[কবি-কথাসাহিত্যিক রফিকুজ্জামান রণির জন্ম ১৯৯২ সালে ৩০ ডিসেম্বর চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার দোঘর গ্রামে। বাংলা একাডেমির মাসিক সাহিত্যপত্র ‘উত্তরাধিকারে’ ছোটগল্প প্রকাশের মাধ্যমে তার লেখালেখি শুরু। দীর্ঘদিন ধরে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর সাহিত্যপাতায় লেখালেখি করছেন। তার লেখা গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ ও ছড়া দেশের ম্যাগাজিনগুলোতেও প্রায়ই দেখা যায়। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন: জেমকন তরুণ কবিতা পুরস্কার ২০১৯, ‘এবং মানুষ’ পুরস্কার-২০১৯, চাঁদপুর জেলাপ্রশাসক পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৮, নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা-২০১৯, নতুন কুঁড়ি লেখক সম্মাননা-২০১৯, পাঠক সংবাদ গুণীজন সম্মাননা-২০১৯, দৈনিক চাঁদপুরকণ্ঠ সম্মাননা ২০১৬, স্বরচিত কবিতায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার ২০১৬, চতুরঙ্গ ইলিশ উৎসব পুরস্কার- ২০১৮, টেকনোবিডি গল্পকবিতা ডটকম পুরস্কার ২০০৯, চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার ২০১৪; জাতীয় সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা ২০১৪; ছায়াবাণী মিডিয়া কমিউনিকেশন লেখক সম্মাননা ২০১৬ ও ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম সাহিত্য পদক ২০১৩সহ অনেক পুরস্কার। অর্ধযুগ ধরে দায়িত্ব পালন করছেন দৈনিক চাঁদপুর বার্তার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। বর্তমানে তিনি চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির মহাপরিচালক পদে নিয়োজিত আছেন। তার সঙ্গে চিন্তাসূত্রের আলাপচারিতায় উঠে এসেছে পুরস্কারপ্রাপ্তিসহ সাহিত্যচর্চার নানা দিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাশিল্পী ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।]
চিন্তাসূত্র: সম্প্রতি কবিতায় জেমকন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এজন্য অভিনন্দন। আমরা জানি, আপনি কবিতার পাণ্ডুলিপির জন্য এ পুরস্কার পেয়েছেন। তাই শুরুতেই পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি ও কবিতার পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে জানতে চাইবো।
রফিকুজ্জামান রণি: আমি বিস্মিত, অভিভূত এবং আনন্দিত। যে পুরস্কার নিয়ে একদিন স্বপ্ন দেখতাম এবং আগে যারা এ পুরস্কার পেতেন, তাদের দিকে অবাক-বিস্ময়ে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতাম, সে পুরস্কার যখন আমার হাতে চলে এলো, খুশিতে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। সত্যি বলতে কী, সংবাদটা শোনার পর আমার গায়ে অদ্ভুত এক থরকাঁপুনি সৃষ্টি হলো! কবিতার পাণ্ডুলিপিটি খুব বেশি বড় নয়, তারপরও বলবো এ আমার সারাজীবনের সঞ্চয়। কবিতাকে আমি আমার সবটুকু দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
চিন্তাসূত্র: তারও আগে গল্পগ্রন্থ ‘দুই শহরের জানালা’র জন্য জোড়া পুরস্কার পেয়েছেন। বলতে গেলে, আপনার পুরস্কারভাগ্য ভালো। তবে ভাগ্যের চেয়ে লেখালেখির সার্থকতাই বলবো একে। শুধু তা-ই নয়, পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, আপনার লেখা মানোত্তীর্ণ হয়েছে। এমন সফলতার পেছনে কোন বিষয়টিকে এগিয়ে রাখবেন?
রফিকুজ্জামান রণি: সফলতার ক্ষেত্রে আমার সাধনা ও আত্মবিশ্বাসই মুখ্য। আমি কখনো অন্যকে ঈর্ষা করিনি, একদিন আমাকে ঈর্ষা করবে মানুষ-অনেকটা সেরকম মনোভাব নিয়েই কাজ করেছি। আমি অনেক পরিশ্রম করে এগোতে চেষ্টা করেছি।
চিন্তাসূত্র: তবে ‘চাঁদপুর জেলাপ্রশাসক পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৮’ পেয়েও আপনি গ্রহণ করেননি। এর কারণটা কী?
রফিকুজ্জামান রণি: সে অনেক কথা। সেটা না হয় আপতত নাইবা বললাম। চাঁদপুরের বর্তমান জেলাপ্রশাসক মাজেদুর রহমান খান অত্যন্ত সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। তার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা ও আস্থা আছে বলেই তার প্রতি সম্মান রেখে এ বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যেতেই আমি পছন্দ করি।
তবে, একটা কথা বলে রাখি, পুরস্কার প্রণয়ন প্রতিষ্ঠান অবশ্যই জানতে হবে একজন লেখকের মর্যাদা কতটা ওপরে। পুরস্কার দিয়ে কাউকে কিনে ফেলার মতো দৃষ্টিভঙ্গি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে দেখা দিলে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকরা সে ফাঁদে পা দেবে না এটাই বাস্তব।
চিন্তাসূত্র: কবিতা ও গল্প-দুই শাখাতেই সফলতার হাতছানি লক্ষ করছি। সে ক্ষেত্রে দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। এমন দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
রফিকুজ্জামান রণি: আমি বর্তমানে যেভাবে এগোচ্ছি, ঠিক সেভাবেই এগোতে চাই। অতিমাত্রায় গতিবৃদ্ধি কিংবা গতিশ্লথ করার ইচ্ছে আমার নেই। খুব বেশি চাওয়া-পাওয়াও নেই, আমি চাই সম্মানজনক অবস্থানে দাঁড়ানো একজন লেখক হতে। তাড়াহুড়ো কিংবা হা-হুতাশ না করে সমান্তরাল হাঁটতে চাই।
চিন্তাসূত্র: পুরস্কৃত গল্পের বইটি পাঠক সাড়া কেমন পেয়েছে? অনেক সময় শুনি, পুরস্কার পাওয়ার পরও বইটি পাঠককে স্পর্শ করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
রফিকুজ্জামান রণি: আমার বইটি যার হাতেই পড়েছে, তার মুখেই প্রশংসা পেয়েছে। দেশের প্রতিনিধিত্বশীল লেখকদের মুখেও আমার বইয়ের প্রশংসা শুনেছি। তবে প্রকাশকের সহযোগিতা থাকলে বইটা আরও ভালো সাড়া পড়তো আমার বিশ্বাস। আজকালকার বেশিরভাগ প্রকাশকই মুনাফার লোভে মানহীন বই নিয়ে মাতামাতি করে বেড়ায়, ফলে ভালো বই থেকে পাঠককুল দূরে সরে থাকে। এতে পাঠক বইয়ের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারছে না। পাঠক শূন্যতার জন্যে ৮০ ভাগ দায়ী সুবিধালোভী মৌসুমী প্রকাশকরা। তারাই এ দেশের বইয়ের বাজার নষ্ট করেছে। সে দায় চাপানো হচ্ছে লেখকদের ওপরে।
চিন্তাসূত্র: বাংলাদেশের যেকোনো পুরস্কার ঘোষণার পরই বিতর্ক ওঠে। নানাজন নানা কথা বলেন। যেমন-স্বজনপ্রীতি, ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা লবিংয়ের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
রফিকুজ্জামান রণি: অভিযোগ তুললেই তো আর সব সত্য হয়ে গেলো না! দূর থেকে অনেকেই অনেক কিছু বলে কিন্তু বাস্তব যে কতটা ব্যতিক্রম, তা তো আমি নিজেকে দিয়েই বুঝেছি। আমার কে আছে লবিং করার? আমার আর্থিক অবস্থা তো খুবই খারাপ, তারপরও আমি পুরস্কার পাচ্ছি কিভাবে? আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, কখনো পুরস্কারের লোভে মানুষের পেছনে আমি ছুটে বেড়াইনি। আমি বরং মতের সঙ্গে খাপ না খেলে, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হলে পুরস্কার গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নজির সৃষ্টি করেছি।
চিন্তাসূত্র: একজন তরুণের ক্ষেত্রে পুরস্কারের অর্থমূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ…
রফিকুজ্জামান রণি: হ্যাঁ, এই মুহূর্তে পুরস্কারটা আমার জন্যে জরুরি ছিল, বিশেষত অর্থ মূল্যটা। এক লাখ টাকা আমার জন্যে অনেক কিছু। অন্তত আমার একটা ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য তো হয়েছে এখন। আমি যে কতটা কষ্টে লেখালেখি করি, সেটা কেউ নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। পত্রিকার লেখক সম্মানীর জমানো টাকা দিয়ে পরীক্ষার ফরমপূরণ করার মতো বিষাদগ্রস্ত স্মৃতিও আমার জীবনে আছে! সুতরাং টাকাটা একটু চিন্তা করেই খরচ করবো। তবে ভালো কাজেই ব্যয় করবো।
চিন্তাসূত্র: দেশে গণহারে পদক বা সম্মাননা সংস্কৃতি চলছে। তাতে প্রথম শ্রেণীর পদক ও সম্মাননা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কেমন হতে পারে?
রফিকুজ্জামান রণি: এগুলোর জন্য বড় লেখকরাও কিন্তু দায়ী। কারণ তারাও এসব অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলেই পূর্বাপর না ভেবে সময় মতো গিয়ে হাজির হন। তাতে এসব কাজে আয়োজকরাও উৎসাহিত হন এবং গর্ববোধ করেন। তবে, আমি মনে করি, উদ্দেশ্য ভালো হলে, লেখার সঠিক মূল্যায়ন হলে এবং নিঃস্বার্থভাবে পুরস্কার/পদক চালু করা হলে সেটা দোষের কিছু নয়। প্রশংসার বিষয়। কিন্তু এসব নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করাটাই নিন্দনীয়। এর জন্যে লেখকদের আগে সচেতন হওয়া উচিত।
চিন্তাসূত্র: সাহিত্যচর্চা করতে এসে কেমন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? ভবিষ্যতে এ চর্চা অব্যাহত রাখতে কেমন পদক্ষেপ নিয়েছেন?
রফিকুজ্জামান রণি: আমি খুব বেশি বাধার সম্মুখীন হইনি। ভবিষ্যতে আরও সময় নিয়ে কাজ করতে চাই, আরও বেশি পঠনপাঠনে মনোযোগ দিতে চাই। আমাদের জানাশোনার পরিধি আরও বাড়ানো উচিত। দিন দিন জানার জগৎটা কেমন ছোট হয়ে আসছে মনে হয়, আমি নিজেকে ঋদ্ধ করতে চাই বই পড়ে।
চিন্তাসূত্র: আপনার জন্য শুভ কামনা। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
রফিকুজ্জামান রণি: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। চিন্তাসূত্র দীর্ঘজীবী হোক। ভালো থাকবেন।