দ্বিতীয় পর্ব
তো এটাই কিন্তু আমরা, ২০০৭-এ যেগুলো বললাম, করলাম সেই নীতিকে সামনে রেখে। আমাদের তো অসাধারণ বিজয় হলো। ভোটার লিস্ট পেলাম।
ঐক্যের বিষয়ে তথ্য দিলেন ড. কামাল হোসেন। বলেন, দলীয়ভাবে আমরা ২০০৫ থেকে আমরা একটা ঐক্যের চেষ্টা করে যাচ্ছি। শুধু ফোরাম না। কাদের সিদ্দিকী এসে প্রথমে বললেন—আমি যোগ দিচ্ছি। তারপরে এসে বললেন এইযে বিকল্পধারা। উনি ওখানে আক্রান্ত হয়েছিলেন, উনার গাড়ি ভাঙা হয়েছিল। তো আমি বললাম, ভাই আমরা পল্টনে মিটিং করব, আপনি আসতে পারেন। উনি পেছনের রাস্তাটা দিয়ে এসে আমাদের মঞ্চে উঠলেন। আমি বললাম, দেখেন আমি কোনও সময় ওর সঙ্গে রাজনীতি করি নাই। কিন্তু যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র আছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। উনি একটা প্রেস কনফারেন্স করতে পারবেন না, উনার গাড়ি ভাঙা হবে এটাতো ঠিক না। তো আমি উনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এখানে এসে জনগণের সামনে উনার বক্তব্য উনি রাখতে পারেন। তো উনি বক্তব্য রাখলেন। মানুষ এটাকে খুব ভালোভাবে নিল। তো উনি বললেন, আপনার সঙ্গে আমরা ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে আসলাম। জাতীয় ঐক্যমঞ্চ ওটা আমরা নাম দিয়েছিলাম। তারপরে আসলেন মেনন, তারপরে আসলেন ইনু। এর আগে ছিল এগারো দল, তাতো বলিনি এখনো। এগারো থেকে বারো হলো, বারো থেকে তেরো হলো। তারপরে চৌদ্দ যখন হলো, সেটা তো স্মরণীয় ঘটনা। এটা আপনার লেখার দরকার নেই বা পত্রিকায় দেওয়ারও দরকার নেই। এটা আমি নিজের প্রশংসা করার জন্য বলছি না, কিন্তু দিস আর দ্য ফ্যাক্ট। এটা জানা দরকার যে, এখন তো মনে হয়, আমরা সব মানে ইজারা করে দেশ দিয়ে দিয়েছি কোনো একটা দলকে। কিন্তু চৌদ্দ নম্বর দলে ছিলেন এরা। জলিল ছিলেন বোধ হয়।
এবার সংবিধান প্রসঙ্গে জানতে প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের মন্তব্য জানতে বলি, বাংলাদেশের সংবিধানতো আপনি তৈরি করেছেন, সেই প্রক্রিয়াটা কেমন ছিল? তিনি বলেন, শিওর। এই সংবিধান কিন্তু, এখন হাসি পায় পলিটিক্যাল করেছে। হ্যাঁ, এটাতো আমাদের আন্দোলনের মধ্যেই ছিল যে, ছয় দফাভিত্তিক একটা সংশোধনী আনতে পাকিস্তান কনস্টিটিউশনে। সেটার ওপর তো কাজ আমাদের ৬৯ থেকে জারি ছিল। ওই কাজে আওয়ামী লীগের যারা ছিলেন, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে আমি বিশেষভাবে এ দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমিরুল ইসলামরা আমার সঙ্গে ছিলেন। আরও আইনজীবী ছিলেন। কথা হলো—সংবিধানের এই কথাগুলো কোথা থেকে এসেছে। তুমি যদি চিন্তা করো, আমি ৫৪’-এর কথা আগেই বলেছি। রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সংবিধানের একবারে ওপরেই আছে। এটা ৫২তে আমরা পেয়েছি না? এটাতো হঠাৎ করে ৭১-এ আসেনি (হাসি)। উৎস যদি চাও। উৎসতো ভাষা আন্দোলন। ৪৮ থেকে ভাষা আন্দোলন। সংবিধান তৈরির সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ৩৪। ওই সংবিধান কার্যক্রমে আমার সঙ্গে আরও ৩৪ জন ছিলেন। প্রথম পাতায় স্বাক্ষরগুলোর মধ্যে ১ নম্বর স্বাক্ষর হলো বঙ্গবন্ধুর, ২ নম্বর হলো সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৩ নম্বর হলো তাজউদ্দিন আহমেদ। ১২/১৩ নম্বরে আমার স্বাক্ষর হতে পারে।
ড. কামাল হোসেনের স্ত্রী মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন। দুই সন্তান-একজন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। আর দিনা হোসেন ফিল্মের কাজ করেন।
সালমান তারেক শাকিল: স্যার মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি কোথায় ছিলেন?
ড. কামাল হোসেন: জেলে ছিলাম। হরিপুর জেল।
ওমর শাহেদ: আপনার সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছিল?
ড. কামাল হোসেন: যেখানে আমাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, যে সেলে আমি ছিলাম, সেখান থেকে বের হওয়ার পারমিশন ছিল না। অন্য জেলে হয় যে ছেড়ে দেওয়া হয়, আপনি জেলের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারেন, অন্য বন্দিদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমাকে তা করতে দেওয়া হয়নি। একদম কোনও পত্রিকা নেই, রেডিও নেই।
ওমর শাহেদ: কতদিন ছিলেন কারাগারে?
ড. কামাল হোসেন: নয়মাস। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন মিয়াওয়ালি জেলে। দু’টাই কিন্তু একদম শেষ প্রান্তে। মানে কোনও পত্রিকা দিতো না কোনও কথা বলতে দেওয়া হতো না। সেলের যে অঙ্গন ওর বাইরে কোনও চলাফেরা নেই।
ওমর শাহেদ: আপনি আগরতলা মামলার আইনজীবী জন্য? আপনি তো আইনজীবী হিসেবে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা।
ড. কামাল হোসেন: না না। সেটাতো আমি বলেইছি দেখো আমিতো অনেক বন্দির ব্যাপারে মামলা লড়েছি। এটাতো জেনারেল রুলে আছে যে পত্রিকা পাওয়ার, সকাল থেকে মাগরিব পর্যন্ত সুযোগ থাকে ঘোরাফেরা করার। তো আমিতো ওদের বলেছি যে দেখো আমার পেটে ব্যথা আছে আমাকে একটু হাসপাতালে যেতে দাও। তারা বলেছে ‘না না ডাক্তার এসে দেখে যাবে।’ ওইযে একটু বেরোবার সুযোগ তখনও পাইনি। মজার বিষয় হলো ১৬ই ডিসেম্বর আমার জন্য মুক্তি দিবস। যেদিন রাতে ওরা আত্মসমর্পণ করলো সেদিন জেলের সুপার এসে বললো যে, ‘আরে আপনার এখানে চেয়ার নেই জেলের ভেতরে। হেই দেখো দেখো একটা চেয়ার এনে দাও।’ তারপর ওরা দেখে বলে, ‘আপনার এই শীতের দিনে কোনও কার্পেট নেই। এই এখানে একটা কার্পেট নিয়ে আসো।’ তো তখন আমি বুঝে ফেলেছি যে কী ঘটেছে। তাদের চেহারা খারাপ আর আমার চেহারার উন্নতি। খাওয়া যখন নিয়ে এলো, দেখি ট্রেতে তিনটা প্লেটে তিন পদ। আমি বললাম ‘ব্যাপারটা কী? কেননা আগে একটা টিনের বাটিতে একটু ডাল আর একটা রুটি দিয়ে যেত। নয় মাস ধরেই। ১৬ই ডিসেম্বর থেকে তিন পদ খাওয়া।’ তো ওরা বলল, ‘না না, ডাক্তার বলেছে আপনাকে ভালোমতো ডায়েট দিতে।’ তখন আমি বুঝতে পেরেছি যে, বাইরে কী ঘটেছে। তো তারপরে আমাকে বলল, আপনি একটু পরিদর্শন করেন জেলে। সুপরিন্টেন্ডেন্ট এসে জেলের তালা খুলে আমাকে সারা জেলে ঘোরাচ্ছে। এই আমাদের কারখানা, এই আমাদের অমুক ইত্যাদি। তো আমিও হাসতে হাসতে বলেছি, নয়মাস পরে তো এটা ভালোই লাগছে। তো তারা বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আপনারা তো এখানে আসেন। আর বাইরে গিয়ে তো আপনারা ভিআইপি হয়ে যান।’ আমিতো বুঝতেই পেরেছি যে, ভিআইপি হওয়ার মানেটা কী? আপনি তো আর বেশি দিন থাকবেন না। যাওয়ার আগে একটা গাছ লাগিয়ে যান।’ আমি বললাম, আমি ওরকম ভিআইপি না। আমার পার্টিতে আমি জুনিয়র মানুষ। আমাকে বলেলেন ভালো কিন্তু গাছ-টাছ লাগানোর লোক আমি না। ব্যবহার মানে ডেইলি ইম্প্রুভ হচ্ছে এইভাবে। তো ২৮ তারিখে সকালে আমাকে বলল, তুমি প্যাক আপ। দুটা কাপড় ছিল, আমি ব্যাগে নিলাম। বলল, তোমাকে সন্ধ্যায় এসে নেবে। সন্ধ্যা ৬টায় আমাকে একটা গাড়িতে নিলো। ইসলামাবাদের দিকে নিলো। আমি ভাবলাম ঠিক আছে রাজধানীর দিকে গেলে হয়ত কিছুটা পরিবর্তন হবে। কিন্তু ওখান থেকে পার হয়ে চলে গেল একটা কাচা রাস্তায়। চারিদিকে মেশিনগান নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো। তখন আমি একটু ভয় পেয়েছিলাম। বললাম কী করতে চাচ্ছ? তো মিলিটারি অফিসার হেসে বলছে ‘না না তুমি চিন্তা করো না। ভালোই হবে তোমার জন্য।’ তো ওইখানে একটা একতলা বাড়ি ছিল ডাক বাংলোর মতো। তো বললো, ওইখানে তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে। গেছি, ঢুকেছি। তখন বলল এক নাম্বার ঘরে ঢুকো। তো ঢুকে দেখছি বঙ্গবন্ধু আছেন।
ওমর শাহেদ: আপনাদের প্রথম কী কথাবার্তা হলো? আপনারা কী করলেন?
ড. কামাল হোসেন: বঙ্গবন্ধু বললেন, এত দেরি হলো কেন? আমি বললাম, এই ব্যাগে তো আর কিছু ছিল না। আমাকে বলার সঙ্গেসঙ্গে আমি ১৫ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে গেছি। যখনই ওরা গাড়িতে নিয়েছে, আমি গাড়িতে উঠেছি। তো ওখান থেকে আসতে অবশ্য দু/আড়াই ঘণ্টা লেগেছে। তখন উনিই বলতে লাগলেন, ২৬ তারিখে তো আমি এখানে। ২৬ তারিখ বা তার কাছাকাছি সময়ে উনি এসেছেন ওখানে। মিয়াওয়ালি জেল থেকে। ওই জায়গাটার নাম ছিল শিহালা গেস্ট হাউজ। এটা পুলিশ একাডেমির একটা অতিথি ভবন আরকি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে দুদিন আগে। আমাকে আনার পরেই দেখি ঢুকছে ভুট্টো। তো আমি ভুট্টোকে বলেছি যে, তুমিও কি বন্দি হিসেবে এসেছো? তো বললো যে, না না, আমি তো প্রেসিডেন্ট।’ তো বঙ্গবন্ধু বললেন যে, ‘তুমি কি করে প্রেসিডেন্ট হলে? আমিতো ১৬৭ সিট পেলাম আর তুমিতো তার অর্ধেকের চেয়ে কম পেলে।’ তখন ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আপনিই প্রেসিডেন্ট হয়ে যান।’ তো উনি বললেন যে, রাখো এসব আমিতো রসিকতা করছিলাম। আমি যত দ্রুত বাংলাদেশ যেতে পারি সেটার ব্যবস্থা করো।’ তো ভুট্টো বললেন যে, ‘দু/চারদিন আমাকে সময় দেন, আমি অবশ্যইে এটা করব।’ তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা কামাল হোসেনও এখানে কোথাও বন্দি আছে। কামাল হোসেন তো আছে তো ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ তো বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘উনি তো কথা রেখেছেন। পরশু ভুট্টো আমাকে বললেন, আর আজ তোমাকে এখানে আনলেন।
ওমর শাহেদ: তারপরে আপনার ওখানে একসঙ্গেই থাকতেন?
ড. কামাল হোসেন: ওইখানে আমরা ১০ দিন থাকলাম।
সালমান তারেক শাকিল: আপনার কি মনে আছে আপনারা যেদিন বাংলাদেশে প্রথম পা রাখেন, কী ঘটেছিল সেদিন? আপনার নিজের অনুভূতিটা কেমন ছিল?
ড. কামাল হোসেন: হ্যাঁ শিওর। প্রথম তো আমরা আকাশ থেকে নিচে দেখি শুধু মানুষ, মানুষ আর মানুষ। গাছের ওপরে মানুষ, ছাদের ওপরে মানুষ। ৬/৭ জানুয়ারিতে আমাদের প্লেনে তুললো। ওটার একটা ব্যাপার আছে, কোথায় নেবে? আমরা বলেছি যে ডাইরেক্ট ঢাকা নিয়ে চলো। তারা বললো, যুদ্ধ হয়েছে তারপরে তো এয়ার স্পেস বন্ধ। আমরা ইন্ডিয়ার ওপরে ফ্লাই করতে পারব না। তো আমরা বললাম যে, আমাদের জাতিসংঘের প্লেন অথবা রেডক্রসের প্লেনে দিয়ে দাও। ওরা বলল ইরান, টার্কি। বঙ্গবন্ধু বললো ওইসব দেশে না কোন নিউট্রাল দেশে। জেনেভায় নিয়ে যেতে পারো, সুইজারল্যান্ড। তো তারা হঠাৎ করে বলে ফেলেছে যে, লন্ডনে আমরা নিতে পারি। তো বঙ্গবন্ধু বললেন যে, আর তো কোনও কথাই নেই। লন্ডনে আমরা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশের লোক পাবো। তুমি ইমিডিয়েটলি বলো যে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুক। তো এইভাবে লন্ডনে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো। বলল, ৬/৭ তারিখে আমাদের নেবে। তো ৬ তারিখ রাতে ৭ তারিখ সকালে আমরা প্লেনে উঠলাম। লন্ডনে এসে পৌঁছেছি ৮ তারিখ।
ওমর শাহেদ: স্যার আমার সবসময় একটা বিষয় জানতে ইচ্ছে করে যে লোকটা একটা দেশ উপহার দিলেন, সেই লোক, সেই স্বপ্নদ্রষ্টাকে তো আপনি দেখেছেন। তখন তার অনুভূতি, তার আচরণ বা তার ফিলিংস আপনি কী রকম দেখেছেন? আপনার নিজেরও একটা ভয়ঙ্কর ফিলিংস আছে।
ড. কামাল হোসেন: তা তো বটেই। উনার ব্যাপারে আরকি, উনি তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই জায়গায় এসেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে উনার জীবনটা উনি ফিরে পেয়েছেন। উনার তো মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে ওখানে। এই কথাটা বলা দরকার যে, ভুট্টো উনাকে বলেছেন, দেখো, সত্য না মিথ্যা সেটা ওর কথা। ইয়াহইয়া খান নাকি উনাকে বলেছেন, দেখো তুমিতো এখন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছো। তো ওই ব্যক্তির (বঙ্গবন্ধু) তো মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। তো ওকে ফাঁসি দিয়ে দাও। আমি অর্ডারটা সই করে দিচ্ছি। তোমার গায়ে লাগবে না। আমি অর্ডারটা সই করে দিচ্ছি। কেননা বিচারটা হয়েছে আগস্ট মাসে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়ে গেছে। আমি ওটাকে কার্যকর করার অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি। তো ভু্ট্টো নাকি বলেছেন, ‘আমি বুঝলাম যে, এই লোকটার তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যে তোমাকে এভাবে বলছে যে কার্যকর করতে। তো আমি তো বঙ্গবন্ধুকে বললাম, হ্যাঁ ৯৩ হাজার লোক তো ওইখানে আত্মসমর্পণ করেছে।’ তো ইয়াহইয়াকে নিয়ে ভুট্টোর কথা যে, তুমি তো এতদিনে অনেক ক্ষতি করেছো। এখন আমি যেটা ভালো মনে করি, করব। তো বঙ্গবন্ধুকে যখন নিয়ে আসে, তখন তো আমি ১৬ই ডিসেম্বর থেকে আমার অভিজ্ঞতার কথা বললাম, কিভাবে আমার অবস্থার উন্নতি হলো। তো উনার কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বরের পরে, উনার একজন ডিআইজি ছিলেন। তো উনি এসে বললেন, দেখুন একটা আশঙ্কার কথা বলি, জেনারেল নিয়াজি তার বাড়ি ছিল মিয়াওয়ালী। তো মিয়াওয়ালী জেলের মধ্যে একটা থমথমে ভাব। তো এখানকার সোলজার যারা আছে, তারা তো বলেছে, আমাদের জেনারেল নিয়াজিকে যারা হেয় করেছে, তাদের কয়েকজন তো আমাদের কাছেই আছে। তো উনাকে যেটা বললেন, ওখানে নাকি কবর খোঁড়া হচ্ছে, যে আপনাকে নাকি আক্রমণ করে মেরে ফেলা হবে। তো জিআইজি বললেন, আমার ওপরে যদি আপনি ভরসা রাখেন, আমার কাছে কিছু পুলিশ আছে, তাদের দিয়ে আপনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ব। এই একটা বিপজ্জনক অবস্থা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাব। তারপরে আপনার নিরাপত্তা আমার দায়িত্ব। আমি নিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করব। তো বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ওই লোকটাকে আমি বিশ্বাস করলাম। কেননা গত কয়েকমাস ধরে তো দেখছিলাম। ওই ডিআইজিকে বিশ্বাস করে বেরিয়ে পড়লাম। সে একটা জায়গায় নিয়ে গেল। একটা প্রজেক্ট যেখানে বাড়িগুলো ছিল, সেখানে নিয়ে গেল। তো পরেরদিন ওখানে একটা হেলিকপ্টার আসলো। তো ডিআইজি কথা-টথা বলে বললো, যে ওকে আমরা ইসলামাবাদের কাছাকাছি নিয়ে যাব, সরকারি আদেশে। তো উনাকে শিহালা পুলিশ একাডেমির রেস্ট হাউজে নিলো। আমাকে আনলো। আমাকে যখন অ্যারেস্ট করেছে, তখন আমার ওয়াইফ করাচিতে চলে গেছেন, উনার বাবার বাসায়। বাচ্চাদের নিয়ে। উনার বাবা রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট জাজ, করাচিতে থাকতেন। আমাদের প্লেনে তোলার সময় একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা যে, প্লেনটা আসবে করাচি থেকে। আমাদের নিয়ে লন্ডনে যাবে। তো আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘আপনি বললে তো কাজ হবে। আমার বাচ্চাদের তুলে দিতে বলেন করাচি থেকে।’ তো ভুট্টোতো বঙ্গবন্ধুকে খুব খুশি করতে চাইছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বললেন, প্লেন যেহেতু করাচি থেকে আসছে, সেহেতু ওর বাচ্চাদের তুলে দিতে বলেন। তো আমি তো অবশ্যই চাইব, আমি কিভাবে ওদের ফিরে পাব। কিন্তু এইভাবে যে হয়ে যাবে, সেটা কল্পনাও করিনি। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, এয়ারপোর্টের পাশেই ওদের বাসা। খুব সহজেই ওদের তুলে দিতে পারে। আমার ওয়াইফকে বলেছে, আপনি এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে যান। আপনাকে প্লেনে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাবে। লন্ডন নিয়ে আসবে সেটা বলেও নাই। তো বলেছে যে কিছু গরম কাপড় নেন। রাওয়ালপিন্ডিতে তো খুব শীত। তো এইভাবে ওদের তুলে দিয়েছে। তো এইভাবে ওদের প্লেনে পেলাম। আর আমাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে আরও উঠলেন গোলাম মওলা। লন্ডন থেকে আমরা যারা উঠলাম তাদের ছবি আছে। উনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। ইন্সুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছিলেন। সাইপ্রাসে আমাদের প্লেন তেল নিতে নেমেছিল। ৯ই জানুয়ারি। সেখান থেকে দিল্লি। অসাধরণ সংবর্ধনা দিলেন মিসেস গান্ধী। ওখানে পাশের মাঠে একটা বাংলায় ভাষণও দিলেন বঙ্গবন্ধু। আমি অনুবাদ করলাম। তো ওখান থেকে আমরা প্লেনে উঠলাম। তো প্লেকে বলেছিল, প্লেনকে মেপে বলো যে, প্লেন ওখানে ঢাকায় নামতে পারবে না। আমাদের এমনই ভাগ্য যে, ওখান থেকে আমাদের যে ম্যাসেজ ব্যাক করল, তো ক্যাপ্টেন বলল, আর ছয় ইঞ্চি কম হলেও আমরা নামতে পারতাম না। জাস্ট যতটুকু আছে রানওয়ে আমরা নামতে পারব বড় প্লেন নিয়ে। আদারওয়াইজ আমাদের বলেছে যে নামিয়ে ছোট প্লেনে যেতে হবে ঢাকায়। তো ওটা করা লাগলো না। যে মাপটা করে পাঠালো, সেই মাপে নামতে পারবে বলে সে আসলো। তো আমরা দেখলাম, যেখানে এসে রানওয়ে শেষ হয়েছে সেখানে এসে থামতে পেরেছে।
সালমান তারেক শাকিল: স্যার তো দীর্ঘদিন আইন পেশায় ছিলেন এবং আছেন। বড় একটা সময় এখানে কাজ করছেন। এখন বাংলাদেশের আইন বিচার—এগুলোর একাডেমিক পরিস্থিতি নিয়ে সংক্ষেপে যদি কিছু বলেন। আশাবাদী আপনি?
ড. কামাল হোসেন: আশাবাদী হান্ড্রেড পার্সেন্ট। কিন্তু এইসব বিষয়ে আমি তো তোমাদের কাছ থেকে ইন্টারভিউ করতে চাই আরকি। তোমরা ঘুরছো সমাজের মধ্যে, মানুষের মধ্যে তোমরা কী ভাবো। বিশেষ করে তরুণ সমাজের ভবিষ্যতের কথা যেটা বলি। আমার বিশ্বাস যে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত বাংলাদেশের অবশ্যই হবে। কেননা দেখো আমাদের, যেহেতু আমি অনেক দেশেই ঘুরেছি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে একটা কর্মক্ষমতা আছে। মানে কোনো জিনিসকে, কোনোন পরাজয়কে মেনে না নিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে সেটার মোকাবিলা করার শক্তি এ জাতির আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগেই আমি দেখেছি। এটা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা। তোমরা লক্ষ করবে যদি ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায় যাও কোনো মানুষকে এইভাবে বসে থাকতে দেখবে না। তারা ছোটাছুটি করছে কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। আমাদের কাছে কেউ হাত পাতে না। বলে যে বীজধান পাঠিয়ে দেন। আমাদের ফসল নষ্ট হয়েছে, বীজধান পাঠালে আমরা আবার ফসল উৎপাদন করতে পারব। বিশেষ করে আমি ৭১-এর পরে যেটা দেখলাম। তোমাদের আমি আফগানিস্তানের কথা বললাম, আমাদের লোকেরা কি দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করল। আমারতো বাড়ি মিরপুর। অনেকগুলো বাড়ি বিধ্বস্ত হলো। গণকবর আছে মিরপুরে। লোকজন সবাই এসে পুনর্বাসনে লেগে গেল। মনে হলো লোকজন রাতারাতি তাদের পুনর্বাসিত করেছে। এইযে ক্যাপাসিটি মানুষের। এই যে আমাদের লক্ষ লক্ষ লোক ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতে। কোনো দেশ পাবে না, যেখানে বাঙালি পাবে না। এইযে ক্যাপাসিটি আমাদের পরিস্থিতিকে মোকবিলা করে দাঁড়ানোর; এটা আমরা সবসময় দেখে এসেছি। আমরা যেভাবে ওইযে দুর্ভিক্ষ করিয়ে দিলো ৭৪-এ। কিন্তু তারপরে আমরা কি দেখলাম যে ৭৫-এ যখন আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ বিদায় নিলাম তখন বঙ্গবন্ধু বললো যে, ‘আমি এতদিন মিটিং করি নাই। মানুষের কাছে যেতে দ্বিধাবোধ করেছি। দুর্ভিক্ষের যারা শিকার হয়েছে আমি কিভাবে তাদের মুখ দেখাব? দেখো আমি এখন যেসব তথ্য পাচ্ছি যে ভালো ফসল হয়েছে। আমি সেপ্টেম্বর মাসে গিয়ে থানায় থানায় মিটিং করব।’ এইযে উনার উপলব্ধি, আমাদের মানুষ একটু সুযোগ পেলে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে দাঁড়াতে সফল হয়। তো সেই বিশ্বাস আমাদের ছিলো যে, একটা পরিবেশ যদি বাংলাদেশের মানুষকে দেওয়া হয়। এই যে জানমালের নিরাপত্তা। স্বাভাবিক অবস্থা যেটাকে আমরা বলি। স্বাভাবিক অবস্থা পেলে সাধারণ ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করবে। এখন সবচেয়ে বেশি তদবির কিসে হয়? লেখপড়ার সুযোগ। চাকরির তদবিরের চেয়েও বেশি। কেন? যে মানুষ মানুষ হবে। আমি এককথায় যদি বলি যে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে একটা অন্তর্নিহিত শক্তি আছে মানুষ হওয়ার, দেশকে কিছু দেওয়ার। এটা হলো আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের মূল উৎস।
চলবে…
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা আজও হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্রযোজ্য: ১ম পর্ব ॥ ড.কামাল হোসেন