চিন্তাসূত্রের নভেম্বর সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছোটগল্প। অর্থাৎ ছোটগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, ছোটগল্প ও তরুণ গল্পকারদের ভাবনা। তরুণ গল্পকারদের ভাবনাপর্বে ছোটগল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন কথাশিল্পী রিপনচন্দ্র মল্লিক।
চিন্তাসূত্র : আপনি কেন ছোটগল্প লিখছেন?
আমি কেন লিখি? এ প্রশ্নের তো ছোট্ট করে উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। তবুও আমার কাছে মনে হয়, লেখালেখি করি মূলত নিজের ভেতরের দ্রোহ, ক্ষরণ, স্বপ্ন, চিন্তার প্রতিফলনকে গল্পের চরিত্রের ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। অর্থাৎ বলতে পারেন, আমার ভেতরের কথাগুলো সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের কাছে উপস্থাপন করি। যা আমার ভালো লাগে। যখন একটি গল্প লিখে শেষ করতে পারি, তখন মনে খুব প্রশান্তি অনুভব করি।
চিন্তাসূত্র : আপনার গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
আমি আসলে নিজের মতো করে লিখি। এটাই আমার বৈশিষ্ট্য হতে পারে। তা হয়তো আমার পাঠকই ভালো বলতে পারবেন। তবে লেখক হিসেবে আমার তো একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য রয়েছেই। তা যদি না-ই থাকে, তবে আমি কেন লিখতে এসেছি। এটা ঠিক যে, আমি বেশি নিরীক্ষা করতে আগ্রহী নই। তবে চেষ্টা যে নেই, তা বলব না। আমার কিছু গল্পে নিরীক্ষার চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়েছে, গল্পে আসলে কোন নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। গল্প তো গল্পই। আপনি যেভাবে উপস্থাপন করেন না কেন, শেষমেষ সবাই একটি গল্পই বলতে চায়। সেটা ইনিয়ে-বিনিয়ে বা যেভাবেই হোক। যদি ঠিকঠাকভাবে আপনার কথাগুলো গল্পের উপযোগী করে উপস্থাপন করতে পারেন; তখন সেটা প্রকৃত গল্প হয়ে উঠবে। তাই আমি মনে করি, গল্পে আসলে শেষ পর্যন্ত নিরীক্ষা বলতে কিছু নেই। প্রচলিত কিংবা অপ্রচলিত যেভাবেই লেখি না কেন, তা গল্পই হয়।
চিন্তাসূত্র : একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে পারে বা চায়?
আমার মনে হয়, পাঠক যখন একটি গল্প পড়ে; তখন সে গল্পের প্রধান চরিত্রের সাথে মিশে যেতে চায়। গল্পটি পাঠ করে একটি পরিপূর্ণ তৃপ্তি চায়। এর ভাষা সহজ ও প্রাঞ্জল হতে হবে। শুধু সহজ ও প্রাঞ্জল হলেই হবে না, আরো কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন- বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণীর। তারাই মূলত পাঠক। এই পাঠক ছোটগল্পে নিজের ও তার আশেপাশের চেনাজানা মানুষকে খুঁজে পেলে; সেই গল্পকে নিজের গল্প মনে করে। পাঠ করে স্বস্তি পায়। তাই আমি মনে করি, একজন পাঠক গল্পে চেনাজানা মানুষের প্রতিচ্ছবি দেখতে চায়।
চিন্তাসূত্র : একজন কবি যখন একজন গল্পকারও; তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
অনেকে কবিতা এবং গল্প- দুটোতেই সফল হয়েছেন। অনেকে আবার তা পারেননি। আল মাহমুদ যেমন ‘সোনালি কাবিন’ লিখে পাঠকদের মুগ্ধ করেছেন। ঠিক তেমনি ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘গন্ধ বণিক’, ‘কালো নৌকা’ কিংবা ‘জলবেশ্যা’র মতো গল্প লিখেও পাঠকদের মুগ্ধ করেছেন। আবার জীবনানন্দ দাশের কবিতা মানে অন্যকিছু। এখন তো এক শ্রেণীর বাঙালি তার কবিতা ছাড়া নিজেকে অসম্পূর্ণ মনে করে। ধীরে ধীরে তার কবিতার পাঠক বেড়েই চলেছে। কিন্তু তিনি তো গল্প-উপন্যাসও লিখেছেন। তিনি কবিতার মতো গল্প-উপন্যাস লিখে পাঠককে মুগ্ধ করতে পারেননি। শামসুর রাহমানও কবিতায় মানুষকে মুগ্ধ করেছেন। গল্পে তা পারেননি। আবার হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, শহীদুল জহির তো কবিতাই লিখলেন না। আবার অনেকে এমন আছেন; তারা সব শাখাতেই শতভাগ সফল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেখানেই হাত রেখেছেন; সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হকরা তো সবখানেই সফল।
চিন্তাসূত্র : একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
যৌনতাকে ছোটগল্পে নান্দনিক করে অবশ্যই উপস্থাপন করা যায়। হচ্ছেও। যৌনতা মানেই যে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে উপস্থাপন করতে হবে এমন কোন কথা নেই। এখন যৌনতাকে একজন লেখক কতটুকু নান্দনিক করে উপস্থাপন করবেন, এটা আসলে লেখকের দায়। আর যৌনতাকে তো কেউ অস্বীকার করতে পারি না। এটি মৌলিক চাহিদা। তাই ছোটগল্পে যৌনতা বার বার ঘুরেফিরে আসছে এবং আসবেই। কে কতটা নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে, সেটাই বিবেচ্য। নান্দনিকতার তো আর মানদণ্ডের শেষ নেই।
চিন্তাসূত্র : কোন শ্রেণির ছোটগল্প সবচেয়ে বেশি পাঠক সমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠে। সে হিসেবে বাংলাদেশের পাঠকরা এই শ্রেণীর পরিবারের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না কিংবা না পাওয়ার হাহাকার বেশি পছন্দ করে। আর প্রেমের গল্প তো চিরন্তন ভালো লাগা গল্প। সব মিলিয়ে পাঠকরা চেনাজানা মানুষের হাহাকারের গল্প পড়তে পছন্দ করে। সেই গল্পে মূলত পাঠক নিজেকে খুব কাছাকাছি খুঁজে পায়। যা অন্য সমাজের গল্প লিখলে পায় না। যেমন বিদেশি গল্প কিন্তু বাংলাদেশের পাঠক সমাজে বেশি সমাদৃত হয় না। এর প্রধান কারণ বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির অমিল রয়েছে। যে কারণে বিদেশি গল্প বেশি পাঠকের কাছে যেতে পারে না। আমি মনে করি, আগামীতে বড় বড় সাইজের উপন্যাসের চেয়ে ছোটগল্পের পাঠক আরো বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, ছোটগল্পকে উপন্যাসের বনসাই করে ফেলতে হবে। মানুষ যাতে কম সময় ব্যয় করে ছোটগল্পের ভেতরেই উপন্যাস পড়ার স্বাদ নিতে পারে। আমার নিজেরও কিছু গল্প আছে, সেগুলো আমি উপন্যাসের বনসাই করেছি। অর্থাৎ ছোটগল্পটি পাঠ শেষেই মনে হবে যেন একটি উপন্যাস পড়া হয়েছে। আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কাঠপরানের দ্রোহ’ বইয়ে ‘সুখনগরে’ নামে একটি গল্প রয়েছে। সেটি আমি উপন্যাসের বনসাই ভার্সন বলে থাকি। ‘জ্যোস্নার ঘরে কান্নার স্বর’, ‘রঙিন অন্ধকারে’সহ কিছু গল্পে উপন্যাসের স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। হয়েছে কি হয়নি, তা পরের বিবেচনা। তবে চেষ্টা আমি করেছি।
চিন্তাসূত্র : একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোন কোন শর্ত পূরণ করতে হয়?
আমি প্রশ্নটির উল্টো করে যদি উত্তর করি, তাহলে এটা দাঁড়ায় যে, একটি আদর্শ ছোটগল্প আমি কোনটিকে বলব। আমরা যে সব কাহিনীকে ছোটগল্প বলছি, সেগুলোর সব গল্পই আসলে নান্দনিক ও শিল্পশর্ত পূরণ করেছে বলেই সেগুলো ছোটগল্প হয়ে উঠেছে।
চিন্তাসূত্র : ছোটগল্প নিয়ে আপনার নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ কেমন ফল দিতে পেরেছে?
না। আমার নিরীক্ষামূলক ছোটগল্প এখনো তেমন কোন ফলাফল দিতে পারেনি। আর নিরীক্ষার ফলাফল পেতে হলে, তার জন্য তো কিছু সময় অপেক্ষা করা দরকার। আমি অপেক্ষায় আছি।
চিন্তাসূত্র : আপনার ছোটগল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আমি আসলে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে ছোটগল্প লিখছি না। তরুণ গল্পকার বাসার তাসাউফ আমাকে প্রায়ই বলে থাকেন, আমি না কি অলস গল্পকার। তিনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন। আমি মূলত একজন অলস গল্পকার। খুব কম লিখি। গল্প লিখে কাটাছেড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাই। তারপর দীর্ঘদিন বিরতি দিয়ে আবার হয়তো একটি গল্প লিখি। তাই তো প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পর তিন বছর বিরতি চলছে। দ্বিতীয় বই আসেনি। তবে এবার হয়তো আশা করছি, আমার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘অন্ধপাখির চোখে’ প্রকাশ হবে। তাই বলছিলাম, আমি আসলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এই মুহূর্তে কাজ করছি না। যখন লেখা মাথায় আসে, লিখতে বসে যাই। সেই গল্প যেভাবেই এগিয়ে চলুক না কেন।
চিন্তাসূত্র : মানুষের কল্যাণে আপনার ছোটগল্প কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
আমার ভেতরে জ্বলতে থাকা ক্ষোভ, দ্রোহ, স্বপ্ন, মুক্তচিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই মূলত আমি ছোটগল্পে তুলতে চেষ্টা করি। আমি মনে করি, আমার গল্প যেকোনো পাঠককে দেশপ্রেম ও শুভ চিন্তার মানুষ হতে সাহায্য করবে।