তৃতীয় পর্বের পর:
হল: ১৯৩২ সালে আপনি কাব্যনাট্যের যে স্তর-তত্ত্ব (প্লট, চরিত্র, রচনাশৈলী, ছন্দ-তাল-লয়, উদ্দেশ্য) দিয়েছিলেন সেটা কি এখনো সমর্থন করেন?
এলিয়ট: কাব্যনাট্য সম্পর্কে আমার তত্ত্বের ব্যাপারে আমার আর তেমন কোনো আগ্রহ নেই, বিশেষ করে ১৯৩৪ সালের আগের তত্ত্বগুলোর ক্ষেত্রে। থিয়েটারের জন্যে লেখায় বেশি-বেশি সময় দেওয়ার পর থেকে আমি তত্ত্ব নিয়ে খুব কম ভেবেছি।
হল: কবিতা রচনা আর নাটক লেখার মধ্যে পার্থক্য কী?
এলিয়ট: আমার মনে হয় দৃষ্টিভঙ্গিটা পৃথক। দর্শকের জন্যে নাটক লেখা আর কবিতা রচনার মধ্যে পৃথিবীর সব পার্থক্যগুলোই বিদ্যমান, আপনি কবিতা লেখেন প্রথমত আপনার নিজের জন্যে— যদিও কবিতাটা পরে অন্য লোকদের কাছে অর্থ বহন না করলে আপনি অবশ্যই সন্তুষ্ট হবেন না। একটা কবিতা নিয়ে আপনি বলতে পারেন, ‘আমি আমার অনুভূতিকে আমার জন্যে শব্দে ধারণ করতে পেরেছি। আমি যা ভেবেছি শব্দে আমি সেটাকে ঠিক সেভাবেই পেয়েছি।’ তাছাড়া কবিতায় আপনি নিজস্ব স্বর সৃষ্টি করার জন্যে লিখছেন, যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি আপনার নিজের স্বরের আলোকে চিন্তা করছেন, আর নাটকে শুরু থেকেই আপনাকে উপলব্ধি করতে হয় যে আপনি এমন একটা জিনিস তৈরি করছেন যেটা অন্য লোকদের হাতে গিয়ে পড়বে যাদের আপনি সে সময় চেনেনও না। অবশ্য আমি একথা বলব না যে নাটকে এমন কোনো মুহূর্ত আসে না যখন দু’টো দৃষ্টিভঙ্গি মিলে না যায়, সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারলে সেটা হওয়া উচিত। শেক্সপিয়ারে প্রায়ই এটা ঘটে, যখন তিনি কবিতা লেখেন আর চিন্তা করেন থিয়েটার, অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং একই সঙ্গে দর্শকের প্রেক্ষাপটে। দু’টো জিনিস তখন এক হয়ে যায়। সেটা অর্জন করা কতই না চমৎকার ব্যাপার! আমার ক্ষেত্রে এটা হয় কেবল হঠাৎ হঠাৎ।
হল: অভিনেতা-অভিনেত্রী আপনার কবিতা উচ্চারণের সময় আপনি কি তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন? যেন এটা কবিতার মতোই শোনায় সেটা নিশ্চিত করতে?
এলিয়ট: আমি এটা ছেড়ে দেই প্রথমত প্রযোজকের হাতে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এমন একজন প্রযোজক পাওয়া যার কাব্যানুভূতি আছে এবং যে তাদেরকে নির্দেশনা দিতে পারবে কবিতার ভাব আনার জন্যে কিভাবে উচ্চারণ করতে হবে, গদ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্যে কতটুকু দূরে যেতে হবে কিংবা কতটুকু এগোতে হবে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই কেবল আমি নির্দেশনা দেই। তাছাড়া, আমি মনে করি, তাদের পরামর্শ পাওয়া উচিত প্রযোজকের মাধ্যমেই। প্রথমে তার সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তারপর সেটা তার দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
হল: আপনি কি মনে করেন যে আপনার কাজে, এমনকি আপনার কবিতায়ও, ছোট থেকে বড় শ্রোতাদের কাছে যাওয়ার একটা সাধারণ প্রবণতা রয়েছে?
এলিয়ট: আমি মনে করি এর মধ্যে দু’টো উপাদান রয়েছে। একটা হচ্ছে এই যে, আমি মনে করি নাটক লেখা—তার মানে মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রাল এবং দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন— ফোর কোয়ার্টেটস লেখা থেকে ভিন্ন জিনিস। এতে ভাষার অনেকখানি সরলীকরণ হয় এবং কথা বলা হয় পাঠকের সঙ্গে কথোপকথনের ভঙিতে। আমি দেখি দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড এবং ‘অ্যাশ ওয়েড্নেস্ডে’-এর চেয়ে পররর্তী কালের কোয়ার্টেটস বোঝা অনেক বেশি সহজ। কখনোকখনোযে-কথা আমি বলতে চাই, মূল কথ্যবস্তু, তা কঠিন হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় সেটা আমি বলছি অপেক্ষাকৃত সরলভাবে। অন্য যে-উপাদানটি এর মধ্যে প্রবেশ করে সেটা হলো, আমি মনে করি, স্রেফ অভিজ্ঞতা এবং পরিপক্কতা। আমার ধারণা, প্রথম দিককার কবিতায় প্রশ্নটা ছিল না-পারার নয়— বরং কিভাবে বলতে হবে সেটা না জেনে বেশি বলার, এবং শব্দ ও ছন্দের মধ্যে এমন কিছু দিতে চাওয়া যা বোধগম্যভাবে দেওয়ার মতো দখল শব্দ ও ছন্দের ওপর তার নেই।
ওই ধরনের দুর্বোধ্যতার উদ্ভব হয় তখন যখন কবি, তদবধি, ভাষার ব্যবহার শেখার পর্যায়ে থাকেন। আপনাকে কঠিনভাবে বলতে হয়। এর একমাত্র বিকল্প হলো ওই পর্যায়ে সেটা আদৌ না বলা। দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর স্টাইলে আমি ফোর কোয়ার্টেটস লিখতে পারিনি। আমি যা বলছি তা আমি বুঝলাম কিনা এ নিয়ে দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর ক্ষেত্রে আমার কোনো উদ্বেগ ছিল না। এগুলো অবশ্য সময়ের ব্যবধানে লোকের কাছে সহজ হয়ে উঠেছে। আপনি দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড বা ইউলিসিস-এর সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।
হল: আপনি কি মনে করেন ফোর কোয়ার্টেটস আপনার সর্বোত্তম রচনা?
এলিয়ট : হ্যাঁ, আমি এটা ভাবতে পছন্দ করি যে এগুলো অপেক্ষাকৃত ভালো। দ্বিতীয়টা প্রথমটার চেয়ে ভালো, তৃতীয়টা দ্বিতীয়টার চেয়ে, এবং চতুর্থটা সবচেয়ে উত্তম। যাই হোক, এ ভাবে আমি নিজে নিজের প্রশংসা করি।
হল: একটা খুবই সাধারণ প্রশ্ন, তবু আমি জানতে চাচ্ছি, একজন তরুণ কবির শৈল্পিক বিকাশের জন্যে কী রকম শৃঙ্খলা ও আচরণের অনুসরণ করা উচিত, আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
এলিয়ট: আমি মনে করি সাধারণভাবে পরামর্শ দেওয়া বিশ্রী রকম বিপজ্জনক। সবচেয়ে ভালো হয় যদি একজন তরুণ কবি বিশেষভাবে তার কবিতার বিস্তৃত সমালোচনা করতে পারে। দরকার হলে তার সঙ্গে যুক্তি-তর্ক করুন; তাকে আপনার অভিমত জানান, আর যদি কোনো সাধারণীকরণ করতেই হয় তাহলে তাকেই করতে দিন। আমি দেখেছি ভিন্ন ভিন্ন লোকের কাজ করার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্নভাবে সেগুলো আসে। আপনি নিশ্চিত হতে পারেন না কখন আপনার মন্তব্য সাধারণভাবে সব কবির জন্য যুক্তিসিদ্ধ হবে বা কখন কেবল আপনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। নিজের মতো করে সবাইকে দেখার চেষ্টার চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই।
হল: এখন সব ভালো কবি, যারা আপনার চেয়ে তরুণতর, মনে হয় তারা সব শিক্ষক, এই বাস্তবতার আলোকে কোনো সম্ভাব্য সাধারণীকরণ করা যায় কি, আপনি কী মনে করেন?
এলিয়ট: আমি জানি না। আমি মনে করি কোনো মূল্যবোধ সম্পর্কে যে-একটি মাত্র সাধারণীকরণ করা যায় তা হলো, পরে সেটা একটা প্রজন্ম তৈরি করে। এখানে এসে আপনি বলতে পারেন যে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জীবিকার ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাবনা বা সীমাবদ্ধতা তৈরী হয়। অবশ্যই একজন কবিকে তার কবিতা ছাড়াও জীবিকার অন্য পথ সন্ধান করতে হয়। মোটের ওপর, শিল্পীরা শিক্ষার ব্যাপারে অনেক কিছু করে, সঙ্গীতজ্ঞরাও।
হল: আপনি কি মনে করেন একজন কবির সবচেয়ে অনুকূল বৃত্তি হওয়া উচিত কেবল লেখা আর পড়া, অন্য কোনো কাজ নয়?
এলিয়ট : না, আমার মনে হয় সেটা হবে…কেউ একজন কেবল তার নিজের সম্পর্কেই কথা বলবে। সবার জন্যে একটা অনুকূল পেশার ব্যবস্থা করা খুবই বিপজ্জনক ব্যাপার হবে; আমি নিশ্চিতভাবে অনুভব করি যে, আমি যদি স্বাধীন উপায় নিয়ে শুরু করতাম, যদি আমাকে আমার জীবিকা অর্জন নিয়ে চিন্তা না করতে হতো, এবং আমার সমস্ত সময় যদি কবিতার জন্যে দিতে পারতাম, তাহলে আমার ওপর তার প্রভাব হয়ে পড়ত নিষ্প্রাণ।
হল: কেন?
এলিয়ট: আমার তো মনে হয় অন্য সব কর্মকাণ্ড করতে পারা আমার ক্ষেত্রে খুব কাজেই লেগেছে, যেমন ব্যাংকে, বা এমনকি প্রকাশনায় কাজ করা। আমি এ-ও মনে করি যে, যতটা সময় আমার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি ততটা না থাকার কারণে আমি অধিকতর মনোযোগ দিতে পারি। আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে এটা আমাকে খুব বেশি-বেশি লেখা থেকে নিবৃত্ত রেখেছে। বিপদ হলো, করার মতো কিছু না থাকলে অল্প কিছুর ওপর অধিক মনোযোগ ও তার শুদ্ধির কাজের চেয়ে সে হয়তো খুব বেশি-বেশি লিখবে। সেটা আমার জন্যে বিপদস্বরূপ।
হল : ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় তরুণরা আজকাল যেসব কবিতা লিখছে তার সঙ্গে আপনি কি সচেতনভাবে যোগাযোগ রাখেন?
এলিয়ট: এখন না, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে না। এক সময় করতাম যখন আমি ছোট ছোট গ্রন্থালোচনা পড়তাম এবং একজন প্রকাশক হিসেবে নতুন নতুন প্রতিভা খুঁজতাম। তবে কেউ যখন বুড়ো হয়, তখন সে তরুণদের মধ্যে থেকে নতুন প্রতিভা শনাক্ত করার ক্ষমতার ব্যাপারে নিজের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারে না। আপনি সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকেন যে আপনি বোধ হয় আপনার পূর্বতনদের মতো চলছেন। ফেবার এন্ড ফেবার-এ এখন আমার একজন তরুণ সহকর্মী আছে, সে পাণ্ডুলিপিগুলো পড়ে। তবে এমনকি তারও আগে, আমি যখন হঠাৎ নতুন কিছু দেখতাম এবং মনে করতাম সেটা প্রকৃতপক্ষেই মূল্যবান, তখনও আমি সেটা তরুণ বন্ধুদের দেখাতাম যাদের সমালোচনা-বিচারবোধের ওপর আমার আস্থা আছে, তাদের অভিমত নিতাম। তবে এ বিপদ সব সময়ই থেকে যায় যে গুণ হয়তো নজরে পড়ল না। সেজন্যে আমি বরং প্রথমে তরুণ লোকদেরই দেখতে দেই। যদি তাদের পছন্দ হয় তাহলে তারা সেটা আমাকে দেখাবে, এবং দেখবে সেটা আমারও পছন্দ হয় কিনা। যদি আপনি এমন কিছু পান যেটা তরুণ এবং প্রবীণ উভয়েরই রুচি ও বিচারকে আকর্ষণ করছে, তাহলে সেটা নিশ্চয়ই কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ। কখনো কখনো খুব প্রতিবন্ধকতা আসে। আমি ভাবতে পছন্দ করি না যে আমি বাধা দিচ্ছি, যেমন লোকেরা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করত আমার কাজের ব্যাপারে, নতুন অবস্থায়, তারা ভাবত যে এটা কোনো না কোনো ধরনের ফাঁকি।
হল: আপনি কি মনে করেন তরুণ কবিরা, সাধারণভাবে, এই শতাব্দীর প্রথম দিককার কবিতার নিরীক্ষাপ্রবণতাকে বর্জন করেছে? আপনাকে যেভাবে বাধা দেওয়া হয়েছিল সেভাবে এখন কিছু কবিকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলে মনে হয়, তবে হার্বার্ট রিডের মতো প্রবীণ সমালোচকদের বিশ্বাস যে, আপনার পরে, কবিতা পুরনো ধরনে ফিরে গেছে। যখন আপনি দ্বিতীয় বারের মতো মিল্টন সম্পর্কে কথা বলবেন, তখন আপনি কবিতার ধর্মকে বর্ণনা করবেন ভাষার ক্ষেত্রে একই সঙ্গে পরিবর্তনের প্রতিবন্ধক এবং পরিবর্তনের সংঘটক হিসেবে।
এলিয়ট: হ্যাঁ, আমি মনে করি না আপনি প্রত্যেক দশ বছরে বিপ্লব প্রত্যাশা করেন।
হল: এ রকম চিন্তা করা সম্ভব কিনা যে, নতুন নতুন সম্ভাবনা আবিষ্কারের পরিবর্তে বরং প্রতিবিপ্লব হয়েছে?
এলিয়ট: না, আমি প্রতিবিপ্লবের মতো কিছু দেখি না। ঐতিহ্যিক আঙ্গিক থেকে সরে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার আগ্রহের কাল আসে। এতে ভালো কিছু উৎপন্ন হতে পারে যদি মাঝখানে যা ঘটেছে তা তার থেকে পৃথক কিছু হয়: যখন এটা নিছকই পশ্চাদ্পসরণ নয়, বরং পুরনো আঙ্গিককে নতুন করে নিয়ে আসা, যেটা বহু কাল যাবৎ অব্যবহৃত হয়ে রয়েছে; এবং এটার সঙ্গে মিলিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা। এটা প্রতিবিপ্লব নয়। কিংবা একে পশ্চাদ্গমন বলাও চলে না। কোনো কোনো মহলের ভেতর জর্জিয়ান দৃশ্য এবং আবেগে প্রত্যাবর্তন করার প্রবণতা দেখা যায়; আর সাধারণ্যে এমন লোক সব সময়ই থাকে যারা মধ্যপন্থা পছন্দ করে, এটা পেলে তারা বলে, ‘কী প্রশান্তি! আবার কিছু সত্যিকারের কবিতা পাওয়া গেছে।’ আবার এমন লোকও আছে যারা চায় কবিতা আধুনিক হোক, কিন্তু তাদের কাছেও সত্যিকার সৃজনশীল জিনিস বেশ কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়— তাদের প্রয়োজন কিছুটা তরল জিনিস। তরুণ কবিদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ভাল যা লক্ষ্য করেছি তা মনে হয় প্রতিক্রিয়া নয় আদৌ। আমি কারো নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না, কারণ আমি তরুণ কবিদের সম্পর্কে খোলামেলা মন্তব্য করা পছন্দ করি না। শতাব্দীর প্রথম বছরগুলোর চেয়ে কম-বিপ্লবী চরিত্রের আরো উন্নয়ন ঘটছে সেটাই ভালো ব্যাপার।
হল: আমার কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন রয়েছে যা দিয়ে আমি ইতি টানতে চাই। ১৯৪৫ সালে আপনি লিখেছিলেন, ‘একজন কবি অবশ্যই তার নিজ ভাষাকে সেইভাবে নেবেন যেভাবে তা সত্যিকার অর্থে তার চারপাশে উচ্চারিত হয়।’ তারপর আপনি লিখেছেন, ‘কবিতার সঙ্গীত তখন এমন একটা সঙ্গীত হবে যা সুপ্ত রয়েছে তার কালের সাধারণ মানুষের ভাষার মধ্যে।’ দ্বিতীয় মন্তব্যের পর আপনি ‘প্রমিত বিবিসি ইংলিশ’-এর নিন্দা করেছিলেন। এখন, গত পঞ্চাশ বছরের পরিবর্তন, এবং সম্ভবত গত পাঁচ বছরের আরও বেশি পরিবর্তনের ফলে, যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর মধ্য দিয়ে কি বাণিজ্যিক ভাষার প্রাধান্য বাড়ছে না? যাকে আপনি ‘বিবিসি ইংলিশ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন সেটা কি আইটিএ এবং বিবিসি টেলিভিশনের মাধ্যমে আরও প্রচণ্ড রকম বেশি শক্তিশালী হয়নি? সিবিএস, এনবিসি, এবং এবিসি-র কথা না হয় না-ই বললাম। এই পরিস্থিতি কি সাধারণ মানুষের ভাষার সঙ্গে কবির সম্পর্কের সমস্যাটিকে আরও কঠিন করে দিয়েছে?
এলিয়ট: আপনি এখানে একটা খুব ভালো প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। আমার মনে হয় আপনি ঠিক বলেছেন, এটা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
হল: আমি চাচ্ছি আপনি এই বিষয় সম্পর্কে বলবেন।
এলিয়ট: হ্যাঁ, কিন্তু আপনি চাচ্ছেন বিষয়টা ব্যাখ্যা করা হোক। সুতরাং আমি এর দায়িত্ব নিচ্ছি: আমি অবশ্যই মনে করি যে, যেখানে যোগাযোগের এবং একটা ছোট্ট জনগোষ্ঠীর ভাষা ও বাকরীতিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার উপায়-উপকরণ মজুদ, সেখানে সমস্যাটা খুব বেশি জটিল। আমি জানি না সেটা ফিল্মের ভাষার ক্ষেত্রে কতটা হচ্ছে, কিন্তু রেডিওর ভূমিকা অবশ্যই অনেক বেশি।
হল: সাধারণের ভাষা বলতে আপনি যা বোঝাচ্ছেন সেটার কি লুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে?
এলিয়ট: ভবিষ্যত বড় অন্ধকার। খুব সত্যি।
হল: আমাদের সময়ে একজন লেখকের সামনে আর কোনো সমস্যা আছে কি যা অনন্য সাধারণ? মানবিক ধ্বংসের আশঙ্কার কোনো বিশেষ প্রভাব কি কবির ওপর পড়ে?
এলিয়ট : আমি জানি না মানবিক ধ্বংসের আশঙ্কা কবিকে কেন অন্য পেশার মানুষের চেয়ে আলাদাভাবে প্রভাবিত করবে। এটা তাকে মানুষ হিসেবেই প্রভাবিত করবে, সন্দেহ নেই তার মাত্রা নির্ভর করবে তার সংবেদনশীলতার অনুপাতের ওপর।
হল: আরেকটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন: আমি বুঝতে পারি কেন একজন মানুষের সমালোচনা একজন কবির সৃষ্টিশীল থাকার পক্ষে ভাল, যদিও তার নিজের পূর্ব-ধারণার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু আপনি কি মনে করেন সমালোচনা লেখার কাজটা কবি হিসেবে আপনাকে সাহায্য করেছে?
এলিয়ট : কবি হিসেবে পরোক্ষভাবে এটা আমাকে কিছু সাহায্য করেছে—যারা আমাকে প্রভাবিত করেছেন এবং যাদের আমি ভক্তি করি সেসব কবিদের সম্পর্কে আমার সমালোচনামূলক মূল্যায়নকে লিখিত আকারে ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। এটা স্রেফ একটা প্রভাব সম্পর্কে আরো সচেতন ও সুস্পষ্ট করা। এটা বরং একটা স্বাভাবিক ঝোঁক। আমি মনে করি সম্ভবত আমার সবচেয়ে ভাল প্রবন্ধগুলো সেইসব কবিদের ওপর লেখা যারা আমাকে প্রভাবিত করেছেন, বলতে হয়, তাদের নিয়ে প্রবন্ধ লেখার চিন্তা করার অনেক আগে থেকেই। সেগুলো, সম্ভবত, আমার সাধারণভাবে করা মন্তব্যের চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান।
হল: জি. এস. ফ্রেজার আপনাদের দু’জনকে নিয়ে লেখা তার এক প্রবন্ধে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছেন আপনি কখনোইয়েটস-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন কিনা। তার সম্পর্কে আপনার কথা থেকে বোঝা যায় যে মনে হয় দেখা করেছেন। আপনি কি আমাদের সেই ঘটনার কথা বলবেন?
এলিয়ট : অবশ্যই আমি ইয়েট্স-এর সঙ্গে অনেক বার দেখা করেছি। কেউ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে ইয়েট্স খুব সহৃদয় আচরণ করতেন, তরুণ লেখকদের সঙ্গে তিনি এমন ভাব করতেন যেন তারা সমপর্যায়ের এবং সমকালীন লেখক। কোনো বিশেষ উপলক্ষের কথা আমি স্মরণ করতে পারছি না।
হল: আমি শুনেছি যে আপনি আপনার কবিতাকে আমেরিকান সাহিত্যের ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করেন। কেন বলবেন আমাদের?
এলিয়ট: আমি বলব যে আমার কবিতা ইংল্যান্ডে আমার প্রজন্মের লেখার চাইতে আমেরিকায় আমার সমকালীন খ্যাতনামাদের লেখার সঙ্গে অবশ্যই অনেক বেশি সমভাবাপন্ন। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
হল: আপনি কি মনে করেন আমেরিকার অতীতের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র রয়েছে?
এলিয়ট: হ্যাঁ, তবে আমি এর চেয়ে বেশি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারছি না, আপনি বুঝতে পারছেন। এটা এমন হতে পারতো না, এবং আমি কল্পনা করি, এতটা ভালো হতে পারতো না; যত সুন্দরভাবেই আমি একে তুলে ধরি না কেন, এটা এমন হতে পারত না যদি আমি এমনকি ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করতাম, আবার আমি যদি আমেরিকায় বসবাস করতাম তাহলেও এরকম হতে পারতো না। আসলে এটা অনেক কিছুর সংমিশ্রণ। কিন্তু উৎসের দিক থেকে, আবেগের উৎসারণের দিক থেকে, এটা এসেছে আমেরিকা থেকে।
হল: শেষ কথা। সতর বছর আগে আপনি বলেছিলেন, ‘কোনো সৎ কবি কখনো পুরোপুরি নিশ্চয়তা অনুভব করতে পারেন না যে, তিনি যা লিখেছেন তা স্থায়ী মূল্যের। হতে পারে যে তিনি তার সময় অপচয় করেছেন এবং জীবনটাকে বৃথা নষ্ট করেছেন।’ এই সত্তর বছর বয়সে এসে আপনি কি সেই একই রকম ভাবেন?
এলিয়ট: এমন সৎ কবি থাকতেও পারেন যারা নিশ্চয়তা বোধ করেন। আমি করি না।
শেষ
কবিতার শিল্পরূপ: টি এস এলিয়ট-৩ ॥ ভূমিকা ও অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ
কবিতার শিল্পরূপ: টি এস এলিয়ট-২ ॥ ভূমিকা ও অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ
কবিতার শিল্পরূপ: টি এস এলিয়ট ॥ ভূমিকা ও অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ