ভাষান্তর: অজিত দাশ
[ব্রাজিলিয়ান সাহিত্যিক পাওলো কোহেলো ১৯৪৭ সালে রিও ডি জেনিরোতে জন্মগ্রহণ করেন। লেখালেখির শুরুতে একজন নাট্যকার, গীতি কবি এবং সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। দ্য অ্যালকেমিস্ট, দ্য ভল্ককাইরিস, ভেরোনিকা ডিসাইডস টু ডাই ঐতিহ্যবাহী জাদুবিদ্যার ওপর লিখিত তার শক্তিশালী তিনটি বই। দ্য অ্যালকেমিস্ট এখন পর্যন্ত সর্বাধিক বিক্রিত ব্রাজিলিয়ান বইয়ের তালিকায় রয়েছে, যা তাকে বিখ্যাত করে তোলে। ]
প্রশ্ন: আপনার বইয়ের ভিতর দিয়ে কী ধরনের দর্শন মানুষের সামনে তুলে ধরতে চান?
কোহেলো: আমি যখন বর্তমানের মুখোমুখি হই, তখন আমার ভেতরের জিজ্ঞাসা এবং সন্দেহ চড়া হয়ে ওঠে। আমি দেখেছি কোনো কিছুর পূর্ণ দর্শন আমাদের ভেতরের প্রয়োজন অনুযায়ী পাল্টাতে থাকে। কিন্তু আমি যদি আমার কাজের বিশ্লেষণ করি, আমি বলব, নিজ অস্তিত্বের সত্যতা যাচাই করো, তোমার স্বপ্নের মূল্য দাও, কোনো কিছুর পূর্ব লক্ষণ খেয়াল করো, তোমার নারী সত্তাকে জাগ্রত করো এবং তোমার নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা করে তৈরি করতে সাহস করো।
প্রশ্ন: আপনি কিভাবে আপনার বইগুলোকে বিবেচনা করেন?
কোহেলো: দুটি বই হচ্ছে আমার কল্প কাহিনিনির্ভর। বাকিগুলো আমার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত-কিন্তু সংকেত এবং রূপকআশ্রিত ভাষা দিয়ে। আমি বিশ্বাস করি কোনো শিল্পী তার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা অর্জন করেন তাই অন্যের কাছে প্রকাশ করেন, সেই অভিজ্ঞতা কতটুকু রূপক আর কতটুকু বাস্তব তা বিবেচনা না করেই।
প্রশ্ন: আপনি কখন থেকে লেখালেখি শুরু করেছিলেন?
কোহেলো: কৈশর থেকেই আমি লেখালেখি শুরু করি। তারপর মা আমাকে জানালেন ব্রাজিলে লেখালেখি করে জীবনধারণ অনেক কষ্টকর। আমি তার কথা বিশ্বাসও করেছি এবং অন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। তাই আমি কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দেই, একজন হিপ্পি হিসেবে ভ্রমণ করতে শুরু করি। যখন আমি ব্রাজিলে ফিরে এসেছি একটি আন্ডার গ্রাউন্ড ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি তখন গীতিকবিতা লেখার জন্য প্রস্তাব পেয়েছি এবং পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতাও করেছি। লেখালেখি ছাড়াই আমি জীবনযাত্রা শুরু করেছিলাম। যদিও আটত্রিশ বছরের আগে আমি কোনো বই লেখা শুরু করিনি।
প্রশ্ন: কেন?
কোহেলো: আমি বিশ্বাস করি দুটি জিনিস মানুষকে স্বপ্নের কাছ থেকে দূরে রাখে। এইটা ভাবতে শুরু করা যে এটা একেবারে অসম্ভব, এবং এইটা উপলব্ধি করা যে এইটা সম্ভব (দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে যদি সে জীবনের আসল মানে হারিয়ে ফেলে)।
প্রশ্ন: আপনাকে কোন কোন জিনিস অনুপ্রাণিত করেছে?
কোহেলো: আমার ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তটি হচ্ছে ‘সান্তিয়াগো দে কম্পোসতিলার’ উদ্দেশ্যে তীর্থভ্রমণে বেড় হওয়া। আর তারপরই আমি আমার জীবনের বেশির ভাগ সময়তে প্রকৃতির গোপন রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নিয়োজিত করেছি, আর উপলব্ধি করেছি সেখানে কোন গোপনীয়তা নেই। আমাদের অবশ্যই কোন কিছুর পূর্ব লক্ষণকে জানা দরকার এবং অন্যের প্রতি মনোযোগ তৈরি করা দরকার। জীবন একটা অপরিবর্তনীয় অলৌকিক ঘটনা এবং এই অলৌকিকতা অন্যকে বিপদের মুখোমুখি ফেলে নিজেই স্পষ্টতর হতে থাকে। এই তীর্থযাত্রার পর আমি আমার আধ্যাতিক অনুসন্ধানকে অনেক বেশি পরিমাণে বোঝার চেষ্টা করেছি এবং এখনো অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: আপনার দ্য ভলকাইরিস বইটিতে আপনি নিজেই নায়ক। বইটিকে আপনার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ বলা যায় কি না?
কোহেলো: হ্যাঁ এটা আত্মজীবনীমূলক। বইটিতে যে বর্ণনা দেওয়া আছে, তার সবই সত্য। ওপরের প্রশ্নগুলোকে পরিপূর্ণভাবে পেতে এবং আরো সহজ সাধ্য করতে আমি একজন অভিভাবক দেবদূতকে খুঁজেছি এবং এখনো আমি মনে করি নির্মলতাই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর জন্য সবচেয়ে উত্তম পথ।
প্রশ্ন: আপনি কি কখনো দেবদূত দেখেছেন?
কোহেলো: আমি দেখেছি। আমরা সবাই জানি দেবদূত হচ্ছে ঈশ্বরের বার্তা বাহক। স্বর্গীয় আলোর দ্যুতি। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে অন্যের মাধ্যম হয়ে অস্বাভাবিকভাবে কথা বলে।
প্রশ্ন: ভলকাইরিস বইটিতে আপনি আপনার নিজেকে জাদুকর বলেছেন। বাস্তবে কি আপনি একজন জাদুকর মনে করেন?
কোহেলো: প্রতিটি মানুষই জাদুকর-সান্তিয়াগো দ্য কম্পোসতিলায় ভ্রমণে যাওয়া আমার জন্য একটি বড় অভিজ্ঞতা। বলতে পার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি আমি। বিষয়টা হচ্ছে, কেহই এটা গ্রহণ করেনা যে,তার মধ্যে একটা সহজাত গুণ এবং ক্ষমতা রয়েছে। জাদুর বিদ্যায় দুটি ঐতিহ্য আছে। একটি চাঁদ আরেকটি সূর্য। প্রথম ব্যাপার হচ্ছে জ্ঞানকে সংবদ্ধ করা আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে তার উন্মোচন ঘটানো। আমার যৌবনে আমি সনাতন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করেছি, এখনো আমি উপলব্ধি করি যে-আমি ও আমরা প্রত্যেকে সবকিছুই জানি। জগতের মূল স্রোতের সঙ্গে আমাদের একাত্ম হতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হচ্ছে একটা উপায় মাত্র।
প্রশ্ন: আপনি লিখেছেন যে, জাদুমন্ত্রকে আপনি শখ হিসেবে চর্চা করেন। এর মধ্যে দিয়ে আপনি আসলে কি খুঁজে পান?
কোহেলো: এটা ভলকাইরিস বইটিতে লেখা আছে। কোনো রকমের দায়িত্ব না নিয়েই, আমি আসলে এমন একটা শক্তির সঙ্গে আবদ্ধ হয়েছিলাম যার সঙ্গে আমার কোনো পূর্ব পরিচিতি ছিল না। কিন্তু ঈশ্বর দয়ালু যে আমাকে একটা কঠিন অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিয়েছেন।
প্রশ্ন: কার্লোস কাস্টানিডাও জাদুবিদ্যার ওপর একটি বই লিখেছিলেন। আপনাদের দুজনের ধারণার মধ্যে কি কোনো সাদৃশ্য আছে?
কোহেলো: কাস্টানিডা আমার যৌবনে অনেক ভূমিকা রেখেছে। আমি স্পষ্টভাবে জানি, বিশ্বাসের ভিতর দিয়েই একজন শাশ্বত জ্ঞান অর্জনের পথে যেতে পারে।
প্রশ্ন: আপনার জীবনের অনুপ্রেরণা কী?
কোহেলো: প্রতিটি মানুষের জীবনে একটি উদ্দেশ্য আছে। এটা আমরা তখনই জানতে পারি যখন আমরা আমাদের হ্নদয়ের কথা শুনে লক্ষ্যের নিকটবর্তী হই। তাই আমার অনুপ্রেরণা হলো প্রতিটি উদ্দেশ্যকে তার লক্ষ্য পর্যন্ত নিয়ে যেতে নিরন্তর সংগ্রাম করতে হবে ।
প্রশ্ন: একজন লেখক কি লেখালেখির জন্যই জন্মগ্রহণ করেন কিংবা লেখালেখির জন্য আগে থেকে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হতে হয় কী?
কোহেলো: তোমার প্রয়োজন অনুপ্রেরণা, দৃঢ়তা এবং ক্ষমাশীলতা। তোমার একটি পরিষ্কার লক্ষ্য থাকা দরকার, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর জন্য তোমার নিজেকে সেভাবে পথপ্রদর্শক হতে হবে।
প্রশ্ন: আজকাল অনেকেই মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার কথা ভাবেন, কেউ কেউ সমাধি বা কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে চায়। আপনার কি মনে হয় মানব জাতির পরিবর্তনে এগুলো কোনো সঠিক নির্দেশনা?
কোহেলো: আমি দেখতে পাচ্ছি যে, মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগটিকে জটিল করে তুলছে। যদিও এই নতুন ধারণা একটা নির্দিষ্ট দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে। কিন্তু এইটাকে সবকিছু ভেবে আমরা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে পারি না। এপেনডিসাইটিসের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসক নয় বরং একজন অস্ত্রপাচারকারী চিকিৎসকের প্রয়োজন।
প্রশ্ন: কোন জায়গাটি থেকে আমরা সমাজ বিকাশের পথ সূচনা করব?
কোহেলো: আমরা দুটি জায়গার মধ্যস্থলে অবস্থান করছি। ইতোমধ্যেই আধ্যাত্মবাদ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমাদের হাতে দুটি সম্ভাবনা আছে। হয়ত আমাদেরকে মৌলবাদী হতে হবে নইলে সহনশীলতার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমি সহনশীলতার কথাই বলব কিন্তু এটা একটা দীর্ঘ সংগ্রাম এবং এটা নির্ভর করবে বর্তমানে মানুষজন ঘটনা পরম্পরায় কিভাবে আচরণ করে তার ওপর।
প্রশ্ন: দ্য অ্যালকেমিস্ট আপনার বইগুলো থেকে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছে। আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন এটা আপনার সবচেয়ে ভালো বই?
কোহেলো: আমি আমার সবগুলো বইকে এ প্লাস দেব, কেননা এই বইগুলোর ভেতর আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠটাকে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তার মানে আমার বই আমার নিজের চেয়েও মূল্যবান।
প্রশ্ন: আপনি কোন কোন লেখক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
কোহেলো: কাস্টানিডা, হেনরি মিলার, উইলিয়াম ব্ল্যাক। কিন্তু সবার ঊর্ধ্বে জর্জ আমাডো এবং জর্জ লুইস বোর্হেস।
প্রশ্ন: একজন লেখক সমাজে কি রকম ভূমিকা পালন করেন?
কোহেলো: একজন মালী বা টেক্সি চালকের মতোই ভূমিকা পালন করে। যদি তুমি প্রবল উৎসাহ আর ভালোবাসা নিয়ে কাজ করো তাহলে মানুষকে মঙ্গলের দিকে প্রভাবিত করতে পারবে।
প্রশ্ন: আপনার বইগুলো প্রচুর পরিমাণে সংবেদনশীলতা চিত্রিত করে। মাঝে মাঝে করুণ রসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই সময়ের বইগুলো তা তেমন একটা পাওয়া যায় না, যা ভালোভাবে ভাবতে আগ্রহ দেবে, আশাবাদী হতে সাহায্য করবে।
কোহেলো: আমি অন্যের বইকে বিচার করতে চাই না। আমার বইগুলো কেবল আমার অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করেছে, আমার প্রজ্ঞাকে নয়। প্রথমত আমি জ্ঞানী নই-যা আমি আগেও বলেছি, সবাই সব কিছু জানে আবার কেহই কিছু জানে না কেননা ঈশ্বর গণতান্ত্রিক। দ্বিতীয়ত, অভিজ্ঞতাই হচ্ছে সব যা তুমি অবশ্যই অন্যকে জানাবে। এটাই আমাদের বিচার, অন্যকে জানানো। একটি বই মানুষের মধ্যে পরিবর্তন এনে দিতে সাহায্য করে, মানুষকে বোঝাতে সাহায্য করে যে সে একা নয়। অনেক লেখকরাই আমাকে এইটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এবং আমি আমার জীবনে অনেক অস্থির মুহূর্তে স্বস্তি পেয়েছি। একটি ভালো বই তোমার ভালো সঙ্গী হতে পারে। কিন্তু তা নির্ভর করে আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর।