ড. শাহনাজ পারভীন—শিক্ষক, কবি, কথাশিল্পী। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
ড. শাহনাজ পারভীন: আমি ঠিক সেটা মনে করি না। কারণ মানুষ যুগের প্রয়োজনেই নতুন নতুন উদ্ভাবন করে। তেমনই একটি উদ্ভাবন সাহিত্যের ওয়েব পোর্টাল। এটা কারও জায়গা দখল করেনি। বরং নিজের জন্য নিজস্ব জায়গা সৃষ্টি করেছে। সেক্ষেত্রে দৈনিকের সাহিত্য পাতা ও লিটল ম্যাগাজিন তার তার নিজস্ব জায়গায় অটুট অবস্থানে স্থির। এই সাহিত্যের প্রতিযোগিতার যুগে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করার জন্য প্রত্যেকেই তাদের গুণগত মান বজায় রাখতে সচেষ্ট বলে আমি মনে করি। উদাহরণস্বরূপ বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাসহ দেশের শত শত লিটল ম্যাগাজিনের রেফারেন্স দেওয় যাবে। সাহিত্যমোদীদের কাছে যেগুলোর কদর এতটুকু কমেনি।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁছ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
ড. শাহনাজ পারভীন: ঠিক তা নয়। এখন হাতে হাতে কম্পিউটার-স্মার্টফোন। ইন্টারনেটের সহজ ব্যবহারের কারণেই সবাই ওয়েব পোর্টালের দিকে ঝুঁকছে। তবে প্রিন্টিং বা ছাপার খরচের দিকটাকেও ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। এছাড়া ওয়েবেও অর্থব্যয়ের ব্যাপার থাকে। ডাটা ছাড়া না লেখা যায়। না পড়া যায়? অর্থের ব্যাপারটা সবখানেই জড়িয়ে আছে।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ড. শাহনাজ পারভীন: এটা ঠিক নয়। যিনি গুণী সম্পাদক, তিনি অবশ্যই সম্পাদনা করেন। হতে পারে যোগ্যতাসম্পন্ন লেখকের লেখায় অহেতুক সম্পাদনা করে যোগ্য সম্পাদক বিতর্কিত হতে চান না। তবে এটা ঠিক হবে না যে, সম্পাদক লেখকের লেখাটি পড়বেন না। বানান দেখবেন না। অথচ লেখাটি ছাপিয়ে দেবেন।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
ড. শাহনাজ পারভীন: সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে শুধু কর্তৃত্বের জন্য কেউ সম্পাদক হতে চাইবেন না। কারণ পৃথিবীতে কর্তৃত্ব করার মতো শত শত জায়গা রয়েছে । সম্পাদনা নয়। তারপরও যদি কারও ওই মানসিকতা থেকে থাকে তো অচিরেই তার মুখোশ লেখক ও পাঠকের কাছে উন্মোচিত হবে এবং তিনি এই সম্পাদনার জগতে বিতর্কিত হবেন। শেষপর্যন্ত বিতাড়িতও হবেন।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
ড. শাহনাজ পারভীন: আমি সেটা মনে করি না। হয়তো ওয়েব পোর্টালগুলো পাঠকের কিছুটা সময় নিয়ে নিচ্ছে। তবে সিরিয়াস পাঠক ও খ্যাতিমান লেখকের লেখার মধ্যে যে সংযোগ, সেটি কখনোই বিনষ্ট করতে পারে না। ওয়েব পোর্টাল কখনো আমাদের সিথানের বইয়ের জায়গা দখল করতে পারবে না। আবার যেখানে-সেখানে চলন্ত পথে ওয়েব পোর্টাল আমাদের সঙ্গে থাকে সব সময়। তখন হয়তো প্রিন্ট মিডিয়ার প্রিয় বইটি হাতের কাছে থাকে না। কিংবা বই পড়ার পরিবেশ থাকে না।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা না লিটলম্যাগ না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
ড. শাহনাজ পারভীন: আসলে যে কথাটি আমি আগের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছি, একেকটির আবেদন একেক রকম। দৈনিকের সাহিত্যপাতা, লিটল ম্যাগাজিন ও ওয়েব পোর্টাল—এই তিনটি বিষয় তিন রকম। আমি মনে করি, পাঠকেরও ভিন্নতা রয়েছে। আমার জানা মতে, এই তথ্য প্রযুক্তির ডিজিটাল সময়েও এমন বিজ্ঞ পাঠক ও লেখক রয়েছেন, যারা ইন্টারনেট সম্পর্কে তেমন সচেতন নন। তারা ব্রাউজ করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে প্রিন্ট মিডিয়ার ওপরই তাদের ভরসা। আমি ব্যক্তিগতভাবে তিনটি মিডিয়াতেই অভ্যস্ত। তিনটি মিডিয়াতেই লিখতে ও পড়তে পছন্দ করি। সেক্ষেত্রে টাইমিংটা ভাগ করার দায়িত্ব আমার। কখন কোনটিতে লিখব, কখন কোনটি পড়ব, সেটিও আমার ইচ্ছ ও আনন্দ ।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
ড. শাহনাজ পারভীন: এটি অবশ্যই একটি ভালো দিক। আমি যদি কবিতার সময়ের কথা বলি, তো বলতে হয় এখন আধুনিক, উত্তরাধুনিক সময় পেরিয়ে সাইবার কবিতার যুগ। কবিতাগুলো আকারেও একটু ক্ষীণ হচ্ছে। অর্থাৎ সাইবার কবিতা। বিষয়টি অনেক ভালো। প্রিন্ট মিডিয়ায়, দৈনিকের পাতায় প্রকাশিত সাহিত্য একবার পড়ার পর তার আবেদন কমে যায়। ওইভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। কিন্তু ওয়েব পোর্টালের আবেদন সবসময় একই রকম থাকে। পুরনো হয় না। এবং একইসঙ্গে লাখ লাখ ব্রাউজারের গোচরে আসে। এটা অবশ্যই সাহিত্যচর্চা, প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
ড. শাহনাজ পারভীন: না, তা হবে কেন? তবে বেশিরভাগ সময় লেখকের যে লেখাটি দৈনিক সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়ে থাকে, সে লেখাটি দৈনিকে ছাপা হওয়ার আগেই তার লিড অংশ অথবা কখনো পুরো লেখাটি তাৎক্ষণিক প্রকাশের নেশায় কোনও ওয়েব পোর্টাল অথবা ফেসবুকে প্রকাশ পেতে পারে। সেক্ষেত্রে ওই লেখার প্রতি কিছুটা হলেও পাঠকের আগ্রহ হারায়। এক্ষেত্রে লেখক ও সম্পাদকের সতর্ক থাকা জরুরি। যদি সত্যিকার অর্থেই সম্পাদক কোনও লেখকের শতভাগ নতুন লেখা ছাপতে পারেন, তাহলে হয়তো দৈনিক সাহিত্য পাতার আবেদন কখনোই কমবে না।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
ড. শাহনাজ পারভীন: একটি উঁচুমানের ওয়েব পোর্টালে সবধরনের লেখাই স্থান পেতে পারে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ইজম, ঐতিহাসিক বিযয়াবলি, ভ্রমণ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, শিল্পকলা, সাহিত্য সমালোচনা, শিশু সাহিত্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, রূপচর্চা, রোমান্স, শরীরচর্চা, খেলাধুলা, রান্না, বিনোদন, বিনিয়োগ—সবকিছুই থাকতে পারে। অর্থাৎ একটি প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত পরিপূর্ণ পত্রিকার পাতায় যে যে বিষয় আমরা দেখে থাকি, তার সবকিছুই ওয়েবেও পেতে চাই। তাহলে অবশ্যই ওয়েব পোর্টাল পাঠকপ্রিয়তা পাবে।