শরাফত হোসেন—কবি। এই পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থ দুটি। ‘ঘাসফুল তোমার সাথে’ ও ‘ফিরে আসি কাচের শহরে’।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
শরাফত হোসেন: লিটলম্যাগ বরাবরই এক্সপেরিমেন্টের জায়গা হিসেবে সমাদৃত। এর চর্চা তারুণ্যকে ঘিরেই শুরু হয়েছিল। তারুণ্যই এর প্রাণ। এখনো তারুণ্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এখানে আবেগ, সাহিত্যপ্রেম ও প্রকাশের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। প্রতিষ্ঠিতদের কথা বলছি না, তরুণরা বেশি পরিমাণে লিটলম্যাগে আগ্রহী। তবে এই সময়ের তরুণেরা অনেকটা টেকনোলজি-নির্ভর হওয়ায় লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে, বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। তবে মানের বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সহজলভ্য হওয়ার কারণে যে কেউ নিজের মতো করে ওয়েবম্যাগের দিকে ঝুঁকতে পারছে। অনলাইন নির্ভর হওয়ায় আড্ডা ও সমালোচনার জায়গাটি সংকুচিত হয়ে আসছে। যা লিটলম্যাগের প্রাণ। তবে এই সময়ে এসে লিটলম্যাগের আবেদন ফুরিয়ে গেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
শরাফত হোসেন: খরচ বেশি হলেও কিন্তু প্রচুর লিটলম্যাগ প্রকাশিত হতো। প্রতিটি জেলা-উপজেলা এমনকি ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক লিটলম্যাগও হয়েছে প্রচুর। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন এই সময়ের সাহিত্যপ্রেমী তারুণ্য। এর কারণ অর্থব্যয়ের থেকেও এখানে সহজলভ্য বিষয়টি প্রধান্য পাচ্ছে বলে আমি মনে করি। আপনি চাইলে সমাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা, বন্ধুদের ট্যাগ করা ইত্যাদি নানা উপায়ে সহজে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। আর এটা সাইক্লিক পদ্ধতিতে ঘটে। বন্ধুরা হয়তো লাইক দিচ্ছে, কমেন্ট করছে, হয়তো তারা পড়ছে, হয়তো পড়ছে না। এই না পড়াটা ঝুঁকির কারণ হবে। কেউ তার খবরও নিচ্ছে না। আমি মনে করি, সহজলভ্য প্রকাশ মাধ্যম পেয়ে এই সময়ের তরুণেরা ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
শরাফত হোসেন: একদম ঠিক বলেছেন। কিছু কিছু ওয়েব সম্পাদনা করে, অধিকাংশই করে না। করলে এত ভুল থাকতো না। বানান, বাক্য ভুল থাকছে বলেই আস্থার জায়গাটি তৈরি হচ্ছে না।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন পনেরো/ষোলো শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
শরাফত হোসেন: সাহিত্য প্রেম থেকেও আমি মনে করি, আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে এমনটা করে থাকেন অনেকই, সবাই না। প্রেম থাকলে যাচ্ছেতাই করতে পারতেন না, মানের দিকে খেয়াল রাখতেন। ওয়েবজিন বা ব্লগজিন সহজলভ্য হওয়ার কারণে তারা এই সুযোগটি নিতে পারছেন। লেখকদের সচেতন হতে হবে, কাকে লেখা দেব, কাকে দেব না, এটা ভেবে দেখতে হবে। না হলে নিজের লেখার মান নিয়ও প্রশ্ন উঠবে।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
শরাফত হোসেন: আমি তা মনে করি না। তবে হ্যাঁ, কিছুটা ভাটা পড়েছে বৈ কি। আমি যখন একটি ভালো সম্পাদিত ওয়েবম্যাগে কোনো লেখা পাঠ করছি, সেটার বই সংগ্রহ করতে আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ভালো সম্পাদিত বলতে নির্ভুল লেখা, সম্পাদকের ওপর আস্থা আছে ইত্যাদি বিষয় বুঝাতে চাইছি। বিনামূল্যে পাঠের পাশাপাশি রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারছি, ডাটা কানেকশনের মধ্যে ঢুকে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, না লিটলম্যাগ, না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে পছন্দ করেন?
শরাফত হোসেন: এটা নির্ভর করে দৈনিক, লিটলম্যাগ বা ওয়েবম্যাগের সম্পাদক হিসেবে কে আছেন, তার ওপর। আমি যেচে দিচ্ছি, না কি চেয়ে নিচ্ছেন। লিটলম্যাগ বরাবরই আবেগের জায়গা। আমি নিজেও ‘সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা’র সঙ্গে যুক্ত। দৈনিকের একাধিক ঈদসংখ্যা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু ‘সাহিত্য একাডেমি প্রত্রিকা’র কথা বলতেই গৌরব বোধ করি।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
শরাফত হোসেন: প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ওয়েব বেশি কার্যকর নিঃসন্দেহে। একটা সমাজের সবাই বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করে না। সংখ্যা দিয়ে মানও বিচার করা যায় না। অনলাইনকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে। একটা বিশাল জনগোষ্ঠী অনলাইনে আসেন, পছন্দের বিষয়ে ঢুঁ মারেন। তাদের সামনে ভালো সাহিত্য তুলে ধরতে পারলেই ইতিবাচক পরিবর্তন অসবে। না হলে বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে ভুল বার্তা পৌঁছাবে। আমি অনলাইনকে একটা মাধ্যম হিসেবে দেখি। এই মাধ্যমকে আমরা কে কিভাবে ব্যবহার করছি, তার ওপর নির্ভর করছে চর্চার প্রসার।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
শরাফত হোসেন: দৈনিকের সাহিত্যপাতার গুরুত্ব আগের থেকে কম মনে হচ্ছে, অন্তত আমার কাছে। মানসম্পন্ন ওয়েবম্যাগের পরিমাণ বাড়লে একসময় দৈনিকের সাহিত্যপাতার গুরুত্ব আরও কমে যাবে; এটা বলাই যায়।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
শরাফত হোসেন: আমি চাই, ওয়েবম্যাগ একটি লেখা সম্পাদনা করে প্রকাশ করবে। এর সম্পাদনা পরিষদে বিজ্ঞজনেরা থাকবেন। আর লেখার কথা যদি বলেন, সাহিত্যের সব বিষয়ই থাকবে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি। তবে এর সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সংবাদ থাকলে ভালো হয়। সাহিত্যের গতিবিধি, কবিতার সাম্প্রতিক ধারা- এসব বিষয় থাকতে পারে। এতে করে একটা সময়কে আলাদা করে চিনতে পারা যাবে।