আবু মকসুদ। কবিতাকর্মী। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে লন্ডনপ্রবাসী। প্রকাশিত গ্রন্থ নয়টি। শব্দপাঠ নামে একটা সাহিত্য কাগজ সম্পাদনা করেন। প্রবাসে সাহিত্যচর্চা নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে সম্প্রতি ভাবনা বিনিময় করেছেন এই কবি।
চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন?
আবু মকসুদ: আমি প্রায় তিন দশক ধরে প্রবাসী। টিনএজের শেষের দিকে দেশ ছেড়েছি। অর্থাৎ আমার এখনপর্যন্ত প্রাপ্ত বয়সের বেশিরভাগ সময়ই প্রবাসে কেটেছে। তাই অনুভূতি ভালো-মন্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
চিন্তাসূত্র:কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
আবু মকসুদ: সুযোগ পাই কেমনের উত্তরে বলা যায়, সুযোগ করে নিতে হয়। প্রবাসের অধিকাংশ লেখকই সৌখিন হন। লেখালেখিকে যেখানে মাতৃভূমিতেই পেশা হিসেবে নেওয়া সম্ভব হয় না, সেখানে প্রবাসে তা অকল্পনীয়। তবু জন্মদাগের দায় মেটাতে সুযোগ খুঁজতে হয়।
চিন্তাসূত্র: দূরপ্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
আবু মকসুদ: দেশ হৃদয়ে অনুভূত হয় ঠিকই, কিন্তু ওই রকম আর মিস করি না। এর দুটো কারণ, দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়া, দ্বিতীয়টি টেকনোলজির কারণে দেশ এখন হাতের মুঠোয়। শৈশবের ঘাসমাড়ানো মাঠ এখান থেকেই অনায়াসে পাড়ি দেওয়া যায়। যদিও মাঠগুলো আর মাঠ নেই, ইট-কংক্রিটের দালানে নিজেদের সতীত্ব হারিয়েছে। এই মাঠগুলোর জন্য প্রাণ কাঁদে, ধূলায় গড়াগড়ি খেতে মন চায়। কিন্তু জগতের সব চাওয়ার মতো এটাকেও অপ্রাপ্তির খাতায় সেঁটে দেই। দেশে কথা মনে হলে আমি বিষণ্ণ বিকাল পাড়ি দেই।
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্যচর্চায় কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
আবু মকসুদ: অনুকূল পরিবেশ কোথায় আছে? প্রতিকূলতা জয় করেই এগোতে হয়। প্রবাসে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে আত্মপীড়ন, একটা পঙ্ক্তি হয়তো মননে তোলপাড় তুলছে কিন্তু সময়াভাবে প্রকাশিত হতে পারছে না। সুস্থির সময়ে হয়তো পঙ্ক্তির গ্রহণযোগ্যতাই বদলে গেছে। তবু পীড়ন শেষে কিছু একটা উৎপাদন কারা যাচ্ছে, এটা কম স্বস্তির নয়।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন? দিবসগুলো পালন করেন কিভাবে?
আবু মকসুদ: আমি দিবসকেন্দ্রিক নই। একটা দিনকে কেন্দ্র করে এক্সাইটেড হতে হবে, এটা আমার ধাঁতে নেই। উৎসববিমুখও আমি নই। আমার উৎসব প্রতিদিনের। প্রতিদিনের শহীদে, বিজয়ে, স্বাধীনতায় আমি দেশ বন্দনা করি। তবু সময় সুযোগে দিবসকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানেও উপস্থিত হই, বন্ধুসঙ্গ লাভ কিংবা আড্ডা উল্লেখযোগ্য কারণ।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
আবু মকসুদ: একটা বই মেলার আগে, চলাকালীন অথবা মেলার শেষে আসতে পারে। কিছুটা আমার ওপর, অধিকাংশই প্রকাশকের মর্জি-মেজাজের ওপর নির্ভর করছে।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্যচর্চা?
আবু মকসুদ: সাহিত্যচর্চার খবর পেয়ে যাই। তবে নিখোঁজ কিছু থাকলে জানি না। সাহিত্যচর্চা নিয়ে মূল্যায়নধর্মী কিছু লেখার যোগ্যতা আমার আছে কি না, তা নিশ্চিত নই। মুঠোফোনের বদৌলতে অন্তর্জালে যা দেখি, তাতে নিরাশ হওয়ার কিছু দেখি না। চর্চা ঠিক পথেই এগুচ্ছে। কিছু পরিকল্পনায় আরও ঋদ্ধ হবে, তবে শঙ্কা হচ্ছে পরিকল্পক যারা, তারা কতটুকু সঠিকের কাঙ্ক্ষা রাখেন?
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে, কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আবু মকসুদ: আন্তর্জাতিকতার জন্য অনুবাদের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, বাংলা একাডেমি বা অন্যান্য সাহিত্য, সংস্কৃতির স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অনুবাদের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা অনুবাদের কাজ করছেন, রাষ্ট্র তাদেরও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে। সর্বোপরি যোগ্য অনুবাদক খুঁজে পেতে অনুবাদ প্রশিক্ষণ কর্মশালা করা যেতে পারে।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার মধ্যে কোন শাখাকে আপনার ঋদ্ধ মনে হয়?
আবু মকসুদ: আমি কবিতাকেই এগিয়ে রাখব। তবে কথাসাহিত্যও হেলাফেলার নয়।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশার কথা জানতে চাই।
আবু মকসুদ: আমার মতে ভবিষ্যতের কোনো হেরফের হবে কি না জানি না, তবু বলি। অতীতের শিক্ষায় যদি আমরা ভবিষ্যৎ মূল্যায়ন করি, তবে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। আদিযুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগের পাঠ শেষে যদি আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারি, তবে উত্তরাধুনিক পাঠেও আমাদের প্রজন্ম তৃপ্তি পাবে; এ আশা আমরা অবশ্যই ব্যক্ত করতে পারি।