সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। ১৯৫৮ সালের ৩০ মে জন্ম। মূলত কবি। তবে কবিতার পাশাপাশি লিখেছেন গান, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ। করেছেন গবেষণাও। বিটিভিতে উপস্থাপনা করেছেন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দৃষ্টি ও সৃষ্টি। বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী। জন্মদিন উপলক্ষে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেদিন। এখানে কথোপকথনোর পুরোটাই তুলে ধরা হলো।
চিন্তাসূত্র: কী পড়ছেন এখন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আমি প্রতিদিন তিন ঘণ্টা ট্রেনে ও বাসে যাতায়াত করি। আমার ব্যাগে সব সময় বই থাকে। টরন্টোর ট্রেনের কামরাগুলো মনে হয় এক-একটা লাইব্রেরি। অনেকে যাত্রীই বই পড়তে পড়তে যান। এই সময়টা আমিও পাঠক হয়ে থাকি, কখনো নোটবুকে লেখালেখি করি। আবার কখনো বা জানালায় তুষার ঝরা বা বরফগলা নদী, চেরিফুলের দৃশ্য উপভোগ করি। দেখি নানা দেশের নানান মানুষ! যাই হোক। বীথি চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনি ‘যাচ্ছি দেশ দুনিয়া’ শেষ করে এখন বই পড়ছি। একটি ‘বঙ্গবন্ধু লেখক বঙ্গবন্ধু’ এবং ১৯৬৪ সালের একটি পুরনো কবিতার বই, ‘The Penguin Book of Japanese Verse’ পাঠ করছি এখন।
চিন্তাসূত্র: আপনার লেখালেখির শুরুটা বলুন।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামের সঙ্গে আমার নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলো অস্থির ছিলাম। কৈশোরের সেই সময়টা খুব টালমাটাল ছিল। আমাদের বাড়ি ছিল ব্রহ্মপুত্রের ওপারে চরাঞ্চলে। একাত্তর সালে আমাদের এলাকা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অভয়ারণ্য। বয়সের কারণে যুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে আসা যোদ্ধাদের সাহায্য করেছি, তাদের কাছে থেকে দেখেছি। তাদের অস্ত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে যুদ্ধ অনুভব করেছি। ক্লাশ ছিল না। পাড়াশোনা ছিল না। তখন মাথায় নানান বিষয়, নানান ভাবনা, নানান চিন্তা কাজ করতো। তা রোল করা খাতায় লিখতাম। কী লিখতাম, আজ আর মনে নেই। তবে সেখান থেকেই হয়তো লেখালেখির বীজ বপন শুরু।
চিন্তাসূত্র: আপনার কবিতায় গ্রাম থেকে শহর, দেশ থেকে বিদেশ, নারী থেকে পুরুষ, অধ্যাত্ম থেকে প্রেম, সবকিছুই যেন একইসুতায় মালা গেঁথে আছে। প্রশ্ন হলো, কিভাবে সম্ভব হলো সবকিছুকেই একইসূত্রে গাঁথা?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আমার সুন্দর শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে। বড় হয়েছি নিষ্ঠুর শহরে, রাজধানীতে। যুদ্ধোত্তর উথাল-পাতাল তারুণ্য কাটেছে জীবনযুদ্ধে, জীবন সংগ্রামে। না-খেয়ে থাকা দিন থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে দক্ষতা এবং দাপটের সঙ্গে জীবন-যাপন, শিল্প-সাহিত্যের বিচরণের অভিজ্ঞতা বিচিত্র। সরকারি চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে বাধ্যতামূলক অবসর, বন্ধুদের আচরণ ও প্রতারণা, মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত এবং হুমকি, স্বদেশ ছেড়ে বিদেশের অভিবাসিত্ব মানে ‘প্রবাস-খাটা জীবন’ অর্থাৎ গ্রাম-শহর-বিভূঁইয়ের অভিজ্ঞতা আমার এক জীবনে তিন জীবনের তিক্ত-মধুর অর্জনসমূহই হয়তো কবিতায় একইসূত্রে গ্রন্থিত।
চিন্তাসূত্র: একসময় আপনি নাটক লিখতেন। এখন লিখছেন না। কারণ কী?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: বাংলাদেশ বেতারে প্রচুর লিখেছি, আশির দশকে। আমি বেড়িওতে ১৯৮৫ সালে হুমায়ুন ভাইয়ের প্রথম রেডিও-নাটক (নাট্যরূপ) লিখি। জীবননান্দ দাশের গল্প থেকে, আল মাহমুদের কবিতা থেকে একের পর এক সিরিজ নাটক লিখেছি। স্রেফ বেকার জীবনে বেঁচে থাকার জন্য। সাহিত্যের জন্য নয়। পরে বাংলাদেশে টেলিভিশনে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘দৃষ্টি ও সৃষ্টি’ উপস্থাপনা করার সময় তৎকালীন ডিজি সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী এবং বন্ধু-প্রযোজক সৈয়দ জামানের অনুরোধেই নাটক লেখা। এর মধ্যে শামসুর রাহমান, আহমদ ছফা, হারুন হাবীবের গল্প থেকে নাটক প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়েছে। কারণ আমার (সাযযাদ আমিনের কথা, জাকির, সাদিকের জীবন ও সাহিত্য, বৃক্ষ বন্দনা, মুহম্মদ আলির চিঠি, ভালোবাসি ভালোবাসি, ওডারল্যান্ড, শাখা ও শেকড়, বৈশাখী, বনসাই, জাদুকর ইত্যাদি) নাটকগুলো ছিল সামাজিক দায়িত্ব থেকে লেখা, চেতনায় নাড়া দেওয়া, শিক্ষণীয় এবং মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা।
এখনো বিটিভি থেকে প্যাকেজ নাটক লেখার অনুরোধ আসে। কিন্তু নাটক আর গান লেখা হয় না প্রবাস-খাটা কঠিন জীবনের ব্যস্ততার জন্য। দেশ থেকে দূরে থাকার জন্যও।
চিন্তাসূত্র: দেশ ছেড়ে কেন বিদেশে গেলেন? আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ। দেশে এখন মুক্তিযুদ্ধে পক্ষের সরকার। এই সময়ও আপনি দেশের বাইরে। দেশে ফিরতে ইচ্ছা করে না?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আগেও উল্লেখ করেছি এবং আবারও বলছি, সরকারি চাকরি থেকে অন্যায়ভাবে বাধ্যতামূলক অবসর, বন্ধুদের আচরণ, ভণ্ডামি, মৌলবাদীদের হুমকি। কিছুতেই কোনো কিছুর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। আমার নিজস্ব নীতি আর ব্যক্তিগত আদর্শ নিয়ে সমাজের সঙ্গে মিশতে পারছিলাম না। সেই সময়ে আমার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নামকরণ থেকেও (ঘাতকের হাতে সংবিধান, একি কাণ্ড পাতা নেই, দ্রবীভূত গদ্যপদ্য, নির্জনে কেনো এতো কোলাহল, ঐক্যের বিপক্ষে একা) কিছুটা প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।
কানাডায় স্থায়ী হওয়ার আগে আমি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছি। বিভিন্ন দেশে দেখছি এবং উপলব্ধি করেছি তাদের আচার-আচরণ, সৌজন্যতা, ভদ্রতা, বিনয়, সততা, আদর্শ। একজন শিক্ষকের সন্তান হিসেবে এই ‘লোভনীয়’ বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার থাকায় আমি গর্বিত। মুক্তিযুদ্ধে পক্ষের সরকার এসেছে বলেই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা একজন লেখক হিসেবে এটাই আমার পরম প্রাপ্তি। সরকারের কাছে তো আমার ব্যক্তিগতভাবে কিছু চাওয়ার নেই। সাবেক তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ তার মিন্টু রোডস্থ বাসায় ডেকে নিয়ে আমাকে দেশে ফিরে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, নজরুল ইনস্টিটিউট কোথাও না কোথাও যোগদান করতে বলেছিলেন। আমি তা বিনয়ের সঙ্গে না করি। তার একাধিক কারণ আছে।
দেশে ফিরতে তো এই মুহূর্তে, প্রতিমুহূর্তে ইচ্ছে করে। আমার শারীরিক অবস্থান বা বাসস্থান টরেন্টো হলেও আমি মনেপ্রাণে সার্বক্ষণিক ঢাকায় থাকি। মনে হয় প্রতিদিন শাহবাগে অফিস করছি। পাঠাশালায় লেখক বন্ধুদের সাথে চা খাচ্ছি, আড্ডা দিচ্ছি।
চিন্তাসূত্র: আপনি প্রায় দেশপ্রেম-মুক্তিযুদ্ধ-বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে শ্রদ্ধাভরে কথা বলেন। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে, আপনি জামায়াতপন্থীদের কাউকে কাউকে প্রমোট করেছেন কখনো কখনো। কিন্তু কেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: এই প্রশ্নটি আমার জন্য অসন্মানজনক, আপত্তিকর এবং বিব্রতকর মনে হচ্ছে। আবার হাস্যকরও মনে হচ্ছে। অনেকটা আমাকে খামোখা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া! তাই এই কবিতাটি মনে পড়লো।
প্রিয় পাকিস্তানটাকে ভেঙে, শেষ করে
তিনি দশ মাস লাহোর জেলে আরামসে
হালুয়া-রুটি খেলে।
সাজানো নাটক থেকে নায়কের মতো কি সুন্দর ফিরে এলেন
১০ জানিয়ারি!তিনি তো স্বাধীনতা চাননি; চেয়েছিলেন স্বায়িত্বশাসন,
কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে
সাত কোটি বাঙালিকে ক্ষেপিয়ে গুলিও সামনে ঠেলে দিয়ে
চেয়েছিলেন বিশাল নেতা হতে-
৭ মার্চ!ত্রিশ লাখ শহীদ, লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানো হরণকারীদের
স্বাধীনিতা বিরোধীদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
জনগণের সংবিধানে হাত দিয়ে
কায়েম করেছিলেন এক নায়কতন্ত্র-বাকশাল
২৪ জানিয়ারি।কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটার অপরাধসমূহ
আমরা কিভাবে ক্ষমা করি?গুঁড়িয়ে তার মাথা, ভেঙে দাও তার হাত।
চুরমার করে দাও তার ‘মূর্তি’, ভাসিয়ে যাও বুড়িগঙ্গায়!(অপরধাসমুহ: সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল)
আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্যকর্ম তথা আমার লেখা গান, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, নাটক, গবেষণা, সম্পাদনার কথা একটু ভাবুন। আমার অর্ধেক বই-ই বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমি সারাজীবন স্বাধীনতাবিরোধীদের বিপক্ষে কাজ করে মামলা খেয়েছি, নিষিদ্ধ হয়েছি এবং বিদেশে এসেও সেই কাজ করছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কানাডায় বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে নিয়ে অনুসন্ধানী গ্রন্থ রচনা করেছি। (এবং দশ বছর ধরে ‘কানাডায় ১৯৭১’ নিয়ে গবেষণা করছি। আমি কোনো দিন মৌলবাদী ইনকিলাব, পূর্ণিমা, নয়া দিগন্ত, মিল্লাতে লিখিনি। এই কাগজগুলো আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা খবর ছেপেছে। শফিক রেহমানের যায় যায় দিনে ইনকিলাবের বিরুদ্ধে কভার স্টরি লেখার জন্য বাহাউদ্দিন মামলা করেছেন, ‘ইনকিলাবের উপ-সাংবাদিকতা’ গ্রন্থের প্রকাশক আমি।
আমার আপন নানা শেরপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তার মৃত্যুর পর ভোরের কাগজে আমার কলাম ছাপা হয়েছিল, (যা মাওলা ব্রাদার্সের একটি গ্রন্থে স্থান পেয়েছে), সে জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধী কামরুজ্জামান আমাকে শেরপুর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। সংগ্রাম আমার কারণে ব্লাসফ্যামি আইন পাসের প্রস্তাব দিয়েছিল। এসব ঘটনার তো শেষ নেই। তবে হ্যাঁ, একবার মান্নান সৈয়দ তার ‘পরাবাস্তব কবিতা’ এক আড্ডায় উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘দুলাল, বইটার একটা রিভিউ চাই।’আমি রিভিউ করে মান্নান ভাইয়ের হাতে দিলে তিনি সেটা আমাকে না জানিয়েই সংগ্রামের সাহিত্য পাতায় ছাপান। সেজন্য (এবং আরও একটি কারণে) মান্নান ভাইয়ের সাথে আমার দীর্ঘ দিন আমার বাক্য বিনিময় বন্ধ ও সম্পর্ক ছিন্ন ছিল। আমার জানা মতে, এই একটা ‘অপরাধ’ আছে।
আর যে কারণে মূলত এই প্রশ্নটি, সেটার ব্যাখ্যাও দিচ্ছি। ২০১৭ সালে নিউ ইয়র্কের এক বিতর্কির কবি (আমি তার নাম পর্যন্ত লিখতে রাজি না) টরেন্টোতে আমার বাসায় এসে ‘কানাডায় যাবেন কেন যাবেন’ বই দেখে বললো, আপনাকে কবি হিসেবে জানি। অথচ গদ্যকার হিসেবে পাঠক জানে না। আমি বইটি নিয়ে লিখবো। তারপর বইটি নিয়ে একটা লেখা পাঠায় এবং তা চিন্তাসূত্রে দেওয়ার অনুরোধ করে। তখন আমিও চিন্তাসূত্রে তা প্রকাশের জন্য ‘সুপারিশ’ করি। এটাই আমার ‘দ্বিতীয় অপরাধ’।
পরে একের পর এক তার মৌলবাদী মুখোশ উন্মোচনের পর তার সাথে শুধু যোগাযোগই বন্ধ করি, তা নয়; সতর্ক হয়ে আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে বিদায় করি। তার সম্পাদিত একটি ইংরেজি গ্রন্থে বার বার অনুরোধ স্বত্ত্বেও কবিতা দেইনি। তৃতীয় ব্যক্তিকে ধরে আমার পাঠশালা, স্বরব্যঞ্জন থেকে প্রকাশের জন্য তার ‘বালিকাদের চাবিওয়ালা’ পাণ্ডুলিপি দেয়। আমি তাও প্রত্যাখ্যান করি। এবং আমার প্রিয় পত্রিকা চিন্তাসূত্রকেও সতর্ক করে বলি, এই ঘটনা। সে আমাদের প্রগতিশীল লেখক রাহমান ভাই, আপা, জাফর ভাইদের নিয়ে ন্যাক্কারজনক লেখা লেখে। এ নিয়ে চিন্তাসূত্রের সাথে আমার সামান্য মনোমালিন্য হয়। কারণ, আমিই চিন্তাসূত্রের সঙ্গে যোগসূত্রটা করিয়ে দিয়েছিলাম। তবে আমিই পরে সতর্ক করি।
চিন্তাসূত্র: সম্প্রতি এমন সব কবি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, যাদের কারও কারও নামই কখনোই শোনেনি দেশের পাঠক। অথচ ময়ুখ চৌধুরী, আসাদ মান্নান এবং আপনিসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কবি এখনো এই পুরস্কার পাননি। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: এই ব্যাপারে আপনারা আরও বেশি ও ভালো জানেন। আমি নানা সময় অ-লেখক এবং অপাত্রে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের প্রতিবাদ করেছি। আমার প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কথাকথিত কবি রইসউদ্দিনের স্বাধীনতা পদক পত্যাহার করে নেওয়া হয়। একটি অজানা গ্রন্থ লেখার জন্য নিউ ইয়র্কের মাহফুজুর রহমান অথবা মন্ট্রিয়লের তাজুল মোহাম্মদদের বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিয়েছে। তার প্রতিবাদ করায় সাবেক ডিজি শামসুজ্জামান খান সবসময় আমার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। আবার মুক্তিযুদ্ধের সরকারের সময় চরম বঙ্গবন্ধুবিরোধী নিয়াজ জামানকে আনিসুজ্জামান-শামসুজ্জামানেরা বাংলা একাডেমি পুরস্কার দিয়েছেন। অথচ এই নিয়াজ জামান বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে, ফেরাওন বলে পঁচাত্তরের পর দেশে-বিদেশে কলাম লিখেছেন। আমার ‘বঙ্গবন্ধু সমগ্র’ বইয়ে তার তথ্য-প্রমাণসহ আছে। এসব ঘটনার কি শেষ আছে?
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল থেকে শুরু করে শহীদুল জহীর, কায়েস আহমেদ, আবু কায়সার, আবিদ আজাদ, খন্দকার আশরাফ হোসেনের মতো শক্তিশালী লেখকদের বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
আবার নজরুলকে কলকাতা থেকে ঢাকায় জাতীয় কবির খেতাব দেওয়া হয়, কিন্তু তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, আহমদ ছফা বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। শামসুজ্জামান খান ব্যক্তিস্বার্থে বাংলা একাডেমিকে ব্যবহার করে তথাকথিত ‘প্রবাসী সাহিত্য পুরস্কার’ দেওয়া প্রবর্তন করে গেছেন। এই দুই নম্বরী বিতর্কিত প্রবাসী পুরস্কার আমাকে ২/৩ বার দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছে। এ বছরও একাডেমির ডিজি হাবীবুল্লাহ সিরাজীও সেই একই কর্মটি করেছিলেন। আমি তা প্রত্যাখ্যান করেছি।
ঘটনাটি খুলেই বলছি।
গত বছর ১৫ ডিসেম্বর ভোর রাতে সিরাজী ভাইয়ের ফোনকল। খুব আবেগ আর আন্তরিকতায় নাটকীয় কণ্ঠে বললেন, ‘দুলাল, কেমন আছেন ভাইটি আমার! একটি সুখবর আছে! এখনি দেবো? নাকি আপনি ঘুম থাকে উঠুন। আস্তে ধীরে আনন্দের সংবাদটি জানাই।’
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আমি বললাম, না না। এখনি বলেন। সিরাজী ভাই অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সাথে বললেন, কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপনাকে আর হাসান ফেরদৌসকে এবার সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হবে। তাই আপনার সম্মতি দরকার! আমি কিংর্তব্যবিমূঢ! বললাম, ‘সিরাজী ভাই, প্রথমত: দুই দুই বার জামান খানের গরম ভাত প্রত্যাখ্যান করেছি। আর আপনি সেই একই বাসি-পচা-পান্তা আবারও সাদছেন! আমার সম্পর্কে আপনার এই ধারণা!
তখন তিনি বললেন, দুলাল, দুলাল ভাইটি আমার রাগ করবেন না। এটা এখন প্রবাসী পুরস্কার নয়। এটা একাডেমির একমাত্র আন্তর্জাতিক পুরস্কার। উইলিয়াম রাদিচেকেও ওয়ালিউল্লাহ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে!
-সিরাজী ভাই, দাদাকে আদা চেনাচ্ছেন? ছিঃ!
-দুলাল, দুলাল, আপনি রাগ করতাছেন! আপনি না নিলে একটা চিঠি দিয়ে জানান।
-আপনি চিঠি দিন।আমি জবাবে প্রত্যাখ্যান করবো। যদিও মৌখিকভাবে প্রত্যাখ্যান জানিয়ে দিলাম।
তারপর তিনি একাডেমির তরফ থেকে আর কোনো চিঠি দেননি। আমিই তাকে কড়া চিঠি দিয়েছিলাম।
পরে অত্যন্ত বিশ্বস্তসূত্রে একজন কবি এবং আরেক জন কাউন্সিলারের কাছ থেকে জেনেছি যে, সিরাজী ভাই প্রবাসীদের জন্য এই সান্ত্বনা পুরস্কার কাউন্সিলের মাধ্যমে বাতিলের প্রস্তাব তোলেন। তিনি মিটিং-এ বলেন, কাউকে ঘুম থেকে জাগিয়ে এই পুরস্কার দিতে পারি না আবার কারও কারও ফোনের অত্যাচারে ঘুমতে পারি না। বন্ধ করে দেন এই পুরস্কার। এটা একাডেমির জন্য বিব্রতকর!
যাই হোক। সচিব-আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা, ক্ষমতাবান, বিত্তবানেরা কিভাবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার নেন; জাতীয় স্বার্থে এসব দুর্নীতি দুদকের মাধ্যমে তদন্ত হওয়া একান্ত জরুরি।
চিন্তাসূত্র: এবার ৬৩তম জন্মদিনে পা দিচ্ছেন। কেমন লাগছে জীবনের এই দীর্ঘ জার্নি?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: এই প্রশ্নে একটা মৃত্যুচিন্তা আছে। আমি মৃত্য নিয়ে চিন্তিত না। মৃত্যু নিয়ে আমার কবিতাগুলোতে অন্যভাবে দেখেছি। মৃত্যুর চেয়ে এক কাপ চা অনেক বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ। অথবা আত্মহত্যা করতে গিয়ে ফিরে আসা। কারণ, একটি বই পড়া শেষ হয়নি, বারান্দার গাছটাকে একটু জল দিয়ে হবে কিংবা অ্যাকুরিয়ামের মাছের খাবার দেওয়া হয়নি ভেবে।
যাই হোক। এখন মনে হচ্ছে জীবনের শেষ প্রান্তে। মিষ্টি মধুর চকচকে সকাল, রোদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে দুপুর, বৃষ্টিভেজা অপরাহ্ন পেরিয়ে একটি চমৎকার বিকেলের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি আর কামিনীফুলের ঘ্রাণে ঘোর লাগা সুন্দর একটি সন্ধ্যার অপেক্ষা করছি।
চিন্তাসূত্র: আপনার লেখালেখির বয়স বেশ দীর্ঘ। লিখেছেন প্রচুর। এবারের জন্মদিনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজকে কিভাবে দেখছেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আমি তো অনেকটা ভাগ্যবান। ‘ঘুম থেকে জেগেই দেখি/ আমি এখনো বেঁচে আছি’। অথচ সমবয়সী কবি বন্ধু রুদ্র, নাসিমা, ত্রিদিব, আজিজ এরা তো অনেক আগেই চলে গেছেন। জন্মদিনে অনেক ভালোলাগা থাকে। যেমন চিন্তাসূত্র আমার কাছে থেকে কত্ত কথা আদায় করে নিলো। কত্ত কথা মন খুলে বলার সুযোগ দিলো। এগুলো ভালো লাগার অংশ!
চিন্তাসূত্র: আপনার অনুজদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কবি-প্রাবন্ধিক-কথাসাহিত্যিক বলে মনে করেন? তাদের নাম উল্লেখ করে তাদের কাজের মূল্যায়ন করবেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: আমি প্রবীণদের চেয়ে সব সময় তরুণদের লেখা বেশি পড়ি এবং আগ্রহী। আমি কারও কারও লেখা পড়ে ঈর্ষাবোধ করি। হিংসা করি তাদের তারুণ্যকে। আমি তো আর দেই বয়স ফিরে পাবো না। আমি আমার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক তরুণদের প্রথম বই বের করেছি। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, ফারহান ইশরাক, জুনান নাশিত, সুমন তুহরান, বাশিরা ইসলাম শান্তি এবং আরও অনেকের নাম।
এখনো যাদের কবিতা ভালো লাগে, আমি তাদের নিয়ে এফবিতে লিখি। অথচ তাদের অনেকের সাথে কোনোদিন দেখাও হয়নি। যেমন কচি রেজা, অং মারমা, মাহী ফ্লোরা প্রমুখ।
চিন্তাসূত্র: একসময় গান লিখতেন কবিরা। আপনিও একসময় বেশকিছু গান লিখেছেন। সেসব বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে। সম্প্রতি কবিদের গান লিখতে তেমন দেখা যাচ্ছে না। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছেন গণমাধ্যমের বিনোদন পাতার রিপোর্টার ও সাবএডিটররা। আর এসব গানও রচিয়তা, সংগীতশিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী ও সুরকার ছাড়া আর কাউকে শুনতে দেখা যায় না। বাংলা গানের এই পরিণতি কেন?
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: গান লিখতাম শখ করে। ১৯৮২ সালে ২৫টি গান জমা দিনে বোর্ড কর্তৃক পাশের পর রেডিও-টিভি থেকে ‘ORC’ নিয়েছি। সেই চিঠিয়ে লেখা সিল দিয়ে লেখা, ‘অনুগ্রহ করে পাকিস্তানের স্থলে বাংলাদেশ পড়িবেন’। এবং একটি গানের জন্য আমাদের গীতিকারে্র সন্মানী ছিল মাত্র এক টাকা।
গানের জগৎটা ভিন্ন। গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর যৌথ ব্যাপার থাকে। আসলেই ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, সেই সময় গান লিখতাম। কী ভাগ্যবান! গানে সুর দিতেন আব্দুল আহাদ, খোন্দকার নূরুল আলম, অজিত রায়, আবেদ হোসেন খান, রাজা হোসেন খান, অনুপ ভ্যাট্টাচার্য, প্রণব দাস, সমর দাস, শেখ মুহিতুল হক, কুটি মনসুর, সুজয় শ্যাম, শেখ সাদী খান। আর গাইতেন ফিরোজা বেগম, নিলুফার ইয়াসমিন, আঞ্জুমান আরা, লায়লা আঞ্জুমান্দ বানু, রুনা লায়না, শাম্মী আক্তার, শাকিলা জাফর, ফেরদৌস আরা, রফিকুল আলম, মিতালী মুখার্জি, আবিদা সুলতানা, এন্ড্রো কিশোরসহ অনেকেই।
তাদের গানগুলো সংরক্ষণে নেই। খুব আপসোস হয়। এখন প্রবাসে বসে নিজের দেশাত্ববোধক গানের কথা খুব মন খারাপ করে দেয়। যেমন, ‘ও ও বাংলাদেশ বাংলাদেশ তোমার তুলনা তো শুধু তুমিই’, ‘এ দেশ আমার মায়ের আরেক নাম’, ‘ঐ পতাকায় তাকিয়ে দেখি আমার মায়ের শ্যামলা মুখ’। শাকিলা-শুভ্রের গাওয়া গানটা ছিল বিটিভির খবরের আগে ও পরে থিম মিউজিক। যে গানটি প্রতি বিজয় দিবসের প্যারেডে ঢাকা স্টেডিয়ামে জিপে চড়ে শিল্পীদ্বয় গাইলেন আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিবাদন গ্রহণ করলেন।
হ্যাঁ। এক সময়ের সিনেমার প্রায় সব জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ছিলেন সৈয়দ হক। এছাড়া, শামসুর রাহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ফজল শাহাবুদ্দিন, কে জি মোস্তফা, জাহিদুল হক, কাজী রোজী, নাসির আহমেদ, আবিদ আনোয়ারেরা চমৎকার গান লিখতেন। এখনো কেউ কেউ লিখছেন। যেমন, তপন বাগচী, সুমন সরদার, হাসান মাহমুদ প্রমুখ। আর শেষ প্রশ্নের শেষাংশের জবাব দিচ্ছি একবাক্যে। এ সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের আরেক নমুনা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিখ্যাত হওয়ার প্রবণতা!