নাহিদা নাহিদ, কবি ও কথাসাহিত্যিক। প্রকাশিত গল্পের বই একটি: ‘অলকার ফুল’। সম্প্রতি ওয়েবম্যাগে সাহিত্যচর্চা নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন এই তরুণ লেখক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
নাহিদা নাহিদ: নতুন পাঠক ও লেখক তৈরিতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাধ্যম দৈনিক। খেলাধূলা, প্রযুক্তি বা বিনোদনপাতার পাঠকরাও পত্রিকা হাতের কাছে পেলে সাহিত্যপাতা উল্টে দেখেন, সে জায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে লিটলম্যাগের পক্ষে পাঠক সমাদৃত হওয়া দুঃসাধ্য, কিছু নতুন পাঠক বা লেখক তৈরি করতে পারলেও লিটলম্যাগের সীমাবদ্ধতা অনেক। লিটলম্যাগ সময়সাপেক্ষ সাহিত্যপ্রয়াস আর বর্তমান দ্রুতগতির পাঠক ঘুরেফিরে পৌঁছাতে চাচ্ছে দৈনিকের মতো তাৎক্ষণিক সহজলভ্য সাহিত্য প্রয়াসে। সেদিক থেকে ভালোমানের ওয়েবজিন পাঠক টানছে, যা পারছে না লিটলম্যাগ। পড়ুক বা না পড়ুক দিনকে দিন দেখতে দেখতেই ভিউয়ার বাড়ছে ওয়েবজিনের। তার এই মাধ্যম সমৃদ্ধির পথে।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
নাহিদা নাহিদ: শুধু অর্থব্যয় প্রধান কারণ বলে মনে হয় না আমার। মনে হয়, ভার্চুয়াল জগতের বলয় ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়ার কারণেই সাহিত্যকর্মীরা সহজ রাস্তায় পাঠকের কাছে কড়া নাড়তে চান। এক্ষেত্রে ওয়েবজিন বেশি সহায়ক।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়া লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাহিদা নাহিদ: ‘লিটলম্যাগ পরিশ্রমসাধ্য ব্যয়নির্ভর সাহিত্যপ্রয়াস, ভালোমানের ওয়েবজিন প্রকাশে অর্থনীতির দিকটি না থাকলেও পরিশ্রমের দিকটি আছে। কোনো কোনো সম্পাদক এই পরিশ্রমকে পাশ কাটিয়ে নামমাত্র সাহিত্যজ্ঞান ও পরিচিতিকে পুঁজি করে পোর্টাল খুলে বসেন আর তারাই ভুলবানানে, সম্পাদনা ছাড়া লেখা ছাপেন। একজন লেখক সম্পদকের কাছে লেখা বুঝিয়ে দেওয়ার পর সম্পাদকেরই দায়িত্ব নির্ভুল বানানে লেখাটিকে উপস্থাপন করা। কিন্তু অনেক ওয়েবজিন একাজটা যত্নের সঙ্গে করে না, দেখেও না।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
নাহিদা নাহিদ: সাহিত্য প্রেম কারও কারও থাকলেও বর্তমানে কর্তৃত্ব বিস্তারের দিকটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। এভাবে আগাতে থাকলে প্রতিটা ফেজবুক আইডির বিপরীতে একটা করে ওয়েবপোর্টাল থাকবে। বুদ্ধিবৃত্তিক সাহিত্যচর্চায় মতের দ্বৈততা থাকতেই পারে। তাই বলে আপন বনে রাজা হয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। জাতীয় দৈনিকের মতো ওয়েবজিনগুলোও প্রতিযোগিতা করুক, মানের মানের দিক থেকে করুক, ব্যক্তির দিক থেকে কেন? প্রমথ চৌধুরীর মতের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেই বলছি, সাহিত্যের মাঠে ব্রাহ্মণ যা, নমঃশুদ্রও তা। এক্ষেত্রে এত এত ওয়েবপোর্টাল এত এত সম্পাদক হলে অন্য লেখকের পরিচর্যা করবে কে?
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
নাহিদা নাহিদ: কিছুটা করছে। তবে পুরোপুরি নয়। ভালোমানের ওয়েবজিনগুলো থেকেই এখন অনেক পাঠক বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম সমন্ধে ধারণা পায়। সমকালীন সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম যাচাই-বাছাই করার সুযোগ ঘটে। এটা একজন পাঠককে নতুন বই কেনার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আমি বলব, ওয়েবজিন বইপাঠে পাঠককে বিমুখ -উন্মুখ দুটোই করে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
নাহিদা নাহিদ: আমি যদি সাহিত্যকর্মে নিজেকে সামান্য কর্মীও ভাবি, তাহলে বলব, আমি দৈনিক, লিটলম্যাগ বা ওয়েবজিন; সর্বত্রই আমার লেখা দেখতে পছন্দ করব। কারণ লেখকমনের তাগিদ থেকে সাহিত্য রচনা করলেও সে সাহিত্য পাঠক সমাদৃত হলে লেখকের আত্মতৃপ্তি ঘটে। তাই মাধ্যম কোনো বিষয় নয়, প্রকাশটাই মূল। আর পাঠক হিসেবে বলব, সব দৈনিকের সাহিত্যপাতা আমার খোলা হয় না, দুই/চারটা নিয়মিত লিটলম্যাগ ছাড়া বাকিগুলো সংগ্রহ করা সময়সাপেক্ষ। সেক্ষেত্রে ভালোমানের ওয়েবজিন হাতের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে সাহিত্য জগতের প্রত্যাশিত নানা প্রসঙ্গ। আমি ওয়েবজিন/ওয়েবব্লগ পছন্দ করি।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
নাহিদা নাহিদ: অবশ্যই ইতিবাচক, যদিও কাগজে ছাপা অক্ষরের আলাদা মাদকতা আছে। এজন্যই লেখকরা বই বের করেন, পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করেন, লিটলম্যাগে লেখা ছাপেন। অন্তর্গত বা বহির্গত নানাবিধ সমস্যায় কখনো কখনো এই ছাপার অক্ষর লেখকের অনুকূলে থাকে না, সেসময় সাহিত্যিকরা ওয়েবজিনের মাধ্যমেই তাদের দৈনন্দিন সাহিত্যপ্রয়াস পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারেন ।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
নাহিদা নাহিদ: আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। মেইল আসাতে চিঠি হারিয়ে গেছে আমাদের সেদিকটাও মনে রাখতে হবে। তবে পত্রিকার কদর একেবারেই কমে গেছে, তা নয়। ঘরে ঘরে টিভি, হাতে হাতে ইন্টারনেট, ফেইজবুক টুইটার, বিভিন্ন অনলাইন সাইট থাকার পরও, সকালে চোখ খুলে পত্রিকার শিরোনাম দেখা মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এজন্যই পর্যায়ক্রমিকভাবে অনলাইন পত্রিকার পাশাপাশি ছাপার অক্ষরের পত্রিকাও বাড়ছে। নানা কারণে কোনোটার হয়তো সার্কুলেশন কমে যায়, কিন্তু সহজে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয় না। আর এই প্রকাশ ধরে রাখার পেছনে সাহিত্যপাতার বিশাল একটা ভূমিকা থাকে।এজন্যই দেখা যায় কিছু পত্রিকার সংবাদের গুরুত্ব কম থাকলেও সাহিত্যপাতার গুরুত্ব অনেক বেশি।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
নাহিদা নাহিদ: একটি আধুনিক ওয়েবম্যাগকে আমি লেখক ও সম্পাদকের যৌথ ভালোবাসার চারণভূমিরূপে দেখতে চাই। আমি কাঠামো বা আঙ্গিকগত সৌষ্ঠবের প্রসঙ্গে বলছি না। কারণ, শিল্পের নান্দনিক বোধ একেকজনের একেকরকম। ওয়েবম্যাগে আমি দেশ-বিদেশের সমৃদ্ধ লেখাগুলো বেশি খুঁজি, তাত্ত্বিক বিতর্ক নয়।
সবশেষে বলতে পারি, এই মাধ্যমটি যদি গোষ্ঠীবদ্ধতার বাইরে দলমত নির্বিশেষে সব ধরনের লেখকদের জন্য শক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারে, তাহলে এখানে এসেই লেখক-পাঠক ডিমান্ডস অনুযায়ী নিজেকে যথাসাধ্য ভাঙবেন এবং গড়বেন। পাঠকও প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ হবেন লেখকের প্রত্যক্ষ ভাব ও শিল্পবোধের ছোঁয়ায়। প্রত্যাশা এটুকুই।