রাজু আলাউদ্দিন একজন কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। ১৯৫৬ সালের ৬ মে তিনি শরীয়তপুর জন্মগ্রহণ করলেও পড়াশোনা ও চাকরিসূত্রে থাকছেন রাজধানী ঢাকায়। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বিশ। তিনি ন্যানো কাব্যতত্ত্ব ও যমজ কাব্যতত্ত্বের জনক। ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষা থেকে প্রচুর অনুবাদ করেছেন তিনি। বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অনেক লেখককে পরিচয় করে দিয়েছেন আমাদের কাছে। হোর্হে লুইস বোর্হেসের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ভাষণ অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তিনি তার গভীর মেধা-শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া অনুবাদ করেছেন মারিও বার্গাস য়োঁসা, সি পি কাভাফি, ঢেউ হিউজসহ আরও অনেকের রচনা। সম্প্রতি এই কবি-প্রাবন্ধিক-অনুবাদকের মুখোমুখি হয়েছেন শাহাদাৎ শাহেদ।
শাহাদাৎ শাহেদ: রাজু আলাউদ্দিন বললেই আমাদের চোখে একজন দক্ষ অনুবাদকের চেহারা ভেসে ওঠে। যদিও আপনি কবিতা, গদ্য ও প্রবন্ধে নিজের একটি জগৎ তৈরি করেছেন। কেন আপনি অনুবাদে ঝুঁকলেন?
রাজু আলাউদ্দিন: বললেন দক্ষ অনুবাদক—আমি জনি না কতটা দক্ষ। এখনো এই দক্ষতার বিষয়ে আমার নিজেরই অনেক সংশয় আছে। আর অনুবাদ কেন নিয়েছি, সেটা বললে এই দক্ষতা বা অদক্ষতার বিষয়টিও সেখানে চলে আসবে। এক হচ্ছে, আমি নিজেকে পাঠক মনে করি এবং অনুবাদক হচ্ছে আরেকটু গভীর পাঠকের কাজ আরকি! কারণ আপনি যখন কোনো লেখা অনুবাদ করতে যান, তখন আপনি আসলে যেই লেখাটি অনুবাদ করবেন, সেই লেখাটিকে আরও গভীরভাবে, আরও অন্তরঙ্গভাবে জানার জন্য চেষ্টা করবেন; তাই না? সেই চেষ্টা থেকে যে পাঠটা তৈরি হয়, সেটা আসলে অনেক বেশি অন্তরঙ্গ পাঠ। আমি যখন কোনো কিছু পাঠ করি, তখন ওইটার একটা অভিঘাত আমার ভেতরে তৈরি হয়। আর সেটাই যখন অনুবাদ করার জন্য চিন্তা করি বা পরিকল্পনা করি বা অনুবাদের চেষ্ট করি, তখন ওই লেখাটিকে আরও খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে অর্থ বোঝার চেষ্টা করি। একই সঙ্গে কবিতার মধ্যে অনেক রকম অলঙ্কারের প্রয়োগ থাকে, সে জিনিসগুলোও বোঝার চেষ্টা করি। যেমন, আমি কবিতার কথা বলছি, কারণ আমি কবিতাই বেশি অনুবাদ করেছি। কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের এমন একটি মাধ্যম যেটি অনেক বেশি সাংকেতিক। কারণ উপন্যাসে আপনাকে অতবেশি সংকেতের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে সাংকেতিকতা অনেক বড় একটা ইয়ে…। কবি কবিতার মধ্যে কথা বলেন ইঙ্গিতময়তার মধ্য দিয়ে, কখনো কখনো পরোক্ষ উল্লেখের মাধ্যমে যেটাকে ইংরেজিতে বলে অ্যালুশন—এ রকম আরও নানা অলঙ্কার আছে, যেগুলো ঠিক প্রত্যক্ষ না পরোক্ষ। সে কারণে আপনি যখন অনুবাদ করতে যান, তখন এই জিনিসগুলো, এই সম্পর্কগুলো এবং পুরো কবিতার পরম্পরাগুলো বোঝাটা অনেক জরুরি হয়ে পড়ে। কারণ অপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি আসলে অনুবাদ করতে পারবেন না। না বুঝে করলে সেটা একটি ব্যর্থ অনুবাদ হবে। তো প্রশ্ন ছিল—কেন আমি অনুবাদে ঝুঁকেছি? ঝোঁকার কারণ হলো, আমি যে লেখাটি পড়ছি, আমি কী পড়ছি, সেটিকে আরও ভালো করে বোঝার জন্যই আসলে আমি অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। অনুবাদক হওয়ার জন্য অনুবাদ করিনি। আমি আরও ভালো পাঠক হওয়ার জন্য অনুবাদ করেছি।
শাহাদাৎ শাহেদ: আপনি যেটা পড়ে আনন্দ পাচ্ছেন, সে আনন্দটা অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুবাদ করেন না?
রাজু আলাউদ্দিন: আমার মধ্যে আসলে সে রকম কোনো বোধ কাজ করে না—আমি যখন অনুবাদ করি। কারণ আমি যেটা অনুবাদ করব ঠিক করি, তখন তো ওই লেখাটির প্রেমেই আগে পড়ি, তাই না? তো প্রেমে পড়ার সময় তো কখনো এটা ভাবি না যে, এই প্রেমটা আমি অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেব, তাই না? কিন্তু ঘটনাটা ঘটে যায়। আপনি চান বা না চান, পরিকল্পনা করেন বা না করেন—সেটার ফলটা ঘটে, সেইটা ছড়িয়ে পড়ে। তো আমি এইটা বিশ্বাস করি না যে, অন্যকে শিক্ষিত করার জন্য বা অন্যের সঙ্গে আমার আনন্দ ভাগ করার জন্য আমি অনুবাদ করি। আমি অনুবাদ করি আমার ভালো লাগে বলে। তবে এটা বলতে পারেন যখন আমি প্রকাশ করি, তখন সে আনন্দটা আমি অন্যদের মধ্যে শেয়ার করতে চাই। এটুকুই হচ্ছে পার্থক্য।
________________________________________________________________________________________
একজন অনুবাদককে অনেক জানতে হয়। যার কবিতা অনুবাদ করবেন, তার সম্পর্কে বিস্তর জানা উচিত। তারপর যেই ভাষার কবিকে অনুবাদ করবেন, সেই ভাষাটি সরাসরি না জানলেও অন্তত ওই ভাষার ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা উচিত।
________________________________________________________________________________________
শাহাদাৎ শাহেদ: আমরা জানি কবিতার ক্ষেত্রে চিত্রকল্প, ভাবের গভীরতা, ভাষার মাধুর্য, বিভিন্ন ধরনের অলঙ্কার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন কবিতা অনুবাদ করেন, তখন এগুলো কতটা নিজে রক্ষা করতে পারেন বলে মনে হয়?
রাজু আলাউদ্দিন: এই প্রশ্নটা আসলে অনুবাদের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা হলো—আমি অনুবাদের ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করি। অনুবাদের তো অনেক রকম-ধরন আছে। যেমন কেউ-কেউ ভাষান্তর করেন, কেউ-কেউ রূপান্তর করেন, কেউ-কেউ ভাবান্তর করেন, কেউ-কেউ লিটারেল ট্রান্সলেশন করেন। আমি লিটারেল ট্রান্সলেশনের পক্ষে। পক্ষে এজন্য—কবিতা, ভাষা বা সাহিত্য যাই বলেন—প্রত্যেকটি ভাষার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।এর নিজস্ব ধরন, নিজস্ব চলন বা নিজস্ব ছন্দময়তা আছে। তো আমি যখন ভাবি যে, অন্য একটি বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ করতে যাচ্ছি, তখন এটি তো আমাদের ভাবনার মধ্যে থাকেই যে, অন্য একটি সাহিত্য আমি পড়ি কেন? সেটা আমার সাহিত্য না বলেই তো। অর্থাৎ আমি জানতে চাই অন্য ভাষার, অন্য মানুষের সংস্কৃতি, তাই না? তো সেইটাই যদি হয়, তাহলে অনুবাদক হিসেবে আমার মনে হয় দায়িত্ব হচ্ছে—ওইভাষার বৈশিষ্ট্য, ওই ভাষার নিজস্ব রং, ছন্দ যতটুকু সম্ভব…জানি এইটা একটা সোনার পাথরবাটির মতো। যেহেতু প্রতিটি ভাষাই আলাদা, সেহেতু ওটাকে আসলে হুবহু অনুবাদ করা মুশকিল। এজন্য আমি বিশ্বাস করি—কবিতার অনুবাদ, অন্তত, এটা প্যারাডক্সের মতো। এটা হয় এবং হয় না, দু’টোই। এইটা এতটাই স্ববিরোধী একটা ঘটনা। যেমন এর আগেও আমি বলেছি যে, ধরা যাক, জীবনানন্দ দাশের কোনো কবিতা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে রূপসীবাংলার কবিতাগুলো—এই কবিতাগুলোর স্থানিকতা, যেটাকে বলে যে লোকালকালার, এইটা এত বেশি যে, অন্য কোনো ভাষায় সেটা ট্রান্সফার করা যায় না। যেটা ট্রান্সফার করা যায় বা স্থানান্তর করা যায়, সেটা হচ্ছে কবিতার মোটামুটি চুম্বকাংশ, বক্তব্য। তারপর এর আলঙ্কারিক কিছু হয়তো স্থানান্তর করা যায় কিন্তু ওর ভেতরের যে অন্তর্নিহিত তাৎপর্য—যেমন, কবিতার মধ্যে আপনার কিছু লোকাল উপকথা বা বেশ কিছু অনুষঙ্গ, যেগুলো আমরা আমাদের ভাষায় জন্মগ্রহণ করার কারণে জানি, সেগুলো বুঝি। সেই বোঝার কারণে আমাদের মধ্যে আলাদা একটা শিহরণ তৈরি করে। কিন্তু যার কাছে এই সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা নেই, তিনি তো আসলে ওইভাবে শিহরিত হবেন না। তিনি শুধু দেখবেন—ও হ্যাঁ, এই কবিতার মধ্যে এ রকম একটি বক্তব্য আছে। এ কবিতার আলঙ্কারিক সৌন্দর্য আছে। কিন্তু ওই কবিতাগুলোয় তো আলঙ্কারিক সৌন্দর্য এবং বক্তব্য উপচে পড়ে এমন কিছু সংবেদনশীলতা, এমন কিছু সংবেদ থাকে, যা শুধু নিজ ভাষায় জন্মগ্রহণের কারণে, নিজেদের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা থাকার কারণে আপনি অন্যভাবে অনুভব করবেন। এটা আরেকজন বিদেশি পাঠকের কাছে সম্ভব নয়। এরপরও অনুবাদ আমাদের করতে হবে, আমরা করি। তবে এর মধ্যেও আবার যতটুকু সম্ভব, সেটুকু যদি আমরা যথাযথভাবে চেষ্টা না করি, তাহলে বিদেশি পাঠক আরও হারাবে। সেক্ষেত্রে আমার আদর্শ হওয়া উচিত নয় কি, আমি যতটুকু সম্ভব সতর্ক থাকি? তাই না? যেন বিদেশি পাঠক কম বঞ্চিত হবে।
শাহাদাৎ শাহেদ: লিটারেল ট্রান্সলেশন, এ বিষয়টা…
রাজু আলাউদ্দিন: ওই টেক্সটের কোনো কিছু বাদ না দিয়ে বা আমার মনের মতো করে টেক্সটের ভেতরে কিছু না জড়িয়ে অনুবাদ করার চেষ্টা করা। মূল ভাষার মূলভাব, ভঙ্গি, তার বিন্যাস যতদূর সম্ভব অক্ষুণ্ন রেখে অনুবাদ করার চেষ্টা করা।
শাহাদাৎ শাহেদ: একটি ভাষা থেকে আরেকটা ভাষার অনুবাদের ক্ষেত্রে যথাযথ শব্দ পাওয়া, পরিভাষা পাওয়া একটা সমস্যা। আপনার ক্ষেত্রে আপনি কিভাবে সেটা ওভারকাম করেন? যেমন এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, আপনি পরিভাষা তৈরি করেছেন…
রাজু আলাউদ্দিন: পরিভাষা…হ্যাঁ, এইটা তো অনুবাদ করতে গেলে পরিভাষার আশ্রয় নিতে হয় এবং কখনো কখনো পরিভাষা তৈরিও করতে হয়। কারণ যেহেতু অন্যভাষার এমন কিছু প্রকাশভঙ্গি থাকে, এমন কিছু নিজস্ব শব্দগুচ্ছ (বাগধারা) থাকে, যেগুলো অন্য আরেকটি ভাষায় নেই। তখন তো পরিভাষা তৈরি করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। তো সেটা তো করতেই হয়। সেটা আমাদের আগে যারা অনুবাদ করেছেন, তাদেরও পরিভাষা তৈরির দরকার হয়েছে। সেটা না করে তো উপায় নেই।
শাহাদাৎ শাহেদ: অনেকে হোর্হে লুইস বোর্হেসকে দুরূহপাঠ্য বলে মনে করেন। তাকে লেখকদের লেখক হিসেবেও উল্লেখ করেন অনেকে। আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বোর্হেস একজন পণ্ডিত লেখক। তিনি জটিল কিন্তু আনন্দদায়ক।’ এই আনন্দই কি আপনাকে বোর্হেস অনুবাদে উৎসাহী করে তুললো?
রাজু আলাউদ্দিন: হ্যাঁ, ঠিকই। মানে বোর্হেস তো একটু দুরূহ। দুরূহ এজন্য বলব যে, আগের সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা যদি আমাদের স্মরণে থাকে, সেই তুলনায় তিনি একটু জটিল। ওনার যে শৈলী, গল্প লেখার যে শৈলী, সেখানে অনেক ট্রিকি ব্যাপার থাকে। ট্রিকি মানে—যেমন তার একটা স্টাইল হচ্ছে মক সিরিয়াসনেস, ওইটা আসলে মক নাকি সিরিয়াস—এই পার্থক্যগুলো ঘুচে যায়। এখন আপনি যখন পাঠ করবেন তখন, যেমন তার গল্পগুলো প্রবন্ধের মতো, প্রবন্ধগুলো গল্পের মতো। তো এটা আমরা মানে প্রথমত বিভ্রান্তি বোধ করি যে, এটা আসলে কিভাবে লেখা, এটা কী? এজন্যই বলছি যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য যে শাখা আছে বা এর আগে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে, তিনি এগুলো নিয়ে খেলা করছেন। তিনি যেমন তাসের মধ্যে শাসন করেন, তাই না? তিনি আসলে এগুলো নিয়ে শাসন করছেন, খেলছেন, নিজের মতো করে একটা বিন্যাসস করছেন এবং সেটা করতে যাওয়ার জন্য যেই পাণ্ডিত্য দরকার, সেই পাণ্ডিত্য তার বিপুল পরিমাণে ছিল। একইসঙ্গে তাঁর সৃজনশীলতাও ছিল। তো সেই পাণ্ডিত্য তো একজন পাঠককে প্রথমে আকর্ষণ করে না, আকর্ষণ করে আনন্দটা। আমি মনে করি সেই আনন্দটা বোর্হেসের মধ্যে বিপুলভাবে আছে। আপনি দেখবেন যেকোনো খেলায়, যখন খেলাটি অনেক বেশি জটিল হয়, তখন ওটার ভেতরে আপনি আরও বেশি লিপ্ত হয়ে যান। আর যেকোনো সহজ খেলা, আমরা ছোটবেলায় অনেক সহজ খেলা খেলেছি, তাই না? ওই খেলাগুলো কিন্তু এখন আর আমাদের টানে না বা আকর্ষণ করে না। আমাদের বয়স ও অভিজ্ঞতা যত বাড়ে, জ্ঞান যত বাড়তে থাকে, আমরা আরও জটিল জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হই। জটিল বলতে আমি বোঝাচ্ছি—ওই খেলাটি কত বেশি কৌশলপূর্ণ, ওই খেলার মধ্যে কত ধরনের ফাঁদ থাকে…। এই জিনিসগুলো যখন আমরা দেখি, সে ফাঁদ এড়ানোর জন্য আমরা নিজেদের মতো করে পরিকল্পনা তৈরি করি বা নিজেদের মতো করে আমরা স্ট্র্যাটেজি তৈরি করি, তাই না? তো এই যে জটিলতা, এই জটিলতা কাটানোর একটা আনন্দ আছে। সেটা বোর্হেসের মধ্যে ছিল। এ জটিলতা বোর্হেসের প্রতি আগ্রহী হওয়ার একটা দিক ছিল। এছাড়া তার বিপুল পরিমাণ কল্পনা শক্তি ছিল। আমাকে যেটা আকৃষ্ট করেছে, সেটা হলো তার অসাধারণ কল্পনাশক্তি আর অসমান্য শিল্পকৌশল। মানে একটি গল্পকে কতখানি নিখুঁত শিল্পকৌশলের মাধ্যমে উঁচুতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেই স্বাধটা বোর্হেসের মধ্যে পাওয়া যায়। সেটা আমাকে আকৃষ্ট করেছে। আরেকটা জিনিস হলো, এই যে পৃথিবীকে অন্যভাবে দেখা—মানুষের জীবন, মানুষের সমস্ত অর্জন, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে অন্যভাবে দেখার যে কল্পনা শক্তি, সেটা বোর্হেসের মধ্যে আছে।
শাহাদাৎ শাহেদ: আপনি স্পেনিশ ও ইংরেজি থেকে অনেক অনুবাদ করেছেন। তো এই ভাষা, সাহিত্য বা ইতিহাস ঐতিহ্যের দখল বিষয়ে আপনি কতটা তৃপ্ত?
রাজু আলাউদ্দিন: (হাসতে হাসতে) আমি তৃপ্ত না, আমি ক্ষিপ্ত। অসামর্থ্য আমকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। বয়স বেশি নেই বলে আমি ক্ষিপ্ততা বোধ করি। এর কারণ হচ্ছে, এর যে বিশাল ভাণ্ডার। মনে হয় আমি সবেমাত্র প্রবেশ করলাম। এই বিশাল ভাণ্ডার শেষ করা যাবে না। এটাই আমাকে ভেতরে ভেতরে ক্ষিপ্ত করে তোলে। আমার কোনো তৃপ্তি নেই।
শাহাদাৎ শাহেদ: আচ্ছা, একজন তরুণ কিছু অনুবাদ করছে বা অনুবাদের পরিকল্পনা করছে—তাকে আপনি কী ধরনের প্রস্তুতির কথা বলবেন?
রাজু আলাউদ্দিন: আমি বলব—আমি নিজে অনুবাদ করার সময় যেটা বিশ্বাস করি, সেই কথাটাই বলি। সেটা হচ্ছে যে, কেউ যেন মনে না করে যে, অনুবাদ করা মানে হচ্ছে একটা ভাষা থেকে আরেকটা ভাষায় স্থানান্তর করা। একজন আদর্শ অনুবাদকের যে বিষয়গুলো অনিবার্য, সেগুলো হচ্ছে, তাকে বিপুল পাঠের অধিকারী হতে হবে। আপনি বলবেন যে, এ পাঠের কী দরকার? যে কবিতা আপনি অনুবাদ করবেন, আপনি ইংরেজি ভাষা থেকে করলে ইংরেজি জানলেই আপনার অনুবাদ করতে পারছেন; ব্যাপারটি আমার কাছে শুধু তা মনে হয় না। কারণ, একটি কবিতার মধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ জড়িয়ে থাকে। সেই অনুষঙ্গগুলো সম্পর্কে আপনার যদি ধারণা না থাকে, তাহলে আপনি অনুবাদে ব্যর্থ হতে পারেন। যেমন একটা উদাহরণ দেই—‘বনলতা সেন’ কবিতাটির। এই কবিতাটির মধ্যে এডগার অ্যালান পোর অনুষঙ্গ আছে, তারপর আপনার কিডসের আছে, শেলির কবিতার অনুষঙ্গ সেখানে আছে, তারপর আপনার হোমার আছে। তো আপনি চিন্তা করেন এই কবিতাটি আমরা যদি এই সমস্ত অনুষঙ্গ মাথায় রেখে পাঠ করতে যাই, তাহলে কিন্তু এই কবির দক্ষতা, এই কবিতাটি পাঠ করতে গেলে এর পরোক্ষ যে উল্লেখগুলো, সেটা কিন্তু আমাদের জন্য আলাদা একটা আনন্দ তৈরি করবে, তাই না? সেটা যদি জানি, তাহলে অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি সতর্ক থাকব। সতর্ক থাকব এই অর্থে যে, ওই শব্দগুলো ব্যবহারের যেই সাংকেতিকতা, যেই সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে, সেই একই সাংকেতিকতা ও সংবেদনশীলতা আমি অন্য যে ভাষায় অনুবাদ করব, সেভাষায় যদি রক্ষা করতে পারি, তাহলেই এই কবিতাটির প্রতি যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হবে। তার মানে একজন অনুবাদককে অনেক জানতে হয়। যার কবিতা অনুবাদ করবেন, তার সম্পর্কে বিস্তর জানা উচিত। তারপর যেই ভাষার কবিকে অনুবাদ করবেন, সেই ভাষাটি সরাসরি না জানলেও অন্তত ওই ভাষার ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা উচিত। তাহলে আমি মনে করি যে, অনুবাদটি অনেক বেশি সফল করা সম্ভব। মূলভাষা থেকে করতে পারলে তো সোনায় সোহাগা।
_______________________________________________________________________________________
এটা শিল্প-সাহিত্যের স্বভাব নয় যে, সঙ্গে-সঙ্গেই তা অনেকের কাছে প্রকাশ করে দেবে। এটাকে বলব প্রি-ম্যাচিউর্ড ইজাকুলেশন। মানে আপনি সঙ্গমে যাওয়ার আগেই স্খলন ঘটে যাচ্ছে। ফেসবুকে অনেকটা এমন হয়।
_______________________________________________________________________________________
শাহাদাৎ শাহেদ: আপনি ও ব্রাত্য রাইসু অনেক গুণীজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আপনারা সাক্ষাৎকারের একটি নিজস্ব প্যাটার্ন দাঁড় করিয়েছেন। এই সম্পর্কে কিছু বলবেন?
রাজু আলাউদ্দিন: একটা ব্যাপার হলো, আমাদের সাক্ষাৎকারগুলো একটু ভিন্ন রকম ছিল। কারণ আমরা যখন সাক্ষাৎকার নিতাম, তার আগে দেখা গেছে যে, সাক্ষাৎকারগুলো নেওয়া হতো লিখিত প্রশ্ন ধরে ধরে। আমরা প্রথমে যেটা ভেবে রেখেছিলাম যে, ওভাবে আমরা ইন্টারভিউ নেব না। কারণ ওই ইন্টারভিউগুলো আমাদের কাছে মানে হয়েছে নিষ্প্রাণ, যান্ত্রিক ও ওগুলোর মধ্যে মানে রক্তহীনতা অনুভব করতাম। কারণ হলো, আসলে এমনভাবে নেওয়া উচিত যে, একটি প্রস্তুতি নিয়ে, তারপর আমরা লিখিত প্রশ্ন ছাড়া যেকোনও একটি জায়গা থেকে শুরু করব। তো সেটা ছিল একটা আমাদের পদ্ধতি। আর আমরা কখনো কখনো একটু ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিলাম। তখন আমাদের সে বয়সে তর্ক করার মানসিকতা থাকে। তো আমাদের সেগুলো ছিল বলে বোধ হয় ওই সাক্ষাৎকারগুলোতে আমরা একটু ভিন্ন হতে পেরেছিলাম। আমার ভালো লেগেছে যে আপনারা সেগুলো পড়েছেন, পছন্দ করেছেন। সেগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন, সেগুলোর আলাদা বৈশিষ্ট্য ধরেছেন। আজ সেগুলো নিয়ে কথা বলছি। তো সেটা ভাবলে কিছুটা আনন্দও লাগে বটে।
শাহাদাৎ শাহেদ: আপনার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘আকাঙ্ক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি’। এটাতে যমজ কাব্যতত্ত্বের একটা ফরমেট দাঁড় করিয়েছেন। এছাড়া আপনিই প্রথম বাংলায় ‘ন্যানো কাব্যতত্ত্ব’-এর ধারণা দিয়েছেন। এগুলো নিয়ে আমরা আরও কিছু শুনতে চাই।
রাজু আলাউদ্দিন: ‘ন্যানো কাব্যত্বত্ত’—আমার মনে হয়েছিল যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার যত বাড়ছে, সেই তুলনায় কোনো মানুষ যখন সেগুলো আহরণ করতে যায়, তার কাছে তো সময় আসলে কম। একটা কথা আছে—শিল্প বিশাল, আয়ু অতিশয় হ্রস্ব। আর দ্বিতীয় কথা হলো যে, মানুষের আকর্ষণের ক্ষেত্র এত বেশি বেড়ে গেছে, এখন সে যেকোনোটাতে দীর্ঘসময় লিপ্ত থাকতে পারে না, তাই না? আরেকটা বিষয় হলো—শিল্পের একটা দিক হলো যত কম সময়ে, যত কম শব্দ দিয়ে, যত কম রঙে যত বেশি বলা যায়। সেই ভাবনা থেকেইে ন্যানো কাব্যের ধারণা মাথায় এসেছিল। আমার মনে হয়, আমি শুধু ম্যানিফেস্টটাই লিখেছিলাম। কিন্তু চর্চাটা হয়নি সেভাবে। তো আমার এটুকু আশা যে, আপনারা যারা আছেন পরবর্তী প্রজন্মের, আপনারা যদি আকৃষ্ট হন, ইশতেহারের যে প্রস্তাব আছে, সেটার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আপনারা হয়তো অনেক ভালো কিছু করবেন। ‘যমজ কবিতা’; আমার মনে হয় ওইটাতে আলাদা কিছু করার চেষ্টা করছি। এভাবে বোধ হয় কেউ চিন্তা করেনি যে, একটি কবিতার মধ্যে দু’টি কবিতা থাকা। এটা এমন যে, একটা প্যারায়ই একটা কবিতা শেষ হচ্ছে ধরেন প্রেমাত্মক ভাবের মধ্য দিয়ে, পরের অংশটি শেষ হচ্ছে বিরহাত্মক ভাবের মধ্য দিয়ে। প্রথম অংশে যা বলছি, সেটাই একটু ভাব-ভিন্নতা দিয়ে শেষ করছি। এ দু’টিকে আপাত মনে হয় একই কিন্তু এক নয়। যমজ সন্তানের মতো। দেখতে এক কিন্তু অনেক ভিন্নতা রয়েছে।
শাহাদাৎ শাহেদ: কেন লিখছেন? কেন অনুবাদ করেন? এই যে শিল্প-সাহিত্য চর্চা, কেন?
রাজু আলাউদ্দিন: আমি লিখি, স্রেফ লিখতে ভালো লাগে, তাই। তারপর এটা এমন একটা ব্যাপার মনে হয়, যেন মাথার ভেতরে মানে এমন কিছু জিনিস, যেটা লিখে ফেললে নির্ভার হই। এটা একটা ইমোশন তো। এর অভিব্যক্তি না হলে আপনি অস্বস্তি বোধ করেন। সেটাও একটা শান্তি দেয়। অভিব্যক্তিটা আনন্দদায়ক।
শাহাদাৎ শাহেদ: আপনাদের সময়ের লিটল ম্যাগাজিন সাধারণত কাগজে হতো। বর্তমানে অনলাইন নির্ভর লিটল ম্যাগাজিন হচ্ছে। এ দু’টির মধ্যে আপনি কোনো পার্থক্য দেখছেন?
রাজু আলাউদ্দিন: আপনি বললেন না যে, কাগজনির্ভর যে লিটলম্যাগ, সেটা থেকে তারা এখন আকৃষ্ট হচ্ছে অনলাইনে। অনলাইনে হলেও তো সেটার মূল বৈশিষ্ট্য, লিটলম্যাগ বৈশিষ্ট্যই, অনলাইনেও থাকতে পারে। কাগজে যেমন লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র থাকতে পারে, সেটাই অনলাইনে মেনটেইন হতে পারে। অনলাইনে যাওয়ায় আমি আশঙ্কা করছি না। আশঙ্কা যেটা, সেটা হচ্ছে আসলে তার মধ্যে লিটলম্যাগ ব্যাপারটা আছে কি না! লিটলম্যাগ তরুণদের কেন করতে হয়? তরুণরা যদি মনে করে তার মধ্যে এমন কিছু আছে, যেটা দৈনিক পত্রিকার কর্তৃপক্ষ সেইগুলোকে প্রকাশের উপযুক্ত মনে করছে না বা সে ব্যাপারে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকরা উৎসাহ দিচ্ছে না। তো, নতুন কোনো ভাবনা-চিন্তা-ভঙ্গি যদি থাকে, তো আপনার লিটলম্যাগ ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। লিটলম্যাগ তখনই আমি জরুরি মনে করি।
শাহাদাৎ শাহেদ: অনেকেই এখন ফেসবুকে লিখছেন। কিছু নবীন লিখে সঙ্গে সঙ্গেই পোস্ট দিচ্ছেন। এটার ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিকগুলোকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
রাজু আলাউদ্দিন: একটি জিনিস হলো যে, ফেসবুকের নামই হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তাই না? এটা তো লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা পালন করবে না। তবে হ্যাঁ, ইচ্ছে করলে পালন করতে পারে। কিন্তু ফেসবুকের একটা ব্যাপার যেটা, যেহেতু সঙ্গে-সঙ্গেই প্রকাশ করা সম্ভব, সঙ্গে-সঙ্গেই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ সম্ভব—তো ওইটা আপনি যদি অসম্ভব রকম সংযমী না হন, তাহলে এই আকৃষ্ট হওয়ার ফাঁদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানে ফেসবুকের মধ্যে ওই টেম্পটেশনটা থাকে। এটা একজন তরুণ মনকে খুব সহজে আকৃষ্ট করতে পারে। তো সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি না যে, ফেসবুক সাহিত্যচর্চার জন্য খুব বড় কোনো ইতিবাচক মাধ্যম হতে পারে। একটা শিল্পকর্ম অনেক বেশি পরিবর্তন, পরিবর্ধন দরকার হয়। শৈল্পিক দক্ষতায় পৌঁছানোর জন্য যে সংযম দরকার হয়, তার সঙ্গে ফেসবুকের স্বভাবের বিরোধ আছে। ফেসবুক তো সঙ্গে-সঙ্গেই বহুজনের সামনে প্রকাশ করে দিচ্ছে। এটা শিল্প-সাহিত্যের স্বভাব নয় যে, সঙ্গে-সঙ্গেই তা অনেকের কাছে প্রকাশ করে দেবে। এটাকে বলব প্রি-ম্যাচিউর্ড ইজাকুলেশন। মানে আপনি সঙ্গমে যাওয়ার আগেই স্খলন ঘটে যাচ্ছে। ফেসবুকে অনেকটা এমন হয়।