অনুবাদ: মোস্তাফিজ ফরায়েজী
পোলিশ লেখক ওলগা তোকারজুক তার উপন্যাসের মাধ্যমে সাহিত্য জগতের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ পরিচিত। এই বছর ২০১৮ সালের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। তার বইগুলোয় তিনি রূপকথা ও মিথের ব্যবহার করেছেন। এছাড়া, বাস্তবতার সঙ্গে ইতিহাসের সংমিশ্রণ ঘটাতেও তিনি পটু। তার বিক্ষিপ্ত উপন্যাস ‘ফ্লাইটস’ তাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ম্যানবুকার পুরস্কারও লাভ করেন। লেখালেখির পাশাপাশি ওলগা তোকারজুক রাজনৈতিকভাবে বেশ সচেতন। এছাড়া তিনি নারী অধিকার ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়েও কাজ করেন। বর্তমানে তিনি একটি পাঠক সমাবেশের জন্য জার্মানিতে অবস্থান করছেন। ওলগা তোকারজুকের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডয়েচে ভেলে’র অতিথি সম্পাদক মাইকেল গচকাভেচ। গত ১১ অক্টোবর প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি ডয়েচে ভেলে থেকে চিন্তাসূত্রের জন্য ভাষান্তর করেছেন তরুণ অনুবাদক মোস্তাফিজ ফরায়েজী।
মাইকেল গচকাভেচ: বৃহস্পতিবার যখন আপনি পটসডামে আপনার গাড়িতে উঠেছিলেন, তখন আপনি ছিলেন ওলগা তোকারজুক, একজন লেখক…
তোকারজুক: আমি আমার নতুন বই নিয়ে বিলিফেল্ডে যাচ্ছিলাম, গাড়ি থেকে নামতেই–আমি হয়ে গেলাম একজন নোবেল পুরস্কারজয়ী! সত্যি বলতে আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না, আমি নিজেকে এই নতুন পরিচয়ে এখনো দেখতে পারছি না।
মাইকেল গচকাভেচ: আপনি ‘ফ্লাইটস’-এর জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন, যেখানে আপনি বলেছেন, জিহ্বা হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে শক্তিশালী অঙ্গ। আপনার কী মনে হয় না আপনার জিহ্বা বর্তমান পোলিশ সরকারের বিষয়ে দ্বিধান্বিত? আপনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে পোল্যান্ডের সংস্কৃতিমন্ত্রী পিয়োটর গ্লিনস্কি বলেছেন, তিনি আপনার কয়েকটা বই পড়ে শেষ করবেন, এমনকি ‘জ্যাকবস স্ক্রিপচারস’-ও।
তোকারজুক: তিনি সত্যিই বলেছেন বইটি পড়বেন! তাহলে তো ভালোই। আমার বইগুলো রাজনৈতিক নয়। আমি আমার বইগুলোয় কোনো রাজনৈতিক দাবি তুলিনি। আমার বইগুলো জীবনের বর্ণনামাত্র। কিন্তু আমরা যখন মানুষের জীবনকে দেখি, তখন সবক্ষেত্রেই রাজনীতি চলে আসে।
মাইকেল গচকাভেচ: আপনার ‘ড্রাইভ ইউর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড’-এ একজন পাগলাটে বয়স্ক নারী চরিত্র আছে–যে প্রাণীদের হত্যা সহ্য করতে পারে না। এরপর হঠাৎ করেই বইটি কড়া রাজনৈতিক বিষয়ের দিকে মোড় নেয়।
তোকারজুক: এটা আমার ইচ্ছায় হয়নি। এটাকে রাজনৈতিক বইতে পরিনত হবে–এটা আমি ভাবিনি। আমি লিখি, মানুষের চিন্তাশক্তির উন্মোচন ঘটানোর জন্য, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের জন্য, মানুষ যেটাকে সুনিশ্চিতভাবে, সেটা যে সুনিশ্চিত নয়, এটা বোঝানোর জন্য। আমি বিষয়গুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করি, যেন তুচ্ছ ঘটনাও নতুন মাত্রা পায়। হঠাৎ করেই তা নতুন মাত্রায় ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। আমরা যেন আমাদের সচেতনতা প্রসারিত করতে পারি, আমাদের জীবনে যা ঘটছে, তার ব্যাখ্যা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারি। আমাদের জীবনে কী ঘটছে, তা জানতে পারি। এগুলোর জন্যই সাহিত্য।
মাইকেল গচকাভেচ: কথা প্রসঙ্গে যা আসছে, আপনার ‘ড্রাইভ ইউর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড’ গ্রন্থের প্রধান চরিত্র প্রাণীদের রক্ষা করার জন্য মানুষ হত্যা করে, যার অর্থ সে অপরাধ করছে, আবার তার মাঝে অপরাধবোধও কাজ করছে না। আপনার কি মনে হয় না যে, সে অপরাধী?
তোকারজুক: হ্যা, অবশ্যই। সে অবশ্যই মানুষ খুনের জন্য অপরাধী। আমি যখন দেখলাম, সে কী করতে যাচ্ছে, আমি এটা স্বীকারই করে নিলাম যে, তার অপরাধপ্রবণতা একটা সমস্যা। তার গল্প বলার ধরনটাই এ রকম। আমি পাঠকদের মনে দ্বিধার সৃষ্টি করালাম। পাঠকের মনে উত্তেজনা সৃষ্টি করা, সন্দেহ সৃষ্টি করা, যেটা স্পষ্ট নয়, সেই বিষয়ে কথা বলা–এগুলোই সাহিত্যের উপাদান। সাহিত্য মানেই সেটা, যা আপনার চিন্তাশক্তিকে আন্দোলিত করবে।
মাইকেল গচকাভেচ: পোল্যান্ডের সংস্কৃতিমন্ত্রী আপনার বই পড়বেন, এই সিদ্ধান্তটা নেওয়ানোর জন্য আপনাকে নোবেল পুরস্কার পেতে হলো। এখন আপনি তার সঙ্গে দেখা করবেন?
তোকারজুক: অশ্যই! আমার কখনো মনেই হয়নি যে, তিনি আমার বই পড়তে পারেন না, কিন্তু আমি জানি আমার বইগুলো সবার জন্য নয়। এটা নির্ভর করে একজন ব্যক্তির মেজাজের ওপর, সাহিত্যের স্বাদ আস্বাদনের সক্ষমতার ওপর এবং অভ্যাসের উপর। সবাইকে তোকারজুক পড়া উচিত–এসব বলে আমি তাগাদা দেই না।
মাইকেল গচকাভেচ: আপনি বর্তমান বিশ্বকে কিভাবে দেখেন?
তোকারজুক: পৃথিবী এখন দুই ভাগে বিভক্ত। কিছু লোক অতীতের চিন্তাভাবনা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। তারা অতীতের রীতিনীতি-ঐতিহ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়। অন্যরা বলে, না, যা আছে তা যথেষ্ট নয়! আমাদের এই বিশ্বটাকে যেভাবেই হোক ভিন্নভাবে তৈরি করতে হবে। অতীতের পৃথিবী একটা ধ্বংসযজ্ঞের নাম, বৈষম্যের উদ্ভাবক। আর বর্তমানে আমরা একটা সদুউত্তর খুঁজছি, আসলে কে সঠিক!
কিন্তু এই প্রশ্নটা একটা লেখকের জন্য নয়। আমার মনে হয়, এই প্রশ্নটা আপনি পোপ অথবা কোনো মহান দার্শনিককে করে দেখতে পারেন। আমি তো শুধু সততার সঙ্গে আমার গল্পগুলো বলি, যেন মানুষ এগুলো পড়তে আগ্রহ প্রকাশ করে। আর এগুলো উপভোগ করে।