[চাণক্য বাড়ৈ—মূলত কবি। দীর্ঘদিন ধরে কবিতা চর্চা করে আসছেন। কবি হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতিও কুড়িয়েছেন। এবার এসেছেন কথাসাহিত্যে। বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন যৌনহয়রানির শিকার নারীকে। বিশ্বজুড়ে যখন যৌনহয়রানির শিকার নারীরা #মিটু আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতি সংঘটিত অপরাধের প্রতিবাদ করছেন, ঠিক তখনই প্রকাশিত হচ্ছে যাচ্ছে যৌননিপীড়নবিরোধী উপন্যাস চাণক্য বাড়ৈ রচিত ‘কাঁচের মেয়ে’। উপন্যাসটির বিষয়-প্রকৃতি নিয়ে এর স্রষ্টার মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ সাহিত্যিক-সমালোচক রাকিবুল রকি।]
চিন্তাসূত্র: প্রথমেই জানতে চাই, আপনার উপন্যাস ‘কাঁচের মেয়ে’ লেখার আগে আপনি আঙ্গিক নিয়ে ভেবেছেন? এটা কিভাবে শুরু করবেন? কাহিনী কিভাবে এগিয়ে নেবেন? না কি কিছুই না ভেবেই লিখতে শুরু করেছেন?
চাণক্য বাড়ৈ: প্রথমে আমি ভেবেছি বিষয় নিয়ে। দেশের সবচেয়ে আলোকিত জায়গাগুলোয় বারবার এত আলোচিত ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, নেতিবাচক অর্থে, এটা নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কিছু লেখা দরকার। আমার উপন্যাসে বিষয়ের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি। বলতে গেলে, যা দেশের একটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বিষয় নির্ধারণের পর আমি এর প্লট নিয়ে ভেবেছি। তখনই আমার ভেতরে কাজ করেছে গল্পটি আমি কিভাবে বলব। কিভাবে বললে পাঠক তা শুনতে বা পড়তে আগ্রহী হবে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটি পড়বে, সেই বিষয়টিই অবশ্যই ভাবতে হয়েছে। তারপরই কি-বোর্ড নিয়ে বসে পড়েছি লিখতে।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাসের কাহিনী বিবৃত হয়েছে একজন নারীর জবানিতে। আপনি গল্প বলার জন্য একজন নারীকে বেছে নিলেন কেন?
চাণক্য বাড়ৈ: দু’টি কারণে। প্রথমত, আমার মনে হয়েছে, ঘটনার গভীরে যেতে হলে এমন একজনকে কেন্দ্রে আনতে হবে, যে নিজে ভিকটিম। কারণ, আমাদের সমাজে মেয়েরা যখন নানাভাবে নির্যতিত হয় এবং যখন এর প্রতিকার চাওয়া হয়, তখন সবচেয়ে বড় অভাব দেখা দেয় ওই ঘটনার একজন সাক্ষীর। আটানব্বই ভাগ ঘটনায় কোনো সাক্ষীই খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই, এমন একজনের মুখ থেকে এসব ঘনটনার বর্ণনা শোনা উচিত, যে নিজেই এর ভুক্তভোগী। অন্য কারও মুখ থেকে নয়। দ্বিতীয়ত, উপন্যাসটি বিবৃত হয়েছে উত্তম পুরুষে। যেখানে উত্তম পুরুষ হলো একজন নারী। উত্তম পুরুষ কেবল একজন পুরুষই হবে, এই যে ধারণার মধ্যে আমরা আছি, আমি এটা ভেঙে দিতে চেয়েছি। দুনিয়া কাঁপানো #মিটু আন্দোলনে যারা মুখ খুলেছে, এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রও তাদেরই একজন হিসেবে তার মুখ খুলেছে, এটাই আমি দেখাতে চেয়েছি। এই উপন্যাসটি #মিটু আন্দোলনকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি বহু নির্যাতিত নারীকে প্রকাশ্যে তাদের নির্যাতনের কথা জানাতে সাহস যোগাবে বলে আমার বিশ্বাস।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাস লেখার আগে আপনি উপন্যাসের সামগ্রিক রূপ ভেবে নিয়েছিলেন?
চাণক্য বাড়ৈ: প্রথমে এর প্লট দাঁড় করিয়েছি। এরপর টুকরো টুকরো ঘটনাগুলোকে জোড়া দিতে দিতে পরিণতির দিকে এগিয়েছি। লেখার সময় আমার পূর্বপরিকল্পনার কিছু বর্জন ও নতুন কিছু সংযোজন করেছি।
চিন্তাসূত্র: এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো কতটা বাস্তবভিত্তিক?
চাণক্য বাড়ৈ: এ উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্র বাস্তব। আবার সব চরিত্রই কাল্পনিক। মানে হলো, যে চরিত্রগুলো আমি নিয়েছি, তার সবই আমাদের সমাজে উজ্জ্বলভাবে বিরাজমান। আমার আপনার পাশের জনও হতে পারে এর কোনো না কোনো চরিত্র। সেই অর্থে সব চরিত্রই বাস্তব। রক্ত-মাংসের মানুষ তারা। আবার সব চরিত্রই আমার কল্পনার মৌলিক সৃষ্টি।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নাম কিভাবে ঠিক করেছেন?
চাণক্য বাড়ৈ: যেহেতু সমসময়ের উপন্যাস এটি, সেহেতু এ সময়ে যেসব নামের মানুষের দেখা বেশি মেলে সমাজে, সেসব থেকেই চরিত্রের নাম চয়ন করেছি। কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নয়।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাসে অনেক চরিত্রের সমাগম হলেও সেভাবে বিকশিত হয়নি। এছাড়া অনেক চরিত্রের নাম শুধু দুয়েকবার এসেছে। ফলে পড়ার সময় কেমন যেন একটা জট পাকিয়ে যায়। এটা কি এড়ানো যেতো না?
চাণক্য বাড়ৈ: উপন্যাসে বহু চরিত্র থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সব চরিত্রকে বিকশিত হতে হবে, এমন নয়। তাহলে মূল প্রসঙ্গ গৌণ হয়ে পড়ে। একটা উৎকৃষ্ট আলোকচিত্রে যেমন ক্যামেরার ফোকাস তার সমস্ত ইলিমেন্টের ওপর সমানভাবে পড়ে না। একটা পেইন্টিংয়ের সমস্ত অংশে কিন্তু সমানভাবে রঙ লাগানো থাকে না বা ডিটেল থাকে না। বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর্মগুলোর দিকে তাকানো যেতে পারে। যেমন, গুয়ের্নিকা, মোনালিসা, সানফ্লাওয়ার, তাহিতির মেয়ে, সানরাইজ; আমাদের বিদ্রোহী, দুর্ভিক্ষের স্কেচ, টোকাই সিরিজ—যেকোনোটির ক্ষেত্রে মিলিয়ে দেখলেও এটা দেখা যাবে। মহাভারতে পাণ্ডু, চিত্রাঙ্গদা, উত্তরা—এরা কতটুকু বিকশিত? বর্ষা নিয়ে কোনো একটি কবিতা পড়তে গেলে দেখা যাবে, বর্ষা ঋতুর সব বৈশিষ্ট্যই কিন্তু তার মধ্যে উঠে আসেনি। তেমনি উপন্যাসের বেলায়ও ব্যাপারটি এমন। মূলত, লেখক তার ফিকশনে নির্দিষ্ট কিছু চরিত্র ও ঘটনাকে ফোকাস করেন। অন্যরা আসে তার অনুষঙ্গ হিসেবে। আবার সবাইকে বিকশিত করতে গেলে বইয়ের কলেবরও অস্বাভাবিভাবে বেড়ে যায়। তা পাঠে পাঠকের অনীহা তৈরি হতে পারে।
আবার কিছু চরিত্র অল্প সময়ের, প্রয়োজন অনুসারে এসেছে তারা। যে-কেউ যদি স্মৃতিচারণ করে দেখে, তাহলে দেখবে, তার জীবনে এমন দুয়েকজন মানুষ খুব অল্প সময়ের জন্য এসেছে, পরবর্তী সময়ে যাদের কিছু না কিছু প্রভাব থেকে গেছে। এ উপন্যাসেও এভাবে এসেছে এই চরিত্রগুলো। এতে জট পেকেছে বলে আমি মনে করি না। বরং এদের উপস্থিতি আরও প্রলম্বিত হলে জট পাকানোর ঝুঁকি তৈরি হতে পারতো।
চিন্তাসূত্র: চরিত্র নিয়ে আরেকটি প্রশ্ন, এ উপন্যাসে সানিয়া মেহজাবীন ছাড়া অন্যান্য প্রধান চরিত্রগুলো আমাদের সামনে পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি। সবাই খণ্ডিতভাবে উঠে এসেছে। এটা কেন?
চাণক্য বাড়ৈ: এ প্রশ্নের উত্তর ইতোপূর্বেই চলে এসেছে অনেকটা। তবু বলছি, চরিত্রের বিকাশ হবে আখ্যানের প্রয়োজন অনুসারে। এখানে সানিয়ার জীবনজঙ্গম। তাকে দেখানো হয়েছে তার গ্রামের বাড়িতে, মামার বাড়িতে, ঢাকার এক আত্মীয়ের বাড়িতে, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও দুটো অংশ: ক্যাম্পাস আর আবাসিক হল। তো, এই পবির্তনশীল জীবনে যেসব বন্ধু, পরিজন, শিক্ষক—যারা এসেছে তাদের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই যতটুকু প্রয়োজন, অন্য চরিত্রগুলো ততটুকুই এসেছে।
চিন্তাসূত্র: সানিয়া উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। শুরু থেকেই আমরা একটা জিনিস দেখতে পাই, সে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছে, লড়াই করে এসেছে। বেশ ব্যক্তিত্বশালী সে। তো সে প্রথমে বান্ধবীদের সঙ্গে বললো, প্রেম জীবনে একবার আসে। অথচ সে মিরাজকে ভালোবাসতো, ভার্সিটিতে পড়তে এসে রিপন স্যারের প্রেমে পড়লো। এটা কি তার ব্যক্তিত্বকে একটু হালকা করে না? কারণ সে মুখে বলছে এক রকম, বিশ্বাস করছে অন্যরকম?
চাণক্য বাড়ৈ: না। এতে ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা চিহ্নিত হয় না। মানুষের জীবন দর্শন বিভিন্ন সময়ে বদলে যেতে পারে। বিশ্বাসও বদলায়। আর যে মেয়েটি উচ্চমাধ্যমিক পাস করে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছে, তার সমস্ত সিদ্ধান্ত পরবর্তী সময়েও অপরিবর্তিত থাকলে সেটাই বরং একটা সন্দেহের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আমি তো মনে করি, জীবনে প্রেম আসতে পারে এর বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে। কোনো বিশ্বাস, দর্শন আর যুক্তির তোয়াক্কা না করেই।
চিন্তাসূত্র: আবীরের সঙ্গেও সানিয়ার সম্পর্কটা আমার কাছে বেশ গোলমেলে মনে হয়েছে। সানিয়া তাদের সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব নামে চিহ্নিত করছে, আবীর যতবারই প্রেমের কথা বলছে, সানিয়া সেটাকে প্রত্যাখ্যান করছে। অথচ সে আবীরের হাত ধরে হাঁটছে, চুমু খাচ্ছে, ক্যাম্পাসে ঘনিষ্ঠভাবেও সময় কাটাচ্ছে—এটাকে আপনি শুধুই বন্ধুত্ব বলবেন? অথচ ধ্রুব যখন তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছে, সে কিন্তু সেটা খুব কঠোরভাবেই প্রত্যাখ্যান করছে।
চাণক্য বাড়ৈ: যেসব সম্পর্কে বহুরূপিতা তথা একাধিক মাত্রাপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে তা একেক পক্ষের কাছে একেভাবে নিরূপিত হয়। আবীর যাকে প্রেম ভাবছে, সানিয়া তাকে প্রেম না ভেবে বন্ধুত্ব ভাবতেই পারে। উপন্যাসেই সানিয়া এ ব্যাপারে তার অবস্থান বা যুক্তি ব্যাখ্যা করেছে। আবার বন্ধুত্বের পরিধিও সমবয়সী দুই তরুণ-তরুণীর কাছে সুনির্দিষ্ট নয়। এসব ক্ষেত্রে অনেক অসতর্ক মুহূর্তের ঝুঁকিও থেকে যায়, যা থেকে নানান বিচ্যুতি বা স্খলন মনুষ্য চরিত্রের বেলায় একেবারেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ জন্যই এই সম্পর্ক বা নৈকট্য যা-কিছু ঘটেছে, তা মানুষের চরিত্রের নিয়ম মেনেই ঘটেছে। কোনো একটা টাইপে তাদের জোর করে আটকে রাখা হয়নি। এই সম্পর্ককে তাই আমি গোলমেলে বলব না। বলব, অনেকটা রহস্যঘেরা অথবা অসংজ্ঞায়িত।
চিন্তাসূত্র: অন্যান্য চরিত্রের মতো ধ্রুব চরিত্রটাও প্রায় অস্ফুটই রয়ে গেছে। কিন্তু উপন্যাসে ধ্রুবর আবির্ভাব বেশ ভালোভাবেই হয়েছিল। তাকে কি আরেকটু গুরুত্ব দেওয়া যেতো না?
চাণক্য বাড়ৈ: তা হয়তো যেতে পারতো। তবে পাঠকের পূর্বানুমান যখন উপন্যাসে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তখন পাঠক নিজেই হতাশ হয়ে পড়েন। আর উপন্যাসে তা-ই তুলে ধরা হয়, যা বাস্তব জীবনে ঘটে। আমাদের জীবনেও তো অনেকের উজ্জ্বল উপস্থিতি একসময় ম্লান হয়ে আসে। অনেকেই হয়তো ভেবে বসে থাকবেন, যেভাবে এগোচ্ছে, ধ্রুবর সঙ্গেই সানিয়ার প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হতে যাচ্ছে, নয় কি?
চিন্তাসূত্র: উপন্যাসে মেরাজ ও জিলানীর মৃত্যুটাকে আমার কাছে কিছুটা সিনেমাটিক মনে হয়েছে। সানিয়া মেরাজকে ভালোবাসে। মারা যাওয়ার কারণে সে মেরাজকে পেলো না। জিলানী সানিয়ার ক্ষতি চেয়েছিল, দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার কারণে সেটা সম্ভব হলো না। এই যে মৃত্যুতে সমাধান এলো, এটা কি অন্য কোনোভাবে করা যেতো না?
চাণক্য বাড়ৈ: মজার প্রশ্ন। প্রথমে বলি, সমাধানের জন্য এখানে মৃত্যু ঘটানো হয়নি। মৃত্যু না ঘটলে কাহিনী হয়তো কিছুটা ভিন্ন দিকে যেতে পারতো, এই যা। মেরাজ বেঁচে থাকলেও যে সানিয়া তাকে পেতো, এমন তো নয়। বা জিলানি মারা গিয়েছে বলেই সানিয়া ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে, তা-ও নয়। এ কারণে, এ দুটি মৃত্যু যে সমাধান এনে দিয়েছে, তা বলা যথার্থ হবে না। আর এ মৃত্যুকে সিনেমাটিক কেন মনে হয়েছে, তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। প্রতিদিনই আমরা পত্রিকা বা টেলিভিশন খুললেই এমন মৃত্যুর একাধিক খবর পেয়ে যাই। চারিদিকে যা হরহামেশা ঘটছে, তাকে ওই অর্থে সিনেমাটিক বলা কতটাক যৌক্তিক?
চিন্তাসূত্র: সবচেয়ে বড় কথা সানিয়া মেহজাবীনও মৃত্যুকেই তার সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। অথচ সে হতে পারতো একজন সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। সেও কি আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কোনো পথ বেছে নিতে পারতো না? যে মেয়ে বাবার কথার অবাধ্য হয়ে আত্মীয়ের বাসা ছেড়ে হলে উঠতে পারে, নিজের খরচ নিজে চালাতে পারে, তারপক্ষে কি লড়াই করে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না?
চাণক্য বাড়ৈ: অবশ্যই সম্ভব ছিল। খেয়াল করে দেখবেন, সানিয়ার পক্ষে লড়াই করে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কিন্তু উপন্যাসে একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলেছে। সমাজ, পরিববার ও প্রথার বিরুদ্ধে অনেক লড়াই করতে হয়েছে তাকে। অনেক দূর যেতেও পেরেছে। এ পর্যায়ে এসে আত্মহত্যার চেষ্টা নিঃসন্দেহে তার জন্য বড় ভুল। কিন্তু অনেক যোদ্ধা একটা পর্যায়ে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। এটাও সত্য। হয়তো তাদের কথা কেউ লেখে না। অথচ বাস্তব জীবনে যা যা ঘটতে পারে, উপন্যাসের চরিত্রের ক্ষেত্রেও তার সমস্ত বিকল্প উজ্জ্বলভাবেই উপস্থিত থাকে।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাসে সানিয়া যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল, তা বাংলাদেশের একটি খ্যাতনামা বিদ্যাপীঠ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে, তার সবটুকু সত্য। একসময় পত্রিকায়ও তা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। তারপরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম কি পরিবর্তন করে দেওয়া যেতো না?
চাণক্য বাড়ৈ: নিশ্চয়ই যেতো। হয়তো তখন প্লট ঠিক রেখে টুকরোটাকরা ঘটনাগুলো অন্য কোনো ক্যাম্পাসের আদলে বিস্তৃতি পেতো। যেহেতু আয়তনে খুব ছোট দেশ আমাদের, কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিতে হতো, যেটা খ্যাতনামা তথা সবার খুবই পরিচিত। যেহেতু আমি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দেখাতে চেয়েছি, সেহেতু সবচেয়ে সুন্দর এবং আমার বসবাসের অভিজ্ঞতা আছে, এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নিতে চেয়েছি রচনা বা বর্ণনার সুবিধার কথা ভেবে। কারণ, আমি সবসময় একটা চেষ্টাই করেছি, পাঠকের কাছে মানুষগুলো যেন রক্তমাংসের হয় এবং কোনো বর্ণিত জায়গাই যেন কল্পিত না হয়ে ওঠে। এখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সব গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিস্বরূপ। আর শুধু সমস্যার কথা উঠে এসেছে বললে ভুল হবে। সফলতা ও সম্ভানার কথাও সমানভাবে উঠে এসেছে।
চিন্তাসূত্র: ‘কাঁচের মেয়ে’ উপন্যাসকে মোটামুটি দীর্ঘ উপন্যাসই বলা যায়। উপন্যাসের শুরুটা খুব টানটানভাবে হয়েছে। তবে মাঝে মাঝে কাহিনীটা শিথিল হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। হয়তো সানিয়া তার কাহিনী বলে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। তো উপন্যাসের আয়তন আরেকটু কমিয়ে সেটাকে আরও আঁটসাটো করা যেতো না?
চাণক্য বাড়ৈ: প্রথমত, এটি কোনো থ্রিলার কাহিনী নয়। বিশেষত, একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ের জীবন এখানে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের জীবন তো কখনো একভাবে যায় না। এর উত্থান-পতনও যেমন আছে, তেমনি নিস্তরঙ্গ প্রবহমানতাও আছে। এ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তা-ই দেখানো হয়েছে। কোনো রকমের অতিনাটকীয় বা চলচিত্রিক দূষণ থেকে পুরো উপন্যাসটিকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এ জন্য এর কোনো একটি অংশ কমানো যেতো বলে আমার মনে হয়নি।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাস লেখার সময় এমন কোনো ঘটনা আছে, যা আপনাকে কষ্ট দিয়েছে?
চাণক্য বাড়ৈ: সত্যি বলতে কী, এমন উল্লেখ করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি কেবল লিখে গিয়েছি। আর আবেগের চেয়ে বস্তুনিষ্ঠতার দিকে বেশি মনোযোগী হতে চেয়েছি। আবেগ যা সঞ্চারিত হবে, তা পাঠকের মনে।
চিন্তাসূত্র: উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে অনেক লেখকেরই এমন হয় যে, কোনো কোনো চরিত্রের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আপনার উপন্যাসের ক্ষেত্রে কি এমনটি ঘটেছে?
চাণক্য বাড়ৈ: একেবারেই না।
চিন্তাসূত্র: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি, কবিতা থেকে উপন্যাসে এলেন কেন? বিষয়টি কি এমন, যা বলতে চান, কবিতায় তা বলতে পারছেন না দেখে উপন্যাস লেখা?
চাণক্য বাড়ৈ: আমার জন্যা এটি একটি সঙ্গত প্রশ্ন। মূলত, কবিতা থেকে উপন্যাসে এসেছি, বিষয়টা এমন নয়। অনেক আগে থেকেই উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা ছিল। হয়তো তার বাস্তবায়ন ঘটল অনেক পরে এসে। আর কবিতায় বলতে পারছি না, এমন নয়। কবিতায় যা বলার তা কবিতাতেই বলছি। উপন্যাসে যা বলার তা, উপন্যাসেই বলা যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। একজন ক্ষুদ্র সাহিত্যকর্মী হিসেবে পরবর্তী সময়ে সাহিত্যের সব শাখায় সমানভাবে কাজ করার ইচ্ছেপোষণ করি।
চিন্তাসূত্র: ‘কাঁচের মেয়ে’ আপনার প্রথম উপন্যাস। তো কথাসাহিত্যে একজন নবাগত হিসেবে আপনি বলুন, নতুন যারা উপন্যাস লিখতে আসবে, তাদের প্রস্তুতিটা কেমন হওয়া উচিত?
চাণক্য বাড়ৈ: এটি আমার প্রথম উপন্যাস। তাই অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, নতুনদের উদ্দেশে বলার মতো অভিজ্ঞতা আমার ভাঁড়ারে এখনো জমে ওঠেনি। তবে হ্যাঁ, দেশি-বিদেশি সাহিত্য প্রচুর পাঠ, কঠোর পরিশ্রম আর নিষ্ঠার কোনো বিকল্প যে নেই, তা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। নতুনদের ক্ষেত্রেও এই তিনটি বিষয়কে আমি গুরুত্ব দিতে অনুরোধ করব।
চিন্তাসূত্র: এতক্ষণ সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
চাণক্য বাড়ৈ: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।