মৃণ্ময়ী পুরকায়স্থ পেশায় শিক্ষক। সাহিত্যের নিবিড়পাঠক। নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগা শেয়ার করেন অন্যের সঙ্গে। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েব নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই শিক্ষক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকে র পাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারাঁ দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না।তাঁরা লিটলম্যাগ বের করতে ন। সম্প্রতি লিটিল ম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।বিপরিতে বেড়েছে অন লাইন সাহিত্য পত্রিকা বা ওয়েব ম্যাগ ।আপনি কী মনে করেন, লিটিল ম্যাগেরজায়গা টি ওয়েব ম্যাগ দখল করে নিয়েছে।
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা থেকেই লিটলম্যাগের জন্ম। যার প্রাক-শর্ত ছিল কবিতাকে পণ্য করা চলবে না। পরবর্তীকালে সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগ এতে সংকলিত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যে লিটলম্যাগ আন্দোলন এক অনন্য ইতিহাসের সৃষ্টি ছিল। শুধু বাংলা সাহিত্যে কেন, বিশ্ব সাহিত্যের কালজয়ী লেখকেরাও উঠে এসেছেন লিটলম্যাগকে আশ্রয় করে। তাদের রচনা সাহিত্য ক্ষেত্রে চিরন্তনতার প্রসাদ লাভ করেছে। আসলে লিটলম্যাগ চিরকাল অখ্যাত তরুণদের চারণভূমি। যারা লিখতেন অবাণিজ্যিকভাবে। লিটলম্যাগ শব্দটি আয়তন অর্থ নয়, সীমিত পুঁজি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। লিটলম্যাগ মূলত বিজ্ঞাপন নির্ভর। আজকের করপোরেট দুনিয়ায় অনেকেই বিত্ত ছাড়া শ্রম ও মেধা ব্যয়ে অপরাগ। লিটলম্যাগ ওয়েব ম্যাগের জায়গা দখল করে নেবে, আমি তা মনে করি না। তথ্যপ্রযুক্তির গতিময় প্লাবনে সাহিত্যের রূপ-রীতি বদল সাহিত্যের গুণগত মানকে হ্রাস করেনি। সাহিত্যরসসিক্ত রচনা চিরকাল পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। লিটিলম্যাগের ঝকঝকে মলাটের সুন্দর প্রচ্ছদ কড়কড়ে নতুন ঘ্রাণ পাতা উল্টিয়ে পড়ার আলাদা আনন্দ যেন বিন্দুতে সিন্ধুপ্রাপ্তি। তাই নিবিড় পাঠকের কাছে লিটলম্যাগের চাহিদা কোনো দিন ফুরিয়ে যাবে বলে মনে হয় না। আমার প্রিয় লেখকদের লেখা আমি ওয়েব ও লিটলম্যাগ—দুটোতেই সমান আগ্রহে পাঠ করি। সাহিত্যের পাঠক চিরকালই সীমিত। তার জন্য শুধু ওয়েবম্যাগগুলোকে দোষ দেওয়া চলবে না। অনেক ওয়েবম্যাগই পাঠককে সাহিত্য পাঠের সুযোগ করে দিচ্ছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের করা হতো। এতে খরচও হতো বেশি। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা।
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: হ্যাঁ, আসলে অনলাইন এমন একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে কম খরচে বেশিসংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায়। ‘অনুষ্টুপ’, ‘এবং মুশায়েরা’র মতো বড় আকারের লিটলম্যাগ বের হতো কিন্তু এর পাঠক-সংখ্যা ছিল সীমিত। অন্যদিকে অনলাইনে পাঠক একই খরচে অনেক ওয়েবম্যাগ পড়তে পারছে। একই খরচে জীবনের অন্যবিধ প্রয়োজনও মেটাতে পারছে।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশির ভাগওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়া লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: এই অভিযোগ অস্বীকার করার উপায় নেই, অনেক ওয়েবম্যাগেই রয়েছে ভুল বানানের ছড়াছড়ি ও সুষ্ঠু সম্পাদনার অভাব। সেটা কিন্তু বাংলা ভাষার প্রচুর ক্ষতিসাধন করছে। তরুণ প্রজম্মের এই সাহিত্যমুখী হওয়ার একটা ইতিবাচক দিকও রয়েছে। সর্বোপরি শুদ্ধ ভাষাচর্চায় যত্নবান হতে হবে।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: যুগে যুগে সৃজনশীল তরুণেরাই সবুজ করে তুলেছে সাহিত্যের বীজতলা। তাই ওদের প্রয়াসকে খাটো করে দেখা উচিত নয়। সাহিত্য প্রেমের তাগিদ ছাড়া নিছক কৃতিত্ব প্রকাশের জন্য কেউ সাহিত্যচর্চা করতে পারে না।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, না লিটলম্যাগ, না ওয়েবম্যাগে লিখতে/পড়তে পচ্ছন্দ করেন?
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: লিটলম্যাগ ও ওয়েবম্যাগ—দুটোই আমি পড়তে ভালোবাসি। ইদানিং ওয়েবম্যাগেই আমি সামান্য লেখালেখি করি।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও সীমিতসংখ্যক পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চার প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: লিটলম্যাগ যেখানে সীমিত পাঠের কাছে পৌঁছে, সেখানে অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তেই পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। ফলে লেখক-পাঠকের ভৌগোলিক দূরত্ব মুছে যাচ্ছে। লেখক নিজেকে বিনির্মাণের সুযোগ পাচ্ছেন। পাঠক ও সরাসরি তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারছেন—সহমত, প্রতিমত বা ভিন্নমত প্রকাশের মাধ্যমে। এই গ্রহণ-বর্জনের মধ্যে ক্রমাগত ঋদ্ধ হয়ে উঠছে লেখকের সৃষ্টিসত্তা। লেখক-পাঠকের এই নিবিড় সেতুবন্ধন সাহিত্যচর্চার প্রসার ও প্রচারের নব দিগন্তের সূচনা করেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকাশক-লেখক তাদের নতুন বই প্রকাশ ও পাঠ-উন্মোচনের বিজ্ঞাপন প্রচার করে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করারও সুযোগ পাচ্ছেন।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন, ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলেছে?
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: ব্যাঙের ছাতার মতো ক্রমবর্ধমান ওয়েবজিন, ব্লগজিন সম্বন্ধে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেন, আমি এর উল্টোটাই বলব। আজকে তরুণ প্রজন্ম এমনিতেই পাঠবিমুখ। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে একটি বইও পড়তে নারাজ। ওয়েবজিন, ওয়েবম্যাগগুলো যদি ওদের পাঠমুখীনতা বাড়াতে পারে, সাহিত্যপিপাসা জাগাতে পারে, তবে তাদের সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য কেন?
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: ওয়েবম্যাগের ক্রমাগত প্রসারের কাছে দৈনিকের সাহিত্যপাতা কিছুটা কোণঠাসা ও ম্লান হয়ে পড়েছে। তবে একেবারেই গুরুত্ব হারাবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
মৃন্ময়ী পুরকায়স্থ: সুস্থ চিন্তা-চেতনাই সুস্থ সমাজ মনস্কতার স্রষ্টা। আজকের বিশ্বায়নের ভোগবাদদুষ্ট সময়ের গভীরে রয়েছে অনেক চোরাস্রোত। ওয়েবম্যাগে থাকবে প্রতিস্রোতের ঢেউ। ওয়েবম্যাগে আমার সময়ের আলোকে আলোকিত সাহিত্যগুণসম্পন্ন লেখা পড়তে ভালো লাগে।