আমিনুল ইসলাম—কবি-প্রাবন্ধিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: তন্ত্র থেকে দূরে (২০০২); মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম (২০০৪); শেষ হেমন্তের জোছনা (২০০৮); কুয়াশার বর্ণমালা (২০০৯); পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি (২০১০); স্বপ্নের হালখাতা (২০১১); প্রেমসমগ্র (২০১১); বিশ্বায়ন বাংলা কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০১০)। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েব নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন খ্যাতিমান এই কবি।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
আমিনুল ইসলাম: ওয়েবম্যাগ একটি নতুন মাধ্যম। সে তার নিজের স্থান করে নিচ্ছে। লিটলম্যাগ গুরুত্ব হারাচ্ছে না, প্রতিদ্বন্দ্বী জুটে যাওয়াই গুরুত্ব বিভাজিত হয়ে পড়ছে। অর্থাৎ লিটলম্যাগ আর একচেটিয়া গুরুত্ব পাচ্ছে না। এখনো লিটলম্যাগ গুরুত্বপূর্ণ। তবে তাকে মানসম্মত হতে হবে, মানসম্মত লেখা প্রকাশ করতে হবে। যাচ্ছেতাই ধরনের লিটলম্যাগের দিন শেষ। আমি মনে করি, এটা সাহিত্যের জন্য ভালো।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
আমিনুল ইসলাম: কম অর্থব্যয় একটি কারণ কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। ওয়েবম্যাগের পাঠকের কাছে পৌঁছানোর গতি ও ব্যাপ্তি অনেক বেশি। ওয়েবম্যাগ পাঠকের প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে এবং দ্রুত। এখানে কাজের তৃপ্তি বেশি। ওয়েবম্যাগে প্রকাশিত হওয়ার পর তার লিংক যুক্ত হচ্ছে টাইমলাইনে। পাঠকরা নগদানগদি অভিমত দিচ্ছেন সেই লেখা পড়ে। তাই লেখক-সাহিত্যকর্মী উভয় দলই ওয়েবম্যাগকে প্রিফার করছেন।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
আমিনুল ইসলাম: লিটলম্যাগ বা ওয়েবম্যাগ সম্পাদক দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকের মতো যাচ্ছেতাইভাবে কাঁচি চালান না লেখকের লেখার ওপর। এখানের অধিকার এবং স্বাধীনতা দুই-ই বেশি। বানান-ব্যাকরণ তো দেখতেই হবে। তা না হলে সেই ওয়েবম্যাগ অচিরেই গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। সম্পাদকের কিছু দায়িত্ব এবং অধিকার তো থাকবেই। সেটা লেখা নির্বাচনের ক্ষেত্রে। সম্পাদকের পছন্দ না হলে তিনি ছাপবেন না। তবে নির্বাচিত লেখা কাটাকাটি না করাই উত্তম।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন, প্রকাশ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
আমিনুল ইসলাম: দুটোই সত্য। সাহিত্যপ্রেম থেকে যেমন ওয়েবম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে ধান্দাবাজি থেকেও। কিছু কিছু তৃতীয় শ্রেণীর কবি-কথাকার পাত্তা পাওয়ার জন্যও ওয়েবম্যাগ প্রকাশ করছেন। এরপরও ওয়েবম্যাগ প্রকাশকে আমি স্বাগত জানাই। আর সংখ্যায় বেশি হলে ক্ষতি নেই। যথার্থ প্রতিযোগিতাই সাহিত্যের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারে। এখানেও শেষপর্যন্ত যোগ্যরাই টিকে থকবেন। অযোগ্যরা ছিটকে পড়বে। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
আমিনুল ইসলাম: ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে কিছুটা বইপাঠ থেকে সরিয়ে নিচ্ছে বটে কিন্তু পাঠবিমুখ তো করছে না। যেসব লেখা পড়ার জন্য আগে বই পড়তে হতো, এখন সেসব লেখার বড় অংশই ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিনে পড়ে নেওয়া যাচ্ছে। পাঠক এখন শুধু আর বইয়ের পাঠক নন, তারা একইসঙ্গে ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন এরও পাঠক। ফলে বিষয়টি ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। ইউটিউবে যে-গান শোনা যাবে, সে-গানের সিডি বা ক্যাসেট সংগ্রহে এখন কেউ আর গানের ডালি বা গীতালিতে যাবেন না, সেটাই তো স্বাভাবিক। পাঠের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটছে। বই কেনার এবং তা সংরক্ষণের সীমাবদ্ধতা আছে। এছাড়া সব ধরনের বই সবসময় হাতের কাছে পাওয়াও যায় না। অথচ ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন-ফেসবুক আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লেখা পাঠের তাৎক্ষণিক সুযোগ করে দিচ্ছে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
আমিনুল ইসলাম: আমি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা / লিটলম্যাগ / ওয়েবম্যাগে সব মাধ্যমেই লিখতে /পড়তে পছন্দ করি। এমনকি ফেসবুক টাইমলাইনও আমার খুব পছন্দ। আমি প্রায়শ ফেসবুকে টাইমলাইনে কবিতা পোস্ট করে থাকি। তবে এটাও সত্য যে দৈনিকের সাহিত্যপাতা এবং লিটলম্যাগ পড়ার সময় কমে যাচ্ছে।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আমিনুল ইসলাম: অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। অন্যান্য সবমাধ্যমকে ছাড়িয়ে উঠেছে অনলাইন পত্রিকা। সেজন্য তো দৈনিক পত্রিকাগুলোও তাদের অনলাইন ভার্সন বের করছে। এটা বাস্তবতা। বাস্তবতাকে অস্বীকার করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। অনলাইন পত্রিকার ক্ষেত্র বৈশ্বিক। এর সঙ্গে অন্য কোনো মাধ্যমের তুলনা চলে না।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
আমিনুল ইসলাম: গুরুত্ব হয়তো সম্পূর্ণরূপে হারাবে না, তবে তা কমে যাবে তো বটেই। এখনই কমতে শুরু করেছে। আমি নিজেই গত কয়েকমাসে কোনো দৈনিকে লেখা পাঠাইনি। প্রয়োজন বোধ করি না। সম্প্রতি একটি ওয়েবম্যাগ কয়েকশত লাইনের হাজারেরও অধিক শব্দের একটি সুদীর্ঘ কবিতা প্রকাশ করেছে। এটা তো কোনো দৈনিকের পাতা করবে না। অনেক দৈনিকের সাহিত্যবিভাগ অ-সাহিত্যিক গোষ্ঠীবাজদের দখলে। এদের কদর কমলে আমি অখুশি হবো না।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
আমিনুল ইসলাম: ওয়েবম্যাগে দেশীয় সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্য পড়তে চাই। আমি ভালো মানের সাহিত্য-সংস্কৃতির পাঠ নিতে চাই যদিও সেটা ঠিক করার মানদণ্ড অনেকসময়ই আপেক্ষিক। এদেশের দৈনিকের সাহিত্যপাতা কিছু গোষ্ঠীবাজ ধান্দাবাজের দখলে। তারা তাদের গোষ্ঠীর নিম্নমানের লেখা ছাপাতেই জোটবদ্ধ। অনেক লিটলম্যাগও তাই। আমি চাই, ওয়েবম্যাগগুলো গোষ্ঠীবাজি, ধান্দবাজি, দলবাজির বাইরে থেকে বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হয়ে উঠুক।