সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মানেই দরজা-জানালা খোলা তরতাজা মন। সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে আর আমাদের মধ্যে সশরীরে নেই, এটাই যে জীবনমৃত্যুর চিরন্তন খেলার শেষ কথা। মেনেও কি তা মানা যায়? অর্ধশতাব্দীরও বেশি বাংলা সাহিত্যে উঠোনে যাঁর রাজকীয় বিচরণ, প্রতিভার মহিমাকে যিনি আড়াল করে রাখতেন আয়াসহীন লাবণ্যে, তাঁর প্রয়াণে দুই বাংলায়, বাংলা ভাষা বলা-লেখা-শোনার মানুষদের কাছে স্বভাবতই এক গভীর বেদনার পরিস্থিতি নির্মিত হয়েছে। কিন্তু না, মৃত্যু তাঁকে দূরে নিয়ে যেতে পারেনি। কবিতার জন্য যিনি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করতে পারেন, তিনি তাঁর পাঠকদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন চিরদিন। অন্তত, যতদিন জেগে থাকবে বাংলা ভাষা। এই কবির জীবনাবসানের মাত্র কয়েকদিন আগে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রেজা নুর সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘অনুরণন’-এর কলকাতা প্রতিনিধি স্বপ্না গুহ ঠাকুরতা। সম্ভব এটিই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষ সাক্ষাৎকার। চিন্তাসূত্রের পাঠকদের জন্য এখানে পুরোসাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো
স্বপ্না গুহ: আপনি এত বড় একজন জনপ্রিয়, ব্যস্ত মানুষ। অথচ প্রতিদিন এত লোকের সঙ্গে দেখা করেন, যে যেখানে ডাকে, কাউকেই ফিরিয়ে দেন না! কিভাবে পারেন এতটা আন্তরিক থাকতে?
সুনীল: (মুখের হাসি রেখে) মানুষের ভালোবাসা উপেক্ষা করব কী করে? আমার কোনো অসুবিধে হয় না। যতদিন পারব করব। আর আন্তরিকতার কথা বলছ? ছোটবেলা থেকেই সংসারে অনটনের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি। আমার বাবা ছিলেন মাস্টার মশাই। এসব কারণেই হয়ত অন্যরকম হওয়ার কথা কখনো মনে হয়নি।
স্বপ্না গুহ: সাহিত্য করতে এসে কখন বুঝলেন সুনীল গাঙ্গুলী একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন?
সুনীল: বুঝিনি কখনো। আজও বুঝি না। সে রকম ভাবিনি। তবে সাহিত্য জগতের সঙ্গে সম্পর্কটা যে একেবারে খুবই নিবিড় হয়েছে, সেটা বলতে পারি। লেখার বেলায় আমার যখন যা মনে হয়েছে, তাই লিখেছি। কেউ আমাকে লিখতে বাধ্য করেনি। আমি কোনও উদ্দেশ্য নিয়েও লিখিনি। ভালো লেগেছে তাই লিখেছি।
স্বপ্না গুহ: ব্যক্তি সুনীল আর কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে তফাৎ আছে?
সুনীল: কোনো তফাৎ নেই। আমি তো বেশির ভাগই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখেছি। আগেকার বইগুলো, যেমন: অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী, আত্মপ্রকাশ, সবই কোনো না কোনোভাবে আমার নিজের জীবনের ঘটনা।
স্বপ্না গুহ: এখনো কি বিশ্বাস করেন, বাংলা উপন্যাসের চেয়ে বাংলা কবিতার মান উন্নত?
সুনীল: হ্যাঁ, এখনো করি। উপন্যাসে সত্যিকারের যে বাঁধুনি থাকার দরকার, চরিত্রগুলোর গভীরে ঢোকা দরকার, সে রকম উপন্যাস অনেক দিন পাচ্ছি না। তার বদলে তরুণ কবির দল কবিতা ভালো লিখছে এবং এই সময় রিমার্কেবল ব্যাপার হচ্ছে যে, অনেক মেয়ে এগিয়ে এসেছে কবিতায়। তারা হয়ত অন্য কিছুও লেখে কিন্তু কবিতা বেশি চোখে পড়ে। এমনও হয়েছে, কোনো একটি বড় সংকলনে মন্দাক্রান্তা সেনের কবিতাটিই সবচেয়ে ভালো। অথচ তার বয়স কিন্তু বেশি নয়! এই যে মেয়েদের সাহিত্য জগতে আসা, এটা আমি খুব ভালোভাবে দেখি।
স্বপ্না গুহ: ইদানিংকালের আধুনিক কবিরা ফেসবুকে কবিতা আপলোড করেন এবং দেখা যায় প্রচুর ‘লাইক’ বা ‘কমেন্ট’ও পড়ে তাতে। কিন্তু আসলেই কি এভাবে কবিতার মান যাচাই হবে?
সুনীল: দ্যাখো, ফেসবুক ব্যাপারটা আমি জানি না। আমি কম্পিউটার অভ্যস্ত নই। লোকের মুখে শুনি বটে, আমার নিজের করার সৌভাগ্য হয়নি। তবে, ওটা বোধহয় বন্ধুর সংখ্যার ওপরেই নির্ভর করে। যার যত বন্ধু, তার তত কমেন্ট। যত দিন যাবে, নব-নব পদ্ধতি আসবে। কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম ছাপাখানার বই। চারশত বছর ধরে আমরা ছাপাখানার মাধ্যমে সাহিত্যকে পেলাম। এবার মনে হচ্ছে, সাহিত্য আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এসেছে। তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তবে সেটা আমি আর পারব না।
স্বপ্না গুহ: ভেবে দেখুন তো, আপনার ‘কেউ কথা রাখেনি’-র সময়ে এই ফেসবুকের ব্যাপারটা থাকলে লাইক বা কমেন্টের সংখ্যা কত দাঁড়াতো?
সুনীল: (হাসতে হাসতে) সেই তো! মজার কথা হলো, কবিতাটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল বটে, কিন্তু আমি লিখেছিলাম খুবই ক্যাজুয়ালি। ভাবলাম, কোনোরকম মিটে গেলেই হলো। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক নিজে নিজেই কবিতাটি জনপ্রিয় হয়েছিল।
স্বপ্না গুহ: বাংলাদেশের কবিতা ও পশ্চিমবঙ্গের কবিতার যে বর্তমান ধারা, তার মধ্যে মৌল পার্থক্য কী মনে হয়?
সুনীল: মৌল পার্থক্য বলতে কিছু নেই। ওরা যে ভাষায় লেখে আমরাও সেই ভাষায় লিখি। ড. শহিদুল্লাহ এবং অনেকের প্রচেষ্টাতে যা সুফল হয়েছে…। ভাষাটা বদলে যায়নি। পূর্ববাংলা এখন বাংলাদেশ। তার সঙ্গে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার বাংলা ভাষার কোনো তফাৎ নেই। ওরা যদি কোনো বিশেষ জেলার ভাষা অবলম্বন করতো…ধরো, চিটাগাঙ-এর ভাষা। তাহলে আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না। কিন্তু যেহেতু পারি, ওদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগে সামরিক শাসন, স্বেচ্ছাচারী শাসন এসে পড়ে। আমাদের এখানে যতই আমরা দুর্বলতা দেখাই, তবু কিন্তু গণতন্ত্রকে ধরে রাখতে পারি। পাঁচ বছর পরপর আমরা নির্বাচন করি। ফলে আমরা একটা গণতান্ত্রিক আবহাওয়ায় থাকি। ওরা অনেকবারই থাকতে পারেনি বলে ওদের কবিতায় প্রতিবাদের ভাষাটা বেশি জোরালো থাকে। ওদেশের নামকরা কবিরা কখনো কখনো শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় লেখে। আমাদের দেশে অত কড়া ভাষায় লেখার দরকার হয় না। তবু আমাদের সমালোচনা করার অধিকার আছে। নতুন কিছু করার জন্য পরিকল্পনা আমরা চালু করতে চাই। এছাড়া দুই দেশের কবিতার ভাষায় কোনো তফাৎ নেই।
স্বপ্না গুহ: প্রবাসী বাঙালিদের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
সুনীল: আমি যখন বিদেশে বহু বছর আগে গিয়েছিলাম, তখন ওখানকার, বিশেষ করে মার্কিন দেশে বাঙালি যে লেখক, কবিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হতো, তাতে দেখতাম, তারা অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলা কবিতা এখানে যেভাবে এগোচ্ছে, যারা বিদেশ থাকে, তারা তা ধরতে পারে না। তখন আমি ঠিক করলাম, আমার পক্ষে ওদেশে থাকা সম্ভব নয়। জোর করেই চলে এলাম। কারণ বাংলায় লিখব এই পোকাটা মাথায় ঢুকেছিল। এখন কিন্তু অনেকটাই পাল্টে গেছে। এরপরে আরও কয়েকবার ইউরোপ, আমেরিকায় গিয়ে দেখেছি, অনেক কবিতা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। নিউইয়র্কে তো একাধিক হয়েছে। তাঁরা এখন সৃষ্টিশীল। তাঁরা কবিতা লিখছেন, প্রবন্ধ লিখছেন, গল্প-উপন্যাস লিখছেন। পত্রিকা প্রকাশ করছেন। বাংলা সাহিত্যের জন্য অবশ্যই আশান্বিত একটি দিক। আমি যদি একটা অল্পবয়সী ছেলে হতাম আর এই প্রথমবার বিদেশে যেতাম হয়তো, আমিও থেকে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কারণ এখন আমার মনে হয় যারা বিদেশে থাকে, তারা ভালোই লেখে।(ভ্যাসপোরার বঙ্গ সম্মেলনের) মাঝে মাঝে যে বিদেশে কনফারেন্স হয় সেখানের উপস্থিতি বেশ জোরালো হয়। সুতরাং তাদের প্রতি জানাচ্ছি আমাদের শুভেচ্ছা।
স্বপ্না গুহ: বিদেশে এই যে বঙ্গ সম্মেলন হচ্ছে এগুলো কি সত্যি উপকার করছে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য?
সুনীল: এসব তুলনা করার কোনো মানে হয় না। তুলনা করাও যাবে না।
স্বপ্না গুহ: সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
সুনীল: দেখো, একটা চেঞ্জ তো হয়েছেই। বেশির ভাগ সাহিত্যটার এখন আর খুব বেশি মূল্য থাকছে না। তার বদলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এইগুলো প্রধান হয়ে উঠেছে। আর কিছুদিন বাদে যদি বাংলা সাহিত্য উঠে যায়, তাহলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এরপর সাহিত্য না থাকলেও ভূতের গল্প, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, এগুলো থাকতে পারে। যেগুলো পুরোপুরি সাহিত্য নয়। দেখা যাক কী হয়।
স্বপ্না গুহ: সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যে কার কার গল্প, উপন্যাস আপনার ভালো লাগে। তাদের সম্পর্কে অল্প যদি কিছু বলেন…।
সুনীল: এখন আর অত মাথা ঘামানোর সময় আমার নেই। একসময় প্রচুর বই পড়তাম। বিদেশে নতুন নতুন কী লেখা হতো, সব পড়তাম। এখন আর আমি অত পড়ি না। একমাত্র রেফারেন্স বই ছাড়া আর কিছু পড়া হয় না। ধরো, অনেক সময় কেউ একটা কবিতার বই পাঠিয়ে দিলো, সেটা হয়ত পড়ে দেখি। এর থেকে বেশি জ্ঞান আমার নেই।
স্বপ্না গুহ: সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে, উৎকৃষ্ট শিল্পমান সম্পন্ন একটি লেখার জন্য আড্ডার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
সুনীল: শোনো, উচ্চ অর্থসম্পন্ন লেখার জন্য কোনো রকম শর্তের প্রয়োজন নেই। যেহেতু, বাঙালির জীবনে আড্ডা একটা প্রধান ব্যাপার, কাজেই সেটাও এড়ানো যায় না। অনেক সময় আড্ডা থেকে নতুন কোনো চিন্তার খোরাক পাওয়া যায়। আমি অবশ্য আড্ডা দিতে ভালোবাসি কিন্তু লেখার সময় সে সব মনে থাকে না।
স্বপ্না গুহ: আপনার মতে, কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্থান বাংলার কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরেই। তবে জনপ্রিয়তার দিক থেকে তিনি শরৎচন্দ্রকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁকে নিয়ে এই আবেগের কারণ কি?
সুনীল: আগে অনেককে বলতে শুনেছি যে, হুমায়ূন তো হালকা লেখে। ওর মধ্যে কোনও গভীরতা নেই। আমি হুমায়ূনের অনেক লেখা পড়েছি। ওর লেখার বিষয়বস্তুও একদম আলাদা। ভ্যারাইটি লিখেছে এবং খুব সরল বাংলায় লেখা তার। অনেকেরই ধারণা নেই সরল ভাষায় লেখা কত কঠিন! বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় আমি তাকে অংশ নিতে দেখেছি। এরপর সে স্বাধীন বাংলাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সে যেমন ছিল একজন বড় মাপের লেখক, তেমনি ছিল মানুষ হিসেবে বড্ড ভালো। বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। স্নেহভাজন না বলে বন্ধুই বলি। মাঝে-মাঝে যখন একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, দেখেছি, কি চমৎকার মানুষটি! কবিতা লেখেনি কখনো। গান ভালোবাসত এবং লিখেছেও। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে মজার মজার কথা বলত। কারোর সম্পর্কে কোনো নিন্দাবাদ তার মুখে শুনিনি। ফলে আমি হুমায়ূনকে বেশ বড় জায়গায় স্থান দেই।
স্বপ্না গুহ: নীললোহিতের সব কাহিনীতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ এবং সে বেকার। সাতাশের বেশি তার বয়স বাড়েনি কেন?
সুনীল: বাড়লে তো অন্যরকম গল্প লেখা হতো। একটা বেচারা নীললোহিত বাউণ্ডুলের মতো। এ রকম চরিত্র তো আছে আমাদের দেশে। সুতরাং আমি সেটাকে স্ট্যান্ডার্ড করে দিয়েছি। আর দেখবে তুমি, গল্প বা উপন্যাসে যদি না লেখক আগে চরিত্র ঠিক করে না রাখে, এদের চরিত্রগুলোর বয়স বাড়ে না। সেই জন্যে আমি নীললোহিতকে এক জায়গাতেই রেখে দিয়েছি। আর একটা সিরিজ লিখি কাকাবাবু। তার যদি ঠিকঠাক বয়স মেনে লিখতাম, তাহলে তার বয়স এখন হতো নব্বই। ওরাও তো একই জায়গায় থেকে আছে। নতুন যুগের পাঠক আসছে তো… তাদের ওইভাবেই দেখানোর জন্য চরিত্রগুলোর বয়স বাড়ে না।
স্বপ্না গুহ: কবি জীবনানন্দ দাশের যেমন ছিল বনলতা সেন, তেমনি আপনার মনে ঝংকার তুলেছিল নীরা। এই নীরাকে কোথায় পেয়েছিলেন? না কি ছুঁয়েছেন কেবল স্বপ্নে মাত্র?
সুনীল: দ্যাখো, নীরা সম্বন্ধে আমি অনেকবার বলেছি। ওকে নিয়ে যে আমার কবিতাগুলো আছে, সব প্রশ্নের উত্তর ওই কবিতার মধ্যেই পাওয়া যাবে। আমি নিজের মুখে কিছু বলব না।
স্বপ্না গুহ: প্রেম এমন একটা জিনিস, বয়স নেই, অবিবাহিত বিবাহিত নেই। সবাই কোনো না কোনো সময়ে প্রেমে পড়ে, একাধিক কারও। প্রেম কি ব্যধি, না কি ব্যধির মুক্তির জ্যোতি?
সুনীল: প্রেম এমন একটা ব্যাপার প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এক একটা আলাদা রূপ পায়। প্রেমের কোনো ফরমুলা নেই যে, এইগুলো মানলে প্রেম হবে আর এগুলো মানলে প্রেম হবে না। এ একপ্রকার নেশা। এই প্রেমে কাউকে অনেক বেশি কাঁদায় আবার কাউকে হাসায়। বাস্তবতা বোঝা সত্যিই কঠিন! আজ যে প্রতিটা মুহূর্ত প্রেমের মোহে হাবুডুবু খাচ্ছে, কয়েকদিন পর তার জন্যই হয়ত অপেক্ষা করছে হতাশা। তবু প্রেম থাকবে। দেশের প্রতি প্রেম, সন্তানের প্রতি প্রেম, নারীর প্রতি প্রেম…আশা করি এভাবেই চলবে।
স্বপ্না গুহ: বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ককে আপনি কোন চোখে দেখেন?
সুনীল: আমি দেখি মানুষের স্বাধীনতার ব্যাপারটা। বিবাহ করলেই যে একটা ছেলেমেয়ে দণ্ডিত হয়ে গেল, আর কারোর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না, বেড়াতে পারবে না, এটা আমি মানি না। এজন্যই নারী বা পুরুষ কেউ যদি মনে করেন যে, আমি এই সম্পর্কে থাকতে পারছি না, আমার মতে, অনায়াসেই আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত। কারণ ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আমি বিশ্বাসী।
স্বপ্না গুহ: গ্রেট যাঁরা, এই ধরুন রবীন্দ্রনাথ। এঁরা কি সেক্স কনসেপ্টটা পুরোপুরি নিজের স্ত্রীর সঙ্গে আনতে পারেননি?
সুনীল: (হাসতে হাসতে) এ কথা আমি জানব কী করে? এ তো গোপন কথা!
স্বপ্নাগুহ: রঞ্জন বন্দোপাধ্যায়ের কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড-নোটে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এই চিঠি সম্পর্ক আপনার কী মন্তব্য?
সুনীল: রবীন্দ্রনাথ একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। সাধারণ মানুষের মতো কেঁদে যেমন তিনি কখনো তার শোক প্রকাশ করেননি, তেমনি তাঁর প্রেমের বেলায়ও…নারীর প্রতি প্রেম তো থাকবেই। তাঁর প্রেম বিরহ, দুঃখ-কষ্ট, শোক সব কিছুই তিনি লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। এর বেশি আমার জানা নেই।
স্বপ্না গুহ: লেখক হিসেবে সবচেয়ে বড় সাফল্য কোনটি?
সুনীল: বড় সাফল্য পাঠকদের অনুভূতি, রি-অ্যাকশান। আমি ডিটেলস্ বলব না, একটা ঘটনা বলি, জার্মানিতে একটি মেয়ে আমায় বলেছিল, তার একসময় খুব অসুখ হয়েছিল। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তাররা বলেছিলেন, ওর কোনো আশা নেই। মেয়েটি বাংলাদেশের। ‘ও’ ডাক্তারকে নাকি তখন বলেছিল যে, আমি ‘পূর্ব পশ্চিম’ নামের একটা উপন্যাস পড়ছি। ওটা শেষ না হলে আমি মরতে রাজি নই। ওই মোটা বইখানা ধরার মতো মেয়েটার তখন শক্তি ছিল না। ওর বুকের ওপর নার্স বইখানা ধরে রাখত আর ‘ও’ পড়ত। মাঝে মাঝে নার্স পাতা উল্টে দিত। পরে মেয়েটা আমায় বলেছিল, বইটাও আমার শেষ হলো না তখন, আর আমিও মরে গেলাম না! এই সব শুনলে মনে হয়, এর চেয়ে নোবেল প্রাইজও আমার কাছে বেশি নয়।
স্বপ্না গুহ: ‘কবি’ ও ‘কথাশিল্পী’ সত্তার মধ্যে আপনার কাছে কোনটা বেশি আনন্দদায়ক?
সুনীল: আনন্দদায়ক যদি বলো, তবে ‘কবি’ সত্তা। কথাসাহিত্যে বেশি পরিশ্রম করতে হয়।
স্বপ্না গুহ: নিজের কোন্ লেখাটা আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
সুনীল: যে লেখাটা এখনো লেখা হয়নি।
স্বপ্না গুহ: এই বয়সেও এত খ্যাতি, প্রশংসা ফ্যান ফলোয়িং…এক কথায় বাঙালির আইকন। জীবনের এই অধ্যায়টি নিশ্চয়ই বেশ উপভোগ করছেন?
সুনীল: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। তবে প্রাথমিকভাবে আমি বাঙালি। বিদেশে যখন যাই, তখন ভারতীয়। আবার যখন বুদ্ধিজ্ঞান সম্পন্নদের মধ্যে কোনো কথা বলতে চাই, তখন আমি বাঙালিও না, ভারতীয়ও না। আমি বিশ্বনাগরিক।
স্বপ্না গুহ: মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে, হিংস্রতাও বাড়ছে। মনুষ্য সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ধরনের বাণিজ্যিক লেনদেনের মতো?
সুনীল: মানুষ এখন আর যথেষ্ট সৎ, সভ্য, শালীন নয়। সব মানুষ নিজের পাতে ঝোল টানে। মানুষ হচ্ছে হিংস্র প্রাণী। সমস্যা সমাধানে এই হিংসা কোনো পন্থা নয়। তবু অন্যান্য জন্তুর মতোই মানুষের মধ্যে কারও কারও প্রবৃত্তি থাকে অন্যদের দমন করার। পায়ের তলায় রাখার। এখন সভ্যতা হয়েছে বলে এটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ওই যে প্রবৃত্তি, সেটা থাকবেই।
স্বপ্না গুহ: একজন জনপ্রিয় ভারতীয় সাহিত্যিক। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, সাংবাদিক, কলামিস্ট। বর্তমানে ভারতের জাতীয় সাহিত্য একাডেমির সভাপতি। কাকে কত নম্বর দেবেন?
সুনীল: জাতীয় সাহিত্য একাডেমির সভাপতি আর মাত্র তিন মাস আছি। (একটু ভেবে) এদের মধ্যে কাউকেই নম্বর দেব না। আমার এই বিভিন্ন রূপকে মাত্র উপভোগ করি। পাঠকদের নানান রকম প্রতিক্রিয়া দেখে অনেক সময় মজাও পাই। এইভাবেই চলছে…
স্বপ্না গুহ: নোবেল প্রাইজের ব্যাপারটা নিয়ে বারবার কথা বলাটা আপনি হ্যাংলামি মনে করেন। কিন্তু এটা তো ঠিক আপনার ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’ সেই সম্মানের যথাযথ যোগ্যতার মাপকাঠির অনেক উর্ধ্বে?
সুনীল: ব্যাপারটা হচ্ছে, এটা কিছু করার নেই। কারণ অনুবাদ বইকে নোবেল প্রাইজ কমিটি পাত্তা দেয় না। আমরা তো ইংরেজিতে অত দক্ষ নই। এখন ভারতীয়রা অনেকে অবশ্য লিখছে ইংরেজি ভাষায়। কিন্তু আমি দক্ষ নই। আমি তো ভালোই আছি। নোবেল প্রাইজে অনেক টাকা পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু এখন তো অত অভাব অনটন নেই। অত টাকা না পেলেও চলবে। তাই বেশ আছি, এই নিয়ে আর মাথা ঘামাই না।
স্বপ্না গুহ: বর্তমান প্রজন্মের জন্য আপনি কী বলবেন?
সুনীল: একটাই কথা আমার, হাত খুলে লেখো।
স্বপ্না গুহ: এই যে সিগারেট খাচ্ছেন আর কাশছেন, সিগারেটের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপনের ছবিগুলো দেখলে ভয় লাগে না?
সুনীল: আরে কেউ কেউ কষ্টতে আনন্দ পায়। আমারও হয়েছে সেই অবস্থা। কাশিতে যেটুকু কষ্ট পাচ্ছি, তার চেয়ে আনন্দটা বেশি পাচ্ছি যে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই তো অ্যাদ্দিন চলল। ধূমপান ছাড়লে এখন কি বহুদিন বাঁচার গ্যারান্টি দেবে কেউ?
স্বপ্না গুহ: অসীম বলে কিছুই নেই জীবনে। সবকিছু সময়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ। এসবে প্রভাবিত হয়ে কখনো অবসন্নতা আসে?
সুনীল: না, এসব নিয়ে কখনো ভাবি না। সময় যখন শেষ হবে, ওটাকে তো লঙ্ঘন করা যায় না! বেশি ভাবতে গেলে যে এ ক’টাদিনও নষ্ট হয়ে যাবে…
স্বপ্না গুহ: আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন। এই ফিলিংসটা কেমন?
সুনীল: এই চিন্তাটাও আমার কখনো হয় না। আমিই নেই আর আমার লেখা পাঠক পড়ছে, এতে কী যায় আসে? আমি খুব ভাগ্যবান। সারাজীবন নিজের আনন্দের জন্যই লিখেছি।
- প্রথম প্রকাশ: অনুরণন, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩