মহীবুল আজিজ—একাধারে কথাসাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক-গবেষক ও অনুবাদক। ১৯৬২ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষক। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তার গ্রন্থ সংখ্যা ত্রিশেরও বেশি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হলো: উপন্যাস- ১. বাড়ব, ২. যোদ্ধাজোড়। গল্পগ্রন্থ- ১. গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ, ২. দুগ্ধগঞ্জ, ৩. মৎস্যপুরাণ, ৪. আয়নাপাড়া, ৫. বুশম্যানের খোঁজে, ৬. নীলা মা হতে চেয়েছিল। কাব্যগ্রন্থ-১. সান্তিয়াগো’র মাছ, ২. হরপ্পার চাকা, ৩. রৌদ্রছায়ার প্রবাস, ৪. পৃথিবীর সমস্ত সকাল, ৫. নিরানন্দপুর, ৬. এই নাও দিলাম সনদ, ৭. আমরা যারা স্যানাটরিয়ামে, ৮. আমার যেরকম প্রস্তুতি, ৯. অসুস্থতা থেকে এইমাত্র, ১০. বৈশ্য বিশ্বে এক শূদ্র, ১১. দৃশ্য ছেড়ে যাই, ১২. পালাবার কবিতা, ১৩. ট্যারানটেলা, ১৪. ওগো বরফের মেয়ে। প্রবন্ধ-গ্রন্থ- ১. কথাসাহিত্য ও অন্যান্য, ২. সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত, ৩. সৃজনশীলতার সংকট ও অন্যান্য বিবেচনা, ৪. সাহিত্য ইলিয়াস ও অন্যান্য নক্ষত্র, ৫. অস্তিত্বের সমস্যা ও লেখালেখি, ৬. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ৭. উপনিবেশ বিরোধিতার সাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ। গবেষণা-গ্রন্থ-১. হাসান আজিজুল হক: রাঢ়বঙ্গের উত্তরাধিকার, ২. বাংলাদেশের উপন্যাসে গ্রামীণ নিম্নবর্গ, ২. ঔপনিবেশিক যুগের শিক্ষা ও সাহিত্য। সম্প্রতি চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে এই বহুমাত্রিক লেখকের মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কবি শামস আরেফিন।
শামস আরেফিন: আজ আমরা ড. মহীবুল আজীজের লেখালেখি ও রচনা সম্পর্কে কথা বলবো। চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই। প্রথমেই জানতে চাইব—আপনি একাধারে বাংলা কবিতা, ইংরেজি কবিতা, গল্প ও উপন্যাস—এ ধরনের বৈচিত্র্য কিভাবে রক্ষা করতে পেরেছেন?
মহীবুল আজিজ: আসলে আমি পুরো বিষয়টিকে সাহিত্য হিসেবে দেখি। ছাত্রজীবনে দুর্ঘটনাবশত ইংরেজিতে পড়াশুনা করিনি। আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন ইংরেজিতে পড়াশোনা করি। আমি চাইনি ইংরেজি পড়তে। আমাদের ঘরে সবসময় ইংরেজি বই ছিল। আমি এই ইংরেজি বইগুলো পড়তাম। ফার্সি সাহিত্য পড়তাম।
শামস আরেফিন: আমরা জানতে চাচ্ছিলাম, সাহিত্যের এত বিচিত্র ধারায় কিভাবে আপনি সমন্বয় রক্ষা করলেন?
মহীবুল আজিজ: হ্যাঁ, আমি তখনই বিভিন্ন আঙ্গিকে লেখালেখি করতাম। যখন যা পারতাম, তাই লিখতাম। ফলে সব মাধ্যমের প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা ছিল। আমি কখনো ভাবিনি—বাংলা-ইংরেজি সব মাধ্যমে লিখতে পারব। কিন্তু দেখলাম একেক সময় একেক ধরনের চিন্তা মনে আসে। কখনো তা গান হয়ে, কখনো কবিতা হয়ে। আর ইংরেজি কিন্তু আমি অনুবাদ করিনি। আমি ইংরেজিতে কবিতা লিখেছি।
শামস আরেফিন: এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যিকরা নিজ ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। তারপর বিভিন্ন ভাষায় তার কবিতা বা সাহিত্য অনূদিত হয়েছে। আপনি সেরকম না করে কেন ইংরেজি ভাষায় কবিতা লিখতে গেলেন?
মহীবুল আজিজ: আসলে আমি যখন আইজ্যাক বাশিরের ২৫০পৃষ্ঠার বই অনুবাদ করি, তখন আমার কাছে ইংরেজিটা সহজ মনে হয়েছে। তারপর যখন ইতালি ক্যালবিনোর দুষ্প্রাপ্য ও কঠিন গল্প অনুবাদ করলাম, তখন ভাবলাম ইংরেজিতে তো লেখা যায়। আর যেহেতু আমি ইংল্যান্ডে পাঁচ বছর ছিলাম, সেখানের ব্যবহারিক ইংরেজি আমার সহজেই আয়ত্তে আসে। এভাবে আমি ইংরেজি কবিতা লিখতে শুরু করলাম, বিশেষত প্রাইভেট মোমেন্ট কবিতার বইয়ের ‘হোমেজ টু আইজ্য বিশস সিঙ্গার’ লেখা শুরু করলাম। দেখলাম আমিও পারি।
শামস আরেফিন: আপনার সম্প্রতি প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ কবিতায় আমরা খুব কম সংখ্যক কবিতা দেখি। মনে হয়েছে আপনি নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন কবিতা নির্বাচনে। পাশাপাশি আপনি সহজ, সাবলিল ও প্রাণবন্ত ভাষায় কবিতা লিখতে চেষ্টা করেছেন। সহজ ভাষায় কবিতা লেখার দৃষ্টিভঙ্গি আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মহীবুল আজিজ: অভিধান থেকে কঠিন কঠিন শব্দ বেছে বেছে কবিতা লিখতে হবে, বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। বরং বিষয় হচ্ছে আমার বাণীটা কি আমি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। ভাব ও বাণীর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। যেমন বিনয় মজুমদারের কবিতা কিন্তু অনেক সহজ। যেমন ‘মানুষ নিকটে এলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’। তারপর ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’ বা ‘ভালোবাসা দিতে পারি তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম’। আমার মনে হয় বিনয় মজুমদারের কবিতা খুবই সহজ। তবে এই সহজের আড়ালে যে বাণী, তা খুবই উচ্চাঙ্গের।
শামস আরেফিন: পাঠক যদি জানতে চায়—সাহিত্যের মাধ্যমে লেখক হিসেবে আপনি কী করতে চান?
মহীবুল আজিজ: আমি মনে করি—পৃথিবীতে একজন মানুষ সহজেই খারাপ কাজ করতে পারে। খারাপের জন্য ১০০টা রাস্তা খোলা আছে। কিন্তু ভালো হওয়ার রাস্তা খুব কম। এই কম রাস্তায় যদি আসা যায়, তবে সেটা সাধনার ব্যাপার। আর সেই রাস্তা যদি ভালো লাগে, তবে সেই রাস্তায় হাঁটা আমার জন্য আনন্দের। অর্থাৎ সেই কবিতার মতো—দ্য রোড নট টেইকেন। মানে যে রাস্তায় হাঁটা হয়নি, সে রাস্তায় কখনো যে কেউ হাঁটবে না, তা কিন্তু নয়। একটা লোক ভুল করেও তো সেই রাস্তায় আসতে পারে। আর সাহিত্য যদি ভুল হয়, তবে সেটা ভুল। আমি বলব, এটা একটা মধুর ভুল।
শামস আরেফিন: আমরা সাধারণত মহৎ কবি বা সাহিত্যিকের মাধ্যমে তার উত্তরসূরিদের প্রভাবিত হতে দেখি। যেমন শামসুর রাহমানের ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ জীবনান্দের প্রভাবে প্রভাবিত। বা আল মাহমুদের ‘শঙ্খ মাঝা স্তন দুটি যেন শ্বেত পদ্ম কলি’—এ পঙ্ক্তিটি পাবলো নেরুদা দ্বারা প্রভাবিত। কবিতা দ্বারা কবিতা প্রভাবিত হতেই পারে। কিন্তু ইদানীং অনুকরণ নিয়ে বা প্রভাবিত হওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। আপনি কি মনে করেন এসব পাঠের অভাব থেকে হচ্ছে?
মহীবুল আজিজ: আমি মনে করি জীবনান্দ দাশের অনেক কবিতা রিকনস্ট্রাক্ট করা হয়েছে। যেমন হায় চিল, সোনালি ডানার চিল। এ কবিতাটি ইয়েটস’র ‘ওহ কার্লিও’ থেকে অনুকরণ করা হয়েছে। কবি জানেন যে, আমি যদি এটি রিকনস্ট্রাক্ট করি, তবে পাঠক জানবেন যে, এটি এ মূল কবিতা থেকে লেখা হয়েছে। কারণ এ রিকনস্ট্রাকট বিখ্যাত কবিতার করা হয়ে থাকে। আর এ কবিতাগুলো মূল কবিদের প্রতি ভালোবাসা থেকে করা হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার প্যারোডি করা হয়েছে। এসবই কবিদের প্রতি ভালোবাসা। আজ যদি এ বিখ্যাত কবিরা বেঁচে থাকতেন, তবে তিনি এ চিন্তাটাকে কিভাবে দেখতেন? সব যে সফল হবে, তা কিন্তু নয়। তবে মানুষ ভালোবাসা থেকে চেষ্টা করে। কিন্তু যদি আমি মনে করি যে, আমার কবিতার ভেতর কিছু কিছু ছন্দ, আঙ্গিক ও শব্দ গ্রহণ করি এবং পাঠককে সেটা বুঝতে না দেই, তবে সেটা হচ্ছে চুরি বা আত্মসাৎ করা। জীবনানন্দ কোনো কবিতা এমনভাবে রচনা করেননি।
শামস আরেফিন: সাধারণত বিদেশে একজন কবিকে গল্প, প্রবন্ধ ও গদ্য লেখার পর কবিতা লিখতে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে কবিতা দিয়ে হাতেখড়ি শুরু। বাংলাদেশে একজন কবিকে গদ্য লিখতে বলা হলে অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ফসকে যান। আপনি কি মনে করেন—বাংলাদেশে সর্বাঙ্গিন সাহিত্যচর্চা হয়?
মহীবুল আজিজ: কে কী লিখবে—তা একান্ত তার নিজের ব্যাপার। তবে আমাদের পঞ্চ পাণ্ডব মৌলিক কবি হয়েও তারা সবাই-ই প্রবন্ধ লিখেছেন। যিনি কবিতা লিখছেন, তার আত্মপ্রকাশের জন্য প্রবন্ধ লিখতে হয়। কারণ পাঠক জানতে চায়, কবি কী ভাবেন। সেক্ষেত্রে প্রবন্ধ লিখলে সমস্যা কী? তবে প্রবন্ধ না লিখলে যে তিনি কবি নন, তাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সত্য নয়। কারণ আবুল হাসান সফল কবি হয়েও তেমন কোনো প্রবন্ধ লেখেননি। কবিতায় সবকিছু প্রকাশ করা যায় না। প্রবন্ধে অনেক কিছুই প্রকাশ করা যায়।
শামস আরেফিন: আমরা সম্প্রতি অনুগল্প লেখার প্রবণতা বেশি দেখছি। যেমন দশ বাক্য, বিশ বাক্য ও গল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। নতুনত্ব সৃষ্টির জন্য গল্পের কাঠামো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আপনি এ বিষয়গুলো কিভাবে দেখেন?
মহীবুল আজিজ: আসলে এগুলো তো তেমন নতুন কিছু নয়। যেমন ইয়ং সামারসনের—‘অ্যাপয়েন্টম্যান্ট ইন সামার’ বিখ্যাত অনুগল্প। মিশরে ও মধ্যপ্রাচ্যে অনুগল্প আছে। আর যেটা আছে, সেটা হচ্ছে আঙ্গিক। সুবিমল মিশ্ররা কিন্তু নতুন আঙ্গিকে লিখেছেন। তবে বর্তমান এ পরিস্থিতিকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারব না। একটা দীর্ঘ সময় যাওয়ার পর হয়তো আমরা বলতে পারব, এটা আসলে কি নৈরাজ্য না শিল্প।
শামস আরেফিন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
মহীবুল আজিজ: ধন্যবাদ চিন্তাসূত্রকে। আমি চিন্ত্রাসূত্র নিয়মিত পড়ার চেষ্টা করি। আমি মনে করি, চিন্তাসূত্রের সঙ্গে যারা আছেন, তারা সবাই সৃজনশীল ও মননশীল। আমরা আশা করি, চিন্তাসূত্র আরও বৃহত্তর পরিমণ্ডলে আমাদের উপস্থাপন করতে পারবে। সাহিত্যের হাল হাকিকত সম্পর্কে আমাদের জানাবে।