[আহমেদ স্বপন মাহমুদের জন্ম ২১ মাঘ ১৩৭২ বঙ্গাব্দ, নেত্রকোণা জেলায় হবিবপুর গ্রামে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন, পাশাপাশি সাংবাদিকতা। বর্তমানে ঢাকাভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী দায়িত্বে নিয়োজিত। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: অতিক্রমণের রেখা (২০০০), সকল বিকেল আমাদের অধিকারে আছে (২০০৪), অবিচল ডানার উত্থান (২০০৬), আদি পৃথিবীর গান (২০০৭), আগুন ও সমুদ্রের দিকে (২০০৯), আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল (২০১০), অতিক্রমণের রেখা, নির্বাচিত কবিতা (২০১১), ভূখণ্ডে কেঁপে ওঠে মৃত ঘোড়ার কেশর (২০১৩), রাজার পোশাক (২০১৪), অনেক উঁচুতে পানশালা (২০১৪), প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম (২০১৪) উল্লেখযোগ্য। গদ্যগ্রন্থ : সমূহ সংকেতের ভাষা (২০০১), কলমতালাশ : কবিতার ভাব ও বৈভব (২০১৪)। এছাড়াও উন্নয়ন নীতিগবেষণা বিষয়ে রয়েছে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত কিছু গ্রন্থ। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন বেশকিছু পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে বগুড়া লেখকচক্র স্বীকৃতি পুরস্কার ২০১৫, শব্দগুচ্ছ সম্মাননা ২০১৬, লোক সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭, বইপত্তর সম্মাননা ২০০০, কলকাতা। সম্প্রতি এই কবি-চিন্তকের মুখোমুখি হয়েছেন কবি শামীম হোসেন। এখানে সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।]
শামীম হোসেন: আপনি কবিতা ও গদ্য দুটোই লেখেন। এখন কী লিখছেন? বড় কোনো গদ্যের কাজ করার ইচ্ছে আছে?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: একজন লেখকের কাজই নিরন্তর লেখনপ্রক্রিয়ার মধ্যে থাকা। সবসময় তিনি হয়তো কাগজে-কলমে লিখছেন না, কিন্তু তিনি লিখে চলেছেন হৃদয়ে, মস্তিষ্কে। আমি এমন এক স্বাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত যেখানে প্রতিনিয়ত লেখাই আমার প্রধান কাজ। প্রতিদিনই। কবিতা লিখছি, প্রচুর গান লিখছি, গদ্য লিখছি। তবে, সম্প্রতি আমি কাজ করছি বাংলার ভাবদর্শন নিয়ে। বাংলার মরম নিয়ে। বাংলা গীতিকাব্যই বাংলার মূল ভাবদর্শনের জায়গা। ইউরোপীয় চালে ও চলে আমাদের সমাজ ও সাহিত্য কথিত আধুনিকতার মুখোশ পড়ে বেড়ে উঠেছে। অথচ আমাদের নিজস্ব সম্পদ রয়েছে, যার দিকে আমরা খুব একটা নজর দেইনি। আমি মনে করি, আমাদের ফেরার সময় এসেছে। পুনর্জাগরণের সময় এসেছে। তো, এই বিষয়েই কাজ করছি। বড় ধরনের কাজ। এ ধরনের কাজ একা প্রায় অসম্ভব, যৌথপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদে করতে পারলে ভালো হয়। আমাদের এখানে এর রেওয়াজ প্রায় নেই।
শামীম হোসেন: সাম্প্রতিক কবিতাপাঠে আমার মনে হয়, অনেক তরুণই সেই বাংলা কবিতার মূল ভাব থেকে সরে এসেছেন।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কেবল তরুণরা বললে ভুল হবে। তিরিশ যা করেছে, পরে, ধারাবাহিকভাবে ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই ধরে প্রায় সবাই সেই ধারাবাহিকতার সাঁকো বেয়ে যাচ্ছি। তবে মাঝেমধ্যে অনেকেই সাঁকো তৈরি করতে চেয়েছেন। বা সেই সাঁকোতে নতুন উপাদান করে যোগ করতে চেয়েছেন। তরুণদের নজর তীক্ষ্ণ, তাদের উদ্দমতা আছে। তারাই পারেন নতুন নির্মাণ করতে। কিন্তু তার আগে দরকার, দেখার চোখটা বদলানো, মনের ভাবটা যেন মাটিসংলগ্ন থাকে। মানুষ ও প্রকৃতি বাদ দিয়ে কোনো শিল্প নেই।
শামীম হোসেন: কবি ও লেখকের জীবন হয় বর্ণিল। আপনার কবিজীবনের কিছু স্মৃতি জানতে চাই।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি ও লেখকের জীবন বর্ণিল হয় কিনা! মানুষের জীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। আনন্দ বেদনার, প্রেম-অপ্রেমের, সংঘর্ষ-সংঘাতের, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার এভতর দিয়েই জীবন বেড়ে ওঠে। কবি ও লেখকেরা সেইসব জীবনকেই তুলে ধরেন।
কবি ও লেখকের জীবন বর্ণিল তো বটেই। অভিজ্ঞতার রঙের মতন আর কি। কিন্তু একজন কবি যে হীরকখণ্ড খোঁজেন, জীবন ও প্রকৃতির ভেতর দিয়ে, মানুষের অন্তরের ভেতর দিয়ে, সেই হীরকখণ্ড আলো ছড়ায় বটে, কিন্তু খুব বেদনায়ময় আলোক। জীবনের অনুভবে যেন নিঃস্বতাই শেষ নিয়তি। তারপর কিছু নাই! কিছু কি আছে? এই আকার-নিরাকার ভাব ও প্রশ্ন, মায়া ও বিরহ লেখকের মর্মমূলে যদি পৌঁছায়, সৃজনশিল্পে ফুটে ওঠে, তাহলে সৃষ্টির সুখ আছে বটে, কিন্তু অনন্ত বেদনাও সেই সুখে কলমুখর থাকে, সবসময়।
শৈশবের স্মৃতি, তারুণ্যের স্মৃতি, দেশ-বিদেশের স্মৃতি। স্মৃতি। স্মৃতিই ইতিহাস। আসলেই স্মৃতিই কাল। স্মৃতি না থাকলে কোনো ইতিহাস ও সৃষ্টি থাকতো না। মূল্যও থাকতো না। আমার তারুণ্য কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মায়াময় মতিহারে। সেই সময়ের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল আড্ডা। তো, আমার আড্ডাবাজি তখন তুঙ্গে। আমাদের শিক্ষক কবি অসীম কুমার দাসসহ ক্যাম্পাস ও শহরের অন্যান্য লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাগুলো মনে পড়ে। মাতাল সময়! কী প্রেমে, কী কবিতায়, আড্ডায়!
শামীম হোসেন: আমি যতদূর জানি তরুণ কবিদের লেখা আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়েন। তাদের কবিতার ভাষা-আঙ্গিক-চিত্রকল্প যাই-ই বলি না কেন, কেমন লাগছে আপনার কাছে?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: নিজেকে সজাগ ও সতেজ রাখতে তারুণ্যের যেমন বিকল্প নেই, লেখালেখিতেও সম্প্রতি কারা কী লিখছেন, সেগুলো জানারও বিকল্প নেই। আমি তরুণদের লেখা পড়িই না কেবল, তরুণরা আমার বন্ধুও। মানে, আমিও তো তরুণই না কি! আমি তো দ্বিতীয় দশকের কবিতা নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধও লিখেছি। তাদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রথম দশকের কবিতা নিয়েও। আশি ও নব্বইয়ের দশকের কবিতা নিয়েও। এক কথায়, বাংলা কবিতা নিয়েই কাজ করেছি আমি। আমার কাছে তো বেশ ভালো লাগছে তরুণদের কবিতা। রীতিমতো নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায় এমন কবিতাও পড়ছি। ভালো।
তবে, খেয়াল করে দেখবেন শামীম, আমরা আঙ্গিক ও প্রকরণে খুব বেশিদূর আগাইনি। ভাষাশৈলী, প্রকাশভঙ্গি ও চিত্রকল্পে নতুনত্ব আসছে বটে, তবু যেন এখনো বাংলা কবিতা তিরিশ-আক্রান্ত। আমি ভালো বা মন্দ বলছি না। কিন্তু আক্রান্ত। অনেক সময় চিত্রকল্পে ঠাসা কবিতা নেওয়া যায় তেমন, অনেক সময়ই কিছু মিন করে না সেসব। কবিতা তো অর্থবোধক রস-শিল্প, তাই না? কিছু শব্দ লিখলাম, তাতেই কবিতা হয় না। সাহিত্য যেহেতু শিল্প, তখন তার কিছু ব্যাপারস্যাপার তো আছেই। সেসব বিষয়ে মনোযোগী হলে ভালো।
আরও একটা বিষয় বলতে চাই গুরুত্বের সঙ্গে, তরুণ কবিদের উচিত হবে মানুষ ও প্রকৃতি, এই ভূখণ্ডের গভীর দৃষ্টি নিয়ে দিকে ফিরে তাকানো। ইউরোপীয় সাহিত্যের ভাবানুবাদ তো চলছেই এতকাল ধরে, আমরা হয়তো পুষ্টিবানও করেছি আমাদের সাহিত্যশিল্পকে, কিন্তু আপন বৈভবের দিকে ফিরে চাওয়া জরুরি। বাংলা কবিতার প্রকৃত মুক্তির শান নিহিত রয়েছে আঠারো-উনিশ-বিশ শতকের বাংলা গীতিকাব্যে। তরুণদের কেউ কেউ সেসব নিয়ে ভাবছেনও, লিখছেনও। এটা বেশ আনন্দের।
শামীম হোসেন : বাংলা কবিতার যে চিরায়ত ভাব, তা এখনকার তরুণ কবিদের লেখায় কতটুকু দেখতে পান?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: এর উত্তর অনেকটা বলেই ফেলেছি। যা লোকায়ত তাই চিরায়ত। বাংলা কবিতা মানে বাংলা গীতিকাব্য। আমরা আধুনিক হতে গিয়ে সেই চিরায়ত ভাবকে কিছুটা পেছনে ফেলে রেখে এসেছি। বাংলার মূল ভাব সাধনভজনের, অধরাকে ধরার প্রচেষ্টা, মানুষের অখ-তার গান, প্রেম ও প্রজ্ঞার, সমর্পণের। মানুষের সাথে মানুষের, জীবের ও প্রকৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলের মূল ভাব, মায়া, বিরহ-বিচ্ছেদ। সেসব তো আমরা বর্জনই করেছি অনেকটা; আধুনিক হতে গিয়ে। তাই না!
শামীম হোসেন: বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা কবিতায় মৌলিক পার্থক্য কিছু রয়েছে, না কি?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: নিশ্চয়ই পার্থক্য রয়েছে। একদম স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা আর বাংলা দেশের কবিতার গতিপ্রকৃতি, প্রকাশশৈলী, ভাষা-প্রকরণ আলাদা। আমাদের অন্তরের, প্রাণের মমতার ঝনঝনানি আছে, ওদের নেই। ওদেরটা ঝনঝন করে না। কাঠপাথর, প্রাণহীন অনেক ক্ষেত্রে। ব্যতিক্রম বাদ দিলে।
শামীম হোসেন: আপনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সেখানকার কবিতা সম্পর্কেও জেনেছেন। আমরা হয়তো অনেকেই বলছি বাংলা কবিতা বহুরৈখিক বাঁক নিচ্ছে—কিভাবে?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: বাংলা কবিতা বাঁক নিচ্ছে। নেবেই তো। সময় নিরন্তর প্রবহমান, জীবনও। ভাষা ছাড়া তো মানুষজীবন ও সমাজের কথা ভাবা যায় না। ভাষাই মানুষকে সমাজ দিয়েছে। বিদেশের অনেক বড় বড় কবির সঙ্গে দেখা হয়েছে। কবিতার আড্ডায় গিয়েছি। সবকিছুই তো বদলে যাচ্ছে। আমাদের জীবনযাপন রীতি, উৎপাদন ব্যবস্থা বদলাচ্ছে। কবিতাও। আমেরিকার কবিতাও তাই, ইংরেজি কবিতাও, কোরিয়ান ও জাপানি কবিতাও। তবে ওখানে ক্রিটিক হয়, ন্যারেটিভ আছে ওদের, আমরা ক্রিটিক করি না, আমাদের ন্যারেটিভ নেই বললে ভুল হবে না।
শামীম হোসেন: প্রচারকাঙাল কবি-সাহিত্যিক সবসময়ই থাকে। অনেক সময় মিডিয়ার ডামাডোলে আড়াল হোন প্রকৃত লেখক। অর্থাৎ ভালো লেখা সম্পর্কে পাঠকের দূরত্বটা কি এখান থেকেই সূত্রপাত করে?
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: সে আড়াল সাময়িক। আমরা তো দেখলাম কত ডামাঢোল। কলরব। বাহাদুরি। তারপর নিস্তব্ধতা। হয় কী, শিল্পের জায়গাটুকুন লড়াই-বড়াই, নর্তন-কুর্দনের না। কর্পোরেট মিডিয়া অনেক কিছুই পারে। সাময়িক আড়ালও করে ভালোকে, মন্দকে সামনে আনে। কিন্তু, দেখেছি, প্রচারসর্বস্বতা কখনোই প্রকৃতকে ঢেকে দিতে পারে না। পাঠক তার নাগাল আগে-পরে পেয়ে যান। আর এই ফেসবুক যুগে, কী করে বুঝবেন, সবারই যখন বুক টান টান, সিনা উঁচু! বাহাদুরির সময় চলছে তো!
শামীম হোসেন: আমার অগ্রজ কবি আপনি-এত সময় দিলেন! এই কবিতাময় কথামালা স্মৃতি হয়ে রইল।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: শামীম, অনেক খুশি হয়েছি। আমি মনে করি, আমাদের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে অনেক কথা বলা দরকার, খুব পদ্ধতিগতভাবে। লেখা দরকার। আড্ডাগুলোও যেন ঝলমল করে ওঠে একসময়।