শর্মা লুনা—কবি, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখক। লেখালেখি মূলত ফেসবুক ও ব্যক্তিগত ব্লগে। সম্প্রতি সাহিত্যের অনলাইন পত্রিকা নিয়ে কথা বলেছেন চিন্তাসূত্রের সঙ্গে।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
শর্মা লুনা: ওয়েবম্যাগ একটি ভিন্ন ধারণা। যদিও একে ওয়েবম্যাগ বলা হচ্ছে, তবে বিষয়টি তো আসলে একটি ওয়েবসাইট। এখন পণ্য থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান সবকিছুরই ওয়েবসাইট আছে। সাহিত্যবিষয়ক ওয়েবসাইট বা ওয়েবম্যাগের সঙ্গে লিটলম্যাগ সাংঘর্ষিক বলে আমি মনে করি না। লিটলম্যাগের আবেদন সবসময় ছিল, এখনো আছে। ভবিস্যতেও থাকবে। কাগজের বইয়ের পাঠক যে কারণে হ্রাস পাচ্ছে, একই কারণে হয়তো লিটলম্যাগও পাঠক হারাচ্ছে, তবে আবেদন নয়। আর কারণটি হলো অন্তর্জালে পাঠকের অধিক উপস্থিতি।
চিন্তাসূত্র: আগে লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
শর্মা লুনা: একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর লিটল ম্যাগে বের করতে যে খরচ হয়, একটি ওয়েবম্যাগ ব্যবস্থাপনায় কিন্তু একই বা এর চেয়ে বেশিই খরচ হয় (!)। তবে খরচের ব্যবস্থাপনাটা লিটলম্যাগের চেয়ে ভালো। যেমন ওয়েবম্যাগ চালাতে বছরে ওয়েব হোস্টিংয়ের জন্য একবার ন্যূনতম হাজার দুয়েক টাকা খরচ করলেই চলে। প্রাথমিক প্রযুক্তি জ্ঞান এখন সবারই আছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপনাও সহজ হয়ে গেছে। অনেক ওয়েবম্যাগ ভালো বিজ্ঞাপনও পায়। সবচেয়ে বড় কথা, এটি সারা পৃথিবীর জন্য উন্মুক্ত এবং সর্বদা উন্মুক্ত।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবে সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
শর্মা লুনা: হ্যাঁ, এটা সত্য। অন্তর্জাল সহজপ্রাচ্য হওয়ায় এখন যেকারও পক্ষে সম্পাদকের আসনে বসা সহজ। একজন সম্পাদকের বানান ও ব্যাকরণ জ্ঞান লেখকের চেয়ে ভালো হবে; সেটাই স্বাভাবিক। লিটলম্যাগে প্রায় ভুল কম থাকে। কিন্ত, ওয়েবম্যাগের সম্পাদক যখন একজন লেখক হন, তখন ভুল থাকতে পারে অনেক। এছাড়া বিষয়টি সহজ হওয়ায় লেখক বা সম্পাদক না হয়েও অনেকে সে দায়িত্ব নিচ্ছেন শুধু সাহিত্যের প্রতি অনুরাগের কারণেই। ফলে ভুল হবেই এবং হচ্ছেও। অন্তর্জালে বাংলা লেখার প্রচলন এখনো পেশাদারিত্বের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অথচ ছাপার অক্ষরের পাবলিকেশনগুলোর পেশাদারিত্বের ঐতিহ্য শত বছরের পুরনো।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শত টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনে পয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন; প্রকাশ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
শর্মা লুনা: সাহিত্যপ্রেম প্রাথমিক কারণ। সাহিত্যপ্রেম না থাকলে কেউ সাহিত্য এরেনায় ঢোকে না। তার উদ্দেশ্য কর্তৃত্ব ফলানো হোক কিংবা না হোক। এই ক্ষেত্রে কাউকে জোর করে আসলে ঢোকানো যায় না নিজস্ব ভালো লাগা না থাকলে। কর্তৃত্ব প্রকাশই যাদের মুখ্য উদ্দেশ্য, তারা ঝরে যাবে একদিন। তাই তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সাহিত্য অযোগ্যদের মনে রাখে না। তবে ওয়েবম্যাগ খোলার আরও একটি কারণ এখন আছে। আর তা হলো গুগল অ্যাডসেন্স। যাদের ন্যূনতম সাহিত্য অনুরাগ আছে, তারাই এখন ওয়েবম্যাগ খুলবে। কারণ অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে(!)। তবে সেক্ষেত্রে যারা সাবধানী ও মানসম্পন্ন Content Deliver করতে পারবে এবং বিপুল সংখ্যক পাঠক আকৃষ্ট করতে পারবে, তারাই সফল হবে।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
শর্মা লুনা: মানুষ বইবিমুখ হওয়ার কারণ ভিন্ন। এখন মানুষ অন্তর্জালে অনেক সময় কাটায়। যারা বইয়ের পাঠক, তারাও কাটায়। যে সময়টা হয়তো সে বই পড়ে কাটাতো, সে সময়টা এখন সে অন্তর্জালে কাটায়। সে সময়টা ভাগ করে তার ক্ষুদ্র একটি অংশ ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিনে কাটায়। এতে সামগ্রিকভাবে আসলে ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন দায়ী না। বরং এগুলো না থাকলে সে অন্যকিছুর পেছনে সময় ব্যয় করতো। কিন্তু সময়টা সে অন্তর্জালেই কাটাতো। ফলে ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন না থাকলে সাহিত্য অ্যারেনা থেকে সে বের হয়ে যেতো, বই পড়ার প্রতি তার আগ্রহ আরও কমে যেতো। এগুলো থাকায় সে সাহিত্য বিষয়ক লেখা অন্তর্জালে পাচ্ছে এবং সেগুলো পড়ছে। তাই বই পড়ার প্রতি আগ্রহটাও থাকছে। তাই আমি বলব, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন থাকায় আরও স্মার্ট পাঠক তৈরি হচ্ছে, বইবিমুখ হতে যাওয়া পাঠককে পাঠমুখী করার পেছনে বরং এর ভূমিকা আছে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
শর্মা লুনা: আমি তিনটি ক্ষেত্রেই লিখতে পছন্দ করি। কোনোটাকেই ছোট বা বড় মনে করি না। একজন লেখকের কাছে মানসম্পন্ন যেকোনো প্ল্যাটফরমে লেখা প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের কাছে যেতে পারাই বড় কথা। অন্য কিছু নয়।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
শর্মা লুনা: সাহিত্য প্রচার ও প্রকাশে ওয়েবম্যাগ প্রযুক্তিগতভাবে সময়োপযোগী মাধ্যম। এখন পত্রিকাগুলোরও ওয়েবসাইট আছে এবং তাদের সাহিত্য পাতার যে অনলাইন সংস্করণ, সেখানেও কিন্তু প্রচুর পাঠক আছে। অতএব, পত্রিকাগুলোর পাঠক যে সীমিত সেটা বলা যাবে না। প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে নেই। লিটলম্যাগেরও অনলাইন সংস্করণ থাকতে পারে, পৃথিবীর সব ম্যাগাজিনেরই অনলাইন/পিডিএফ সংস্করণ থাকে এখন। আমাদের দেশে যারা লিটলম্যাগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এবং যারা চালাচ্ছেন, তারা এই বাস্তবতার সঙ্গে যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবেন, তত লাভবান হবেন।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
শর্মা লুনা: না, হারাবে না। পত্রিকায় অনেক বিভাগ থাকে। রাজনীতি, বিনোদন, সাহিত্য, খেলা ইত্যাদি, সব বিষয়ই থাকে। পত্রিকার সাহিত্যপাতার যে লেখা তার ধরন ওয়েবম্যাগের চেয়ে আলাদা। তাই তার একটি স্বতন্ত্র আবেদন আছে পাঠকের কাছে। ওয়েবম্যাগ সেটা প্রভাবিত করে না। তবে পত্রিকার সাহিত্য পাতার পাঠক ওয়েবম্যাগও পড়ে। আবার ওয়েবম্যাগের পাঠক পত্রিকার সাহিত্যপাতা পড়বেই।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
শর্মা লুনা: একটি ওয়েবম্যাগকে দেখতে চাই, সাহিত্যচর্চার একটি দারুন মাধ্যম হিসেবে। সেখানে মানসম্পন্ন লেখা থাকবে, ভালো লেখক সৃষ্টির ক্ষেত্র হবে সেটা। সব ধরনের লেখাই দেখতে চাই সেখানে। মৌলিক বিষয়ের ওপর লেখা যেমন থাকতে হবে, তেমনি জন অনুভূতির প্রতিফলন আছে, এমন লেখাও দেখতে চাই। মানুষের মাঝে ভাবনার খোরাক দিতে পারে, জনমানসে ধাক্কা দিতে পারে; এ রকম লেখা ও লেখক তুলে আনতে পারার উন্মুক্ত চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করতে পারে ওয়েবম্যাগ। এছাড়া ভাষার শব্দ ভাণ্ডার ও সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ করার যে মৌলিক ও অপরিহার্য দায়, সেটাও ওয়েবম্যাগ পরিচালনাকারীদের থাকতে হবে। নতুবা, আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো সরকার বা বাংলা একাডেমিকে বাধ্য হয়ে এখানে নাক গলাতে হবে।