চিন্তাসূত্র: এবারের বইমেলায় আপনার কী কী বই আসছে? প্রকাশক কে? প্রচ্ছদ কে করেছেন? প্রকাশিত বই সম্পর্কে কিছু বলুন।
হুসাইন হানিফ: এবারের বইমেলায় আমার প্রথম প্রকাশিত বই ‘বহিষ্কার’ আসছে। প্রকাশক চিলেকোঠা পাবলিকেশন। প্রচ্ছদ করেছেন, সুবন্ত যায়েদ। ১২টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘বহিষ্কার’। সমকালীন সমাজ বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে গল্পগুলোতে। সমাজের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। মাদ্রাসায় পড়া কিছু শিক্ষার্থীর করুণ জীবন আর সময়ের তুলনায় তাদের ভাবনা তুলে ধরার চেষ্টা আছে। আছে প্রেম-অপ্রেমের গল্প। আছে ব্যক্তির একাকিত্বের যন্ত্রণার গল্প। আছে সন্তানহীন জননীর হাহাকারের চিত্র। গরিব পরিবারে জন্ম শিশুকে দত্তক নেওয়ার করুণ চিত্র আছে। আর আছে ব্যক্তির অপরাধের ফিরিস্তি আর আত্মগ্লানির বর্ণনা। বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাগুলোই যেন বই সম্পর্কে আসল তথ্য দেয়। এখানে তুলে ধরলাম, ‘আমাদের ছোট্ট খেলাঘরে ভীষণ আলোস্বল্পতা। জমানো কিঞ্চিৎ আলোয় দেখা যায় কদাকার মুখগুলো। বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু আলো হঠাৎ ভেতরে এলে কদাকার মুখগুলো যেন ম্যাজিক দেখায়। মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে বীভৎস খোলস। তারপর প্রদর্শিত হচ্ছে সুবোধ ও সুশীল কিছু সংলাপ। অথচ কণ্ঠের ভারে ঝুলে আছে নিস্তব্ধ অন্ধকার। আমাদের ভেতরে মনুষ্যত্ববোধ প্রধান হয়ে উঠলে হঠাৎ মনে হয়, এসব কি অমানবিকের মত দেখতে মজার ও নেশাতুর কোনো ম্যাজিক? অথচ জাদুবাস্তবতার মতো দেখতে নিরেট বাস্তবতা, শরীর গুলিয়ে ওঠা বিষম ক্ষত। তবু সমাজে যত্নে তা পালিত হয়, সুপ্তভাবে লালিত হয় মননে। গল্পের চরিত্রগুলো এমন নিরেট বাস্তবতার ভেতরে বসবাস করে। এইসব আখ্যানে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ যে নির্যাস, তা পাঠককে ব্যাকুল করে তোলে, গা ঘিনঘিনে বাস্তবতার সামনে অস্বস্তি আনে। যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে সমাজের স্বরূপ চেনায়।’
চিন্তাসূত্র: সারাবছর লেখক-প্রকাশক বই প্রকাশ না করে এই একুশে বইমেলা এলেই বই প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন?
হুসাইন হানিফ: আমি মনে করি ব্যাপারটা ভালো লেখার জন্য। তবে, লেখকের জন্য ও প্রকাশকের জন্যও অতটা ভালো নয়। মৌসুমকেন্দ্রিক যেকোনো জিনিসেরই ঝুঁকি আছে, সুবিধাও আছে। কিন্তু এই ট্রেন্ড না থাকাই ভালো। যদিও একটা উৎসব উৎসব আমেজ পাওয়া যায়, এতে করে অধিকাংশ লেখক পাঠক খুশি, কিন্তু আমার কাছে বিষয়টা মন্দের ভালো। যেহেতু আমাদের দেশে পাঠক ক্রমশ কমে যাচ্ছে, সেই হিসেবে এটা ভালো।
আমি মনে করি, সারাবছরই বই প্রকাশ করা উচিত। সারা বছরই বই পড়া উচিত, কেনা উচিত। একজন ভালো পাঠক প্রতিদিনই কিছু না কিছু পড়েন, একজন সিরিয়াস লেখক সব সময় কিছু না কিছু লেখেন। ফলে সারা বছরই বইয়ের চাহিদা এবং প্রকাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। অন্যদিকে মেলা-কেন্দ্রিক লেখক পাঠক বিষয়টা জোর-জবরদস্তির একটা চিহ্ন বহন করে।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে?
হুসাইন হানিফ: একজন পাঠক হিসেবে আমি মনে করি এটা ভালোই প্রভাব ফেলে। সারা বছর আমি অপেক্ষায় থাকতাম কবে বইমেলা আসবে, কবে ব্যাগভর্তি করে বই কিনে আনবো। অনেকেই সারাবছর টাকা বাঁচিয়ে রাখেন, যেন বইমেলায় নিজের পছন্দের বইগুলো কেনা যায় অনায়াসে।
চিন্তাসূত্র: একুশে বইমেলা প্রকাশনা শিল্পে তরুণদের উৎসাহিত করার ব্যাপারে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে বলে আপনি মনে করেন?
হুসাইন হানিফ: এটা তরুণদের ভালো উৎসাহিত করে বলে আমার মনে হয়। বইমেলায় যখন লেখকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, তাদের কথা শোনার সুযোগ হয়, তখন একজন তরুণ নিজেকেও একজন লেখক হিসেবে কল্পনা করে সুখ পায়। বড় হয়ে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। অনেকে বই বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে, সুন্দর সুন্দর বিষয়ের ওপর বই করে নজর কাড়ে, তখন তরুণদের মনেও স্বপ্ন জাগে এরকম সুন্দর একটা শিল্পের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে। যে শিল্পে বইয়ের প্রাচুর্য, সারাক্ষণ বইয়ের ঘ্রাণে ডুবে থাকা যায়, প্রগতিশীল, রুচিবান, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা যায় সব সময়, তা যেকোনো তারুণকে উৎসাহিত করবে।
চিন্তাসূত্র: প্রকাশনা উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে যে কেউ ইচ্ছা করলেই বই প্রকাশ করতে পারেন। এতে বছর বছর বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মান বৃদ্ধি ঘটছে না বলে অনেকেরই অভিযোগ; বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন। বই প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন আছে কি?
হুসাইন হানিফ: ‘মান’ বিষয়টা নিয়ে কথা বলা খুব ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। আমরা জানি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বাজি ধরে গল্প লিখেছিলেন। সেই ঘটনাটাই তাকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়েও অনেক হাসিঠাট্টা হয়েছে। ওই সময়ের পণ্ডিতদের কাছে জীবনানন্দর কবিতা মানহীন দুর্বোধ্য মনে হতো। ফলে কবিকে আক্রমণ পর্যন্ত করেছে। এই ঘটনা আমরা সবাই জানি। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ আজ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ (?) কবি।
তাই কারও সামর্থ্য থাকলে, লিখতে পারলে, ইচ্ছা থাকলে যেকারও বই প্রকাশ করতে পারা উচিত। আজ যেটাকে মানহীন মনে হচ্ছে, কাল সেটা মানোত্তীর্ণ মনে হতে পারে। এখানে নীতিমালা ব্যাপারটা অপ্রয়োজনীয়। নীতিমালার চাপে হয়তো অনেক পটেনশিয়াল মাস্টারপিস মুখ থুবড়ে পড়ছে। পাঠকের সামনে আসতে পারছে না। তাই বই প্রকাশের ক্ষেত্রে নীতিমালা বিষয়টা না থাকাই ভালো।