সালাহ উদ্দিন শুভ্র—আপাদমস্তক কথাশিল্পী। সাধারণত সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস-ছোটগল্পে এতদিন তাকে পাওয়া গেছে। তবে, এবার পাওয়া যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্রে, ভিন্ন রূপে। এবার তিনি নিয়ে এসেছেন সায়েন্স ফিকশন ‘আলোয় অন্ধ শহর।’ এই উপন্যাসের মূল কাহিনি একটা মানুষের ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্টের শিকার হওয়া। সালাহ উদ্দিন শুভ্রের ইতোপূর্বে প্রকাশিত বইগুলো হলো—মানবসঙ্গবিরল (গল্পগ্রন্থ), গায়ে গায়ে জ্বর (উপন্যাস), মেয়েদের এমন হয় (গল্পগ্রন্থ)।
তার জন্ম ফেনীতে। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্নতত্ত্বে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে দেশ রূপান্তর পত্রিকার অনলাইন শিফট ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০ উপলক্ষে প্রকাশিত সায়েন্স ফিকশন ‘আলোয় অন্ধ শহর’-এ নিয়ে সালাহ উদ্দিন শুভ্রের মুখোমুখি হয়েছেন লেখক-গবেষক ওয়াহিদ সুজন।
ওয়াহিদ সুজন: বাংলাদেশের কল্পবিজ্ঞান চর্চায় ‘আলোয় অন্ধ শহর’ ব্যতিক্রম এদিক থেকে যে, ঢাকা শহরকে নিয়ে লেখা পুরো আখ্যান। প্রথম প্রশ্নটা এভাবেই করা যাক—ঢাকা শহরকে কল্পবিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে ভাবলেন কীভাবে?
সালাহ উদ্দিন শুভ্র: আসলে ঢাকায় যে মেট্রোরেল হচ্ছে, তা প্রতিদিনই দেখতে হয় আমাকে। বিশেষ করে রাতের বেলা বড় বড় ক্রেন, লরি, ক্লিনকার, পিয়ার টেনে আনা, লাইট জ্বালিয়ে কাজ করা—তাদের এসব কাজ দেখি আমি। দেখতে দেখতে মনে হয়, কী হবে আসলে ঢাকা শহরের আজ থেকে অনেক বছর পরে। তা ছাড়া আমি নিজের আশপাশ নিয়েই লিখতে পছন্দ করি। লেখার ভেতর ব্যাপারটা চলে আসে। কোনো পূর্বপরিকল্পনা লাগে না। এমনিতে আগে কেউ ঢাকাকে নিয়ে সায়েন্স ফিকশন লিখেছে কি না, সেটা জানা ছিল না লেখার সময়।
ওয়াহিদ সুজন: প্রায় দেড় শ বছর পরের কাহিনিতেও ঢাকায় দেখা গেলো সেখানেও উন্নয়ন চলমান। আপনার কি মনে হয় ‘ঢাকার’ এ উন্নয়ন চলতেই থাকবে, কখনো থামবে না?
সালাহ উদ্দিন শুভ্র: ডেভেলপমেন্ট মানেই কিন্তু নিরন্তর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়া। তবে আমার উপন্যাসে একটা কথা বলতে চেয়েছি যে, অবকাঠামোগত পরিবর্তন কিন্তু খুব একটা বেশি ভবিষ্যতের ঢাকায় ঘটবে না। বরং মনজাগতিক পরিবর্তনটা বেশি ঘটবে। তথ্যপ্রযুক্তির পরিবর্তনটা বেশি ঘটবে। ঢাকা বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসে সাজানো-গোছানো থাকবে। বিভিন্ন অ্যাপস, ডিভাইস—এসবের অনেক বেশি ব্যবহার হবে। তাদের হাতে শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে অনেকটাই। এর সঙ্গে আমি এই সময়ের করপোরেটদের যে নিয়ন্ত্রণ সেটার আরও শক্তিশালী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছি। তবে, এগুলো কোনোটাই মূল কাহিনি নয়। মূল কাহিনি কিন্তু একটা মানুষের ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্টের শিকার হওয়া। সেটা কীভাবে হলো, তা বের করা নিয়ে এগিয়েছে ‘আলোয় অন্ধশহর’।
ওয়াহিদ সুজন: এখনকার সময়ে সার্ভিল্যান্স সিস্টেমের মধ্যে আমরা আছি, তা যেন আরও সর্বাত্মক হয়েছে ‘আলোয় অন্ধ শহর’ উপন্যাসে। তাহলে ব্যক্তির গোপনীয়তা বা স্বাতন্ত্র্য—এসব বিষয়ে আমাদের আশাবাদী হওয়ার মতো কি কিছু নেই?
সালাহ উদ্দিন শুভ্র: আসলে সার্ভিল্যান্স থেকে ব্যক্তি কতটা বাইরে যেতে চায় বা পারবে? এই সময়েই আমরা দেখি যে, ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য সে-ই সার্ভিল্যান্স দাবি করে। ধর্ষণ থেকে মুক্তি পেতে অ্যাপস বা কোনো প্রযুক্তিগত সহায়তা চায় সে। ব্যক্তির গোপনীয়তা, নিজস্ব কিছু থাকার যে নৈতিক দাবি বা এর যে সংকট, সেই নৈতিকতাকে আমি প্রশ্ন করেছি উপন্যাসে। ব্যক্তির গোপন তথ্য দিয়ে ব্যবসা করা, সেগুলোকে পুঁজি করা, এই পরিস্থিতির সামনে ব্যক্তির নিজস্ব কৌশল কী হওয়া দরকার—তার কিছু ইঙ্গিতও আছে উপন্যাসে। যেমন গুজব ব্যাপারটা। আমি মনে করি সেটা আরও বাড়বে। বরং গুজব ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সামষ্টিক একটা ঐক্য তৈরি করে। এই গুজবের নৈরাজ্য তার রাজ্য। যেটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ঘটবে। রিয়েল ওয়ার্ল্ড গুরুত্ব হারাবে। সার্ভিল্যান্স সিস্টেমকে ব্যক্তিরা বিভ্রান্ত করতে থাকবে। এগুলো ভবিষ্যতে আরও আকারে বাড়বে। যারা সার্ভিল্যান্স করবে আর যাদের ওপর সার্ভিল্যান্স হবে, তাদের মধ্যে একটা নাগরিক বোঝাপড়া আপাত মীমাংসা হতে পারে বলে উপন্যাসের কিছু ঘটনা ধরে ব্যাখ্যা করলে মনে হবে।
সব উপন্যাসেরই নিজস্ব লজিক থাকে বা প্রাসঙ্গিকতা থাকে। সেই হিসাবে এরিয়েলের মতো নিম্নবিত্ত গোছের একটা চরিত্র থাকতেই পারে বলে আমার মনে হয়েছে।
ওয়াহিদ সুজন: খুব পরিচিত নাম বললে আইজ্যাক আসিমভের কথা তুলতে পারি। তার ‘ফাউন্ডেশন’ সিরিজ ভবিষ্যতের সমাজতত্ত্ব নির্মাণ করে। বাংলাদেশের তুলনায় একটু ব্যতিক্রম হলেও ‘আলোয় অন্ধশহর’ এ সচেতনতা আমরা পাই। একটু আগ বাড়িয়ে বললে ছেলেভোলানো গল্পের চেয়ে এ উপন্যাস যেন বেশি কিছু। এখানে কি লেখক হিসেবে কোনো দায় অনুভব করেছিলেন?
সালাহ উদ্দিন শুভ্র: আইজ্যাক আসিমভ আমি পড়ি নাই। তবে শুনছি তিনি রাশিয়ার যে সমাজতন্ত্র তার পক্ষের লেখক। তার ফিকশনে বিষয়গুলা নাকি আছে। আমি তারও আগে যারা সায়েন্স ফিকশন লিখতেন রাশিয়ার, ছোটবেলায় সেগুলা পড়ছি। তার মধ্যে আলেক্সান্দার বেলায়েভ বা অনেকের নাম এখন মনে নাই। আমি মূলত কাহিনি লিখি। কাহিনির মধ্যে অনেক কিছু চলে আসে। আসতেই হয়। কোনো টার্গেট আমার সমাজ বা রাজনীতির জন্য থাকে না। লেখকের দায়িত্ব আমি মনে করি চরিত্র সৃষ্টি করা। এ উপন্যাসে যেমন রিমেককে তৈরি করেছি। সে একটা ক্যারেক্টার হিসেবে সমাজে বিচরণ করতে থাকলে নিজেকে সফল মনে করব। যেমন এক তরুণী উপন্যাসটি পড়ে বলছেন, যে তিনি দেড় শ বছর পরের ঢাকার, উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রিমেকের প্রেমে পড়ে গেছেন।
ওয়াহিদ সুজন: কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে আপনার আগের লেখা গল্প-উপন্যাসের অভিজ্ঞতার তফাত কেমন?
সালাহ উদ্দিন শুভ্র: কল্পবিজ্ঞানকে আমার আরও এক্সাইটিং, ইনোভেটিভ মনে হয়। ফিকশন লেখার মজাই এখানে যে, আপনি যা নাই তাকে যত আছে করে তুলতে পারবেন। সায়েন্স ফিকশনে সে মজাটা আরও বেশি আছে। অন্য ধরনের উপন্যাস লেখায় এই মজাটা প্রয়োজনেই আসে না। সে তুলনায় ঐতিহাসিক উপন্যাসকে আমার ক্লান্তিকর মনে হয়, মরবিড মনে হয়। এ উপন্যাস পড়ে যেমন একজন বললেন যে, ঢাকার রাস্তায় জ্যামে আটকা পড়ে তার বারবার মনে হচ্ছিল দেড় শ বছর পরের ঢাকায় যদি যাওয়া যেতো। এই যে একটা স্পেস ক্রিয়েট করতে পারা, আর সেটা যদি পাঠকের মনে জায়গা পায়, তাহলে তো খুব আনন্দ হয়।
ওয়াহিদ সুজন: এই উপন্যাসের মূল চরিত্র ‘রিমেক’। যে কিনা দেড়শ বছর পর অন্য একজন মানুষের শরীরে বেঁচে ওঠে। যার স্মৃতি এই সময়ের বাংলাদেশের। কেন জানি মনে হয়, এমন চরিত্র বেছে নেওয়ার কারণ, ভবিষ্যতের সঙ্গে বর্তমানের ফারাকটুকুকে আপনি আশাবাদের জায়গা থেকে দেখেন না। সে হতাশা ভবিষ্যতে ছড়িয়েছেন।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র: না কোনো হতাশা নাই। বরং আমি ফুর্তি নিয়েই লিখছি। ফুর্তির সমাপ্তি টানার চেষ্টা করছি। অ্যাডাল্ট রাখার চেষ্টা করছি। আমি ধরে নিছি, সায়েন্স ফিকশন পাঠকরা অ্যাডাল্ট হন। তাদের বোঝাপড়া অনেক লজিক্যাল হয়। হতাশার যে টোন সেটা আসলে একজন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে যে একটা অপারেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, এর যে বিস্ময় বা অসহায়ত্ব সেটা আছে। হতবিহ্বলতা আছে। যে কারণে তাকে কিছুটা হতাশ মনে হতে পারে। তবে সে কিন্তু কাটিয়ে উঠতে চায় সেই ব্যাপারটাও আছে। আরও যা আছে তা উপন্যাসটা পড়ার পরই বুঝা যাবে।
ওয়াহিদ সুজন: ‘আলোয় অন্ধ শহর’-এ এরিয়েল নামের একটা চরিত্র আছে। আউটল গোছের। তবে আইনি-বেআইনি যে ফাঁকফোকরটুকু আমরা দেখতে পাই—তেমন একটা ভারসাম্য এই চরিত্রে আছে, যার সঙ্গে রিমেকের পরিচয় হয় খারাপ একটা ঘটনায়। সমাজের রূপান্তর প্রশ্নে এ ধরনের চরিত্রগুলো অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্ব পায়। এদের একটা চাহিদাও এই সময়ের সমাজে আছে। দেড় শ বছর পরের দুনিয়ায় এরিয়েলরা শেষ পর্যন্ত কতটা গুরুত্বপূর্ণ থাকবে?
সালাহ উদ্দিন শুভ্র: এই চরিত্রটা আসলে কাহিনির প্রয়োজনে চলে এসেছে। যখন রিমেক বাসা থেকে পালায়, লজিক্যালি সে আসলে একটা আশ্রয় পায় তখন। সেই আশ্রয়টা এরিয়েলের ঘরে হলো। এখন রাতের বেলা বাইরে থাকে সাধারণত কারা? এরিয়েলের মতো কারেক্টাররাই। যারা কিছুটা অপরাধ, কিছুটা সামাজিক সেবা এসবের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। তো দেড় শ বছর পরে ঢাকায়ও এরা থাকবে। আমি উপন্যাসে বলেছিও রিমেক যে নারীদের দেখছে দেড় শ বছর পরের ঢাকায়, যার শরীরে তার মস্তিষ্ক স্থাপন করা হলো, সেই ট্রাভেলর স্ত্রী মায়শা বা বান্ধবী নিওলি—সেখানে সে আগের নারীদের সঙ্গে এদের কিছু মিল পাচ্ছে। আসলে তো কোনো কিছু প্রমাণ করার সুযোগ উপন্যাসের নাই, সেটা তার কাজও না। সব উপন্যাসেরই নিজস্ব লজিক থাকে বা প্রাসঙ্গিকতা থাকে। সেই হিসাবে এরিয়েলের মতো নিম্নবিত্ত গোছের একটা চরিত্র থাকতেই পারে বলে আমার মনে হয়েছে। কারণ আমার উপন্যাসে কোনো বিপ্লব নাই। সাধারণ চিন্তায় মনে হয় যে, হিউম্যান ক্যারেক্টার সর্বত্র, সব রকমভাবে পাল্টে যাবে না। আগেও যেমন ছিল, কোথাও কোথাও পরেও তেমন থাকবে। স্পিরিচুয়াল একটা ব্যাপার আছে। এটা অন্য আলোচনা। খুনি, জোচ্চোর, নেশাখোররা সব সময়েই থাকবে বলে আমার মনে হয়।
আলোয় অন্ধ শহর
সালাহ উদ্দিন শুভ্র
প্রকাশক: বৈভব।
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। বইমেলায় স্টল নম্বর: ৭১৮।
পাওয়া যাচ্ছে রকমারি ডটকম ও বাতিঘরে।