চিন্তাসূত্রের নভেম্বর সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছোটগল্প। অর্থাৎ ছোটগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, ছোটগল্প ও তরুণ গল্পকারদের ভাবনা। তরুণ গল্পকারদের ভাবনাপর্বে ছোটগল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন কথাশিল্পী মুর্শিদা জামান।
চিন্তাসূত্র: আপনি কেন ছোটগল্প লিখছেন?
ধন্যবাদ, প্রথমেই যেটি বলতে চাই, সেটি হলো—ছোটগল্প লিখতে শুরু করার আগে অনেক পর্যায় পার হয়ে আসতে হয়েছে। প্রথম দিকে ছড়া বা কবিতার মধ্য দিয়ে আমার ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। সেসবের বেশিরভাগই ছিল লুকিয়ে লুকিয়ে লেখা। দুই-একজন দেখার পর যখন সাধুবাদ জানাতো, আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠতো মন। এই যে আনন্দ, এর স্বাদ পাওয়ার জন্য বার-বার লিখেছি। একটা পর্যায়ের পর কবিতায় থেমে থাকতে পারছিলাম না আর। যা বলতে চাই, লিখতে চাই, তার সব ভঙ্গিমা প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। তখন চিঠি লিখতাম।
সমাজ, মানুষ, রাজনীতি, দেশ, প্রেম, বিরহ, স্বপ্ন, আশাভঙ্গ—সবকিছু নিয়ে চিঠি লিখতাম। এই করে করে কখন যে গল্পের উদ্যানে প্রবেশ করেছি নিজেও বলতে পারব না। ছোটগল্প লেখার পর দেখলাম, আরে এই তো সেই ক্যানভাস, যেখানে আমি মানুষের কথা, জীবনের গল্প, সমাজের নিম্নচাপ, ঊর্ধ্বচাপ—সবটুকু নিয়ে মনের মতো করে আঁকতে পারছি। আমার দেখাকে, আমার উপলব্ধিকে নতুন করে খুঁজে পেলাম এখানে।
চিন্তাসূত্র: আপনার গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
গল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কখনো ভেবে দেখিনি। এটা পুরোপুরি নির্ভর করে আমি যা নিয়ে লিখতে চাচ্ছি, তার প্রেক্ষাপট বা যে মানুষগুলোকে নিয়ে আমার গল্প তাঁদের জীবনযাপন তাঁদের মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতে। এটা একটা দিক যেমন, তেমন আমি যা জানি না বা কাছ থেকে দেখিনি, সেটার ভাসা ভাসা বোধ নিয়ে লিখতে বসি না কখনোই।
যেমন দুই-বছর আগে একজন শখের মৎস্যশিকারির গল্প আমি শুনেছি, সেই গল্পটি এত হন্ট করল আমাকে অথচ দুই কলম লিখতে পারিনি। এর কারণ নদীতে বরশি ফেলে কী করে মাছ ধরতে হয়, সেটা যেমন জানি না, তেমনি ২৭-২৮ কেজি মাছও দেখিনি কোনোদিন। যার ফলে ওই গল্পটি মগজের তলায় পড়ে আছে। গল্প লেখার বৈশিষ্ট্য নিয়ে নাড়াচাড়া যাই হোক না কেন, আমার কাছে অনুভব বা পর্যবেক্ষণটাই জরুরি। যত দেখা যাবে, জানা যাবে, অনুভব করা যাবে, তত গল্প হয়ে উঠবে ভাষায়-অবয়বে-ঘটনায় নন্দিত ও শৈল্পিক।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে চায়?
যেকোনো শিল্পের প্রাথমিক দায় থাকে অন্যকে আনন্দ দান করা। ছোটগল্পেও ঠিক তাই। একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে পারে, এই বিষয়ের আগে একটু চওড়া করতে চাচ্ছি প্রসঙ্গটি। গল্পের নানা ধরন রয়েছে। যেমন ধরুন, সামাজিক বা মনস্তত্ত্ব প্রধান গল্পের বিষয়বস্তু একরকম আবার বিশুদ্ধ দার্শনিক-পর্যায়ের গল্পগুলোও ভিন্ন দিকের।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেনা-পাওনা, ত্যাগ অথবা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘দরজা’, ‘টোপ’—এগুলো সামাজিক গল্প; এর থেকে পাঠক সামাজিক সাজ সরঞ্জামের স্বাদ পাবেন। অন্যদিকে, জীবনের গভীর রহস্যময় নিবিড়-নিঃসঙ্গ রস পাঠক পেতে পারেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে। আবার যারা থ্রিল পেতে চান, তারা অগাথা ক্রিস্টি, ডরোথি সেয়ার্স, আর্থার ক্লার্ক, শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, নীহার রঞ্জন গুপ্ত—এই সব লেখক ছোটগল্পে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েন।
‘সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম’, অথবা ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’-এর আনাগোনাও ছোটগল্পে পাঠক টের পেতে পারেন। নিয়ত পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ তাঁর চিন্তার জগতে নানা মাত্রায় মূল্যবান শিল্প সৃষ্টি করে যাবে, পাঠকও এর নির্যাসে মথিত হতে থাকবে। তবে ছোটগল্পে পাঠক আধুনিক স্কয়ারফিট মাপের ফ্ল্যাটগুলোর মতো কিচেন উইদ স্টোরেজ বা উইন্ডো গার্ডেনের মতো ছোটপরিসরে সাচ্ছন্দ্য ও প্রয়োজন—দুটোই সামলে নিতে পারেন। চেনা-দেখা ঘটনার ভেতর কত শত কর্নার যে একটি ছোটগল্পে থাকে, তা কেবল পাঠকই খুঁজে পেতে পারেন। মনস্তত্ত্ব বলুন আর দর্শনই বলুন বা Phenomenology—এর সবই তো উন্মোচিত হয় একজন মানুষের বা একজন পাঠকের কল্পনাশক্তির সমৃদ্ধির বলে।
চিন্তাসূত্র: একজন কবি যখন একজন গল্পকারও, তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
সৈয়দ শামসুল হক কবি হিসেবেও পছন্দের আবার গল্পকার হিসেবেও। প্রথমে তো তাঁর কবিতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, এরপর বাড়ে গল্পের সঙ্গেও। Reception Theory ব্যক্তিমানসে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে গৃহীত। সৈয়দ শামসুল হকের গল্পে যে অন্তর্ভেদী ও আবেগবর্জিত সূক্ষ্ণদর্শন পাই, সেটা তিনি কবি বলেই কি? আবার তাঁর শৈল্পিক দৃষ্টি কবিতায় যে ভাবে আছড়ে পড়েছে, তাতে সমূদ্রের গভীরতাই ছুঁয়ে গেছে।
লেখার বিষয়টি এমনই সংঘবদ্ধ যে আমি নিজেও কবিতা লেখার পাশাপাশি গল্প লিখছি। তবে শব্দ ও ভাষার গড়ন, উন্মোচন এর রূপ বিন্যাস অনেকটাই চোখে পড়ার মতো। দেখা গেল কবিতায় যেটিকে আমি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি, গল্পের প্রেক্ষাপটে তা অনেক সময় Private Symbol থেকে বের হয়ে আসতে হয়।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
যৌনতা যেকোনো মাধ্যমেই নান্দনিক হতে পারে। ছোটগল্পের পরিসরে এর দৃষ্টিনন্দন উপস্থিতি যদি থেকে থাকে, তবে মানবজীবনের নানান স্তরের কথা মাথায় রেখেই তা করতে হবে। যদি সমাজের একজন বিকৃত যৌনচারীর কোনো গল্প লেখা হয়, তবে সেখানে কোনো নন্দনচিত্র কি ফুটে উঠবে? না, যৌনতা কখনো কখনো নির্মম বাস্তব। আর এই বাস্তবতার গল্প কেবল নির্যাতনের গল্প তাও নয়। হতে পারে একজন পুরুষ ইমপর্টেন্ট। তখন তাঁর যন্ত্রণার গাথাও হয়ে উঠতে পারে একটি শিল্পনন্দন গল্প।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প ‘তারাবিবির মরদ পোলা’ এখানে যৌনতাকে গল্পের মূল টানাপড়েন হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। অতৃপ্ত দাম্পত্য যে জীবনের অন্যতম সংকট, সেটা ব্যক্ত করার সময় যে লিবিডো চেতনার বিস্ফোরণ ঘটে গল্পে, এটাকে স্পর্শ করার জন্য যৌনতাকে সবসময় নান্দনিক হতেই হবে, তার কোনো মানে হয় না।
একজন ক্ষুধার্ত দিনমজুর যখন ভাত খান, তখন সেটি আমার কাছে চূড়ান্ত বাস্তব এবং প্রয়োজনীয়। তাঁর সেই খাবার দৃশ্যকে হাজার রঙ চড়ালেও বাস্তব সত্যের চেয়ে সুন্দর কখনোই হয়ে উঠবে না। তেমনি একজন নিঃসঙ্গ মানুষের যৌন জীবনের গল্পও রীতিমতো নির্মম। ফলে ছোটগল্পের ডিকনস্ট্রাকশনে যৌনতা কতখানি শিল্পনৈপুণ্যে উত্তীর্ণ বা নান্দনিক হয়ে উঠবে, সেটির অবস্থান কিন্তু দেশ বা সংস্কৃতির ওপরও নির্ভর করে। যেমন হোমোসেক্সুয়ালিটি নিয়ে যদি একটি গল্পের অবয়ব দাঁড় করানো যায়, সেটির গুরুত্ব কি কেবল নির্মাণ শৈলির ওপরই বর্তাবে? না কি সমাজের মানসিক গঠনের ওপরও এটির ভাগ্য গুটিয়ে যাবে?
চিন্তাসূত্র: কোন শ্রেণীর ছোটগল্প সবচেয়ে বেশি পাঠকসমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
আবারও রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফিরে যাই তাহলে। গল্পগুচ্ছের সব গল্পগুলোই মানুষ পড়েছে। তবু কিছু গল্প মানুষকে আবেগের আন্তরিকতায় হৃদয়ানুভূতির ঐকান্তিক প্রকাশে বারবার পড়িয়েছে। ‘সমাপ্তি’, ‘দালিয়া’, ‘একরাত্রি’—এই গল্পগুলোর ভেতর যে সব উপকরণ রয়েছে, হয়ত তাই পাঠক মনে তুমুল রেখাপাত করেছে। আবার লিবিডো চেতনার গল্পগুলোও পাঠক সমাদৃত সমানভাবে। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈাতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’ বহুল পঠিত গল্প।
চিন্তাসূত্র: একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোন কোন শর্ত পূরণ করতে হয়?
সেই অনার্সে পড়ার দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিলেন দেখছি। থার্ড ইয়ারের সেই সিলেবাস আর পাবলিক লাইব্রেরির টেবিলে উঁচু হয়ে থাকা রেফারেন্স বুকের ছোটখাটো পাহাড়ের পাশে নিজেকে আবার দেখতে পাচ্ছি। যা হোক, ছোটগল্প উত্তীর্ণ হওয়ার প্রশ্নে যাওয়ার আগে মাথায় রাখতে হবে আমরা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশে অবস্থান করছি। মাত্র কয়েক দশক আগে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। তার পরপরই একটি মর্মান্তিক ক্যু এই দেশে ঘটে গেছে।
রাজনৈতিক পেষণ এত বেশি আমাদের ভোগ করতে হয়েছে যে, আমাদের গল্পগুলোতে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বা শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের ওপর উচ্চস্বর হতে হয় সেটা আমরা ভুলে গেছি। এই কারণে সোলজেনিৎসিন লেখককে দেশের ‘দ্বিতীয় সরকার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বেশিদূর যেতে হবে না, ভাষা আন্দোলন বা স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্পগুলোর দিকে দৃষ্টি বোলালেই দেখতে পাব, লেখকরা কি ভয়ানক গঠনমূলক শিল্প নির্মাণ করেছিলেন দেশকাল এবং এর জীবনযাত্রার ভেতর যে যন্ত্রণা নিসৃত হয় তার বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গিটির যে খাড়া মেরুদণ্ড পাওয়া যায় তাই আমার কাছে শিল্পশর্ত।
এবারে বলি, ছোটগল্পে প্রধানতম আবেদনই হলো সমাপ্তির ধরন ও আঙ্গিক বিবেচনা। Unity of Impression এর ওপর ছোটগল্পের শৈল্পিক উৎকর্ষ নির্ভর করে। আবার গল্পের কেন্দ্রীয় সংকট বা Pointing Finger গুরুত্বপূর্ণ ছোটগল্পের ক্ষেত্রে । মোপাসাঁর সেই নকল হীরার মালার গল্পটির কথা মনে আছে তো! সেই চাবুককষা সমাপ্তি! ছোটগল্প উৎরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট বৈকি।
চিন্তাসূত্র: ছোটগল্প নিয়ে আপনার নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ কেমন ফলাফল দিতে পেরেছে?
অনেক ধন্যবাদ। নিরীক্ষা কি না জানি না, তবে ‘কালি ও কলমের’ ছোটগল্প সংখ্যায় প্রকাশিত ‘কলুষ্কাল’ গল্পটি পড়ে অনেকেই ফোন করেছেন আমাকে। চট্টগ্রাম থেকে একটি ফোন এসেছিল। তিনি ফোনে কাঁদছিলেন রীতিমতো। এটি আমাকে ভাবিয়েছে খুব। আর আমার কাজের সময়সীমাও খুব কম ফলে এখনই বলা যাচ্ছে না কিছুই।
চারপাশের মানুষ বা পরিস্থিতি সবই তো পর্যবেক্ষণ করে চিন্তা ও লেখা ফলে মানুষ গল্পে নিজেদের রিলেট করতে পারুক, সেটাই তো একজন লেখকের কাম্য। তবে যে হারে মানুষ যন্ত্রমুখী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, তাতে করে মানুষ কতটা আগের মতো গল্পের ভেতর ঢুকে যেতে পারবে সেটিও বেশ ভাবায়।
চিন্তাসূত্র: আপনার ছোটগল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ভবিষ্যতের কথা কে বলতে পারে বলুন? ছোটগল্প লেখার সময়কাল বাড়াতে চাই। মানে বেশি বেশি লিখতে চাই।
চিন্তাসূত্র: মানুষের কল্যাণে আপনার ছোটগল্প কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
তীব্র আত্মপ্রেম থেকেই মানুষ সৃষ্টিশীল হতে শেখে। এরপর ধীরে ধীরে সমাজের অংশ ও এরপর মানবিক কোনো প্যাসেজের ভেতর দিয়ে লেখকের যাতায়াত। সাধারণ মানুষের সংগ্রাম নিয়ে কথা বলার সময়ই গল্পগুলো হয়তো মানুষের কাজে লাগলেও লাগতে পারে।