[কাজী নাসির মামুন। কবি। জন্মেছেন ১৯৭৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। পেশায় শিক্ষক। এই পর্যন্ত তার চারটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো, লখিন্দরের গান (২০০৬), অশ্রুপার্বণ (২০১১), কাক তার ভোরের কোকিল (২০১৭) ও রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই (২০১৮)। এ ছাড়া ২০১৪ সালে ‘লখিন্দরের গান’ কবিতাগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ Song of Lokhindar প্রকাশিত হয়েছে। এই কবির ৪৭তম জন্মদিন উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছেন আবৃত্তিশিল্পী কাজী শহীদ শওকত।]
কাজী শহীদ: জীবনের আরেকটি বছর পেরিয়ে এলেন। জন্মদিন এলে কেমন লাগে আপনার? এবার নিশ্চয়ই কিছুটা ভিন্নতা আছে?
কাজী নাসির মামুন: বিশেষ কোনো অনুভূতি হয় না। আমাদের জীবন রিপিটেশনে ভরপুর। ফলে জন্মদিন চমকপ্রদ কোনো বিষয় নিয়ে হাজির হয় না। আগে তো জন্মদিন কখন এলো-গেলো, এসব খেয়ালই করতাম না। আমার এক ভাগ্নি মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতো। এখন ফেসবুক স্মরণ করিয়ে দেয়। কাজেই আড়াল হওয়ার উপায় নেই। আরও এক বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হলো। এটি মানুষ হিসেবে আমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। না-ও পারে। কিন্তু মানবজনম নিয়ে আমার পরিতৃপ্তিবোধ আছে। ফলে একটা বছর যে খোয়া গেলো, সেই বোধ আমাকে হয়তো একটু বিষণ্নও করে তোলে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, জীবনের প্রতি আমার খুব মায়া। বোদলেয়ার বা র্যাঁবো’র মতো জীবনকে তুচ্ছ করে তুলতে পারি না। সেই মায়াবোধ থেকেই লিখেছিলাম কি না, খেয়াল নেই। ‘অশ্রুপার্বণ’-এ কয়েকটি লাইন আছে:
আয়ুর আকাশে চিরদিন
একটি দীঘল কালো মেঘ
অনন্ত উপেক্ষা নিয়ে জীবনকে পরিহাস করে।
প্রতিটি জন্মদিনে সেই পরিহাস টের পাই। কাজেই এবারের জন্মদিন ভিন্ন হওআর কোনো কারণ তো দেখি না।
কাজী শহীদ: আপনার কবিতার প্রসঙ্গে জানতে চাইবো। তবে তার আগে আপনার কবি হয়ে ওঠা নিয়ে যদি কিছু বলতেন। কবিতাকে সিরিয়াসলি নিলেন কবে থেকে?
কাজী নাসির মামুন: আগে নাটক লিখতাম। স্কুলে আমার লেখা নাটক হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ঢাকার গাইড হাউজ মঞ্চেও ‘অচিনপুরের অগ্নিগাথা’ নামে আমার একটা নাটক মঞ্চত হয়। নিজেও অভিনয় করেছি ওই নাটকে। পরে আর ওই নাট্যদল টিকে থাকেনি। আমিও প্রেমটেমে জড়িয়ে বিয়েশাদি করে ফেললাম। নাটকে স্থিত হতে পারলাম না। কবিতা তো সেই স্কুল জীবন থেকেই লিখতাম। তবে ১৯৯৩ বা ৯৪ সালের দিকে জীবনানন্দ পাঠ করে বুঁদ হয়ে থাকতাম। পড়লাম আল মাহমুদ ও জয় গোস্বামী। শামসুর রাহমান তখন অনেক সরব। এমনিতেই কানে আসে। ফলে কবিতার আবহ আমাকে দারণ তাড়িত করছিল। কিন্তু নাট্যকার হওয়ার বাসনায় ওই দিকে নজর দিতে পারি নাই। কিন্তু ২০০০ বা ২০০১ সালের দিকে রাতুল আহমেদ সম্পাদিত ‘লাস্ট বেঞ্চ’ লিটলম্যাগকে কেন্দ্র করে কবিতার তাড়না আবার জেগে ওঠে। সে-ই এক উত্তাল সময়! সিদ্ধি খাওয়া ও সিদ্ধি অর্জন এক সঙ্গেই চলছিল। হা হা হা। সাঈফ ইবনে রফিক তার ‘কাঁটাতার’-এ আমার ‘পরম্পরা’ কবিতাটা ছাপে। সেই থেকে কবিতায় ঝাপিয়ে পড়লাম। বিয়ের আগে হয়তো প্রেমের স্বার্থে কবিতা লিখেছি। তবে বিয়ের পর সত্যিকার অর্থেই কবিতায় নামলাম। কবিতা আসলে পরিকল্পনার বিষয় না। কল্পনার বিষয়। কবি হওয়াটাও ঠিক তাই।
আর মিলান কুন্ডেরা পড়ে আমার ঘোর ভেঙে যায়। এখন শিল্পের ক্ষেত্রে কোনটা অত্যাচার এবং কোনটা নিরাময়, সেটা পাঠক বিবেচনা করুক।
ও, আরেকটা কথা। ওই সময়টাতে আমি কিন্তু ‘মেইনরোড’ সম্পাদনা করি। কয়েকটা সংখ্যা করেছিলাম মাত্র। ‘মেইনরোড’ ও সাঈফ ইবনে রফিকের সুবাদে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই অগ্রজ কবি আমাকে দারুণ প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই ভালোবাসাও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি আজ। ‘মেইনরোড’-এর সম্পাদকীয় তিনি শামসুর রাহমানকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। তিনিও বেশ পছন্দ করেছিলেন ওই সম্পাদকীয়। পরে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমরা দেখাও করি। ওই স্মৃতি আমার অনেক ভালো লাগে। আমি তো মফস্বলেই পড়ে থাকি। ভালোও লাগে আমার। বড় কবিদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগও তাই কম। সেই দেখা হয় পাঠে। হয়তো এটাই সত্যিকারের দেখা হওয়া। বিভিন্ন কারণে শাহরিয়ার ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা নেই অনেক দিন। আমার ‘আলস্য মোড়ানো হাঁটা’ অনেক কবির সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে দূরে রাখে। পাঠে পাঠে সেই দেখা সেরে নেই।
কাজী শহীদ: আপনার কবিতায় ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের নাম এসেছে। যেমন সত্রাসিয়া, শস্যমালা, নারায়ণখোলা ইত্যাদি। এসব অঞ্চলের গ্রামীণ প্রকৃতি ও মানুষের জীবনছবির পিক্সেলকে আপনি কবিতার দৃশ্যকল্পে এনেছেন। এমন কি হয়েছে যে, এসব জনপদ ভ্রমণের সময় তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যতাড়িত হয়ে কোনও কবিতা লেখা হয়েছে, না কি দৃশ্যের অভিজ্ঞতাগুলো পরে কখনো কবিতায় ইমেজ আকারে এসেছে?
কাজী নাসির মামুন: আমি মনে করি কবিতা লোকাল বিষয়। বিশেষত কবিতার রূপকল্প তথা ইমেজ, উপমা বা দৃশ্যকল্প বিবেচনায় নিলে। কবিতায় যে যাপন উঠে, আসে সেটাও। কিন্তু এসবের ভেতরে চিন্তার যে পরিচর্যা থাকে, তা লোকালিটিকে ছাড়িয়ে যায়। জীবনানন্দের ‘বেতের ফলের মতো ম্লান চোখ’ আমাকে যেভাবে আকর্ষণ করবে, একজন ইউরোপিয়ান সেভাবে তাড়িত বোধ নাও করতে পারেন। কিন্তু ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’—এই বোধ চিরন্তন আবহ তৈরি করে। এখানে লোকালিটি নাই। চিন্তা কটমট করলে কবিতা ভালো লাগে না। চিন্তা হলো মালার ভেতরের সুতার মতো। সমস্ত ফুলগুলোকে ধরে রাখে। ফুলগুলোই হচ্ছে লোকালিটির ইমেজ। সম্ভবত ইমরুল কায়েসের কোনো কবিতায় উটপাখির ডিমের সঙ্গে প্রেমিকার চোখের উপমা দেখেছিলাম। তো সেটা আমার লোকালিটিতে খুব বেশি কমিউনিকেট করে না। কিন্তু কবিতার রূপকল্পের ভেতরে থাকা চিন্তাটাই লোকালিটিকে ছাপিয়ে সর্বজনীন স্তরে উঠে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলছি, দেখো, চর্যাপদের একটা লাইন হলো ‘আপনা মাঁসে হরিণাবৈরী’। অর্থাৎ হরিণের আপন মাংসই তার শত্রু। তো চর্যার অনেক পরে শেক্সপিয়ারের As You Like It-এ একই চিন্তা পাওয়া যায়। শেক্সপিয়ার বলছেন: To some kind of men, their graces serve them but enemies.
তো আমার কবিতার ক্ষেত্রেও আমার যাপন ও যাপনের পরিপার্শ্ব ঘিরে যে লোকালিটি, তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এসেছে। এটা বরং আমার আইডেন্টিটিকে, স্বদেশকে, স্থানিক গুরুত্বকে কবিতায় অর্থবহ করেছে। কিন্তু এসবের ভেতরে গ্লোবাল চিন্তাটা সর্বজনীন করতে চেষ্টা করেছি। তাৎক্ষণিকভাবেই সবসময় লোকালিটির ছাপ স্ফূর্ত করে তুলেছি এমন নয়। কারণ কবিতা তো নির্মাণেরও ব্যাপার। শুধু স্ফূর্ততায় সার্বভৌম নয়। অবচেতনায় এসব দৃশ্যপট যাপনের ভেতর দিয়ে উদযাপনে উঠে এসেছে কবিতায়।
কাজী শহীদ: প্রেমকে আপনি কিভাবে দেখেন? মানুষে মানুষে যে প্রেম। নরনারীর যে প্রেম। এ প্রশ্ন একারণে যে, আপনার কবিতায় প্রেমের যে বিচিত্ররূপ, তা থেকে এটিকে ঠিক নিরূপন করা মুশকিল। কোথাও দ্ব্যর্থতাপূর্ণ, কোথাও অবদমিত, কোথাও ধোঁয়াশাময়। আপনি একবার বলছেন, ‘বাগান সংগুপ্ত রেখে তুমি কেন পাথর ভালোবাসো’, আবার আরেক জায়গায় মেয়েটাকে পাথরের প্রজাপতি হতে বলছেন। এমন কেন? আরেকটি প্রশ্ন একইসঙ্গে করে রাখি, হাইরোগ্লিফিক্স-এ আপনি লিখেছেন, যেমন উদাহরণ আরও অনেক রয়েছে, যে, ‘রতির শাপমূলে তুমিও কি প্যাঁচানো সাপ ফণায় উলঙ্গ থাকো, গোপনে শৃঙ্গার করো এবাদত?/ তোমার কাঁচুলিভরা সোনা মসজিদ, প্যাগোডার গেরুয়া স্তুতি নাভি বরাবর।/ প্লাবিত মন্দিরে বুক ভাসিয়ে ওঠো।’ এই যে নারীর শরীর এনে, বাঁক ও বুক দেখিয়ে, শৃঙ্গারের দৃশ্যে লিবিডোর উত্থানকে উসকে দিয়ে সহসা মসজিদ মন্দির প্যাগোডার এবাদতের হামান দিস্তায় সব গুঁড়িয়ে দিয়ে পাঠকের ভেতর যে বিষম বোধের অস্থিরতা তৈরি করেন, আপনার কি এটাকে অত্যাচার মনে হয় না?
কাজী নাসির মামুন: প্রেম সম্পর্কের মধ্যে কতটা ভূমিকা রাখে এই নিয়ে আমার সংশয় আছে। আমার জ্যাঠা মিয়াকে দেখতাম জ্যাঠি মাকে সপ্তাহে দুই-একবার মার-ধর করতেন। কিন্তু তাদের সংসার টিকে গেছে। হয়তো মার দেওয়া আর মার খাওয়ার মধ্য দিয়ে জীবনের প্রতি একটা মায়া তাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সম্পর্কে প্রেম ছিল না, আমি নিশ্চিত। যা ছিল, তা হলো মায়াময় অভ্যাস। অভ্যাস চূড়ান্ত হলে হয়তো তাকে নেশা বলি। মানুষ সেই অভ্যস্ত নেশায় সিগারেট বা মদ ছাড়তে পারে না। কিন্তু বউ ছেড়ে দেয়। হা হা হা। আমি ভাবি, ওই অভ্যস্ত যাপনের মধ্যে জ্যাঠা আর জ্যাঠির নেশা ধরে গিয়েছিল। জীবনতৃষ্ণা খুব বড় জিনিস। সেই তৃষ্ণা প্রেম কি না, জানি না। অন্য কেউ হয়তো আরও ভালো ব্যাখ্যা দেবে এর।
তবে প্রেম খুবই ইন্ডিভিজুয়াল স্তরে নিয়ে যায়। বিশেষত মানব-মানবীর প্রেম। তাই তার রঙ বিচিত্র। সেই বিচিত্র প্রেমকে কবিতায় ধরতে গিয়েই আমার মধ্যে হয়তো স্ববিরোধ এসেছে। আর স্ববিরোধ জীবনের লক্ষণ। তাই নাগরিক প্রেমের ক্ষেত্রে ‘পাথরের প্রজাপতি’ হওয়ার কথা বললেও অন্য কবিতায় পাথরকে উপেক্ষা করতে বলেছি। দু’টোর পরিপ্রেক্ষিত আলাদা। ‘হাইরোগ্লিফিক্স’ কবিতা অবচেতনার কবিতা। নানা রকম শরীরবৃত্তীয় অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রেম ওখানে এবাদতের স্তরে উন্নীত। একটা ঘোরের মধ্যে ওই কবিতা হয়েছে। প্রেমের অবদমন ওখানে নেই। আছে লিবিডোর অবদমন। এখন কথা হলো—এই যে কবিতায় বিভিন্ন অনুষঙ্গ জমা করে puzzling mood তৈরি করা, এটা পাঠকের জন্য অত্যাচার কি না? ধরো, মার্কেজের উপন্যাস পড়ে আমি ঘোরগ্রস্ত হই। কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলি। আর মিলান কুন্ডেরা পড়ে আমার ঘোর ভেঙে যায়। এখন শিল্পের ক্ষেত্রে কোনটা অত্যাচার এবং কোনটা নিরাময়, সেটা পাঠক বিবেচনা করুক।
কাজী শহীদ: আপনাকে শূন্য দশকের কবি বলা হয়। কালখণ্ডের ভিত্তি মেনে কবিতা ও কবিকে বিচারের এই প্রবণতাকে আপনি সংকীর্ণতা ভাবেন কি না? দশকের আবর্তে যেহেতু নেবো কি নেবো না’র রাজনীতি স্পষ্ট, তাই তিরিশে এবং এর পরে যারাই এসেছেন, সবাইকে আধুনিক হিসেবে মেনে নিলে সমস্যা কী হতো?
কাজী নাসির মামুন: তিরিশের আগে দশক ধারণা ছিলো বলে মনে করি না। দশক ধারণা এসেছে সামষ্টিক প্রবণতাকে ধরার জন্য। এটা আসলে ট্রেন্ড হয়ে গেছে। এককভাবে কোনো কবির নিজস্ব ইমেজ যখন তৈরি হয় না, তখন দশকের মধ্যে ঢুকে সেই কবি পাত্তা পাওয়ার চেষ্টা করেন। সেই অর্থে এটা অবশ্যই সংকীর্ণ ধারণা। এমনও হয় যে-দশকে কবি আবির্ভূত, কবির শ্রেষ্ঠ কাজটি হয়তো পরের দশকে গিয়ে প্রকাশিত হলো। দশক ধারণা তাই খুব একটা কাজের কিছু না। একেক দশকের সংকলনে কত শত কবি স্থান পাচ্ছেন! কিন্তু দশক শেষে হয়তো দুই-একজনকেও সক্রিয় দেখা যায় না। কিন্তু আমি চাই বা না চাই, যুগের ট্রেন্ডের মধ্যে এমনিতেই পড়ে যেতে হয়। আমি নিজে দশক নিয়ে ভাবিত না কিন্তু শূন্য দশকে আমি অন্তর্ভুক্ত। কবিতায় পরে প্রকাশিত হওয়ায় আমাকে বলতে পারো শূন্যের সবচেয়ে বুড়ো কবি। কবিতা শেষ পর্যন্ত কবির একার কাজ। নিজস্বতার চিহ্ন না থাকলে দশক কবিকে বাঁচাতে পারে না। দশক তো ছোট্ট সময়। এক শতকে কয়জন কবিকে মোটা দাগে চেনা যায় বলো তো দেখি?
কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আলাদাভাবে সবাই যেন একটা কবিতাই লিখতেছে। যে-কবি আলাদা রুচির মধ্যে পাঠককে জাগিয়ে তুলবেন, তার ভবিষ্যৎ ভালো।
আবার আধুনিকতার যে-কথা বললে, সেটাও বিতর্কের বিষয়। ইউরোপ আর আমাদের আধুনিকতার পারসপেকটিভ নিশ্চয় ভিন্ন হবে। মধ্য যুগের পর মধুসূদন কি প্রথম আধুনিক নন? আমরা তো রবীন্দ্রপরবর্তী তিরিশি কবিদের আধুনিক বলি। মাঝখানে বাদ পড়েন নজরুল। কিন্তু নজরুলের কবিতার চিন্তার জায়গাটা শুধু অসাম্প্রদায়িকই নয়, অনেক আধুনিক। কিন্তু তাকে আধুনিক হিসেবে নিতে গেলে আমরা ঔপনিবেশিক চাপ অনুভব করি। আমাদের কৌলিন্যে আঘাত লাগে। বাঙালির হীনম্মন্যতা বহুবিধ। এখন তো উত্তরাধুনিকতার প্রশ্ন জড়িত। কে আমাদের উত্তরাধুনিক কবি? এইসব টার্মগুলো ইউরোপশাসিত বলে তাদের পারসপেকটিভে আমাদের এখানে এসবের পরিচর্যা করা বিভ্রান্তিকর।
কাজী শহীদ: বাংলা কবিতার তিরিশ পরবর্তী কোন্ কোন্ কবি আপনাকে বিশেষভাবে টানেন এবং এঁদের কারও দ্বারা আপনার লেখা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে কি না?
কাজী নাসির মামুন: প্রশ্নটা যদি হতো তিরিশ পরবর্তী কোন্ কোন্ কবির প্রতি আপনি মনোযোগী, তাহলে উত্তর দেওয়াটা সুবিধা হতো। কেননা সব কবির সব কবিতা তো আর টানে না। কারও কারও কবিতা না টানলেও আমি যখন গুরুত্বপূর্ণ ভাবি, তখন সেই কবিদের আমি মনোযোগী পাঠক। কাজেই সেই পাঠের তালিকা দীর্ঘ হবে। যেমন জীবদ্দশায় শামসুর রাহমানের অতি জনপ্রিয়তার কারণগুলো তার কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে আবার যাচাই করার চেষ্টা করছি। দেখলাম রাজনীতির বহু বিষয় নিয়ে ডিল করলেও তিনি পলিটিক্যাল ছিলেন না, বরং ক্রিটিক্যাল। কবিতায় এই ক্রিটিক্যাল জায়গাটা এখন নতুনভাবে আসতে পারে। ‘সোনালী কাবিন’-এরপর আল মাহমুদের ট্রেশ অনেক বেশি। তবু ‘ উড়াল কাব্য’র ‘ঈগল থাকবে ইতিহাস থাকবে না’ আমাকে বেশ আলোড়িত করেছে। আর কোন্ গ্রন্থে যেন তার সনেট ‘পঞ্চক পড়েছি’ ভালো লেগেছে। এক সময় শহীদ কাদরী গোগ্রাসে গিলেছি। তার ওপর লিখেছিও। এখন তার দিকে অত মনোযোগ দিতে পারছি না। মান্নান সৈয়দের ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ কয়েকদিন আগে আবার পড়লাম। পরাবাস্তবতার রূঢ় সৌন্দর্য আছে এই গ্রন্থের কবিতাগুলোয়। সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’ শুধু পড়েছি। নিস্তরঙ্গ নাগরিক ঋষির মতো তার অনুভব। ফরাসি ফ্লেভার দেওয়া। আবুল হাসানের মনন ও হৃদয় উভয়টাই জাত কবির লক্ষণাক্রান্ত। সময় পেলে আরও ভালো করতেন। কামাল চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, ফরিদ কবিরের ওপর আমি লিখেছি। লিখেছি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান ও খোন্দকার আশরাফ হোসেনের ওপর। মাসুদ খানের ওপর লেখাটা পরে আর ছাপা হয়নি। এখন ধরো নব্বই দশকে আবির্ভূত প্রায় বিশ বাইশ জন কবির ওপর আমার লেখা আছে। যাদের ওপর লিখেছি, তাদের তো মনোযোগ দিয়েই পাঠ করেছি। কিছু কবিতা টেনেছে কিছু কবিতা টানেনি। এখন যে কথাটা বলতে চাই, তাতে দশক ধারণা কিছুটা কাজে লাগবে।
আমি দেখেছি সত্তরের কবিতায় অতি স্ফূর্ততা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাবালুতায় নিঃশেষ হয়েছে। আবার আশির কবিতা ঠিক বিপরীত। অতি শিল্প সচেতনতায় কোনো কোনো কবিতা স্ফূর্ততাহীন বানানো কবিতার মতো। ম্যাকানিক্যাল। কাজেই কবিতায় এই টানাটনির ব্যাপারটা আপেক্ষিক লাগে আমার কাছে। পশ্চিমবঙ্গের রণজিৎ দাশকে আগে ভাল্লাগতো, এখন পড়ি না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাই। এখন আর টানে না। শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’ বইটির চেয়েও আমাকে টেনেছে ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’। উৎপলের স্বাদ নিতে আমার সময় লেগেছে। পান-সুপারি চিবাতে থাকলে প্রথম যেমন কষ্টে কষ্টে একটা ভাব হয়। পরে চুন খেলে আস্তে আস্তে জমে ওঠে পানের মজাটা, উৎপলের কবিতা আমার কাছে সেরকম। আরও বহুদিন তাকে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। ভাস্কর চক্রবর্তীর কিছু কবিতা ভালো লাগলেও আমাকে তেমন টানেনি। স্বদেশ সেনও না। জয় গোস্বামীর কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকের স্পেস বড়। বিচিত্র প্রসঙ্গ আছে। আমি এখনো তাকে মনোযোগ দিয়ে পড়ি। এখন পড়ছি মণীদ্রগুপ্ত। জহরসেন মজুমদারের ‘বৃষ্টি ও আগুনের মিউজিক রুম’ চিত্রকল্পের চমৎকারিত্বে ভরপুর। কিন্তু এত বেশি তিনি বলেন যে, চমৎকারিত্বও খেই হারিয়ে ফেলে। প্রভাত চৌধুরী উত্তরাধুনিক ঘরানায় আরও সংহত। শ্রীজাত উইট ভালোই খেলেন। তবে কাঠখোট্টা টাইপের কবিতা। প্রাণের চেয়ে মস্তিষ্ক বেশি বলে মনে হয়। তবু তাকে আমি আবার পড়বো ভাবছি। একজনের কথা এখনো বলিনি। তিনি বিনয় মজুমদার। তার ‘ফিরে এসো চাকা’র পর ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ বিস্ময়কর আনন্দ দিয়েছে আমাকে। তাকে পড়ি এবং পড়বো। প্রত্যেক কবিই হয়তো এভাবে তালিকা দিতে পারবেন। কোন্ কবি কিভাবে টানলেন বা টানলেন না, সেটা বললাম। সামগ্রিকভাবে সব কবির পাঠ আমার মন ও মননে প্রভাব ফেলে। কিন্তু মোটা দাগে আমি কোনো কবির দ্বারা প্রভাবিত, এমন কথা কেউ বলেনি। তবে বন্ধু মাদল হাসান বলেছে একবার। সে বলেছে আমার কবিতায় এলিয়টের প্রভাব আছে। কিন্তু এলিয়ট যে ইন্টেলেকচুয়াল ঐতিহ্যের কথা বলেছেন, আমি তো সেটার সঙ্গে একমত নই। তিনি বলেছেন ঐতিহ্যের অর্জন শ্রমসাধ্য। আমি মনে করি, একজন বিদেশি এসে যদি আমাদের ঐতিহ্য অর্জনে ব্রতী হন, তবে সেটা শ্রমসাধ্য। কিন্তু নেটিভের জন্য ঐতিহ্য অর্জনে প্রয়োজন মরমি দৃষ্টিপাত। ‘মিস্টিক’ অর্থে ‘মরমি’ না। ‘মর্ম থেকে আসা’ এই অর্থে। ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যের প্রথম কবিতাটা ‘পরম্পরা’। শুরু হয়েছে এভাবে:
এখানে মরণ অস্থির গায়ে দনকলসের পাতা
বাকল খুলেছে মহাকাল ঋষি, ভেষজের নীল ছাতা
মাটির ডেরায় ডিমের আদল, ঘুমাও পরম গুরু
তোমাকে ফোটাই দাদাজান পাখি, এখানে তাবৎ শুরু।
এলিয়টের কোনো কবিতায় মরমের এই নৈকট্য নাই। মাদল হয়তো ফর্মের দিক বিবেচনায় বলে থাকবে। তবে এলিয়ট আমার প্রিয় কবি।
কাজী শহীদ: আপনি একবার বলেছিলেন কবিকে নিরন্তর প্রচেষ্টায় যেমন হয়ে উঠতে হয়, পাঠকেরও তেমনি হয়ে ওঠার দায় আছে। পাঠককুল নির্দিষ্ট কবির সৃষ্টি অনুধাবনের উপযোগী হয়ে উঠবেন, না কি কবি বৃহত্তর পাঠকের রুচি বুঝে লিখবেন? আপনি কী করেন?
কাজী নাসির মামুন: কথাটা এলিয়টও বলেছেন। সত্যিকারের পাঠক হওয়াটা প্রস্তুতিরই ব্যাপার। জগৎ জটিল হচ্ছে। সেটার প্রভাব পড়ছে কবিতায়। প্রস্তুতি ছাড়া পাঠক সেই জটিলতা ধরবেন কিভাবে? আমি মনে করি কবির কাজ শুধু পাঠকের রুচিকে মান্য করা নয়, রুচির নির্মাণও তার কাজ। জনপ্রিয়তার মোহে অনেক কবি শুধু পাঠকের রুচিকে মান্য করে চলেন। পাঠকের রুচিকে বদলানোর চেষ্টা করেন না। রুচির বদল না করলে নতুন কবিতা কিভাবে সৃষ্টি হবে? এই বদল করানোটা কবির কাজ। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ এরকম সব বড় কবিরাই এটা করেছেন। মধ্যযুগের মতো একই কবিতা সবাই লেখেননি। বিচ্ছিন্নভাবে এখনো কিন্তু এক অর্থে এমনই হচ্ছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আলাদাভাবে সবাই যেন একটা কবিতাই লিখতেছে। যে-কবি আলাদা রুচির মধ্যে পাঠককে জাগিয়ে তুলবেন, তার ভবিষ্যৎ ভালো।
কাজী শহীদ: ইংরেজি সাহিত্যের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা আপনার কাব্যসত্তায় কিভাবে প্রভাব ফেলেছে? কিংবা পরবর্তী সময়ে ইংরেজি সাহিত্যকে যেভাবে অভিজ্ঞতায় নিয়েছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাই।
কাজী নাসির মামুন: অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার বাইরে ইংরেজি কবিতা আমি বেশি পড়িনি। আর অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার তাগিদ অন্য বিষয়। এটা অনেক ক্ষেত্রে নিজের কবিতার ক্ষতি করে। ফলে আমার গড়ে ওঠার পেছনে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সরাসরি প্রভাব নেই। এলিয়টের আগে আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি জন ডান। আর এলিয়টের পর অডেনও আমাকে খুব টানে নাই। রোমান্টিকদের মধ্যে কিটস তো অসাধারণ। শেলির দুই একটা কবিতা ভালো লাগতো। পোপের যুগে বেশি ভালো লেগেছে ‘গালিভার’স ট্র্যাভেলস’। স্যাটায়ার কত চমৎকার হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চসারের ‘ক্যান্টারবারি টেলস’-এর প্রোলগটা সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক স্যাটায়ারের ক্ষেত্রে অনন্য। এটা পড়ে বর্তমান সময়ে বাংলা কবিতাতেও নতুন কিছু করা সম্ভব বলে মনে করি। ইয়েটস আমার প্রিয় কবি। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ ইয়েটস থেকে অনেক ঋণ নিলেও ‘অবসরের গান’-এর মতো কবিতা ইয়েটসে পাবো না। অবসরের গান বিস্মিত করে আমাকে। ইংরেজি কবিতা সেই বিস্ময় আমাকে দেয়নি। আমেরিকান কবিতার মধ্যে আমি রবার্ট ফ্রস্ট অনেক পড়েছি। তাকে আমার ভালো লাগে। আর্থার মিলারের নাটক আর হেমিংওয়ের উপন্যাস খুব ভালো লাগে আমার। শেক্সপিয়ার নিয়ে এই অধম যদি বলতে যাই, বাতুলতা হবে। শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডির নায়কেরা নয়, আমাকে টেনেছে ভিলেনগুলো। ওথেলোকে ছাপিয়ে যায় ইয়াগো। মনে হয় জীবনকে বোঝানোর জন্য ভিলেনগুলো নানাভাবে ওঁৎ পেতে আছে। হিরোদের মধ্যে ওথেলোকেই বেশি ভালোবাসি আমি। কেননা তার আফ্রিকান চরিত্রে প্রাচ্যগন্ধ পাই। ড. জনসন যা-ই বলুন, শেক্সপিয়রের কমেডিগুলো খুব টানে না আমাকে। তবে চরিত্রের উইটি কথাবার্তাগুলো বেশ লাগে।
‘সম্পর্কের তাঁবু’ নামে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। আরেকটা পাণ্ডুলিপির অর্ধেকটা হয়েছে। হয়তো সামনের বইমেলায় দু’টো কাব্যগ্রন্থ আসবে।
তবে একটা বিষয় আমার মনে হয়। ইংরেজি সাহিত্য অনেকটা ট্রেন্ডভিত্তিক। শেক্সপিয়রের সময় নাটক ছাড়া সাহিত্যের অন্য ঘরানা প্রধান হয়ে ওঠেনি। পোপের যুগে স্যাটায়ারের প্রভাব সর্বত্র। রোমান্টিক যুগে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলি, কিটস, বায়রন—এক ঝাঁক মহান কবি। কবিতাই এ সময়ে প্রধান। চার্লস ডিকেন্স রোমান্টিক যুগের, না কি ভিক্টোরিয়ান—খেয়াল করতে পারছি না। তার তিনটি উপন্যাস পড়েছি। জীবনের কাঁচামালে ভরপুর তার উপন্যাস। জীবনগন্ধী বলেই কি না, জানি না, টলস্টয়ের চেয়ে ভালো লাগে। ও আরেকটা কথা, টেড হিউজে মৃত্যুর আগে তার ‘ক্রো’ পড়ে বেশ ভালো লেগেছে।
আমি ছাত্র ভালো ছিলাম না। ইংরেজি সাহিত্যের গভীর পাঠ নাই। অনুধাবনগুলো স্বাভাবিক মাত্রার। ফলে আমার সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিকে এই পাঠের বিশেষ প্রভাব নাই। আমি আপনাতে আপনি বিভোর। নিজের ভাষার সাহিত্যটাই মজা লাগে আমার।
কাজী শহীদ: বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ নিশ্চয়ই জরুরি। এই নিয়ে কেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে করেন?
কাজী নাসির মামুন: কোথায়? তেমন কোনো কাজ তো দূরের কথা শুধু পরিকল্পনার কথা শুনে আসছি বহু বছর। আমাদের জায়ান্ট পোয়েটদের পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিতে অনুবাদ, বিশেষত ইংরেজি অনুবাদের বিকল্প নাই। কিন্তু সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। অনেক টাকা ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার আছে। ব্যক্তি উদ্যোগে যে-অনুবাদ হয়, সেটা টুটকা ফাটকা। কাজের না। শুনলাম বাংলা অ্যাকাডেমি ‘বিষাদসিন্ধু’র খুব ভালো অনুবাদ করিয়েছে। কিন্তু বিশ্বে সেটা কতদূর পৌঁছালো? মার্কেটিং পলেসি ছাড়া এসব পৌঁছায় না। অনুবাদ ঘরে বসিয়ে রাখলে লাভ নেই।
অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা বিষয় তোমাকে বলি। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের প্রথম অনুবাদ বের হয় ১৯২৬ সালে। রাজেন্দ্রনাথ সেন সেটা অনুবাদ করেন। সেটা কিন্তু বেনারস থেকে প্রকাশিত হয়। বাঙালি পাঠকের কাছেই খুব একটা পৌঁছয়নি। বিশ্বে পৌঁছার কথা আর কী বলবো? এর ষাট বছর পর ১৯৮৬ সালে শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায় এটির অনুবাদ করেন। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও বাঙালি সমাজে এ নিয়ে কোনো সাড়া পড়েনি। কাজেই বিশ্বে পৌঁছার কথা বাদ দাও। ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের তৃতীয় অনুবাদ করেন ক্লিন্টন বি সিলি। ২০০৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে এটি প্রকাশ করেন তিনি। এই প্রথম এটি বৃহৎ পরিসরে বিদেশি পাঠকের কাছে পৌঁছার সুযোগ পায়। বাঙালি পাঠক তো বাংলা টেক্সটও ঠিক মতো জানে না। ইংরেজি অনুবাদের কথা আর কতটা তাদের কাছে পৌঁছবে? সম্প্রতি উইলিয়াম রাদিচি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের চতুর্থ অনুবাদটি করেছেন। গোলাম মুরশিদের লেখায় ব্যাপারগুলো জানলাম। তো মাইকেলকে বিশ্বে পৌঁছে দিচ্ছেন দু’জন বিদেশি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমরা ওদের সাহিত্য পড়ি। ওরা আমাদের সাহিত্য পড়ে না। অনুবাদের অভাব একটা কারণ। আরেকটা কারণ শ্রমসাধ্য ভালো অনুবাদের অভাব। মার্কেটিং পলিসি না থাকাও কারণ। সাহিত্যের প্রতি সেই টান বা devotion না থাকলে অনুবাদে ব্যক্তিগতভাবে কেউ উদ্যোগ নেবে? এজন্য সরকারি উদ্যোগ থাকা দরকার। মুরাকামি বই লেখার সঙ্গে সঙ্গে তিরিশ চল্লিশটা ভাষায় অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সেই বাজার কোথায়? আরেকটা কথা বাহুল্য বলি, এখানে অগ্রজ কবিরা নিজেরা কোনো অনুজ কবিদের নিয়ে দুই কথা লেখেন না। বলেনও না খুব একটা। শুধু তাদের ওপর কেউ লেখুক এটা চান। কাজেই নিজ উদ্যোগে কেউ অন্যের বই অনুবাদ করবে, সেই স্বার্থহীন পরিস্থিতি এদেশে নাই। জুয়েল মাজহারকে দেখি অন্যের কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে পোস্ট দেন। এটা ভালো। কিন্তু প্রকল্পিত উদ্যোগ ছাড়া আমাদের অনুবাদ বৈশ্বিক হয়ে উঠবে না।
কাজী শহীদ: কবিতার আবৃত্তি কবিতাকে ম্লান করে বা বলে মনে করেন?
কাজী নাসির মামুন: এ বিষয়ে ভাবিনি। আমার মনে হয় ম্লান করে না। বরং জনসমক্ষে আনে। তবে মহৎ কবিতার জন্য আবৃত্তির কিছু করার নেই। বেশিরভাগ শিল্পনন্দিত কবিতাই আবৃত্তিযোগ্য নয়। আবার অনেক বাজে কবিতাও আবৃত্তির জন্য খুব উপযোগী। আবৃত্তি শিল্পীরা সেই উপযোগটাই বেশি চান। কাজেই আবৃত্তি কবিতাকেন্দ্রিক হলেও ভিন্ন একটি বিনোদনময় শিল্প ধারা। কবিতার সঙ্গে তার সম্পর্ক সৎ ভাই বোনের মতো। তুলনাটা ঠিক হলো কি না, বুঝতেছি না।
কাজী শহীদ: অনুজ কবিদের কাছে প্রত্যাশা কী?
কাজী নাসির মামুন: অনুজ কবিরা আমার প্রত্যাশার ধার ধারবেন কেন? তারা নিজেদের প্রত্যাশা নিজেরা তৈরি করবেন। তবে সৃষ্টি তো সেটাই মহৎ যেটা পড়লে মনে হয়, হ্যাঁ, এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। সৃষ্টি নিজেই প্রত্যাশা হয়ে পাঠককে জাগিয়ে তোলে। বলে, দেখো, আমি এসেছি।
কাজী শহীদ: এখন কী পড়ছেন, লিখছেন?
কাজী নাসির মামুন: বাংলা উপন্যাসের একটা সিলেবাস তৈরি করেছি। বঙ্কিম থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত। যেগুলো পড়িনি, আস্তে আস্তে পড়ে ফেলবো। শুরু করেছি ‘বিষাদ-সিন্ধু’ ও এলিফ শাফাকের ‘দ্য ফোরটি রুলস অব লাভ’। ‘সম্পর্কের তাঁবু’ নামে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। আরেকটা পাণ্ডুলিপির অর্ধেকটা হয়েছে। হয়তো সামনের বইমেলায় দু’টো কাব্যগ্রন্থ আসবে।