নভেম্বর-ডিসেম্বর এলেই লেখক-প্রকাশকদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। কারণ সামনেই একুশে বইমেলা। তবে কয়েকবছর ধরেই এই ব্যস্ততা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বাইরেও। এর কারণ কলকাতায় ‘বাংলাদেশ বইমেলা’।অনুষ্ঠিত হচ্ছে নভেম্বরের ১৫ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত। এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের বইয়ের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি হলো কলকাতায়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই মেলা সেই সুযোগের কতটুকু সদ্ব্যবহার করতে পারছে? এছাড়া অমর একুশে বইমেলা নিয়েও পাঠক, লেখক, প্রকাশকদের ভাবনা কী? এসব বিষয় নিয়েই এই সময়ের তরুণ কথাশিল্পী সাদাত হোসাইনের মুখোমুখি হয়েছেন আরেক তরুণ কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আপনি তো এখন কলকাতায়। বইমেলা তো পনেরই নভেম্বর শুরু হয়েছে। আপনি কবে গেলেন?
সাদাত হোসাইন: হ্যাঁ, খুব জরুরি কিছু কাজ থাকায় দুদিন দেরি হলো। তবে ১৭ তারিখ থেকেই কলকাতার বাংলাদেশ বইমেলায় আছি।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: এই মেলায় আপনার নতুন বই এসেছে?
সাদাত হোসাইন: হ্যাঁ। এসেছে। ‘আমি একদিন নিখোঁজ হবো’। এটি বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে লেখা নানান পঙ্ক্তির কালেকশন। আমি যাকে বলি অকবিতা।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: অকবিতা কেন?
সাদাত হোসাইন: এগুলোকে অকবিতা বলার কারণ আমি বইয়ের ভূমিকায় লিখেছি। পাঠক আশা করছি সেখানেই আমার ব্যাখ্যাটা পেয়ে যাবেন। তবে আমার মনে হয়, এগুলো কবিতা না অকবিতা, তা পাঠকই নির্ধারণ করুক। কারণ শেষ পর্যন্ত পাঠকই নির্ধারক।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: এই বইমেলা নিয়ে প্রত্যাশা বা প্রাপ্তির জায়গাটি কী?
সাদাত হোসাইন: আমার মনে হয় এটি চমৎকার একটি আয়োজন। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি ওপার বাংলার লেখকদের বই আমাদের ঘরে ঘরে, ফুটপাতের বইয়ের দোকান থেকে অভিজাত দোকান, লাইব্রেরি পর্যন্ত। ওপারের লেখকদের নাম, বইয়ের নাম আমাদের ঠোঁটস্থ। অথচ আমাদের লেখকদের নাম ওখানকার পাঠকেরা বলতে গেলে সেভাবে জানেনই না। আমাদের হাতেগোনা যা-ও দুয়েকজন লেখক ওখানে পরিচিত, তা-ও সেভাবে বিস্তৃত পরিসরে নয়। এখানে যেমন সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু। হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া ওপারের তরুণ পাঠকরা আমাদের অন্য লেখকদের কথা, লেখার কথা তেমন জানেনও না। এর প্রধান কারণ, কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে আমাদের বইয়ের বাজার তেমন বিস্তৃত নয়, সহজলভ্যও নয়। কলকাতায় এই বাংলাদেশ বইমেলাটা সেই পরিপ্রেক্ষিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমার মনে হয়। মেলায় প্রবীণদের পাশাপাশি তরুণ পাঠকদের উপস্থিতিও আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে দুই বাংলার তরুণ লেখক ও পাঠকদের মধ্যে একটি নতুন সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে হ্যাঁ, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রকাশক, লেখকদের চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সংশ্লিষ্ট মহলকেও আরও এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার মিডিয়াকে। এখন বাজার ব্যবস্থার যুগ। আর বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে বিজ্ঞাপন, প্রচার, প্রসার খুব জড়িত। কলকাতার মেইন্সট্রিম মিডিয়াগুলো যদি এই মেলা নিয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ ছাপে, আমার মনে হয়, তাহলে এই মেলাটি আরও কার্যকর ও জমজমাট হয়ে উঠতে পারে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: কলকাতার তরুণ পাঠকরা বাংলাদেশের লেখকদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলছেন? না কি এটি শুধু ফেসবুককেন্দ্রিক কিছু স্ট্যাটাস লেখক আর স্ট্যাটাস পাঠকের মধ্যকার সাহিত্য মান বিবেচনায় অগুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, যোগাযোগ?
সাদাত হোসাইন: কলকাতার পাঠকেরা বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন—এটি সত্য। এর পেছনে অবশ্যই একটি বড় কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিশেষ করে ফেসবুক। একটা সময় আপনি সীমানা বন্ধ করে দিলেই বা কড়াকড়ি আরোপ করলেই লেখালেখি, সিনেমা বা বইয়ের মতো সৃজনশীল কন্টেন্ট হয়তো একদেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছাতে পারত না। এখন আর সেই অবস্থা নেই। এখন আপনার লেখা বা সিনেমা যদি ভালো হয়, তাহলে তা এই দৃশ্যমান সীমানাকে থোড়াই কেয়ার করে ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে বিশ্বব্যপী ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেক্ষেত্রে কন্টেন্ট ভালো হতে হবে। কন্টেন্ট যদি পাঠক বা দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারে, তবে এখন সীমানা আর বাধা হয়ে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা রাখে না। খেয়াল করে দেখেন, এই ফেসবুকের কল্যাণেই কিন্তু মূলধারার সাহিত্য বা লেখালেখির চর্চায় উপেক্ষিত বা অগুরুত্বপূর্ণ অনেক লেখকই পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছেন বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। সেটি এপার বাংলার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি ওপার বাংলার লেখকদের ক্ষেত্রেও। এখন আপনি তাদের লেখক বা পাঠক বলবেন কি না, সেটি আপনার বিষয়। তারা কিন্তু আপনার স্বীকৃতির বা মনে করার অপেক্ষায় বসে নেই। কারণ, বিশ্ব এখন ওপেন প্ল্যাটফর্মের। ধরুন, একটা সময় তরুণ লেখকদের বিশাল বড় নির্ভরতার জায়গা ছিল দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদকেরা। যেন তাদের দেওয়া একটা সুযোগই এই নবীন লেখকদের লেখকজনম স্বার্থক করে দেবে, প্রতিষ্ঠিত বা গুরুত্বপূর্ণ করে ফেলবে। নবীনদের লেখা বিস্তৃত পরিসরে পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেবে। এই সুযোগ তারা না পেলে তাদের আর পাঠকের কাছে পৌঁছানো হবে না। কিন্তু সময় বদলেছে। আপনি যত যাই বলুন না কেন, লেখেলেখিতে পাঠকই শেষ কথা। যে এটি স্বীকার করতে চায় না, সে-ও জানে—এই কথাই শেষ কথা, সত্য কথা। ফলে একটি সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছে নতুন লেখকরা এই পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্যই তখন নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সাহিত্য পাতার সম্পাদকদের প্রতি ডিপেন্ডেসি বা তাদের তোয়াজ করার দিন বলতে গেলে শেষই হয়ে গেছে। কারণ ওই উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম। কেউ আপনার বা আমার স্বীকৃতির অপেক্ষায় বসে নেই। আসলে আমাদের অগোচরেই একটা বড় বিপ্লব বা পরিবর্তন ঘটে গেছে, পাঠক ও লেখকের সম্পর্ক ও যোগাযোগে। এর কারণ প্রযুক্তি। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত একটি ব্যবস্থা বা ধারণার মধ্যে বসবাস করেছেন, অভ্যস্ত হয়েছেন, তারা কেউ কেউ বিষয়টি উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ অগ্রাহ্য বা নাকচ করে দেয়ার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ মেনেও নিচ্ছেন। আসলে সময় এবং ব্যবস্থা পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনটা যারা ধরতে পেরেছেন, মানিয়ে নিতে পেরেছেন, তারাই কিন্তু টিকে রয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সামগ্রিক পরিসরে একটি বড় পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে। এটি অলরেডি ঘটে গেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপনি সেটিকে কিভাবে নেবেন? আর না নিলে আপনার এক্সিস্টেন্সটা আসলে কোথায় থাকছে, কিভাবে থাকছে?
আমি মনে করি, এই পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের তরুণ লেখকেরা চমৎকারভাবে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। যার ফল তাদের পাঠক বেড়ে যাওয়া। সেটি এপার বাংলায় যেমন ওপার বাংলায়ও।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: তার মানে ফেসবুক খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে? কিন্তু এটিকে তো অনেকেই হালকা বা তরল লেখালেখির মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করছেন। এমনকি ফেসবুকের লেখকদেরও।
সাদাত হোসাইন: সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? কেউ কেউ কেন? আগের সিস্টেমে অভ্যস্ত বেশিরভাগ লেখক বা পাঠকেরই তো এটিকে সেভাবেই নেওয়ার কথা। ওই যে বললাম, পরিবর্তন মেনে নেওয়া বা স্বীকার করা কখনোই সহজ ছিল না। কোনো ক্ষেত্রেই না। আমি আগেই বলেছি, এটি বাজার ব্যবস্থার যুগ। আপনি মুখে মুখে যত যা-ই বলুন, শেষ অবধি এই সময়ে বা এই বৈশ্বিক ব্যবস্থায় এসে আপনি এর বাইরে গিয়ে টিকে থাকতে পারবেন না। এখন ধরুন, আপনি একটি পণ্য বিক্রি করছেন, আপনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বা লিফলেট ছাপিয়ে আপনার পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে অভ্যস্ত। কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ বছর ধরে আপনি এই সিস্টেমেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এখন হঠাৎ করেই যদি সিস্টেমে বড় ধরনের ইনোভেশন বা উদ্ভাবন ঘটে, সবাই কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই তা গ্রহণ করবেন না। তারা আগের সিস্টেমেই বিলং করার আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। এই যে এখন হরদম ফেসবুকে পণ্যের বিজ্ঞাপন হচ্ছে, অনলাইন শপ হচ্ছে, কেনাবেচা হচ্ছে, এখন বলুন তো, দেশের বা বিশ্বের কোন প্রতিষ্ঠান বা পণ্য এই নতুন এবং উদ্ভাবনী মাধ্যম থেকে দূরে আছে? কারা এখানে তাদের প্রচার বা প্রসার করছে না? সবাই করছে। কেউ আগে, আর কেউ পরে। বাস্তবতা এটাই। আপনি এই বাস্তবতায় এডাপ্ট করতে না পারলে টিকে থাকতে পারবেন না। এখন আপনি ফেসবুকের লেখকদের হালকা লেখক বা লেখা বলছেন। কে জানে, আজ থেকে কুড়ি, পঞ্চাশ, একশ বছর পরে কী হবে? আপনি জানেন? জানেন না। সো এভাবে সবজান্তা নির্ধারক হয়ে লাভ নেই। নতুনকে গ্রহণ করতে জানতে হবে। আপনি পরিবর্তিত হননি বলে কিন্তু পরিবর্তন থেমে থাকবে না। সো কে লেখক, কে লেখক না, সেটি সময় আর পাঠকই নির্ধারণ করবেন।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, সবকিছুর জন্যই প্রচার খুব জরুরি? এমনকি লেখালেখির জন্যও?
সাদাত হোসাইন: অবশ্যই এবং অবশ্যই। এর কোনো বিকল্প নেই। এর অসংখ্য কারণ আমি দেখাতে পারি। একটি মাত্র কারণ বলছি। প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে গত দশ বা কুড়ি বছরে আমাদের বিনোদনের অসংখ্য বিকল্প মাধ্যম তৈরি হয়েছে। ফলে আগে যে সকল পাঠক কেবল বইয়ের ভেতরই বিনোদন খুঁজতেন বা আগ্রহী ছিলেন, তারা এখন অন্যান্য বিকল্প মাধ্যমগুলোতেও ভাগ হয়ে গেছেন। ফলে বইয়ের পাঠক কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। আর নতুন আসা বিকল্প মাধ্যমগুলোকে আরও বিস্তৃত পরিসরের ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, গ্রহণযোগ্য করা জন্য তার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা কিন্তু সম্ভাব্য সকল প্ল্যাটফর্মে সর্বোচ্চ প্রচারণা চালাচ্ছেন। এর প্রভাব তো পড়বেই। পড়বে না? নিঃসন্দেহে পড়বে। একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: তাহলে তো আর সব পণ্যের মতোই বইয়েরও একই রকম বিজ্ঞাপন প্রয়োজন। আপনি সেটিই বলছেন। কিন্তু বই কি পণ্য? বই তো একটি শিল্প।
সাদাত হোসাইন: হা হা হা। অবশ্যই বই একটি পণ্য। আর সব পণ্যের মতোই। আর সব পণ্যের যেমন উপযোগিতা আছে, বইয়েরও আছে। তবে এই উপযোগিতার মধ্যে ফারাক রয়েছে। সব পণ্যের উপযোগিতা এক নয়। বই একাধারে যেমন শিল্প, তেমনি পণ্যও। ধরুন, একটি সিনেমা, সিনেমা কি? শিল্প নয়? নিঃসন্দেহে শিল্প। তাহলে? সিনেমার কী প্রোডাক্ট ভ্যালু নেই? অবশ্যই আছে। একটি সিনেমা নির্মাণে প্রোডাকশন কস্ট বা উৎপাদন ব্যয় রয়েছে। এখন আপনি কোটি টাকা দিয়ে সিনেমা বানাবেন, সেই সিনেমার প্রচার করবেন না। ফেসবুকে প্রচারণা চালাবেন না, টেলিভিশন, বিলবোর্ড, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবেন না। আপনার সিনেমা চলবে? যতই সেটি ভালো হোক, শিল্পসম্মত হোক, সেটি চলবে? চলবে না। কারণ সেটি মানুষ জানবেই না। এখন এই কোটি টাকা দিয়ে নির্মিত সিনেমা নির্মাণের টাকা আপনাকে যিনি দিয়েছেন, তিনি আপনার চেহারা দেখেই এই কোটি টাকা দিয়ে দেবেন? সিনেমা বিক্রি থেকে তিনি তার টাকা ফেরত চাইবেন না? চাইলে আপনি কোত্থেকে দিবেন? আর না দিলে, আপনার সিনেমার কথা প্রচারণার অভাবে কেউ না জানলে, না দেখলে, আপনার পরের সিনেমার জন্য কে আপনার পেছনে টাকা প্রোডিউস করবে? কেউ না। বইয়ের ব্যাপারটাও অনেকটা তাই। আপনি যতই ভালো লেখেন, আপনার বইয়ের কথা যদি কেউ না জানে, যদি প্রচারণা না হয়, ধরুন আপনি তরুণ একজন লেখক, আপনাকে কেউ চেনেই না, তাহলে কে আপনার বই কিনবে? আর আপনার বই কেউ না কিনলে, এই যে বই ছাপাতে আপনার প্রকাশকের টাকা খরচ হলো, এই টাকা তাকে কে দেবে? আপনি পকেট থেকে দেবেন? আপনার প্রকাশককেও কিন্তু এই বই বিক্রি করেই খেতে হয়। তার সংসার চালাতে হয়। বউ-বাচ্চা পালতে হয়। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে হয়। তাহলে?
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: কিন্তু অনেকেই তো এটাও বলেন যে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো লেখক, যাকে কি না বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক বলা হয়, তাকেও কি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে এমন প্রচারণার আশ্রয় নিতে হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ? বা এমন বিখ্যাত, জনপ্রিয় যারা রয়েছেন?
সাদাত হোসাইন: এই প্রসঙ্গ যারা তোলেন, আমি তাদের চিন্তার ধরন দেখে হতাশ হই। আচ্ছা, আপনিই বলুন তো, তখন টেলিভিশন ছিল? ফেসবুক ছিল? ইউটিউব ছিল? কম্পিউটার ছিল? ছিল না। তাহলে তারা তখন এসব মাধ্যমে কিভাবে তাদের প্রচারণা চালাবেন? দ্বিতীয়ত, তখন বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম ছিল কম, ফলে উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মনোযোগ আকর্ষণ করা সহজ ছিল। খুব ছোট পরিসরে বিজ্ঞাপন বা প্রচার বা এমনকি প্রকাশই হয়তো খুব দ্রুত মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতো। এখন সেই সময়, সেই পরিস্থিতি নেই। আর তৃতীয়ত, আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন যে, তাদের প্রকাশকও শরৎচন্দ্রের বই বের হওয়ার সময় একটা প্রচারণামূলক পোস্টার ছাপাননি? একটা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেননি? কিভাবে নিশ্চিত আপনি? ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখুন, তিনি বা তাঁরাও তাদের সময়ে, তাদের ব্যবস্থায়, তাঁদের সুবিধামতো, সেই সময়ের প্রচলিত মাধ্যমে বইয়ের প্রচারণা করেছেন। এই সময়ে তারা বেঁচে থাকলেও রেডিও টিভিতে তাঁদের বই নিয়ে প্রচারণামূলক সাক্ষাৎকার প্রকাশ হতো, ফেসবুকে বইয়ের প্রচার হতো। সুতরাং নিজে অন্ধ বলে জগতও অন্ধকারে ডুবে থাকবে এটি আশা না করাই ভালো। সময় বদলেছে, ব্যবস্থা বদলেছে, মানুষের লাইফস্টাইল, রুচি বদলেছে। আর আপনি এই সময়ে এসে সেই সময়ের বইয়ের প্রচারণার তুলনা করছেন। তাহলে আমাকে বলুন, তখন মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন হতো? এখন হয়তো বলবেন যে তখন কী মোবাইল ফোন ছিল? তখন ফেসবুকে, টুইটারে, টিভিতে বিজ্ঞাপন হতো? ওয়েল, আপনি বলবেন তখন মোবাইল ফোন ছিল না, ফেসবুক, টুইটার, টিভি ছিল না। কিন্তু এখন হয়েছে। অর্থাৎ পৃথিবী বদলেছে, ধারণা বদলেছে। সময় এবং প্রযুক্তি অভিনব সব আবিষ্কার করেছে, আপনি সেসব গ্রহণ করবেন কি করবেন না, সেই সিদ্ধান্ত আপনার। কিন্তু আপনি গ্রহণ না করলেই যে অন্যরা থেমে থাকবে, তা কিন্তু নয়। আপনি অন্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে অন্যকেও আপনার মতো চোখ বন্ধ করে থাকতে বলতে পারেন না।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: তাহলে বইয়ের সর্বোচ্চ বিজ্ঞাপন হওয়া উচিত?
সাদাত হোসাইন: অবশ্যই। ফেসবুকে তো বটেই, আমি চাই বিলবোর্ডে, টেলিভিশনে, রেডিওতে, রাস্তায়, বাসে, শহরের দেয়ালে দেয়ালে এমনকি মানুষের ঘরে ঘরে বইয়ের বিজ্ঞাপন হোক। বই কী সমাজের জন্য কোনো ক্ষতিকর বিষয় না কি? এ দেশে হেন কোনো জিনিস নেই যার বিজ্ঞাপন হয় না। কেবল বইয়ের বিজ্ঞাপন, প্রচার প্রসারের কথা উঠলেই এক শ্রেণীর মানুষের গাত্রদাহ শুরু হয়। এর কারণ আমি বুঝি না। কেন, বই কী এই দেশের সবচেয়ে ক্ষতিকর কোনো বিষয়? কেন বইয়ের বিজ্ঞাপন, প্রচার, প্রসার হতে পারবে না? আমি অবশ্যই চাই, এই শহর, শহরের দেয়াল, বিলবোর্ড ছেয়ে যাক নানান রঙের বইয়ের বিজ্ঞাপনে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: আসছে অমর একুশে বইমেলায় নতুন বই আসছে?
সাদাত হোসাইন: হ্যাঁ। ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ নামে একটি উপন্যাস আসছে, ভাষাচিত্র থেকে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
সাদাত হোসাইন: আপনাকেও।