।
কবিতার মতো এত শুদ্ধ শিল্পমাধ্যমে পাঠক কারা? যারা নিয়ত একটি পাঠের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে কবিতার মাধ্যমে নিজের হৃদয়ের কাছে যেতে চায়। যে দেশে প্রকৃত পাঠকই হাতে গোনা। সে্েক্ষত্রে কবিতার পাঠক অল্প থাকাটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া কবিতার কম পাঠকের পিছনে সত্যিকার দায়ী নয়। বরং কবিতানাশক শব্দভার-ই এর জন্য দায়ী। যা বিভিন্নভাবে অসুস্থ মস্তিষ্ক থেকে প্রকাশ পায়। পাঠক তো দায়ী নন মোটেই—পাঠ করতে করতে একদিন তিনিও কবিতার কাছে যাবেন। সমকালীন কোনো কোনো লেখকের চিন্তার দূরত্বের সাথে, পাঠকের চিন্তার-বোঝার দূরত্বের কারণে, কবিতার অধিক পাঠের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রভাব ফেলে। তাছাড়া আমার তো মনে হয়, কবিতার পাঠক বাড়ছে। কারণ এত লেখক! এত তরুণ—সত্যিকারের কবিতা লেখা চেষ্টা করছে। এরা তো পড়ছে এবং কবি যশোপ্রার্থী এরা অনেকেই সাহিত্যের কবিতার মুগ্ধ পাঠক।
কিছুধ্বনি : বাংলা কবিতায় ত্রিশ একটা উল্লেখ করার মতো দশক। এর ধারাবাহিকতায় কোন্ দশক ত্রিশের মতো উল্লেখযোগ্য?
হেনরী স্বপন : তিরিশ হচ্ছে রবীন্দ্রবলয় বিচ্ছেদের কাল! বাংলা কবিতার আত্মরক্ষার স্বতন্ত্রতা সৃষ্টির দ্গি¦লয় হতে এ সময় একদল কবি বেলেহাঁস হয়ে এলেন। রোমান্টিক, আধ্যাত্মিকতার সংশয় কাটিয়ে এরা কেউ কেউ আধুনিক ছায়া-বলয় রচনার ভাষায় লিখছেন: উটের গ্রীবার মতো নিস্তব্ধতার ছবি। ইউরোপের নানা স্বরগ্রামে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল—নতুন কবিতার নানা উপমা, রূপক, চিত্রকল্প, অন্বয়ে…।
আধুনিক কালের অভিধায়, এ সময়ের পঞ্চকবির আধিপত্য বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপা-বের কীর্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে এদের স্ব স্ব কাব্য ভাবনায়, অনেক-ই পার্থক্য ছিল। পরাক্রমশালী এই কবিদল বাংলা কাব্যে ছড়িয়ে আনলেন রহস্য প্রশান্তির পরিম-ল। আজ পর্যন্ত তাদের ভাষার অতিন্দ্রিয় রহস্যময়তা কাটিয়ে সকলেই জনপ্রিয়তার সমতল পায়নি।
তিরিশের এই নির্জন গীতিলতার আত্মময় প্রবাহের ধারায় পঞ্চাশের কবিরাই ঝুঁকেছিলেন বেশি। এদের প্রধানত দুটি পত্রিকাগোষ্ঠীর অবলম্বন হয়ে ওঠা, একটি ‘শতভিষা’, অন্যটি ‘কৃত্তিবাস’। অন্যপক্ষে তিরিশের কবিদের প্রধান পত্রিকা অবলম্বন বলতে—‘কল্লোল ও কবিতা’। তিরিশের কবিদের সমগ্র কীর্তি সামনে মেলে ধরে পঞ্চাশের কবিরা নানাভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন, একঝাঁক অনেক জন মিলে: শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, সৈয়দ হক, সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ এবং সেইসাথে শঙ্খ, সুনীল, শক্তি, উৎপল, শরৎ, তারাপদ, সমরেন্দ্র, দীপক আরও অনেক, অনেক জন। পঞ্চাশের এরা সকলেই অন্তর্বয়নে একেক জগতের—একেকজন কবিতার ঈশ্বর।
কিছুধ্বনি: দশকওয়ারী মূল্যায়ন কোন দৃষ্টিতে দেখেন? এ রকম মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা কি আদৌ আছে ?
হেনরী স্বপন : দৈনিকের তোষণ চিন্তা এবং পোষাকবি তৈরির চিন্তা থেকে আংশিক, বাকীটুকু লিটল ম্যাগাজিনের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকেই আজকের এই দশক চিন্তা—কবি এবং কবিতাকে নিরীক্ষা করছে।
আগে প্রবীণরা নতুনদের বুঝতে পারতেন। বোঝার চেষ্টা করতেন। দায়ও অনুভব করতেন। কবিতার রিলেটা ঠিক রাখার জন্য। স্বার্থও ছিল, তরুণরা তাদের মনে রাখবেন, উচ্চারণ করবেন। নশ্বরতা থেকে তুলে ধরবেন—অবিনশ্বরে। আজ তরুণ কবিরা নিজেদের গায়ে দশকের লেবেল এঁটে, এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছেন—এক ধরনের স্মৃতি তৃপ্তি। আর এই লেবেল ধরেই চলছে অস্বীকার পর্ব। যেনো দশকটাই এক মহাকালের দূরত্ব। এই কাল সর্বস্ব তৈরি করে, বিচ্ছিন্নতা আরোপ করে, অন্যকে অন্ধত্ব আরোপ করে, নিজেকে মূর্খ আলোয় আলোকিত হয়ে দেখাতে চান—তিনিই সবচেয়ে উজ্জ¦ল-অবিনশ্বর। যেখানে কবিতা কাল নিরপেক্ষ হয়ে ওঠার কথা অথবা সম্মুখ সময় মনে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে স্পষ্ট থাকার কথা, সেখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের সংকীর্ণ করে, আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছি। তাহলে দশকের প্রয়োজন হলো কেন? পাঠকের বোঝার স্বার্থে! কবি না কবিতাকে বোঝার স্বার্থে? এই প্রশ্নগুলো আরও জরুরী। কবি কতটা ভার্জিন বোঝানোর প্রয়োজনে পাঠক অথবা কবিতা কারোরই প্রয়োজন নেই। আমাদের মনে রাখা উচিত—কবি অথবা সময় নিঃশেষ হয়, কিন্তু টিকে থাকে কবিতা।
দশক বিভাজনের প্রয়োজন নেই। কবিতার কাঠামো, দর্শন, মেধা ও চিন্তার এতোসব দশক ধরে আগায় না। বিভাজন যদি করতেই হয়, তবে এখন সেটা কবিতা বিভাজনের সময় এবং এর ভিতর দিয়েই কবিতার সেই দিগন্ত স্পষ্ট করা সম্ভব। এর যে কোনো সুবিধাহজনক ব্যাখ্যা যেন কবিতাকে ঘিরে, তার সৃষ্টিকে ঘিরেই হয়। হওয়া উচিত…।
দশক-তারুণ্য, লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্রিক গোষ্ঠীবদ্ধতা, অস্বীকারের তত্ত্ব, ব্যক্তি আক্রমণ—এসবই প্যারাসাইড কাঠামো—যা আমাদের কবিতা নির্মাণে প্রভাব ফেলে, ক্ষতি বাড়িয়ে গ্যাংগ্রিন করে…।
কিছুধ্বনি : আপনার সমকালীন প্রিয় কবি কে কে ? কেন তারা প্রিয়?
হেনরী স্বপন : আমার কাছে সমকাল শব্দটি হচ্ছে আমার সময়ের আয়না। সেখানে আমি নিজেকেই বিন্যস্ত হতে ভালবাসি। যে আয়নায় অন্যের সৌন্দর্য গাঁথা উচ্চারিত হলে, ঈর্ষায় জ্বলে উঠি। মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে ফেলি। কিন্তু একজন তুষার কন্যা (কবিতা কন্যাও বলা যেতো…) তো মরে না। বরং কারো না কারো কৃপা পেয়ে যায়। রাজত্ব—রাজকুমারের অপেক্ষায়।
অথচ নিজের কবিতার আয়নায় উদ্ভাসিত হতে হতে—অনন্তকাল বেঁচে থাকবে কবি। আমি তো আমার সমকাল বুঝি—দেখি, যে আয়নায় কোনো অকবিত্বের জীবাশ্ম নেই। নেই খরাদগ্ধ-ইথিওপিয়া!
সমকালীন বন্ধুরা লেখে…। আমি তাদের কবিতা পাঠে শুদ্ধ হই। নির্জন-অলৌকিক পাঠক হওয়ার ঘোরে নেশাগ্রস্থ হই। আরও যাদের কবিতার স্বরগ্রামে আমার রেওয়াজ মেতে ওঠে—তারা সংখ্যায় এক-দুই-চারজন কিংবা সংখ্যাবাচক কেউ নন। তারা হয়তো শূন্য থেকে যোজন যোজন…।
কিছুধ্বনি : আপনার কবিতা সম্পর্কে কিছু বলুন?
হেনরী স্বপন: কবিতা নিয়ে কথা বলার অনেক বিপদ। কি হলে কবিতা হবে ? কি না থাকলে কবিতা হবে না, কোনো কবিই তা বলতে পারে না। কারণ, কবিতা অনেক রকমের। শিল্পের কোনো সার্বজনীন সংজ্ঞা নেই। আর সংজ্ঞার শেকলে বেঁধে থাকেন বলেই, আলোচকরা অনেক সময়েই কবিতাটি ঠিক বুঝতে পারেন না। এমন কি কখনো কবি নিজেও। শুধুমাত্র সত্যিকার পাঠকই বুঝতে পারেন, কোন্টি শুদ্ধ কবিতা হয়ে উঠেছে। কী কারণে শুদ্ধতম ! তা সম্ভবত তিনিও জানেন না। শুধু কবিতাটি ভাললাগা থেকেই পাঠকের এই সিদ্ধান্ত রচিত হয়। এটা অবশ্য যার যার কবিতা অনুভব করার, প্রবাহিত হবার ইনার প্লেট আছে, কেবল সেই সত্যিকার পাঠক দ্বারাই সম্ভব হয়। আবার সব পাঠকের একই কবিতা—সকলের ভাল লাগবে, তাও নয়, বরং সবচেয়ে মজার! এই পাঠককূল তার সিদ্ধান্তের কারণ লিখতে পারে না। সম্ভবও নয়।
কবিতার সংজ্ঞার ক্ষেত্রে পাঠকই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। যে ভাললাগা নিয়ে একজন কবি, কবিতা শেষ করেন। তারচেয়ে অধিক ভালবাসা যদি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তবেই কেবল সেই পাঠকের কাছে, আমার কবিতার সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং এভাবে একজন কবি কালনিরপেক্ষ হয়ে উঠবেন।
এই অসীম সূত্র আমার ভিতরে কীভাবে আয়ত্বে থাকবে ? কবিতার ঘোরে না পড়লে অথবা শব্দ ধরার ফাঁদ নিয়ে না ঘুরলে কোন মুডই আমাকে প্রথম পঙ্ক্তির অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেবে না। যা প্রখর চেতন অবস্থা থেকে অবচেতন স্তর থেকে যুক্তি শৃঙ্খলিত হয়ে, সুষম ছন্দের বিন্যাসে উঠে আসবে আমার সাদা পৃষ্ঠায়…
এরপর কবিতার সবচেয়ে মূল্যবান কথা—আবিষ্কারের হৃদয়াবেগ—সচেতন মনের আকুতি যে ভাষায় প্রকাশ পেতে থাকে। উৎসারিত ধ্যানের মধ্যেই আমার কবিতা সৃষ্টির দ্যুতি—মূর্ত হতে—অমূর্তে পৌঁছে দেবার সেই ভাষা হয়ে ওঠে। আমি এই ভাষাকে সাজিয়ে উৎকৃষ্ট সামঞ্জস্যে কবিতা বানাই। আমার শরীর থেকে সুলিপির অজ¯্র ভার কমতে থাকে। কবিতা প্রবর্তিত আবেগে সরল-জটিল-বাস্তব কিংবা পরাবাস্তবের সৌষ্ঠবে—একেকটি পঙ্ক্তির সাথে অন্যান্য পঙ্ক্তিরা জুড়তে থাকে, এই পঙ্ক্তিগুলোর স্থিতি এবং গতি-জড়তার বিন্যাস, কয়েকটি পঙ্ক্তির উপমা-রূপক-অন্বয়-বিশ্লেষণ যোগসূত্রে প্রাসঙ্গিক হয়ে কবিতা আমাকে গিলে খায়। যে কবিতার খোঁজে আমাকেও নিয়ত অতলের দিকে যাত্রা করতে হয়।
কিছুধ্বনি : ৩৮ বছর ধরে প্রকাশিত কবিতাপত্র কিছুধ্বনি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন?
হেনরী স্বপন: কিছুধ্বনির এই তিন যুগেরও অধিক যাত্রায়—একজন আনওয়ার আহমদ ছিলেন। তিনি কবি-গল্পকার এবং লিটলম্যাগের অবতার।
এজন্যই তিনি অবতার ! এত দীর্ঘ সময় পর্যন্তই কারোর-ই লিটলম্যাগ চর্চা অব্যাহত থাকে নি। তার সময়ের সমস্ত কাগজই স্ব স্ব স্বার্থ ও সিদ্ধিলাভে কালগর্ভে বিলীন হয়েছে। অথচ একজন আন্ওয়ার আহমদ এতদিনেও তথাকথিত একটি প্রতিষ্ঠান না হয়ে—হলেন তথাগত পুরুষ প্রাণ!
এতকাল উত্তীর্ণ হলেও অহং-কিছুধ্বনি-কে খেয়ে ফেলেনি। অথচ আমরা, আন্ওয়ার আহমদের এই সুদূর যাত্রার মিথ টেনে তুলতে চাই না। তার সমস্ত নির্মাণ ও সৃষ্টির ঘোর আসক্তিতে ফলিডল রমণী প্রসঙ্গ টেনে—একজন আন্ওয়ারের সামগ্রীক উত্তরণ থেকে তাকে একায়তনিক স্থিতাবস্থায় নিয়ে তুলি এবং এভাবেই অভিনন্দনযোগ্য ভাষা লুকাবার কাছিম হয়ে উঠি—আমরা।
ছোটকাগজের ক্রান্তিকাল ও অন্যান্য॥ হেনরী স্বপন, প্রচ্ছদ: নাজিব তারেক, প্রকাশক: শ্রাবণ, প্রকাশকাল: বইমেলা-২০১৬