চিন্তাসূত্র: ছোটগল্পে এলেন কেন?
ছোটগল্প লেখার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি সত্যিকার অর্থে প্রতিমুহূর্তে ভেতরে লালন করি কবিতা। পথে হাঁটতে হাঁটতেও অসংখ্য কথা জন্ম হতে থাকে। আর প্রতি পদে পদে মৃত্যুবরণ করতে থাকে একেকটি কবিতা। যারা হয়তো হয়ে উঠতে পারতো অনন্য। কখনো যে দু’একটা বেঁচে যায়, তা কবিতা রূপে প্রকাশ পায়। কিন্তু গভীরে লিখতে এসে দেখি– এসব কিছুই আসলে কবিতা নয়। সব কথা। কথা আর কবিতার মধ্যে পার্থক্য নিশ্চয়ই একজন লেখক কিংবা কবি বুঝতে পারেন। অসম্ভব কঠিন কাজ কবিতা লেখা। কিন্তু মনের ভেতর তো কথার জন্ম হতেই থাকে। তাদের তো প্রকাশের একটা পথও চাই। তাই গল্প অধ্যয়ন শুরু। কবিতার তুলনায় গল্প লেখা সহজ আমার কাছে। এটা গোপন কারণ। আজ প্রকাশ করলাম। প্রবন্ধ কিংবা কবিতার মতো অতো কঠিন নয়। আমি সহজের পথ বেছে নিয়েছি। আমি আসলে বরাবর যা কিছু সহজ, যা কিছু সুন্দর- তার পক্ষে। যা আমার দ্বারা সম্ভব, তারই দিকে ধাবমান। আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে আমি বেশ শক্তিশালী। আরও একটা বিষয় আছে। পাঠক সহজে রিলেট করতে পারে যাতে, আনন্দ বেশ দ্বিগুণ হয়ে ওঠে তাতে। গল্পের মাধ্যমে খুব সহজে পাঠকের কাছে যাওয়া যায়। কবিতা খুব শিক্ষিত মানুষের কাজ। পাঠক আর লেখক দুই-ই শিক্ষিত হওয়া চাই। গল্প দেহাতি মানুষের জন্য। আমি দেহাতি। ভাষা এবং চিন্তা সবই খুব সাধারণ। তাই গল্প লিখি। জীবন লিখি।
চিন্তাসূত্র: আপনার গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
আমার গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হওয়া চাই—ভাষার ব্যবহারে বিশিষ্ট রূপ আরোপ করা। অর্থাৎ একটা ভাষাভঙ্গি তৈরি করা। গল্প পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেউ বুঝতে পারবে এ শাপলা সপর্যিতারই লেখা। অন্য কারো হতে পারে না এ ভাষাভঙ্গি। চারপাশের মানুষ আমার গল্পের প্রাণ। যে প্রাণ দেখেছি আমি নিজে। যে জীবন যাপন করেছি আমি নিজে। যার সঙ্গে হেঁটেছি। পড়ালেখা করেছি। যে যুদ্ধ জয়ে একসঙ্গে লড়াই করেছি। যার সঙ্গে চলেছি। ঝগড়া করেছি। ভালোবেসেছি। ঘৃণা করেছি। মিছিলে রাজপথে নেমেছি। যার সঙ্গে বসবাস করেছি। সেই সব প্রাণ আমার গল্পের চরিত্র হতে হবে। হোক তা আমার বাড়ির দারোয়ান, আমার শিক্ষক, পাশের বাড়ির মাদকাসক্ত ছেলেটি। হই আমি। আর শব্দ হবে খুব সহজ। সহজ শব্দ যা সহজে মানুষের মনে কড়া নাড়ে। আলোড়ন তৈরি করে। ছোট্ট মানুষ তুচ্ছ ঘটনা। অথচ ঘটনার রেশ বিশাল দাগ দিয়ে যায় মনে না মাথায় কে জানে—এই আমার ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য। সেই জাদু চাই—পড়া শুরু হবে পাঠকের ইচ্ছায়, কিন্তু তারপর আর যা কিছু সব লেখকের দখলে। নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না তার। শেষ করেও মনে হবে কোথাও কিছু যেন বাকি রয়ে গেছে। আরও কী যেন জানার ছিল, বলার ছিল।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে চায়?
ছোটগল্প বা উপন্যাস হোক, পাঠক খোঁজে নিজের অস্তিত্ব। বেদনাটুকু তার বুক চিরে চলে যায় নিয়ত। আনন্দটুকু যেন তার। চরিত্রটা যেন খুব চেনা। হাসি-আনন্দে ভেসে যেতে চায়। দুঃখ-যাতনায় রক্তাক্ত হতে চায়। সেই বেদনা থেকে খুঁজে পায় এক ঊর্ধ্বতর সত্তা। সাবলিমিশন। বার বার তাতেই অবগাহন করতে চায়। যে কারণে আমি বার বার পড়ি হৈমন্তী, মহেশ কিংবা অতিথি।
চিন্তাসূত্র: একজন কবি যখন একজন গল্পকারও, তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
কারো কিছু বলতে পারি না। আমি গল্প লিখতে গেলে প্রায়ই কবিতা আমাকে গ্রাস করে। আমার গল্পকে গ্রাস করে। গল্পের বারোটা বাজায়। ভাষা থেকে ভাব। আমাকে কেবলই কবিতা তাড়িত করে। তাই অনেক গল্প লেখার পর দেখি, তা আর গল্প নামে চলে না। গোপনে সেগুলো লুকিয়ে রাখি। কিছু গল্প আধাআধি রয়ে যায়। আট হাজার কি দশ হাজার শব্দ লেখার পর আমার নিজেরও মনে হয়, এর আঙ্গিক আসলে গল্পের নয়। কবিতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে লিখতে পারলে কোনো কোনো গল্প দারুণ গল্পও হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার জন্য এ খুব দুঃসাধ্য। আমার জন্য এ ভীষণ একযুদ্ধ। বর্তমানে এ যুদ্ধই করে চলেছি। যদিও সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, প্রত্যেক কথাসাহিত্যিকই প্রথমে কবি। বিখ্যাত সব কবি গল্প লেখার সময় আমিত্বকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। আমি কবিতায় পড়ে থাকি। তাই কবিতা প্রচণ্ডভাবে জেঁকে বসে গল্পে। কবিতাকে আলাদা করে একমাত্র গল্প করে তোলারই যুদ্ধ করে চলছি।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
গল্পে যৌনতাকে নান্দনিক করে তোলা আর ব্যক্তিগত জীবনে যৌনতাকে নান্দনিক করে তোলা একই। আসলে যৌনতা শব্দেই আমার আপত্তি। নিছক যৌনতা কোনো শিল্প নয়। যৌনতাকে জীবনে যেভাবে শিল্পোত্তীর্ণ করে তোলা সম্ভব, গল্পেও তাই। আমি গল্পে কখনো স্রেফ যৌনতা দেখাতে পারব না। কখনো কোনো চরিত্রকে কেবল যৌনতায় লিপ্ত করার চেষ্টাও করতে পারব না। কিন্তু আমার গল্পের বিষয় যদি কখনো যৌনতা হয়, তাহলে ভালোবাসা প্রেম হবে তার মাধ্যম। আবেদন আর নিবেদনের মাধ্যমে ভালোবাসার অপিরহার্য আর শেষ মার্গ হয়ে উঠবে যৌনতা আমার গল্পে। অমি ঠিক সেটাই দেখাতে চাই। কিন্তু তখন সে আর যৌনতা থাকে না। তখন এ ভালোবাসার সর্বশেষ প্রকাশ। সর্বোচ্চ অনুদান। অসাধারণ প্রেমের এক একটি অনিবার্য সেশন বলতে চাই আমি যৌনতাকে। পাঠক পড়ার পর ভাববে আমার তো এমনই । কিংবা এমনি তো সব আমি ভাবছিলাম। কিংবা এমনই আমি চাইছিলাম। আসলে যা যা বললাম সেগুলো জিস্ট। সার সংক্ষেপ। যৌনতা বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি কথা বলিনা আমরা। সামাজিক সংস্কার আর ধর্মীয় আচরণ আমাদের যৌনতা বিষয়ে কথা বলার জন্য কুণ্ঠিত করে রাখে। কিন্তু বলা দরকার। এটি একটি দারুণ শিল্প হতে পারে। লিখতে বসলে হয়তো বের হয়ে আসবে আরও আরও কত নান্দনিক উপায় যা এখন এভাবে বলা ঠিকও নয়। সম্ভবও নয়। বস্তুত সৃষ্টিতো এক স্রোত ধারা। এত গণিত নয়। তাই এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের ফর্মুলার মতো একে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে লিখতে বসা সম্ভব নয়। অন্তত আমার পক্ষে। এর জন্য বিষদ ব্যাখ্যা দরকার। অনেক বড় ফিল্ড দরকার। একটি প্রশ্নের উত্তরে এত সল্প পরিসরে এর ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
চিন্তাসূত্র: কোন শ্রেণীর ছোটগল্প পাঠকসমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
ছোট প্রাণের ছোট ব্যথা—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ছোটগল্প বিষয়ে। আমি বলছি দুঃখ আর বিরহ। পরিপূরক এ দুটি শব্দকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সব হৃদয়মন্থন। আমি এও বলি—সাহিত্যমাত্রই হৃদয়ের কারবার। আমার ছাত্ররা যখন প্রশ্ন করে সাহিত্য কী, আমি বলি তোমার মনে ব্যথা দেওয়া সাহিত্য। তোমার মনে বিষ ঢোকানো। সাহিত্য, কিন্তু সে ব্যথায় তুমি আমার ওপর ক্ষেপে উঠবে না। সে বিষে তুমি নীল হবে। কিন্তু আমাকে দোষারোপ করবে না। তুমি কেবল ওই বিষে বিষাক্ত হতে চাইবে। তুমি কেবল ওই বেদনায় ব্যথিত হতে চাইবে। তুমি কেবলই খুঁজে খুঁজে আমার এই কর্মক্রিয়া দেখতে চাইবে। পড়তে চাইবে। এই হলো সাহিত্য। চিরকালীন সাহিত্য সবই বেদনার রসে সিক্ত। কবিতা গল্পে কী উপন্যাসে ওই এক কাজ লেখকের। হৃদয়কে স্পর্শ করা। বেদনার রস সঞ্চার করে দেওয়া। মন-মাথা-মগজ কানায়-কানায় ভরে তোলা প্রাত্যহিক জীবনের যাবতীয় জটিল মনোদৈহিক যাতনার বিষে। নীল বিষে একাকার হতে হতে একসময় পাঠক সেই বেদনাকে উপভোগ করতে থাকবে। এই ধরনের ছোটগল্পই সবচেয়ে বেশি পাঠক সমাদৃত হয়। চির পুরাতন। কিন্তু নতুন নতুন প্রাণে এর যোগ। নব নব ধারায় প্রকাশ। এই আবেগ চিরকালেরও। নতুন নতুন পথে তা এসে মানুষের মনে স্থান করে নেয়। প্রকাশেও তার নতুন রূপ। কিন্তু সেই একই কথা বিয়োগব্যথা যাতনা-ক্ষরণ-দহন একাকিত্ব। যে কারণে বিলাসী গল্পের মেয়েটিকে আজও আমি ভুলতে পারি না। যে কারণে হৈমন্তীর পাশে পাশে অপুও আমাকে ব্যথিত করে। আজও। আজও দুর্গার মুখ ব্যথাতুর করে তোলে আমার হৃদয়। এত এত বছর এত এত পড়ার পরও। এত এত চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার পরও আমাকে ব্যথিত করে ফটিক। ফটিকের মৃত্যুর মুহূর্তে মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার ঐকান্তিক বাসনা। ফিরে যাওয়ার আর্তি আমাকে আজও অস্থির করে তোলে। বুকের ভেতর বেদনার রস এতটাই সঞ্চার করে যে, আমি বিপন্ন হয়ে পড়ি। অবসন্ন ব্যথাতুর করে তোলে ফটিকের মায়ের অনুতপ্ত বেদনার গরল এখনো এই অবসন্ন বিকেলেও।
চিন্তাসূত্র: একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোনো কোনো শর্ত পূরণ করতে হয়?
জীবনের যাবতীয় জটিলতা নিয়ে হবে গল্প। কিন্তু আমি যা দেখছি, অবিকল তাই গল্প হতে পারে না। যে ছেলেটি নিত্যদিন বউয়ের খেচর-খেচর শুনছে, সে যখন গল্পে একই বিষয় দেখবে, তখন তা আর তার ভালো লাগবে না। তার ভালো লাগবে খেচর-খেচরের পর রোমান্স। যে রিকশাঅলা প্রতিদিন মানুষ পারাপার করে। তার জীবন গল্পে কী আর যোগ করবে? কিন্তু যে রিকশাঅলাটি হঠাৎ তার রিকশায় ফেলে যাওয়া একটি পিস্তল পেয়ে বসে, ভয় পেয়ে দ্রুত সে সেটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণ আগের আরোহীকে খোঁজে। না পেয়ে ক্লান্ত গাছের ছায়ায় বসে দুশ্চন্তিাগ্রস্ত হয়ে বিশ্রাম করে, পিস্তলটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে, জানাও থাকে না ভেতরে গুলি রয়েছে, একসময় না বুঝেই টিপে বসে ট্রিগার, এ ফোঁড়-ও ফোঁড় হয়ে যায় তার বুক। এটা পাঠককে রিলেট করবে। এই হলো গল্পকে নান্দনিক করে তোলার কায়দা। তার জন্য গল্পকারকে আশ্রয় করতে হয় অনেক বিষয়ের ওপর। ঘটনা। কাহিনীর পরম্পরা। ঘটনা, পরিপ্রেক্ষিতে রস সঞ্চার করতে হয় লেখককে। সরল রেখার পথ পরিহার করে পরিভ্রমণ করতে হয় নানা পথে নানা আঁকাবাঁকা রেখায়। তবেই একটি ঘটনা গল্প হয়ে ওঠে। তবেই সে রিকশাঅলার এ ফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া বুকের রক্তকেও শিল্পোত্তীর্ণ করে তুলতে পারে।
চিন্তাসূত্র: ছোটগল্প নিয়ে আপনার নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ কেমন ফল দিতে পেরেছে?
এ দৌড়ে আমি অনেক পেছনে। যখন শুরু করার নয় তখন আমার শুরু। তাই আমার পর্যবেক্ষণ এখনো চলছে। চর্চা চলছে। নিরীক্ষা করার সময় আমার আসেনি এখনো। ছোটগল্পে আমি এখনো নতুন। তবে নিরীক্ষা আর পর্যবেক্ষণ করে যে, সৃষ্টি তা অবশ্যই সমৃদ্ধ। অবশ্যই গ্রাহ্য।
চিন্তাসূত্র: আপনার ছোটগল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
অনেক গল্প লিখব। প্রতিটি সেকেন্ডে যে একটি গল্পের জন্ম হয়, লিখব তার সবই। সব ছোটগল্পই হবে একেকটা বিশাল জীবনের প্রতিরূপ।
চিন্তাসূত্র: মানুষের কল্যাণে ছোটগল্প কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
আমার ছোটগল্প থেকে মানুষ কেবল অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। কল্যাণে না অকল্যাণে ভূমিকা রাখবে কি না, তা নির্ভর করবে ব্যক্তির রুচি আর ইচ্ছের ওপর। এটা জোর করে করা সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট করে বলাও সম্ভব নয়। এটা কে না জানে, পথ সামনে দুটো। কে কোন পথে চলবে, সেটা একদম ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়। একটা সময় যখন খুব বেশি খুন, দখল, হানাহানি ঘটতে শুরু করলো, সংবাদ মানেই নানা আগ্রাসী আর সহিংস ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন টিভিতে, তখন টিভি দেখা বন্ধ করলাম ঘরে। লুকিয়ে তো আর টিভির সংবাদ দেখা যায় না। আমার মনে হলো এই খুনোখুনি দেখে, এই রক্তাক্ত জখম দেখতে দেখতে আমার মেয়েরাও আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। ভাবতে পারে প্রতিশোধ নেওয়ার এটি মোক্ষম উপায়। যখন দেখলাম, আমার মনের ভেতর ওই সব জটিলতা গুলো কাজ করছে, তখন টিভি সিরিয়াল দেখা বন্ধ করলাম। বিষয়টা এমন যে, যাতে আমরা আক্রান্ত হই, তাকেই ঠিক তেমনভাবেই আহত করতে চাই। কিন্তু এর বিপরীতের যে মেসেজ রয়েছে, সেটা বের করে নিজের মধ্যে ধারণ করা বা জনকল্যাণে ব্যবহার করাটা আসলে চর্চার বিষয়।