কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের জন্ম ১৯৫৮ সালে। একযুগ ধরে কানাডায় বসবাস করছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা অর্ধশতাধিক।চিন্তাসূত্রের বিশেষ আয়োজন প্রবাসে সাহিত্যচর্চায় থাকছে তার সাক্ষাৎকার।
চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: বারো বছর। এক যুগ! আমার ভালো লাগে না। এই এক ‘প্রবাস খাটা’ জীবন। ‘প্রবাস খাটা’ নামে একটা বই লিখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি! তবে আমি দ্বৈত নাগরিক হিসেবে কানাডা নিয়ে গর্ব করি। আমাদের দুই প্রধানমন্ত্রী আমার দুই হাতে দুই পতাকা!
চিন্তাসূত্র: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: জীবনটাকে বাধ্যতামূলক একটা ছকে ফেলে নিয়েছি। এখানে নিজেই সব করতে হয়। হাঁটবাজার, ঘর মোছা, হাড়িপাতিল ধোয়া। শীতকালে মাইনাস ২০/২২তে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ! তবু জীবন থেমে থাকে না! আমেরিকা ও কানাডার যৌথ একটা বড় কোম্পানিতে মাঝারি গোছের চাকরি করি। আমি থাকি টরন্টোর একপ্রান্তে আর আমার অফিস বিপরীত প্রান্তে। বাসে-ট্রেনে যেতে লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। সপ্তাহে পাঁচ দিন। সেদিন একটা স্যাটাসে লিখেছিলাম:
একটা প্রবাদতুল্য কথা আছে—মাস গেলেই বেতন। বিশেষ করে বাংলাদেশে সরকারি অফিসে- মান্থলি সেলারি। আর সুবিধে? সুবিধের শেষ নেই। দুই/একঘণ্টা দেরি করে গেলেও বা আগে চলে এলেও অসুবিধে নেই। চেয়ারে কোট ঝুলিয়ে বাইরে চলে যান। অসুবিধে নেই। মাঝে মাঝে কোনো কারণে ২/১ দিন অফিসে না গেলেও ঝামেলা হয় না! আহ আরামের বাংলাদেশ!
আর কানাডায় সিংহভাগ চাকরি তথা কাজে প্রতিঘণ্টা হিসেবে বেতন। হাজিরা দিতে হয় আঙুলের ছাপ দিয়ে। ছুটির পরেও তাই অথবা আইডি কার্ড ঘষে অফিসে ঢুকতে ও বেরুতে হয়। উপায় নেই গোলাম হোসেন!
পনের মিনিট করে দুটি ব্রেক টাইম। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ছোটাছুটি। আবার কোথাও কোথাও এই আধাঘণ্টার পে করা হয় না। কারণ, এটা আপনার খাবারের সময়। ফলে অনেক অফিস এই আধঘণ্টার পয়সা কেটে নেয়!
যাই হোক। ওটোয়া লাইব্রেরিতে, চার্চে অ্যাসিসটেন্ড ম্যানেজার, পত্রিকার সম্পাদক, কাপড়ের স্টোরে সেলসম্যান, পড়াশোনা (এখানে এটাও এক ধরনের চাকরি), কারখানার শ্রমিক—এ সব করে এখন একটা পার্মানেন্ট চাকরি করছি।
এই ফাঁকে দৈনিক ইত্তেফাকের কানাডার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। চলছে নিজের লেখালেখি। এছাড়া আরও একটি বিষয় আছে। ঢাকায় আমার একটি অফিস ‘স্বরব্যঞ্জন’ ও বইয়ের দোকান ‘পাঠশালা’ আছে। প্রতিদিন এখান থেকেই সেগুলো পরিচালনা করি। তবে এত কঠিন জীবনের সঙ্গে লড়াই করেও লেখালেখিটা ছাড়িনি। সেটা একটা প্রাণের মতো।
আরেকটা বাড়তি সুযোগ পাই। ভালো ভালো বিদেশি সব বই পাই, লেখার উপদান ও বিষয় পাই। যেমন, কানাডায় না এলে ‘কানাডায় যাবেন কেন যাবেন’, ‘কানাডার কাশিমপুরে খুনি নূর চৌধুরী’, ‘যুদ্ধশিশুর জীবনযুদ্ধ’, ‘ভূতের পাসওয়ার্ড’ ও ‘কানাডার হাড়ির খব নাড়ির খবর’—এই বইগুলো লেখা হতো না।
আর একটি কথা। মাতৃভূমির প্রতি আমার কবিতায় প্রবল তৃষ্ণা তীব্রভাবে প্রতিফলিত হওয়ার পরও পরবাস জীবনের সঙ্গে স্বদেশের সম্পর্ক ও সেঁতু বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলার চেষ্টা করছি। ‘প্রবাস-খাটা জীবন’ থেকে বিচিত্র অভিজ্ঞতা নান্দনিকতায় মিশিয়ে কবিতায় উপস্থাপন করেছি। ফলে স্বদেশ-বিদেশের সমন্বয়ে কুশিকাটার মতো করে সাজিয়ে, দ্রবীভূত করে যমজজীবন মতো নির্মাণের প্রয়াস চালিয়েছি এক যৌথখামার।
প্রবাস এক পরশপাথর, সুন্দর সর্বনাশ অথবা নিষ্ঠুর নির্বাসন। তাই কখনো কবিতায় ফুটে উঠেছে স্বর্গীয় সৌন্দর্য আবার নরকীয় জীবনের ভয়াবহ কাব্যিক চিত্রকলা। এই দুই বৈপরীত্যকে সমান্তরাল করে এক পরাবস্তব ট্রেনে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পাঠকদের নিয়ে গেছি এক অজানা ভ্রমণে।
যেমন ‘মাইনাস থার্টি কিংবা থার্টি ফাইভ তাপমাত্রা মামুলি ব্যাপার, কোনো কোনো দিন মাইনাস ফর্টিরও মুখোমুখি হতে হয়। ফ্রিজের ভেতর মাছেরাও থাকে না হিমাঙ্কের এতটা নিচে’। এভাবেই বরফে জড়ানো মানব জীবন থেকে কখনো মাছজীবন, কখনো পোকাজীবন অথবা পাখিদের অন্তর্নিহিত আনন্দ-বেদনার জীবন যাপন পাবেন আমার কবিতায়।
চিন্তাসূত্র: দূরপ্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;— তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি… খুব বাস্তব মনে হয়! আসলে দেশের বাইরে না থাকলে দেশের অভাব বা নাড়ির টান টের পাওয়া কঠিন।
আর ‘অনুভব’? আমি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে অনুভব করি। সেটা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। দেশে ফেয়ার জন্য তো সারাক্ষণ (ব্যক্তিগতভাবে) অস্থির থাকি। আসলে পরবাস এক ধরনের অন্য রকমের ‘পরকাল’। তবে মানিয়ে নিতে পারলে চমৎকার। কানাডা সব দিক দিয়েই পৃথিবীর সেরা দেশ।
বর্তমানে এই ইন্টারনেটের যুগে বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। দেশটা মনে হয় আয়নার ভেতর বা দেয়ালের ওপারে। সব কিছু মুহূর্তেই মধ্যে পেয়ে যাই। খবরাখবর, যোগাযোগ।
দেশের কথা মনে পড়লে একা একা স্মৃতিচারণ করি। কবিতা লিখি। ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। আর বলি—আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়…
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্যচর্চায় কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: খুব একটা না। আসলে আমার অবস্থান কানাডা হলেও আমার ‘উপস্থিতি’টা বাংলাদেশেই। সশরীরে না থাকায় অনেক সমস্যায় পড়ি। বাংলা বই পাই না। লিখতে গেলে অনেক তথ্য হাতের কাছে পাই না। কিছু গবেষণা কাজ আটকে আছে। যা দেশে না গেলে হবে না।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন? দিবসগুলো পালন করেন কিভাবে?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: বিদেশে প্রচুর সংগঠন আছে। সাংস্কৃতিককর্মী আছে। তারা প্রতিটি অনুষ্ঠান মহা ধুমধামে পালন করে। এখানে হেমন্ত নেই; কিন্তু প্রবাসীরা নবান্ন উসৎবও পালন করে।
শীতের সময় বিজয় দিবস, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস পড়েছে। তারপরও সেই অস্থায়ী উপেক্ষা করে শহীদ মিনার, স্মৃতি সৌধ বানিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তবে একটা অসুবিধা হচ্ছে, দিন তারিখগুলো সঠিক দিনে পালনে তারতম্য হয়। কারণ প্রবাসের কঠিন ও কর্মব্যস্ত জীবনে তা শনি-রবি ছুটির দিনে উদযাপন করা হয়।
তবে এ প্রসঙ্গে ক’টি তথ্য জানাচ্ছি:
ক) আজ আমাদের মাতৃভাষা আন্তর্জাতিক হিসেবে স্বীকৃত। তার সূচনা করেছিলেন যারা, তারা এই কানাডার অভিবাসী।
খ) কানাডার সব চেয়ে বড় প্রদেশ অন্টারিও সরকার ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সম্মানে মার্চ মাসকে ‘বাংলাদেশ হ্যারিটেজ মান্স’ ঘোষণা করেছে।
গ) ভ্যাংকুভার, আলবাট্রার পর এবার সিটি অব অটোয়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে অনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি দিলো গত ১৫ নভেম্বর।
ঘ) আমি ব্যক্তি গত ভাবে ১০/১২ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কানাডার ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করছি। আ নিয়ে লিখছি—‘কানাডায় ১৯৭১’।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: এবার কয়েকটি বইয়ের পুনঃমুদ্রণ হবে। নতুন আসবে ২/৩টি বই। ছোটদের গল্পের বই—‘কালারফুল কানাডা বিউটিফুল বাংলাদেশ’; স্মৃতিচারণমূলক গদ্য ‘দূরের মানুষ কাছের মানুষ’; ছোটদের নাটক ‘জাদুকর’ আর একটা গদ্যের বই— ‘বাংলাদেশ ক্ষমা করো’। কিন্তু এখনো পাণ্ডুলিপি শেষ করতে পারছি না।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্য চর্চা?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: পাই। পাচ্ছি তো। অনলাইনের কারণে ঘরে বসেই নিয়মিত খোঁজ পাই। তবে তা নিয়ে আমি খুব হতাশ। নানা কারণে সাহিত্যের গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। প্রসার পাচ্ছে সাহিত্যের আগাছা! আর সাহিত্য চর্চার চেয়ে বেশি হচ্ছে—পরচর্চা, স্বজনপ্রীতি, নোংরা রাজনীতি!
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: অনুবাদ এবং অনুবাদ। আমাদের গল্প-উপন্যাস-কবিতা বিশ্ব সাহিত্যের অন্যান্য ভাষায় রচিতা সাহিত্যকর্মের চেয়ে কোনো অংশেই দুর্বল নয়; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আর বেশি সমৃদ্ধ। কিন্তু ইংরেজি অনুবাদের অভাবে তা যথার্থ মূল্যায়ন হচ্ছে না, পাচ্ছে না স্বীকৃতি।
আর আমাদের অনুবাদগুলো খুবই পানসে ও দূর্বল অনুবাদ। আমার একটি দ্বিভাষিক কবিতার বই (পরের জায়গা পরের জমিন) পড়ে বিদেশে অনেকেই বলেছেন—এই সব অনুবাদ সংবাদপত্রের ইংলিশ ও এশিয়ান ইংলিশ।
বর্তমান সরকার সাহিত্যবান্ধব সরকার। ইতোমধ্যে অনেক ধরনের কাজ করেছে। একটি ভালো অনুবাদ কেন্দ্র খুলে সেখানে দেশি-বিদেশি এবং প্রবাসী প্রকৃত অনুবাদকদের নিয়ে একটা শক্তিশালী সেল দ্রুত কার্যকরী করা উচিত।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার মধ্যে কোন শাখাকে আপনার ঋদ্ধ মনে হয়?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: সব দেশে বাজে অবস্থা প্রবন্ধসাহিত্যে। তুলনামূলক কবিতার অবস্থান ভালো। পশ্চিম বঙ্গের কবিতার চেয়েও। ফরিদ কবির একটা ফানি কিন্তু মজার কথা বলেছেন, সূর্য পূর্বেই উঠবে আর অস্ত যাবে পশ্চিমে! তবে আমাদের গল্পও অনেক ঋদ্ধ। অনেক তরুণ গল্প-কবিতা এখন চমৎকার লিখছে। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি! যদিও তারা অনেকেই বেয়াদপ!
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার অভিমত-মূল্যায়ন জানতে চাই।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: বাংলা সাহিত্যের সূর্যাস্ত নেই। কারণ, পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই আশঙ্কা থেকে মুক্ত। ভাষাগত দিশক থেকে এটা একটা বিষয়। আর আমি খুব আশাবাদী। যদিও ১৯১৩ সালে রবি ঠাকুর নোবেল পেলেন। তার এত বছর পরও আর কোনো অগ্রগতি নেই।
আমার বিশ্বাস, এলিস মুনরো বা কাজুও ইশিগুরোর রচনার চেয়ে আমাদের বাংলা সাহিত্য কোনো অংশেই কম নয়।