আঞ্জুমান রোজী—১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি কানাডা প্রবাসী। প্রবাসে সাহিত্যচর্চার বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তাসূত্রের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন।
আঞ্জুমান রোজী: প্রবাসে আঠারো বছর ধরে আছি। মনে হয় শূন্যে ঝুলে আছি। এক যান্ত্রিক ও অনুভূতিহীন অসার জীবন বলতে পারেন।
চিন্তাসূত্র: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
আঞ্জুমান রোজী: একদম সুযোগ পাই না। প্রচুর ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। অবশ্যই তা জীবনজীবিকার জন্য। লেখার জন্য রাত জাগতে হয়। তখন পরদিন কাজে যেতে ভীষণ কষ্ট হয়। এছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ, লেখাটা আমার প্রাণের ক্ষুধা, লিখতে যে হয়ই।
চিন্তাসূত্র: দূর প্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
আঞ্জুমান রোজী: বিয়ের আগে আমি কখনো মাকে ছেড়ে থাকিনি। তবে মাঝেমাঝে যখন খালা-ফুফুর বাসায় যেতাম দুই/একদিনের জন্য, তখন মায়ের কথা খুব মনে পড়তো। বাসায় ফেরার জন্য মনটা উশখুশ করতো। না আসা পর্যন্ত অস্থির হয়ে যেতাম। পরে একেবারে কেঁদে দিতাম। ঠিক সেই রকম অনুভূতি কাজ করে এখন, যদিও আমার মা আর বেঁচে নেই। তারপরও মনে হয়—দেশে গেলে মায়ের ছোঁয়া পাব। প্রাণটা সারাক্ষণই হু হু করে কাঁদে। দেশের কথা মনে পড়লে বাংলা গান শুনি, বই পড়ি, না হলে দেশে ভিডিও কলে ভাই-বোনদের সঙ্গে কথা বলি।
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্য চর্চায় কোনো প্রতিকুলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
আঞ্জুমান রোজী: প্রবাসে অনেক প্রতিকূলতা রয়েছে। বিশেষ করে সময়ের বড় অভাব। সমমনা মানুষ অনেক সময় খুঁজে পাওয়া ভার। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে বই পাওয়া যায় না। পরিবেশটাও ভিন্ন। ভিন ভাষার দেশে বাংলা ভাষাকে ধরে রাখাও একটা যুদ্ধের মতো ব্যাপার। যদিও অনেক প্রবাসী বাঙালি চেষ্টা করে যাচ্ছেন দেশীয় আদলে এখানে শিল্প, সাহিত্যের অঙ্গন তৈরি করতে। তবে দেশের মতো কি আর সেই আবেগ এখানে পাওয়া যায়! যা কিছু চর্চা, তা নিজ উদ্যোগেই করতে হয়। তবে যোগাযোগের মাধ্যম ইন্টারনেটভিত্তিক হওয়ায় এখন প্রবাস আর স্বদেশ বলে কোনো অনুভূতি কাজ করে না। মনে হয় এক বাংলাদেশেই আছি।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন? দিবসগুলো পালন করেন কিভাবে?
আঞ্জুমান রোজী: একসময় অনুষ্ঠান করে বিজয় দিবস উদযাপন করতাম। প্রবাসেও এখন বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো মহা ধুমধামে পালন করা হয়। তখন মনে হয়, এক ছোট্ট বাংলাদেশে আছি। তবে এখন অনলাইনের বদৌলতে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব বলে আমি বিজয় দিবসের সঙ্গে থাকি। তখন তো মনটা স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। দেশের মাটির সোঁদা গন্ধ যেন নাকে এসে লাগে। যখন একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের কথা মনে পড়ে, তখন রক্তে আগুন জ্বলে।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
আঞ্জুমান রোজী: হ্যাঁ, আমার দুটো বই আসবে। একটি কবিতার বই, বরফ বৃষ্টি নামে, কালাঞ্জলি প্রকাশনা থেকে; আরেকটি এ যাবতকাল বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা গদ্যগুলো দিয়ে একটি গদ্যের বই—মুখর জীবনগদ্য। এটি আসবে অনুপ্রাণন প্রকাশনা থেকে।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্য চর্চা?
আঞ্জুমান রোজী: নিয়মিত বলতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেই বেশি জানতে পারি। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি। আমার কাছে সবকিছুই পরীক্ষামূলক ও নিরীক্ষামূলক। এসবের মধ্য দিয়েই তো কিছু না কিছু সৃষ্টি মহাকালের যাত্রায় থেকে যায়। সব সময়েই কিছু না কিছু বিষয় গুরুত্ব রাখে। কালের পাটাতন থেকে কোনো সময়কেই ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে কথা হচ্ছে, কে কিভাবে দেখছে এবং তা কিভাবে প্রকাশ করছে, সময়ই বলে দেবে কতটুকু থাকবে আর থাকবে না। তবে চর্চা তো চলছে, যেভাবে হোক, হচ্ছে তো!
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে, কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
আঞ্জুমান রোজী: অবশ্যই অনুবাদ। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের দ্বারস্থ হতে হবে। অন্যভাষার সাহিত্য যেভাবে অনুবাদ হয়ে আমাদের কাছে আসে ঠিক সেভাবে। নাহলে অন্য কোনো ভাষার কেউ আমাদের সাহিত্য পড়বে না। কারণ, বাংলা ভাষা এখনো সর্বত্র সমাদৃত নয়। বিশ্ব দরবারে বাংলা ভাষাকে পৌঁছে দিতেও আমাদের কাজ করে যেতে হবে।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার মধ্যে কোন শাখাকে আপনার ঋদ্ধ মনে হয়?
আঞ্জুমান রোজী: অবশ্যই প্রবন্ধকে আমার ঋদ্ধ মনে হয়। বাস্তবতার নিরিখে প্রবন্ধ রচনা হয়, অনেকটা গবেষণামূলক রচনা বটে। যা সময় বা যুগের কাছে গুরুত্ব রাখে। আর গল্প, উপন্যাস, কবিতা আবেগকে নিঙ্ড়িয়ে কল্পনাজগতের ওপর ভর করে রচিত। অবশ্যই তা সময়কে ধারণ করে রচিত হয়। তবে এসবের মধ্যে প্রবন্ধকে বেশ শক্তিশালী মনে হয়।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কেমন আশাবাদী?
আঞ্জুমান রোজী: ভবিষ্যতের কথা বলতে গেলে তো বর্তমানকে বিশ্লেষণ করতে হয়। আর বর্তমানে যা হচ্ছে, তাতে এক ধরনের অন্ধকার ছায়া নেমে এসেছে। সাহিত্যচর্চার নামে চলছে বাণিজ্য আর প্রচারবিলাস। আর যাই হোক, করপোরেট মানসিকতা নিয়ে অন্তত সাহিত্যচর্চা চলে না। এভাবে চলতে থাকলে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ অন্ধকারই বলতে হবে।
চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্য আজ পর্যন্ত অনেক চড়াই-উৎরাই করে গড়িয়ে এসেছে। বলতে গেলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সাহিত্যচর্চা চলে এসেছে। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণালি যুগ শেষ হয়ে গেছে। ষাট, সত্তর ও আশির দশককে মূলত স্বর্ণালি সময় বলা হয়। তারপর তো ধীরেধীরে মৌলবাদীর উত্থান এবং সেই সঙ্গে ভোগ বিলাসের মানসিকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলা সাহিত্যচর্চায় চরম ভাটা পড়ে যায়। তারপরও আমি আশাবাদী, এর ভেতরই বাংলা সাহিত্য ঠিকই মাথা উঁচু করে থাকবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিবেশ গড়ে না তুললে অতীতের মতোই ঢিমেতালে তা এগুবে। শুধু বাংলা একাডেমির ওপর নির্ভর না করে আরও গবেষণা-অনুবাদ সহায়ক প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা উচিত। তাহলে, জোর গলায় বলা যাবে, বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ, বাংলা সাহিত্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার আছে, যা খুবই ঋদ্ধ। গবেষণা করে তা কখনো ফুরাবে না । আর এভাবেই বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।