চিন্তাসূত্রের নভেম্বর সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছোটগল্প। অর্থাৎ ছোটগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, ছোটগল্প ও তরুণ গল্পকারদের ভাবনা। তরুণ গল্পকারদের ভাবনাপর্বে ছোটগল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন কথাশিল্পী কাজী রাফি।
চিন্তাসূত্র: কেন ছোটগল্প লিখছেন?
ছোটগল্প মানুষের জীবনের পশ্চাৎমঞ্চকে উন্মোচন করে। একজন মানুষ যে জীবনটা কাটায়, তার জীবনটা কি তেমনই হওয়ার কথা ছিল?—এই প্রশ্ন আমাকে তাড়িত করে। আমি মানুষের সামনে চলমান একটা জীবনের অন্তরালে তার গভীরতর অনুভূতি আর আকুতিকে খুঁজতে চাই। জানতে চাই, তার স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার পতনবিন্দুকে। এটা একজন কথাশিল্পী হিসেবে এক ধরনের আত্মানুসন্ধান বৈকি! ছোটগল্প সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের জীবনের বাস্তবতার অন্তরালে তার সত্যিকার আবেগ-অনুভূতি ও পরাবাস্তবতা খোঁজার এক নেশা কাজ করে। আর ছোটগল্প সৃষ্টির এই অভিযাত্রা আমাকে আলোক দেখানোর পাশাপাশি নির্ভীকও করে তোলে, নিঃসন্দেহে।
চিন্তাসূত্র: একটি গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
আমার গল্পে আমি ভাষাকে তীক্ষ্ণ করে তোলার চেষ্টা করি। ছোট পরিসরে জীবনের একটা বৃহত্তর অবয়বকেই তো ছোটগল্প ধারণ করে। সে হিসেবে আমি চাই, আমার গল্প এত প্রকাশ্য অথচ নিগূঢ় যেন হয়, যা মানুষের বোধের মধ্যে একটুকরা স্মৃতি হিসেবে বাস করে। এটা যেন হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ এক ঝলক দেখেই চমকে ওঠার মতো হয়। ভ্রম হয়েও যা বোধকে জাগিয়ে দেয়; তেমন বৈশিষ্ট্যই আমি গল্পে ধারণ করতে চাই। আমার কোনো গল্পেই আমি গণ্ডিবদ্ধ চরিত্রকে নিয়ে কাজ করতে চাই না। প্রবন্ধের মতো করে পাণ্ডিত্যপূর্ণ কোনো চরিত্রকে নয় বরং আমি চাই বাস্তবতার সঙ্গে কল্পলোকের চরিত্রগুলো আলাদা প্রক্ষেপণ তৈরি করুক। সেই প্রক্ষেপণ, যা জীবনের অনিত্যতার প্রতীক হয়। জীবনের সাদৃশ্যময়তা, সাদৃশ্যহীনতা, মূর্ছনার মতো করে গাওয়া অন্তর্লোকের সুরকে আমার ছোটগল্প ধারণ করতে চাই।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে চায়?
গল্পের মতো করে কোনো হিতোপদেশ, কোনো ধর্মীয় বাণী মানুষের অন্তরকে, তার বোধকে জাগায় না। গল্প সরাসরি উপদেশ না দিয়ে জীবনের পুঞ্জিভূত অভিজ্ঞতা ও সম্ভাবনাময় কোনো স্বপ্নকে নর-নারীর মননে প্রোথিত করে দেয়, যা পক্ষান্তরে একজন মানুষের প্রজ্ঞাকে সমৃদ্ধ করে। তার অনুভবকে শাণিত করে। তাকে বিনয়ী করে এই বোধে যে, জীবনের সময় খুব ক্ষুদ্র আর স্বল্প হলেও স্মৃতি প্রলম্বিত এবং মানুষের মানবিক আচরণটুকুই কারও স্মৃতিতে বাস করে। খাবারের জল এগিয়ে দেওয়ার সময় স্ত্রী/প্রেমিকা অথবা মায়ের হাতটা অসুস্থতা অথবা দুর্বলতা অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে কাঁপতে থাকে বলে সারাজীবন ইন্টারনেটে তথ্য আর উপদেশ শেখা মানুষগুলো বিরক্ত হয়ে বিরূপ আচরণ করলেও গল্পে সমৃদ্ধ হৃদয় সেই সীমাবদ্ধতার মাঝেও মায়া খুঁজে পায়।
চিন্তাসূত্র: একজন কবি যখন একজন গল্পকারও, তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
একজন কবি গল্পকার হতে পারেন। তবে, শুধু কাব্যময়তা দিয়ে গল্প বিনির্মাণ করতে গেলে তা গল্পের আবেদনটুকু হারিয়ে ফেলবে। একজন গল্পকারের ভাষায় কবি-প্রতিভা থাকতে হয়। কারণ, শেষপর্যন্ত কবিতা ও গল্পের প্রকাশমাধ্যম ভাষাই। গল্পকে মর্মস্পর্শী করে তোলার জন্য একজন কথাশিল্পীকে তার আবেগাপ্লুত ভেতরটাকে শাসন করে নিষ্ঠুর হতে হয়। পক্ষান্তরে কবিতাকে প্রাণময় করে তোলার জন্য কবি তার ভেতরকে উন্মুক্ত করে আবেগকে আমন্ত্রণ জানান। কবি যদি গল্পকার হন, তাহলে এই দুই স্থানের সম্মিলন তাকে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে ঘটাতে হবে।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
গল্পে অপ্রয়োজনীয়ভাবে যৌনতাকে টেনে আনা বোকামি। এমনকি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসবের জন্য তো ইন্টারনেটের লাগামহীন জগৎ আছেই। কিন্তু গল্প তো জীবনের আর্তিকে খোঁজে। গল্পের কাজ কখনোই উত্তেজনা তৈরি করা নয় বরং শান্ত আর স্নিগ্ধ এক জীবনের দিকে মানুষের অন্তরকে আকর্ষিত করা। তবে, যৌনতা যেহেতু জীবনের অনুষঙ্গ সেহেতু ঘটনার প্রয়োজনে গল্পে যৌনতা আসতেই পারে এবং তার নান্দনিক চিত্ররূপটুকু নির্মিত হয় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, তার মানসিক স্তরের রুচির ওপরে। লেখককে সবসময় মনে রাখা প্রয়োজন, যৌনতার সুড়সুড়ি দিয়ে আর যাই-ই হোক, এ সময়ে অন্তত কোনো বই পাঠকনন্দিত করা যায় না। আবার যৌনতার নান্দনিক ও মানবিক চিত্রায়ণের কারণে পাঠকের মননকে এক স্নিগ্ধ-সতেজ অনুভূতিতে আপ্লুত করে একটা গল্প পাঠকনন্দিত এমনকি সময়োত্তীর্ণও হতে পারে।
চিন্তাসূত্র: কী ধরনের ছোটগল্প পাঠকসমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
এটা বলা কঠিন। আমাদের দেশের পাঠকের মনন বিচিত্র ধারায় বিভক্ত। ছোটগল্পের পাঠকও কম। অথচ আমাদের দেশের ম্যাগাজিন ও পত্রিকাগুলো কিন্তু ছোটগল্পই প্রকাশ করছে। তাহলে, ছোটগল্পের পাঠক কম কেন? হালকা মানের উপন্যাস পাঠকের সূক্ষ্ণ বোধের জায়গাটাকে ভোঁতা করে দিয়েছে। বিশ্বের ছোটগল্পগুলোর শিল্পমানের সমৃদ্ধির জায়গায় এবং তার তুলনায় আমাদের কমসংখ্যক ছোটগল্প সেই শিল্পমান অর্জন না করার পেছনে এটাও একটা কারণ বলে আমি মনে করি। তা নাহলে, হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’ সবচেয়ে পঠিত ছোটগল্প হতো।
চিন্তাসূত্র: একটি কাহিনীকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কী কী শর্ত পূরণ করতে হয়?
ওই যে বলছিলাম ছোটগল্প যেন হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে চলন্ত ট্রেনে হঠাৎ এক ঝলক দেখেই চমকে ওঠার মতো হয়। ভ্রম হয়েও যা বোধকে জাগিয়ে দেয়। আসলে কবিতা মানুষের চলমান জীবনে নিত্য ভাবনা ও অনুভবের অনুষঙ্গ হলেও গল্পটা বোধের অনুষঙ্গ। কবিতা বাইরের জগৎকে অন্তর্লোকে পাঠাতে চায়। আর শিল্পমানোত্তীর্ণ একটা গল্প যেন পাঠকের অন্তর্লোক দিয়ে বাইরের জগৎটাকে দেখতে চায়। এমন শর্ত যে গল্প পূরণ করতে পারে, যে কোনো ফর্মেই লেখা হোক, তার নান্দনিক আবেদন চিরস্থায়ী।
চিন্তাসূত্র: ছোটগল্প নিয়ে আপনার নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ কেমন ফল দিতে পেরেছে?
‘পাসওয়ার্ড’ নামে আমার এক ছোটগল্পে ফুয়াদ নামের এক তরুণের চরিত্রে বর্তমান অস্থির সময়ের কারণে নেমে আসা মানবিক অসহায়ত্বের ধরণ আমি খুঁজেছিলাম। অজ্ঞান ফুয়াদের অনুভূতি নিয়ে গল্পটায় কাজ করেছি। শোনার সক্ষমতা ও ব্রেন জীবিত থাকলেও ডাক্তার ফুয়াদকে মৃত ঘোষণা করে। তাকে কবরে নেওয়া পর্যন্ত সেই চরিত্রের অডিও সেন্সরি নামের স্নায়ুতন্ত্র জীবিত থাকার কারণে চলৎশক্তিহীন হলেও সে পরিপার্শ্বকে স্পষ্ট করে শুনতে পায়। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশী দুঃখ-কষ্টে ভেঙে পড়লেও কেউ-ই তার প্রশ্বাসটুকু পরীক্ষা করে দেখার প্রয়োজন মনে করে না। কারণ, পনেরো দিন হাসপাতালে নিযুত বিল বানানো ফুয়াদ তখন একটা বোঝামাত্র। ঠিক সেই মুহূর্তে অবিবাহিত ফুয়াদ তার হারানো প্রেমিকাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিতে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজের জীবনের পাসওয়ার্ড খুঁজতে থাকে। তার মনে হয়, জন্মলগ্নে স্রষ্টা তাকে কোনো একটা ‘পাসওয়ার্ড’ অথবা গোপন কোড দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। মায়ের গর্ভে থাকাকালে সাদা ডানার অসংখ্য পরিরা হাসতে হাসতে ফিসফিস করে সেই পাসওয়ার্ড তাকে বলে গিয়েছিল। সেই পাসওয়ার্ড মনে করলেই এই গভীর অন্ধকার ঘোর কাটিয়ে সে ফিরে পাবে তার জীবনে ফেরার সূত্র!
এছাড়া আমি ‘রূপডাঙ্গার সন্ধানে’ গল্পটিতে মাত্র ইন্টার্ন করা মৌটুসী নামের এক নারীকে নির্মাণ করেছি। প্রকৃতির কাছে গিয়ে অনুভবের আত্মানুসন্ধান যার কাছে নিত্যনতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়। দুই ডজনের মতো ছোটগল্পের মাঝে আমার এই গল্প দুটি বেশি নিরীক্ষাধর্মী। এর ফল কী হয়েছে জানি না। তবে আমার ছোটগল্প নিয়ে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক রেজভি জামানের মন্তব্যটুকু প্রণিধানযোগ্য। তিনি আমার গল্প নিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘I have read some excellent short stories of Kazi Rafi with keen interest and utmost sincerity. Kazi Rafi came to the limelight with the publication of his debut novel DHUSHAR SWAPNER SASANDRA. The book was hugely appreciated, admired and eulogised by lots of serious readers and seasoned literary personalities. The book earned him envious reputation and it was awarded with a number of prestigious prizes. While reading his short stories I was attracted by his captivating prose style, enthralling art of storytelling, subtle aptitude of character portrayal, meticulous use of humour and pathos. His insightful analysis of modern psyche is quite evident both in his novels and short stories. Rafi’s stories are replete with almost all the ingredients of modern literature. There is both vehemence and magnetism in narrative art. His devotion, diligence, integrity, aesthetic acumen are quite noticeable in all his literary works.
In his stories Kazi Rafi has rightly diagnosed the the perilous and morbid effects of socio-cultural disintegration, erosion of traditional values, extreme alienation, neurotic disorder and intricacies of the contemporary time. In fact, he is a very committed author.
চিন্তাসূত্র: আপনার ছোটগল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ভালো কিছু ছোটগল্প নির্মাণ ছাড়া আমার আর কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই। আধুনিক জীবন যাপনের যে যন্ত্রণা, অতিমাত্রায় সামাজিক যোগাযোগের নামে বস্তুত অসামাজিক হয়ে ওঠা, লাইক পাওয়াকে সফলতা মনে করার ভ্রান্তিকর বিচ্ছিন্নতা আমি ছোটগল্পে ধারণ করে মানুষের বোধ জাগরণের সংকেত তৈরি করতে চাই।
চিন্তাসূত্র: মানুষের কল্যাণে আাপনার ছোটগল্প কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
সে বিচারের ভারটুকু পাঠকের অন্তর্লোকের অনুভবের কাছে ছেড়ে দিতে চাই। এ প্রশ্নের উত্তর আমার চেয়ে ‘সময়’ নামক মহান এক ‘যাযাবর’ সবচেয়ে ভালো জানে।