রেজুয়ান মারুফ দেড়যুগেরও বেশি সময় লন্ডন বসবাস করছেন। নিজের লেখালেখি, দেশের প্রতি টান; এসব নিয়ে সম্প্রতি তিনি চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন।
চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন?
রেজুয়ান মারুফ: প্রায় কুড়ি বছর। প্রবাসে থাকার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। সুবিধা-অসুবিধা মেনে নিয়েই জীবনযাপন করতে হয়। দেশের মতো পরবাসেও অসৎ আর হিপোক্রেটদের ছড়াছড়ি, আবার ভালো মানুষেরও অভাব নেই। সব মিলিয়ে আমার কাছে অনাবাসী জীবন মন্দ লাগে না।
চিন্তাসূত্র: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
রেজুয়ান মারুফ: সুযোগ তো আসলে তৈরি করে নিতে হয়। কর্মব্যস্ততা দেশে কিংবা পরবাসে সবখানেই সমান। বিদেশে কিছু বাড়তি কাজ করতে হয়, দেশে হয়তো এই সময়টা লেখালেখিতে ব্যয় করা যায়।
চিন্তাসূত্র: দূর প্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
রেজুয়ান মারুফ: দেশ থেকে দূরে থাকলেও দেশ তো আর দূরে থাকে না, সর্বদা বুকের মধ্যেই তার বাস। শারীরিকভাবে বিদেশে আছি ঠিকই, মানসিকভাবে তো দেশেই থাকি। হঠাৎ না, সব সময়ই দেশের জন্য প্রান কাঁদে। দেশের কথা মনে পড়লে মনকে বলি, ‘মন ওরে মন, তুই কেন উচাটন?’ লন্ডন-ঢাকা তো আর ধানমন্ডি-মিরপুর না যে, মধ্যরাতে গাড়ি না পেলে হেঁটে হেঁটেই চলে যাব!
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্যচর্চায় কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
রেজুয়ান মারুফ: আমার প্রতিকূলতা হচ্ছে লেখালেখিতে সময়ের সদ্ব্যবহার করতে পারি না। একইসঙ্গে প্রকাশের অলসতা তো আছেই। আমার ধারণা, ডায়াসপোরার লেখকরা ২০ ভাগ জীবনীশক্তি দিয়ে সাহিত্যচর্চা করেন, বাকি ৮০ ভাগ শক্তি ব্যয় হয় রুটি-রুজির ধান্দায়। হাতে গোনা কয়েকজন সৌভাগ্যবান অবশ্য এর ব্যতিক্রম। লেখালেখির বাইরে তাদের হয়তো আর কিছুই করতে হয় না।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন? দিবসগুলো পালন করেন কিভাবে?
রেজুয়ান মারুফ: আমি দীর্ঘদিন ধরে পূর্ব লন্ডনে বসবাস করেছি। এখানকার বাংলা টাউন হচ্ছে তৃতীয় বাংলার কেন্দ্রবিন্দু। আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারকে ঘিরে বিজয় দিবসসহ অন্য জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হয়। সময়-সুযোগ করে সে সবে যোগ দেই। তারপরও দেশের কথা ভাবলে একটা অপূর্ণতার চিনচিনে ব্যথা তো থেকেই যায়।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
রেজুয়ান মারুফ: আমার পরিচিতরা জানেন, আমি খুব অলস লেখক। লিখি কম, প্রকাশের ব্যাপারে আমার আগ্রহ আরও কম। আগামী বই মেলায় নতুন বই প্রকাশের কোনো পরিকল্পনা আপাতত নেই।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্যচর্চা?
রেজুয়ান মারুফ: আমরা তো এখন বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা। তথ্যপ্রবাহ আর প্রযুক্তির প্রসারে সব কিছু হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেট-ব্লগ বা মাইক্রো ব্লগের কল্যাণে সাহিত্য আদান-প্রদান, যোগসূ্ত্র তৈরির কাজগুলো আজকাল অনেক সহজ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাহিত্যচর্চার বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। নিজের লেখাটা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য এখন আর অপেক্ষায় থাকতে হয় না। ‘মুঠোফোন সাহিত্য’ অসংখ্য লেখক সৃষ্টি করেছে। তাদের কারও কারও লেখা তো অসাধারণ।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
রেজুয়ান মারুফ: অনুবাদ ছাড়া তো বাংলা সাহিত্য বিশ্বপাঠককে পড়ানোর উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশার্স এবং মার্কেটিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের বেল্টের কয়েকজনের কবিতা অনুবাদ করে পরিচিত প্রকাশনী থেকে দুই শ কপি বই ছাপিয়ে মেইনস্ট্রিম মেইনস্ট্রিম করে যতই গলাবাজি করি, লেখক কপি আর সৌজন্য কপি বিতরণ শেষে দেড়শ বই থেকেই যায়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যে গুটিকয় লেখক ইংরেজিতে লেখালেখি করেন, তারা অবশ্য এই ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে পারেন।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা জানতে চাই।
রেজুয়ান মারুফ: সমৃদ্ধ সাহিত্য হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ভিত তো মজবুত। ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য ম্লান, দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়বে এ রকমটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে যারা বাংলায় সাহিত্যচর্চা করবেন, তাদের চিন্তা-চেতনার জায়গাটায় বৈশ্বিক প্রভাব অধিক হবে। ব্যারিয়ার-কাঁটাতারহীন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যই অনেক উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করবেন তারা।