হারুন পাশা—গল্প ও উপন্যাস লেখেন। সম্পাদনা করেন ‘পাতাদের সংসার’ নামে সাহিত্য পত্রিকা। প্রকাশিত গ্রন্থ তিনটি। অল্প কিছুদিনের ভেতর প্রকাশিত হবে ‘তিস্তা’ উপন্যাস। এটি ধারাবাহিকভাবে চিন্তাসূত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই তরুণ সাহিত্যিক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
হারুন পাশা: জায়গা দখল-বেদখলের ব্যাপার নয়। ব্যাপারটা হলো—সবাই চেষ্টা করে কিংবা করেছে পাঠককে কিছু দিতে। এমন অনেক সাহিত্যিক আছেন, লিটলম্যাগ যাদের সাহিত্যসাধনার পীঠস্থান কিংবা বলা যায় সূতিকাগার। এখনো অনেকেই লিখছেন লিটলম্যাগে, জাতীয় দৈনিকে লিখছেন না। দৈনিকের অনেক ব্যাপার-স্যাপার থাকে, যেমন শব্দসংখ্যা ধরিয়ে দেওয়া। এমন ধরাধরিতে সাহিত্য ঠিক হয়ে ওঠে না। একটা গল্প হাজার পনেরো শো শব্দে ঠিকঠাক প্রকাশ পায় না। এক্ষেত্রে লিটলম্যাগ বেশ উদার, ওয়েবম্যাগ তো অবশ্যই। লেখক প্রয়োজনীয় শব্দ নিয়ে একটি গল্প দাঁড় করাতে পারেন। এখানে লেখক নিজের তৃপ্তি খুঁজে নিতে পারেন। আবার দৈনিকে একটি লেখা প্রকাশিত হলে বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছায়, এটাও হতে পারে লেখকের আরেক তৃপ্তি। তখন সে লেখা ছোট করে ‘অলেখাও’ ছাপতে আগ্রহী হয়। যখন ওয়েবম্যাগ এত সহজলভ্য ছিল না, তখনো তো সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশ যথানিয়মে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সৃষ্টিকর্মকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় আনতে গেলে লিটলম্যাগের ভূমিকার কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এক্ষেত্রে জাতীয় দৈনিক কিংবা ওয়েবম্যাগ খুবই অসহায়। কেননা তারা সর্বোচ্চ দু্-চারটা লেখা ছাপতে পারে কোনো সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে ঘিরে। এখানে লিটলম্যাগ এ+ পেয়ে যায়, ওই দুই প্রকাশ মাধ্যম থেকে আলাদা হয়ে যায়। আমরা যতই বলি না কেন হারিয়ে যাচ্ছে লিটলম্যাগ কিংবা সংখ্যা কমে যাচ্ছে, এই বাড়া-কমা সব সময়েই ছিল। যেমন ছিল এবং আছে দৈনিক ও ওয়েবম্যাগও। ওয়েবম্যাগ তার অবস্থানে ঠিক আছে, লিটলম্যাগ তার অবস্থানে এবং দৈনিকও তার অবস্থানে ঠিক আছে। কেউ কারও অবস্থান নিতে পারে না, বরং সহযোগী হতে পারে।‘একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন।’ এটা হতে পারে কিংবা নাও হতে পারে, নিশ্চিত হয়ে বলতে পারলাম না, কারণ সেই সময়টায় আমার উপস্থিতি ছিল না।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
হারুন পাশা: ঝোঁকাঝুঁকির ব্যাপার নেই। যে যেখানে সহজ মনে করছে সে সেখানে যাচ্ছে এবং অতীতেও গিয়েছিল। লিটলম্যাগের অর্থ সংকট নতুন কোনো ব্যাপার নয়, আগের মতো এখনো বর্তমান। ওয়েবম্যাগে তারা ভালো করছেন এবং করবেন। তবে অন্য প্রকাশ মাধ্যমের সঙ্গে কেনই বা এই তুলনা, ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
হারুন পাশা : কোনো কিছু বাস্তবে থাকলে সেটা ফেনিয়ে বড় করা যায় এবং বড় হয়। হয়তো কিছু ওয়েবম্যাগে আছে এ সমস্যা। সেখান থেকেই ঢালাও এ মন্তব্য এসেছে। এক্ষেত্রে সম্পাদক কিংবা সহযোগীদের সতর্ক হতে হবে।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
হারুন পাশা : পাওয়ার কে না হোল্ড করতে চায়? আপনি চারপাশে খোঁজ রাখার চোখে তাকালে দেখতে পাবেন একজন রিকশাচালক কিংবা বাদাম বিক্রেতা কিংবা হকার কিংবা হেল্পার পাওয়ার হোল্ড করতে চায় এবং সময় সুযোগ আসলে তারা এর সদ্ব্যবহার করে। অথচ তারা নিম্নবর্গ। সাহিত্যরাজ্যেও এ থাকবে, থাকাটা স্বাভাবিক, সাহিত্যিকরা তো উচ্চবর্গ (হা হা হা)। আমরা কেবল কর্তৃত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে না দেখে যদি বলি, এগুলোও সাহিত্য-সেবার উপায়, তাহলে মন্দ হবে না। সেখানে আরও অনেকেই লেখার সুযোগ পাচ্ছেন। নিজের চিন্তা কিংবা প্রকাশের সংখ্যায় তৃপ্ত থাকতে পারছেন। ভুল-ত্রুটিও বুঝতে পারছেন এবং সংশোধনীর মাধ্যমে নিজেকে আরও আপডেট করতে পারছেন। কারণ, একটা লেখা প্রকাশিত হয়ে গেলে সেখানে ভুল কিংবা দুর্বলতার মাত্রাটা নির্ণয় করা যায়, যা প্রকাশের আগে চোখে নাও আসতে পারে।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
হারুন পাশা: এ অভিযোগটা প্রায়ই শুনি। কিন্তু এ মাধ্যমগুলো পাঠককে বই বিমুখ করতে পারবে না কখনোই। বরং বই পাঠে সহযোগী হবে। সহযোগী হবে এভাবে যে, ওইসব মাধ্যমে কোনো কিছু জানতে পেয়ে ওই লেখা কিংবা লেখক সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে তার বড় কিংবা অন্য কোনো লেখায় আগ্রহী হবে। বই পড়া তৃপ্তি কিন্তু অনলাইনে পড়ার মতো নয়। অনলাইনে কোনো কিছু পড়লে মনোযোগ দীর্ঘসময় ধরে রাখা সম্ভব নয়, মাথা ধরা ও চোখের সমস্যা বৃদ্ধি পায়। এখন না, পরে পড়বো, এজন্য অনলাইনে পাতা ভাঁজ করে রাখা যায় না। এমন অনেক কারণে পাঠক বইয়েই ফিরে আসবে এবং ফিরে তো আছেই। নইলে এত এত বই বিক্রি হয় কেমন করে? এত এত প্রকাশনী টিকে আছে কেমন করে? তাই বলা যায়, ওই মাধ্যমগুলি পাঠককে বই বিমুখ না করে ‘বইপ্রিয়’ করে তুলবে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
হারুন পাশা: আমি এর সব মাধ্যমেই পড়তে পছন্দ করি, কিন্তু হার্ডকপি বেশি পছন্দ করি। লেখার ক্ষেত্রে তিন মাধ্যমই পছন্দের।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
হারুন পাশা : এখানে একটা কথা আছে, ওয়েবম্যাগ কেবল লাখ লাখ ইউজারের হাতে পৌঁছলেই হবে না, তারা পেজ ওপেন করে পড়ছে কি না, এটাও নজরে রাখতে হবে। হার্ডকপি হলে পেজ ওপেন হতে যে সময় লাগে সেই সময়ে পাঠক লেখার কিছু অংশ পড়ে ফেলতে পারে। অনেকের কাছে পৌঁছানোর প্রবণতা মানুষের সহজাত। তাহলে মানুষের তৈরি প্রচার মাধ্যমগুলো এর বাইরে কেন থাকবে? সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে ওয়েবম্যাগের এ চেষ্টা ভালো ও নান্দনিক। একটু আগেই বললাম, পাঠক পেজ ওপেন করে পড়ছে কি-না সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ওয়েবম্যাগ আরও পাঠপ্রিয় হোক!
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
হারুন পাশা : সব দৈনিক তো সাহিত্য করে না, এটা আমরাও জানি। যারা সাহিত্য করার তারা করবেই। যাদের টিকে থাকা দরকার তারা তেলাপোকার মতো করে হলেও টিকে থাকবে। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
হারুন পাশা: বাংলাদেশের সাহিত্যকে তারা আলোচনা-সমালোচনায় বেশি গুরুত্ব দেবে, এটাই চাওয়া। অর্থাৎ বাংলাদেশের সাহিত্যের খুঁটিনাটি দিক তারা প্রকাশ করবে মূল রচনার সঙ্গে। নবীন-প্রবীণের সৃষ্টিশীল রচনা এবং সেসবের আলোচনাও ছাপবে বিশেষ আয়োজনে। এ ঘর ফিলাপের পর কিংবা ফিলাপের প্রবণতা বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরের দেশের সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার টেক্সট, আলোচনা, সমালোচনা প্রকাশ করে লেখক ও পাঠককে সমৃদ্ধ করুক।