চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
লুনা রাহনুমা: একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষে আমার লেখা প্রথম উপন্যাস ‘সুখ নদী দুখ নদী’ প্রকাশিত হয়েছে এই সপ্তাহে। এটি প্রকাশ করেছে চলন্তিকা প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন সজীব ওয়ার্সি। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মণিকা নামের একজন নারী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মণিকার বন্ধুত্ব ও প্রেম হয় শুভ নামের একটি সহপাঠীর সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে মণিকার জীবনে বেশ কিছু বাঁক এবং ঘটনার পরিক্রমায় উপন্যাসের গল্প আগাতে থাকে, সেই সঙ্গে প্রধান চরিত্র মণিকার জীবনে প্রবেশ করে আরও দুজন পুরুষ অন্তু ও বশির আহমেদ। মণিকা হারায় তার একমাত্র অভিভাবক পিতাকে। উপন্যাসটি প্রধান চরিত্র মণিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও এটিকে একটি সামাজিক উপন্যাস বলা যায়। কারণ এই উপন্যাসে মণিকার দৃষ্টিতে পাঠক দেখবেন একজন নারীর চারপাশের পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ। নিত্যকার অভ্যস্ত আচারের মধ্যে সহজভাবে মেনে নেওয়া কিছু ভুল নিয়মের ব্যাপারে প্রশ্ন জাগবে পাঠকের মনে।
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
লুনা রাহনুমা: অনেক প্রকাশনী কিন্তু সারা বছর ধরেই বই প্রকাশ করে থাকে, ঠিক যেমন বেশিরভাগ লেখক সারা বছর ধরেই লিখে থাকেন। তবে একথা সত্যি যে, ফেব্রুয়ারির বইমেলার আগেআগে লেখক এবং প্রকাশদের মধ্যে একটা বেশ তাড়াহুড়ো পড়ে যায়। প্রকাশক চেষ্টা করেন শতভাগ না হলেও পঁচান্নব্বইভাগ বইই মেলার সময় প্রকাশ করতে। আমার মনে হয় এর পেছনে মূল কারণটা হচ্ছে বাণিজ্য। আমাদের দেশে পাঠক বই কিনে পড়তে চায় কম। আবার ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক পাঠকই মেলায় আসেন বেড়াতে আর বিস্তর হলেও কিছু বই কিনতে। তার ফলে প্রকাশক মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে নতুন বই এলে সেটি তাদের জন্য বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে অধিক বাণিজ্যিক সাফল্য বয়ে আনবে। মেলাকেন্দ্রিক এই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতার অবশ্যই খারাপ কিছু দিক আছে। যেমন, প্রেস এবং প্রকাশনার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে অত্যাধিক চাপ থাকায় বইয়ের মান খারাপ হতে দেখা যায়। হয়তো প্রুফ রিডিং ঠিক মতো হয় না, বাইন্ডিং কিংবা ছাপার মান ভালো হয় না, ইত্যাদি। আর আমার কাছে মনে হয় এটা পাঠকের জন্যেও একটা কঠিন প্রেশার তৈরি করে। কারণ একজন পাঠকের কিন্তু বই কেনার পেছনে নির্দিষ্ট বাজেট থাকে। তাই পাঠক চাইলেও একই সময়ে যত খুশি বই সে কিনতে পারে না।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
লুনা রাহনুমা: আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে একুশের বইমেলার উল্লেখযোগ্য একটা অবস্থান রয়েছে। আব্বার সঙ্গে বইমেলায় গিয়ে বই কিনতাম আমরা ভাই বোনেরা। আমাদের মননে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তৈরির পেছনে বইমেলায় অবদান আছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের সাহিত্যে এই বইমেলা অনেকখানি অবদান রাখছে। কারণ বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক, পাঠক, প্রকাশক, মুদ্রণসহ অনেকগুলো মানুষ একটা উৎসব উদযাপনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। একজন লেখক তার সমসাময়িক অনেকজন লেখকের লেখার সঙ্গে এবং আলাপচারিতার মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পাচ্ছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি দেশের বাইরে বসবাসরত প্রবাসী লেখক এবং পাঠকের একটা বড় অংশ এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় থাকার চেষ্টা করেন।এছাড়াও নিজের লেখাকে বিশ্লেষণ ও উন্নত করার একটা আবশ্যকতা টের পেয়ে থাকেন অধিকাংশ লেখক বইমেলার প্রাণোচ্ছ্বল আমেজে।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
লুনা রাহনুমা: আমার কাছে তো মনে হয় অধিকাংশ তরুণ লেখক চায় তার প্রথম বইটি বছরের অন্যান্য সময়ে প্রকাশিত না হয়ে একুশের বইমেলাতেই আসুক। আর প্রকাশকেরাও উৎসবের এই মৌসুমটাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আয়োজন করেন তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করতে। তরুণদের মধ্যে অনেকে হয়তো শখের বসে একটি উপন্যাস কিংবা গল্পের বই প্রকাশ করে ফেললো, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই একটি বই সেই তরুণ লেখককে অনুপ্রাণিত করতে পারে লেখালেখির ব্যাপারটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে। সত্যি সে নিজেকে একজন কমিটেড লেখক হিসেবে পরিচিত করতে পারে ভবিষ্যতে।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
লুনা রাহনুমা: বর্তমানের পরিপেক্ষিতে এটি একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়: প্রকাশিত বইয়ের মান, অর্থাৎ লেখার মান। ফেইসবুকে লেখালেখির কারণে অনেক লেখক তৈরি হয়েছে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে। তারা অনেকে লেখার মান উন্নয়নের চেয়ে বেশি মনোযোগী নিজের নাম প্রচারে এবং বই বিক্রিতে। অসংখ্য নতুন লেখকের ভিড়ে হিমশিম খেতে হয় নতুনদের মাঝে হিরের টুকরোগুলোকে খুঁজে বের করতে। কারণ, অতিরিক্ত পুস্তক প্রকাশিত হওয়ায়সব লেখা সব পাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আর এই ব্যাপারটি অবশ্যই আমাদের সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর একটা দিক। অসংখ্য মানহীন এবং গুণহীন পুস্তকে ভরে উঠছে আমাদের বইমেলার প্রাঙ্গন। পুস্তক প্রকাশকেরা যদি পাণ্ডুলিপি নির্বাচনের ক্ষেত্রে একমত হয়ে নীতিগতভাবে কিছু কাঠামো তৈরি করে নেন নিজেরদের মধ্যে এবং তা অনুসরণ করেন, তাহলে হয়তো এই সমস্যার সমাধানে কিছুটা কাজ হতে পারে।