আহমেদ শরীফ শুভ—কবি, গল্পকার ও কলাম লেখক। লেখালেখির হাতেখড়ি কবিতা দিয়ে হলেও গল্প এবং সামাজিক রাজনৈতিক ধারাভাষ্যে সমান স্বচ্ছন্দ্য। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ: বিহঙ্গ উড়িয়ে দাও, স্বপ্নে দেখি তোমার মুখ। গল্পগ্রন্থ: তৃষ্ণা ও জলে। রাজনৈতিক কলামের সংকলন: মৃত্যুবার্ষিকী মৃত্যুবার্ষিকী খেলা। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন এই লেখক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
আহমেদ শরীফ শুভ: খুব সহজে প্রকাশনাযোগ্য ও মাননিয়ন্ত্রণে শিথিলতার কারণে সম্প্রতি ওয়েবম্যাগের সংখ্যাধিক্য দেখা যাচ্ছে। সাহিত্যমাধ্যমের বিবর্তনের ধারায় এক সময় হয়তো অনলাইন সাহিত্যপত্রিকাগুলো দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা ও লিটলম্যাগের জায়গা অনেকটাই নিয়ে নেবে কিন্তু পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারবে কি না, তা বলার সময় হয়েছে বলে মনে করি না।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
আহমেদ শরীফ শুভ: অর্থের সাশ্রয় একটি কারণ, তবে একমাত্র কারণ বলে আমি মনে করি না। সাহিত্যকর্মীদের লিটলম্যাগ থেকে ওয়েবম্যাগে আকৃষ্ট হওয়ার ধারাটি বহুকারণিক।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
আহমেদ শরীফ শুভ: এটা সত্যি বেশিরভাগ ওয়েবম্যাগেই সম্পাদক কিংবা সম্পাদনা পরিষদ থাকলেও প্রকৃত অর্থে সম্পাদনার বালাই থাকে না। আবার একটি বিরাট অংশে সম্পাদনার বিষয়টি থাকে নামে মাত্র। ফলে কেবল বানানের বিভ্রাটই নয়, বাক্যের বিন্যাসেও যথেষ্ট দুর্বলতা সচরাচরই চোখে পড়ে।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
আহমেদ শরীফ শুভ: সাহিত্যপ্রেমের বিষয়টি আমি উড়িয়ে দেই না। তবে এক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রকাশ ও আত্মপ্রচারের প্রবণতাই মুখ্য।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
আহমেদ শরীফ শুভ: ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন—এগুলোকেই আমি একমাত্র দায়ী বলে মনে করি না। এটা সামগ্রিক ইন্টারনেট বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বই, লিটলম্যাগ কিংবা ওয়েবম্যাগের মধ্যে পাঠক কোনটিকে অগ্রাধিকার দেবেন, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট মাধ্যমগুলোর স্বকীয় মানের ওপর। তবে ছাপার অক্ষরে বইপাঠ ও ইন্টারনেটে বইপাঠের তুলনামূলক আলোচনা স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
আহমেদ শরীফ শুভ: আমি নিজে ওয়েবম্যাগে লিখতে বেশি পছন্দ করি, তবে সেটা যদি মানসম্মত ওয়েবম্যাগ হয়।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আহমেদ শরীফ শুভ: সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে ওয়েবম্যাগ, লিটলম্যাগ ও দৈনিকের সাহিত্যপাতার স্বতন্ত্র ও পরিপূরক ভূমিকা আছে। কিন্তু মাননিয়ন্ত্রণহীন ওয়েবম্যাগের সংখ্যাধিক্য এই প্রক্রিয়াকেও বিঘ্নিত করতে পারে।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
আহমেদ শরীফ শুভ: এই নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় এখনি এসেছি কিনা, তা বলা কঠিন। হয়তো বিবর্তনের ধারায় এই গুরুত্বহীনতা কিংবা গুরুত্বের অবনয়ন অপরিহার্য হয়ে উঠবে। কিন্তু তা সাহিত্যচর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
আহমেদ শরীফ শুভ: এই ব্যাপারটি নির্ভর করে ওয়েবম্যাগের চরিত্রের ওপর। এক কথায় উত্তর চাইলে বলব, মানসম্মত লেখা পড়তে চাই। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু আমার কাছে তেমন জরুরি নয়। তবে অন্তর্নিহিত দর্শন না থাকলে সেই লেখা আমাকে আকর্ষণ করে না। যেকোনো লেখা সুখপাঠ্য হওয়া আবশ্যক, তবে তার মধ্যে দর্শন থাকা চাই। কারণ এটি একটি মানোত্তীর্ণ লেখার অত্যাবশকীয় উপাদান। অন্যথায় তা হবে মেধাহীন সৌন্দর্যের মতো।