[বীরেন মুখার্জী (জন্ম: ১৯৬৯) মূলত কবি। তবে, শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য সৃজনশীল-মননশীল শাখায়ও তার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। তরুণ নির্মাতা হিসেবে আলোচনায় আসেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঘোর’ নির্মাণের মাধ্যমে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও লোকঐতিহ্যের গবেষক। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা: কবিতা ৯। এরমধ্যে গল্পের ১টি, প্রবন্ধের ৩টি, সম্পাদনা প্রবন্ধগ্রন্থ ২টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই ১টি। ১৯৯৪ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন ছোটকাগজ ‘দৃষ্টি’। সম্প্রতি কবিতায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯’। বীরেন মুখার্জী একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত।]
চিন্তাসূত্র: আপনার লেখালেখির শুরুর কথা বলুন।
বীরেন মুখার্জী: শৈশবে হাতেখড়ি, আমার এলাকার একজন কবির কবিতা অনুসরণে। এরপর তো নিজের মতো চলা। এখনো চলছি।
চিন্তাসূত্র: কী ধরনের রচনাকে আপনি কবিতা বলে স্বীকার করেন? কী কী গুণ থাকলে একটি রচনাকে আপনি কবিতা বলবেন?
বীরেন মুখার্জী: কবিতার নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড আছে? নানা জনে তো নানা কথা বলেছেন। এরপরও বলব, শিল্পের যাবতীয় শর্ত ও দাবি পূরণ করতে সক্ষম হলেই তা আমার কাছে কবিতা। যেকোনো কবিতা যদি ১. জীবনের প্রতি, ২. শিল্পের প্রতি, ৩. উপলব্ধি বা অভিজ্ঞতার জগতে কোনো নতুনত্ব বা পুনরাবিষ্কার যুক্ত করতে সক্ষম হয়, তাহলে সেটি কবিতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
চিন্তাসূত্র: অনেকেই গদ্যছন্দের কবিতার নামে মূলত আবেগঘন গদ্য লিখে তাকে কবিতা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ ছন্দকে অস্বীকারও করছেন। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
বীরেন মুখার্জী: কবিতাবোদ্ধারা ‘কবিতায় আবেগের সংযত প্রয়োগ’-এর কথা বলেন; সুতরাং আবেগের কচকচানিকে কিভাবে কবিতা বলব? এমন রচনা আমার কাছে ‘অক্ষমের হাহাকার’ ছাড়া আর কিছু নয়। কবিতা গদ্যাকারে লিখিত হলেও অন্তঃস্থলে ছন্দের স্পন্দন থাকা জরুরি। প্রথা ভেঙে যেকোনো শিল্পকে নতুন রূপে গড়া দোষের নয়; এক্ষেত্রে মনে রাখা জরুরি পৃথিবীর সব কিছু নির্দিষ্ট ছন্দ মেনেই চলে; সুতরাং কবিতায়ও নিরূপিত ছন্দ থাকতে হবে। আর ছন্দকে যারা অস্বীকার করেন, তারা মূলত মূর্খ, অক্ষম, গৌণকবি।
চিন্তাসূত্র: এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বলেছেন, ‘ছন্দহীন রচনা কবিতা নয়’, আবার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য’। এই প্রসঙ্গে আপনি কী বলবেন?
বীরেন মুখার্জী: যারা জীবন অতিবাহিত করেছেন কবিতার ধ্যানে, তাদের অভিজ্ঞতা অস্বীকার করছি না। দু’জনই নমস্য কবি। তবে ‘কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য’-বিষয়টির প্রতি আমার দ্বিমত আছে। ‘ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য’ কিভাবে কবিপ্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞান হবে? তাহলে তো, জীবনানন্দের কথা মিথ্যে হয়ে যাবে। কবিতার গঠন, প্রকরণ, ছন্দ-ইত্যাদি নিয়ে এ যাবত কম কথা বলা হয়নি। যতদিন কবিতা চর্চা থাকবে ততদিন এমন আলোচনা-সমালোচনাও অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে আমার অবস্থান আগেই স্পষ্ট করেছি।
চিন্তাসূত্র: আপনি কবিতায় কী বলতে চান? আপনি কি মনে করেন, এখন কবিতা দিয়ে রাষ্ট্র-সমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব?
বীরেন মুখার্জী: বাংলা সাহিত্যে বিপুল সংখ্যক কবিতা থাকা সত্ত্বেও আমি কবিতা রচনা করছি, আমার যাপনের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরতে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আমার সমকালীন সময়টাকে আমি লিখছি। অভিজ্ঞতার সঙ্গে ধারণা মিশিয়ে অতীতের সঙ্গে সমকালীনতার রসায়নে ব্যক্তিগত বোধটুকুই বিনির্মাণ করছি। আমি মনে করি, রাষ্ট্র একটি ধারণা ছাড়া আর কিছু নয়। কবির কথা রাষ্ট্র শুনলে শুভময় পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়-এমনটি মনে করি না।
চিন্তাসূত্র: আপনার সমকালীন কবিদের মধ্যে কাকে কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন? তাদের মধ্যে কার কার স্বতন্ত্র কাব্যভাষা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন?
বীরেন মুখার্জী: এ প্রশ্নের উত্তর নির্দ্বিধায় এড়িয়ে যাওয়া যায়। আমি সেটা করব না, আমি বলতে চাই। স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণ খুব সহজ নয়-এটা মনে রেখেই বলি; সমকালীন অনেকে কবি নিজেকে স্বতন্ত্র দাবি করেন। আমি বলব, তারা ‘স্বতন্ত্র’ শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা দেন। এদের কথা বিবেচনায় নিলে প্রত্যেকের স্বরই পৃথক। ব্যক্তিভেদে চিন্তা যেমন পৃথক, তেমনইভাবে বয়ানকৌশলও পৃথক। যা হোক, এ ক্ষেত্রে ছন্দ কুশলতায় তপন বাগচী, আর স্বতন্ত্র কাব্যভাষা নির্মাণে রহমান হেনরীকে এগিয়ে রাখতে চাই।
চিন্তাসূত্র: কবির রাজনৈতিকভাবে সচেতনতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
বীরেন মুখার্জী: কবি একাধারে স্রষ্টা ও দ্রষ্টা; ফলে কবিকে সববিষয়ে সচেতন থাকতে হয়।
চিন্তাসূত্র: আপনি তো গল্পও লিখছেন? গল্পের একরৈখিকতা না বহুরৈখিকতার পক্ষে?
বীরেন মুখার্জী: গল্প নানামাত্রিক হতে পারে। গল্পের ভেতর গল্প না থাকলে সেরূপ রচনাকে সাংবাদিক প্রতিবেদন মনে হয়। এ পর্যবেক্ষণ আমার ব্যক্তিগত। আমি সব সময় বহুরৈখিক গল্পের পক্ষে; তবে একরৈখিক গল্পকেও খাটো করছি না।
চিন্তাসূত্র: গল্পের শরীর গঠনে আপনি কিভাবে ভূমিকা রাখেন? অর্থাৎ গল্পের শরীর কি আপনি পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলেন, নাকি লিখতে লিখতে দাঁড়িয়ে যায়, আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকে না?
বীরেন মুখার্জী: একজন লেখক জানেন, তিনি কিভাবে গল্পটি লিখবেন। গল্পের নির্দিষ্ট একটি স্টোরিলাইন লেখক আগেই পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী তিনি চলেন। এটা ঠিক যে, অনেক সময় চরিত্রকে যথেষ্ট স্পেস দিতে গিয়ে তাকে তার মতো চলতে দিতে হয়; কিন্তু নাটাই তো লেখকের হাতে। ফলে একটি গল্প লেখকের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনারই অংশ হয়ে ওঠে।
চিন্তাসূত্র: আপনি সমালোচনামূলক প্রবন্ধসহ বিভিন্ন ধরনের প্রবন্ধ লেখেন। প্রকাশিত হয়েছে আপনার বেশ কটি প্রবন্ধের বইও। কবিতা-গল্প লেখার পাশাপাশি প্রবন্ধের মতো কঠিন শাখায় এলেন কেন?
বীরেন মুখার্জী: আমার সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলো একান্তই পাঠউপলব্ধিজাত। সাহিত্য পাঠের মধ্যদিয়ে সঞ্চিত অনুভূতিগুলো আলোচিত সাহিত্যকর্মের রসায়নে প্রকাশ করা। এগুলো কতটা সমালোচনামূলক প্রবন্ধ তা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কবিতা সম্পর্কে নিজের বোধের জায়গাটি স্পষ্ট করার জন্য হলেও তো কিছু গদ্য লেখা প্রয়োজন। আমি সেটাই করেছি। প্রবন্ধের তুলনায় সাহিত্যের অন্যশাখায় কাজ করা সহজ, আমি মোটেও তা মনে করি না।
চিন্তাসূত্র: এসময়ের সমালোচনা সাহিত্য সম্পর্কে আপনি কী বলবেন?
বীরেন মুখার্জী: সম্প্রতি ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস দিয়েছি আমি। বিষয়টি এমন যে, ‘বইয়ের ব্লার্ভ পাঠ করে যারা সাহিত্য সমালোচনা লিখেন তাদের আমি সমীহ করি। কেননা, এরা যে কোনো সময় যে কোনো কবি-সাহিত্যিককে খারিজ করার যোগ্যতা রাখেন।’ আমি মনে করি, সাহিত্যের সমালোচনা যেমন সহজ কাজ নয়, তেমনি যথাযথ সমালোচনা সহ্য করাও শক্তিও সবার থাকে না। দু’কলম লিখেই যখন কেউ স্তূতি আশা করছেন, তখন প্রকৃত সমালোচনা আপনি কোথায় পাবেন। কেউ কেউ তো অর্থ কিংবা ক্ষমতা দিয়ে এরূপ স্তূতিবাক্য লিখিয়েও নিচ্ছে। আপনিও জানেন। এটি প্রকাশ্য গোপন বিষয়। অন্যদিকে সমালোচনা করতে হলে, সমালোচকের যে পঠন-পাঠন, যুক্তির প্রাখর্য, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ইত্যাদি গুণাবলি প্রয়োজন তা ক’জন সমালোচকের আছে? বিষয়টি এমন দাঁড়িয়ে যে, একটি প্রবন্ধ থেকে কবির নাম আর উদ্ধৃতি পাল্টে দিলে আরেক কবিকে নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়ে যায়। আবার কবি-সাহিত্যিকের মৃত্যুর জন্যও অপেক্ষা করি কেউ কেউ। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই দৈনিকের পাতার চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই দিতে পারলেই আমি বড় আলোচক বনে যেতে পারি। সেলুকাস! কবি জীবনানন্দ দাশ এদের নিয়েই ‘সমারূঢ়’ কবিতাটি লিখেছিলেন। বাস্তবতা হলো, সমালোচনা সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা। যদি যথাযথভাবে, প্রক্রিয়া মেনে এটি করা হয়; যেখানে অযথা পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের সুযোগ থাকবে না। কিন্তু এই অস্থির-মূর্খ সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে সকলেই লেখক হওয়ার অঘোষিত প্রতিযোগিতায় মেতেছেন; কোথায় পাবেন আপনি সেই মনীষা? তবে কিছু নির্মোহ কাজও চোখে পড়ে, যা ভরা কলসের মধ্যে এক বিন্দু শিশিরের মতো।
চিন্তাসূত্র: গত ত্রিশ বছর ধরে যারা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখছেন, তাদের মধ্যে কাকে কাকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ হয়?
বীরেন মুখার্জী: এ প্রশ্নের উত্তর আংশিক দিচ্ছি। কবিতা ও গল্পের বাইরে প্রবন্ধ নিয়ে আমার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। আমি মূলত প্রশ্নশীল গদ্যকে প্রবন্ধ মনে করি। অযথা তত্ত্ব কপচানো, পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হয়তো কাজে লাগতে পারে, কিন্তু আমার মতো মূর্খ পাঠককে প্রশ্নশীল-বিশ্লেষণসমৃদ্ধ প্রবন্ধই বেশি টানে। এক্ষেত্রে আমি মোহাম্মদ নূরুল হক-কে এগিয়ে রাখবো। তার প্রবন্ধ পাঠ করছি এক যুগ ধরে। এ ধরনের প্রবন্ধ একশ’ বছর পরও প্রকৃত পাঠককে টানবে।
চিন্তাসূত্র: আপনি হঠাৎ করে শর্টফিল্ম বানাতে এলেন কেন?
বীরেন মুখার্জী: হঠাৎ আসিনি। আসলে, আমি কয়েক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে শর্টফিল্ম নির্মাণে এসেছি। এ সংক্রান্ত পড়াশোনা করেছি, গুণীদের কাজ প্রত্যক্ষ করেছি; এমনকি হাতে কলমেও শিক্ষা নিয়েছি। সুতরাং হঠাৎ করে বলা যাবে না।
চিন্তাসূত্র: কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-ফিল্ম, শিল্পের এসব শাখার মধ্যে আপনি কোন শাখায় কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
বীরেন মুখার্জী: বস্তুত কবিতার মানুষ আমি। আমার ধ্যান-জ্ঞান-জাগরণে কবিতা মিশে আছে। কবিতা ভালোবেসেই সাহিত্য-শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সৃজনশীল প্রতিটি শাখা বৈশিষ্ট্যগতভাবে পৃথক; আর সেভাবেই বিষয়টি উপস্থাপনের চেষ্টা করি। তবে সাহিত্য বা শিল্পের যে শাখায় আমি কাজ করি না কেন, সব কবিতাময়। সেই ইশারা, সেই আড়াল, সবকিছুই।
চিন্তাসূত্র: সম্প্রতি কবিদের পরিচয় দেওয়ার সময় বলা হয়, অমুক দশকের কবি, তমুক দশকের কবি। সাহিত্যের এই দশক বিভাজনকে আপনি কিভাবে দেখেন?
বীরেন মুখার্জী: আমি দশক বিভাজনের পক্ষে, কবি বুদ্ধদেব বসুর মতানুসারে কবির উত্থানপর্ব বিবেচনায়। কিন্তু যারা দশক দশক করে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, বিশেষ স্বার্থ হাসিল কিংবা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন আমি এর বিপক্ষে। কবি কেন দশকের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ হবেন! কবি কী দশকে দশকে জন্ম নেন! প্রকৃত কবির বিস্তার তো মহাকালে। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার যথার্থই বলেন-‘দশক হচ্ছে গৌণ কবিদের আশ্রয়স্থল।’
চিন্তাসূত্র: দশক বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যে চলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-গোষ্ঠীপ্রীতিও। এই প্রবণতা সাহিত্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর বলে মনে করেন?
বীরেন মুখার্জী: দশক বিভাজনের চেয়েও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-গোষ্ঠীপ্রীতি ভয়াবহ। গোষ্ঠীপ্রীতির কারণে গৌণ কবি-সাহিত্যিক ব্যাপক আলোচিত হতে পারেন; অন্যদিকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে ভালো মানের সাহিত্যকর্ম রচনা করেও সেই লেখক থাকতে পারেন অনালোচিত, অন্ধকারে। পাশাপাশি এ কথাও স্বীকার করতে হবে, যুগে যুগে গোষ্ঠী তৈরি করে সাহিত্য চর্চার নজির আছে। বিভিন্ন আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব-গোষ্ঠীপ্রীতি মানে সাংঘর্ষিক-সন্ত্রাসী ব্যাপার-স্যাপার। এ প্রবণতা সাধারণ মানুষের মনে সাহিত্যিক শ্রেণী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে। গৌণ সাহিত্যকর্মকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রচার চালালে তা সাহিত্যের জন্য নিঃসন্দেহে ক্ষতির। একটি উদাহরণ দিতে চাই। যাদের প্রতিবছর সার্ক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে দেখেন, দেশের সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে দেখেন, তাদের বেশিরভাগের সাহিত্যকর্ম সাহিত্য পদবাচ্যে গৃহীত হয় কি? বলতে চাই, তাদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্মই যেখানে মানের প্রশ্নে সংশয়মুক্ত নয়, সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মাধ্যমে কী বার্তা পৌঁচ্ছে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে? গোষ্ঠীপ্রীতির কারণেই এই শ্রেণির কবি-সাহিত্যিক সেখানে যোগ দিচ্ছে। এর জন্য প্রকৃত সাহিত্যকর্মীরাও কম দায়ী নয়। তাদের নির্লিপ্তি এ ধরনের ঘটনাকে বেগবান করছে। এটাও সাহিত্যের জন্য ক্ষতি বৈ অন্য কিছু নয়।
চিন্তাসূত্র: বর্তমানে বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে বড়কে ছোট, আর ছোটকে বড় করে দেখানোর রাজনীতি প্রকট। এই রাজনীতির অংশ হিসেবে চলে পুরস্কার দেওয়া-নেওয়ারও খেলা। সরকারি বেসরকারি অনেক পুরস্কারের বিরুদ্ধে এই রাজনীতির অভিযোগ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
বীরেন মুখার্জী: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। আমি যদিও কর্মে বিশ্বাসী, তারপরও পুরস্কার-প্রাপ্তি’র প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করবো না। কেননা, এর সঙ্গে অর্থমূল্য এবং সম্মান জড়িত। তাছাড়া কোনো লেখক পুরস্কৃত হলে তিনি একটি স্তর অতিক্রম করলেন বলেও মনে করা যায়। এর অর্থ দাঁড়ায়, পাঠক সহজেই ওই লেখককে শনাক্ত করে তার লেখাপত্র সংগ্রহ করার সুযোগ পান। ‘আর ছোটকে বড় করে দেখানোর রাজনীতি প্রকট’ বলে যে প্রসঙ্গটি আপনি উল্লেখ করেছেন, এটা বিশ্বায়নের একটি কৌশল হতে পারে। কোনো জাতি দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়লে, এর নেতিবাচক প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই সব ক্ষেত্রে পড়বে। কেননা, অস্বস্তি উৎপাদনও এক ধরনের প্রচার। তবে কোনো ‘অযোগ্য ব্যক্তি’ পুরস্কৃত হয় বলে আমার জানা নেই। কেননা, পুরস্কারের ভিত্তিগুলোর মধ্যে ‘যোগ্যতা’ও একটি। এটা বলা যায়, পুরস্কৃত ব্যক্তির তুলনায় তার সময়কালে অন্য কেউ যোগ্য ছিলেন, তাকে কেন পুরস্কারটি দেওয়া হলো না! আমি মনে করি, এসব কারণে ‘তদবির’, ‘যোগাযোগ’ শব্দগুলো অভিধানে ঠাঁই পেয়েছে। আবার এর সঙ্গে ‘রাজনৈতিক দর্শন’ও সংশ্লিষ্ট। আপনি তো জানেন, ‘তেল মাথায় তেল দেওয়া’ প্রবাদটির কথা। অভিজ্ঞতার আলোকেই এগুলো লিখিত হয়েছে। মূলত সাহিত্যিক যোগ্যতা নিরূপণের মাপকাঠি হতে পারে লেখকের টোটালিটি। লেখকের দর্শন বা চেতনার জায়গাটিও এক্ষেত্রে বিবেচ্য। সুতরাং এ নিয়ে আমার আক্ষেপের কিছু নেই।
চিন্তাসূত্র: সাহিত্যপুরস্কার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? আপনি নিজেও সম্প্রতি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। আপনি কি মনে করেন সাহিত্যপুরস্কার লেখকের কাজের মূল্যায়নের যথার্থ মাধ্যম?
বীরেন মুখার্জী: এ বিষয়ে ইতি ও নেতি দু’ধরনের পর্যবেক্ষণ আছে। সাহিত্যপুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে বই জমা দেওয়া কিংবা আবেদন করার যে প্রচলন আমাদের দেশে দেখা যায়, তা একজন লেখকের জন্য রীতিমতো অপমানজনক। যারা পুরস্কার দেন এবং গ্রহণ করেন, তারা কতটুকু লাভবান হন, জানি না। আমি এদের উভয়পক্ষকে সন্দেহ করি। কেননা, মৌসুমি পদকবাণিজ্য কিংবা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার চেয়ে নেওয়ার মতো হাস্যকর ঘটনাও তো আমাদের সমাজে সর্বজনবিদিত। আমার সাহিত্যপুরস্কারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যারা আমাকে পুরস্কার দিয়েছেন, এদের মধ্যে দু’একজনকে আমি যৎসামান্য চিনি। এর আগে অনেকেই আমাকে পুরস্কার দিতে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, আমি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছি। তাদের বলেছি, পুরস্কার গ্রহণ করার যোগ্যতা আমার নেই, আমি অত্যন্ত ছোট কবি। গুণী কবিদের মধ্যে একটু ঠাঁই হলেই আমি ধন্য।
চিন্তাসূত্র: আপনি তো লিটলম্যাগ সম্পাদনাও করেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে লিটলম্যাগ, দৈনিকের সাহিত্য পাতা, সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ, সব মাধ্যমই ব্যবহার করছেন। এরমধ্যে কোন মাধ্যমকে আপনার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
বীরেন মুখার্জী: মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি নিজেকে প্রকাশ করা, আর এসব-ই যেহেতু প্রকাশ মাধ্যম, সুতরাং কোনো মাধ্যমকেই গৌণ করে দেখতে চাই না। স্বীকার করি, টেকনিক্যাল কিছু বিষয় এসব মাধ্যমে ওতপ্রোত। আপনি কী লিখছেন, তা কোথায় প্রকাশ করবেন, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যে লেখা আপনি ‘লিটলম্যাগ’-এ লিখবেন, তা সঙ্গত কারণেই ‘দৈনিকের সাহিত্য পাতা’ প্রকাশ করবে না। লিটলম্যাগে যথেষ্ট স্পেস পাচ্ছেন আপনি, নতুন চিন্তার বিশ্লেষণ সমৃদ্ধ লেখা প্রকাশ করতে পারছেন। আপনিও বোধ করি চাইবেন না এমন একটি লেখা দৈনিকে প্রকাশিত হোক। কেননা, দৈনিকে স্পেসের সীমাবদ্ধতা, বাণিজ্য, সংশ্লিষ্ট সম্পাদককে মান্যতা দেওয়া-ইত্যাদি বিষয় জড়িত। আপনি সেটা চাইবেন এমনও কথা নেই। অন্যদিকে ‘ওয়েবম্যাগ’-এ প্রকাশিত কোনো লেখা আপনি তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন না, এমনকি সংরক্ষণও করতে পারছেন না। কিন্তু বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে দৈনিকের সাহিত্যপাতা কিংবা লিটলম্যাগের তুলনায় আন্তর্জালে প্রকাশিত লেখা পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে, এমনটি উচ্চারিত।
চিন্তাসূত্র: সাহিত্যে চৌর্যবৃত্তি প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
বীরেন মুখার্জী: ‘সাহিত্যে চৌর্যবৃত্তি’ অত্যন্ত পরিতাপের এবং ঘৃণ্য একটি বিষয়। চিন্তার সারবত্তা নেই অথচ লেখক হওয়ার তীব্র বাসনা আছে মনে, কিংবা অর্থ আছে বলে লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে-এমন অসুস্থ চিন্তা-প্রবণতার কারণে চৌর্যবৃত্তি করছেন অনেকে। সাহিত্যে ‘ঋণগ্রহণ’ প্রবণতাকে স্বীকার করেছেন প্রখ্যাত লেখকরা। সুতরাং, যথাযথ সূত্র উল্লেখ করে বিশেষ অংশটুকু সংযোজন করা তো দোষের নয়। গবেষণাকর্মে এর প্রাচুর্য বেশি, প্রয়োজনও। কিন্তু মৌলিক লেখার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত জঘন্য। ‘বিপ্লব শাহনেওয়াজ’ নামের প্রবাসী এক গল্পকার ভারতের একজন গল্পকারের গল্প হুবহু নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। গল্পটি প্রকাশের ৫ বছর পর সম্প্রতি একজন লেখক বিষয়টি তুলে ধরেছেন। পরিতাপের যে, গল্পটি আমার সম্পাদনায় ‘দৃষ্টি’তে প্রকাশিত। স্বীকার করতে অসুবিধা নেই, এটি আমার জন্য বিব্রতকর। কৈফিয়ত হলো, পৃথিবীর হাজার হাজার গল্প আমার পাঠ্ করা নেই। ফলে কোন লেখক কার লেখা চুরি করছেন তা শনাক্ত করাও সম্ভব নয়। এরূপ ঘটনা লেখকের স্বচ্ছতা, সৃজনশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনুসন্ধানে জেনেছি, তথাকথিত ওই লেখকের ‘লেখালেখিতে ভাবনার চুরি’ নামে একটি প্রবন্ধ দেশের বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক প্রকাশিত হয়। নিজের ঘৃণ্য কাজকে বৈধতা দিতে গিয়ে তিনি এই প্রবন্ধের অবতারণা করেছেন, এমন ভাবনাও অমূলক নয়।
আমি অল্প-বিস্তর প্রবন্ধ লিখি। লক্ষ করেছি, এসব প্রকাশিত প্রবন্ধের হুবহু ‘প্যারা’ অন্য লেখকের প্রবন্ধে সংযুক্ত, অথচ সেখানে কোনো সূত্রের উল্লেখ নেই, নেই কোনো কোটেশন। কবিতার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটছে। কী আশ্চর্য! আমি মনে করি, এসব যারা করেন তারা অদীক্ষিত, সাহিত্যের পঠন-পাঠনও এদের নেই। বিষয়টি সামগ্রিকভাবে মনন-পচনের ইঙ্গিত বহন করে। সবারই লেখক হতে হবে এমন কথা আছে নাকি! এ প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, কবি-সাহিত্যিক হওয়ার সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নেই। কপিরাইট অ্যাক্টে এদের নামে ক্ষতিপূরণ মামলার বিধান আমাদের দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। থাকলে, সেটা করা যেতে পারে; ফৌজদারি মামলাও করা উচিত। বিশ্ব-সাহিত্যে মামলা, জরিমানা আদায় ও মুচলেকা প্রদানের অনেক দৃষ্টান্ত আছে।