[বীরেন মুখার্জী।জন্মেছেন ১৯৬৯ সালের ৪ মার্চ। মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার দরিশলই গ্রামে। মূলত কবি ও প্রাবন্ধিক। তবে, লিখেছেন ছোটগল্প ও কলামও। পেশায় গণমাধ্যমকর্মী। ১৯৯৪ সাল থেকে সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ ‘দৃষ্টি’। মুক্তিযুদ্ধ ও লোকসাহিত্যের সৌখিন গবেষক। ২০১৯ সালে স্বল্পদের্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ঘোর-দ্য ইনটেন্স অব লাইফ’ নির্মাণ করে নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। বর্তমানে ডকুমেন্টারি ও নাটক নির্মাণ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রকাশিত কবিতা গ্রন্থ ১১টি, প্রবন্ধ ৫টি (দুটি সম্পাদনা), ছোটগল্প-গ্রন্থ ১টি ও মুক্তিযুদ্ধ ১টি। কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯)’। কবিতার জন্য এবার পেয়েছেন ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’ (২০২০)। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ সাহিত্যকর্মী পবন সন্ন্যাস।]
পবন সন্ন্যাস: কবিতার জন্য চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেলেন। কেমন লাগছে? সাহিত্য পুরস্কার কি লেখককে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করে?
বীরেন মুখার্জী: ২০১৯ সালে শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলাম কবিতায়। এবার চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমিও কবিতায় পুরস্কার দিয়েছে। কদিন আগে বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পাওয়ার পর অনুজ কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক শিল্পসাহিত্যের ওয়েবম্যাগ ‘সংক্রান্তি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পুরস্কার লেখকের মূল্যায়ন নয়, স্বীকৃতিও নয়। পুরস্কার হলো লেখকের প্রতি রাষ্ট্র-সংঘ-প্রতিষ্ঠানের ভালোবাসা। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা। এরবেশি কিছু নয়।’ এই অনুজের মতো আমিও বলবো, আমার কাছে পুরস্কার হলো লেখকের প্রতি পাঠক-সংঘের ভালোবাসার প্রকাশ। ভালোবাসা কার না ভালো লাগে। আমিও আপ্লুত এই ভালোবাসায়। সংশ্লিষ্টদের প্রতিও ভালোবাসা জানাই। যোগ্য লেখক পুরস্কৃত হলে ভালো লাগে। পাঠকও পুরস্কার পাওয়া লেখকের সৃজনকর্মের দিকে মনোযোগী হয়। অন্যদিকে পুরস্কারদাতারাও স্বচ্ছ থেকে বিতর্ক এড়ানোর সুযোগ পান। অনেকে হয়তো পুরস্কারকে লেখালেখির স্বীকৃতি মনে করেন। আমার তেমন মনে হয় না। পুরস্কার সবসময় লেখককে মূল্যায়ন করে, এমন বলা যায় না।
পবন সন্ন্যাস: আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। লিখতে গিয়ে অনেকের লেখাই পড়েছেন। একটি সার্থক লেখার গুণাবলী কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
বীরেন মুখার্জী: লেখার সুবাদে নয়, অভ্যাসবশতই পড়াশোনা করেছি। পড়তে পড়তে লিখতে এসেছি। ডা. লুৎফর রহমানের উন্নত জীবন, মহৎ জীবন দিয়ে শুরু। এরপর রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, মধুসূদন, নজরুলসহ অনেকের লেখা পড়া হয়েছে। আর সমসাময়িকদের লেখা তো আছেই পাঠের তালিকায়। অন্যদিকে মহাভারত, রামায়ণসহ মিথসমৃদ্ধ গ্রন্থগুলো পৈতৃকসূত্রে পেয়েছি এবং পড়েছি। আমার বাবা ছিলেন তৎকালিন টোলের পণ্ডিত। এলাকার বহু মানুষ আসতেন নানান বিধান নিতে। মাঝে মধ্যে সহযোগিতা করতে হতো বাবাকে। মূলত পারিবারিক আবহেই পাঠের মধ্যে ঢুকে পড়ি। জীবনঘনিষ্ঠতা, শিল্পঘনিষ্ঠতা, উদ্ভাবনঘনিষ্ঠতা, সময়ঘনিষ্ঠতাকে লেখার প্রধান গুণ বলে বিবেচনা করি। অনুকরণসর্বস্ব রচনাকে আমি সাহিত্যকর্ম বলি না। একজন লেখক লেখালেখির ব্যাকরণগত সব শর্ত মেনে চলবেন এবং নিজস্ব কণ্ঠস্বরে কথা বলবেন, তবেই তিনি প্রকৃত লেখক, অন্যথায় নয়।
পবন সন্ন্যাস: আপনি সাহিত্যের অনেক শাখায় কাজ করছেন। তাই সমকালীন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
বীরেন মুখার্জী: অনেক শাখায় নয়, আমি মূলত কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প লিখি। এটা আমার পরিচয়। তবে পেশাগত কারণে অনেক বিষয় নিয়ে লিখতে হয়।
সমকালীন কবিতার কথা বলতে গেলে, অনেকেই ক্রুদ্ধ হতে পারেন। কারণ সমকালের বেশিরভাগ কবির অবস্থাই অত্যন্ত শোচনীয়। বেশিরভাগ কবি নামধারী আসলে সময়ের বুদ্বুদ। আর অধিকাংশ প্রাবন্ধিক হলেন স্তূতিকারক। অনেকেই পড়াশোনা নেই, অথচ খ্যাতির কাঙাল। মিডিয়ায় চোখ রাখলে তাদের জয়জয়কার দেখতে পাবেন। মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে প্রকৃত কবি ও প্রাবন্ধিক প্রায় আড়ালেই চলে গেছেন। এটি অত্যন্ত লজ্জার। তবে, কথাসাহিত্যে বেশ ভালো কাজ হচ্ছে বলে বিবেচনা করি।
পবন সন্ন্যাস: কথাসাহিত্যে বললেন, বেশ ভালো কাজ হচ্ছে। তা কার কার কথাসাহিত্য ভালো হচ্ছে। দুই একটির প্রসঙ্গ যদি বলতেন…
বীরেন মুখার্জী: চাণক্য বাড়ৈ, হামিম কামাল, রুমা মোদক, স্বকৃত নোমান, মোজাফফর হোসেন, ইশরাত তানিয়া, কাজী মহম্মদ আশরাফ, আনিফ রুবেদ, নাহিদা নাহিদ ভালো লিখছেন। এদের গল্প-উপন্যাসের আখ্যান ভিন্নধর্মী। আরও একজন আছেন, নামটা মনে করতে পারছি না। তার একটিমাত্র গল্প পাঠ করেই সম্মোহিত হয়েছি আমি।
পবন সন্ন্যাস: আপনার সমসাময়িক ও অনুজদের মধ্যে কার কার কবিতা আপনাকে আকৃষ্ট করে, কার কার প্রবন্ধ গল্প-পছন্দ করেন। কিংবা কাকে কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
বীরেন মুখার্জী: আমার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে প্রথমেই আসে রহমান হেনরীর নাম। এছাড়া পরিতোষ হালদার, মজনু শাহ, শামীম রেজা, আমিনুল ইসলাম, তপন বাগচী, সমর চক্রবর্তী, শেলী নাজ, কচি রেজা, শাহেদ কায়েস, মোস্তাক আহমদ দীন, আলফ্রেড খোকন, মাসুদার রহমান, হেনরী স্বপনের কবিতা আমার ভালো লাগে।
অনুজদের মধ্যে চাণক্য বাড়ৈ, জাহিদ সোহাগ, সঞ্জীব পুরোহিত, ফারহান ইশরাক, কুমার দীপ, মোহাম্মদ নূরুল হক, মামুন রশীদ, ফেরদৌস মাহমুদ, আপন মাহমুদ, ইমতিয়াজ মাহমুদ, তুষার প্রসূন, জাকির জাফরান, চন্দন চৌধুরী, শামীম হোসেন, তুহিন তৌহিদ, শেখর দেব, সৌম্য সালেক, রফিকুজ্জামান রণি, মুহাম্মদ ফরিদ হাসান প্রমুখের কবিতা ভালো লাগে।
প্রবন্ধে মোহাম্মদ নূরুল হকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। এছাড়া, হামিম কামরুল হক, কাজী মহম্মদ আশরাফ, মামুন রশীদ, কুমার দীপ, রঞ্জনা বিশ্বাস, ফারুক সুমন, মোজাফফর হোসেন, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ভালো লিখছেন।
কথাসাহিত্যে চাণক্য বাড়ৈ, হামিম কামাল, রুমা মোদক, স্বকৃত নোমান, মোজাফফর হোসেন, ইশরাত তানিয়া, কাজী মহম্মদ আশরাফ, আনিফ রুবেদ, নাহিদা নাহিদ ভালো লিখছেন।
পবন সন্ন্যাস: সমকালীন সমালোচনা সাহিত্য অনেকটাই দুর্বল, বেশিরভাগই লেখকের গুণগান আর সম্পর্কের চর্চা বলে মনে হচ্ছে। আপনি এ সম্পর্কে কী বলবেন?
বীরেন মুখার্জী: আপনার পর্যবেক্ষণ আর আমার পর্যবেক্ষণের মধ্যে সাযুজ্য আছে। খুব কাছে থেকে বিষয়টি দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। সাহিত্যের নামে বন্ধুকৃত্য এবং সম্পর্ক চর্চা এখন বেগবান। এটা লেখক-সম্পাদকদের অক্ষমতা বলতে চাই। অক্ষমদের দখলে আছে মিডিয়াগুলো, যে কারণে এই অচলাবস্থা। আরেকটি কথা না বললেই নয়, সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা এবং ধৈর্য এখনকার লেখকদের নেই, এরা রাতারাতি খ্যাতিমান হতে চায়। এটা এক ধরনের স্ট্যান্টবাজি।
পবন সন্ন্যাস: এই স্ট্যান্টবাজদের শনাক্ত করার চিহ্ন সম্পর্কে কিছু বলবেন? এদের প্রতিহত করার উপায় কী?
বীরেন মুখার্জী: স্ট্যান্টবাজদের চিহ্নিত করা সহজ নয়। এরা আপনার সামনে কিছু বলবে না, অন্যের কাছে কুৎসা রটাবে। এদের আসলে প্রতিহত করা সহজ নয়। যেখানে সবকিছুতেই পচন ধরেছে, সেখানে এদের কিভাবে প্রতিহত করবেন? একজন কবিযশপ্রার্থী কথা প্রসঙ্গে আমাকে জোরের সঙ্গেই বললেন, কবিতায় ছন্দ প্রয়োগের বিষয়টি আমি মানি না। আমি তাকে ছন্দ নিয়ে আলোচনার ফাঁদে ফেললাম। বুঝলাম ছন্দ সম্পর্কে তার ন্যূনতম ধারণা নেই। অথচ দৈনিক খুললেই এদের লেখা চোখে পড়ে। এদের লেখা যারা ছাপে, তারাও তো স্ট্যান্টবাজ। নিজেদের অপসাহিত্য প্রচারের জন্য এরাই সৃষ্টি করেছে এই স্তূতিবাজদের। কিভাবে প্রতিহত করবেন, যদি না এরা নিজেরা হাতাশ হয়ে ফিরে যায়?
পবন সন্ন্যাস: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে; তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
বীরেন মুখার্জী: সাহিত্যচর্চা বৃদ্ধি পাওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা যায়। এটা ঠিক যে চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এটা অত্যন্ত লজ্জার। লেখায় অগ্রজদের প্রভাব থাকা দোষের নয়, কিন্তু কোনোরকম ঋণস্বীকার ছাড়া আপনি যে কোনো লেখার অংশ বা পুরো লেখাটি আপনার নামে চালিয়ে দিতে পারেন না। এটা রীতিমতো অপরাধ বলে মনে করি। এ সংক্রান্ত কঠোর আইন থাকা দরকার। শুনেছি মেধাস্বত্ব আইন আছে। এটার সফল প্রয়োগ করা গেলে চৌর্যবৃত্তি থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাওয়া যাবে বলে মনে হয়।
পবন সন্ন্যাস: আপনি কি সাহিত্যে দশক বিভাজনে বিশ্বাস করেন? সাহিত্যে দশক বিভাজন কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ? যদি বিশ্বাস করেন, তবে নিজেকে কোন দশকের বলে দাবি করেন?
বীরেন মুখার্জী: দশকপ্রথা নিয়ে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি—’দশক গৌণ কবিদের আশ্রয়।’ এছাড়া, ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন’ নামে এক প্রবন্ধে মোহাম্মদ নূরুল হক বলেছেন, ‘বাংলা সমলোচনা সাহিত্যের একটি বিষফোঁড়া—দশকিয়া বিশ্লেষণ। এটি যেমন সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি সৃষ্টিশীলতার অন্যান্য বিভাগের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক। মহাকালের হিসাবের খাতায় শতকই যেখানে গৌণ, দশক সেখানে অতি তুচ্ছবিষয় মাত্র। তবু দশকবিভাজন নিয়ে মেধাহীনদের আহ্লাদের শেষ নেই। দশকবিভাজনের একটি লক্ষণীয় দিক হলো—প্রতিনিধিত্বশীলতার দোহাই দিয়ে অকবি-অলেখকরাও দশকিয়া সংকলনে স্থান পেয়ে যায়।’ আমিও তাই মনে করি। যেখানে শতকে একজন প্রকৃত কবি পাওয়া ভার সেখানে দশক তো তুচ্ছ। দশক বিভাজনে আমার বিশ্বাস নেই, তবে কবিদের উন্মেষকাল বিবেচনায় একই সময়পর্বে আবির্ভূত কবিদের শনাক্ত করতে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে; যেমনটি করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। আমার উন্মেষকাল নব্বইয়ের সময়পর্বে, মাঝামাঝিতে।
পবন সন্ন্যাস: সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কখনো কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা কারা? কিংবা সেই প্রভাবের ধরনটি কেমন হতে পারে?
বীরেন মুখার্জী: আমার প্রধান সমস্যা যে, আমি ভালো লেখায় প্রভাবিত হই; অগ্রজ-অনুজ যেই হোক না কেন। জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে অনতিতরুণ (পছন্দের) কবির কবিতায় প্রভাবিত হই। লেখার জীবনঘনিষ্ঠতা আমাকে স্পর্শ করে। এই প্রভাব মূলত লেখার প্রেমে পড়া। তবে লিখতে বসলে নিজস্ব কৌশলের বাইরে যাই না। এতে হয়তো একক কোনো কবির দৃশ্যমান প্রভাব থাকে না।
পবন সন্ন্যাস: ইদানিং পত্র-পত্রিকায় আপনার লেখা খুব বেশি চোখে পড়ে না। কী নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন? না কি লেখা প্রকাশিত না হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ আছে?
বীরেন মুখার্জী: ‘ভেলকির মাছি’ শীর্ষক এক কবিতায় বলেছি,
ভেলকি দেখার লোভে, চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি; তবুও আছি…
প্রতিদিন রক্তকণিকায় উথলে উঠছে যাদু, তোমরা ভাবছো—
জ্যোৎস্না-বাতাসে উত্তাল সমুদ্র, আমি কিন্তু বয়ে যাওয়া দেখছি…তামাশা দেখছি আর দিনদিন বুকের ভেতর ফুঁসে উঠছে সমুদ্র
কিন্তু নিজের উপস্থিতি বুঝতে দিতে চাইছি না কাউকেই…
এভাবেই—শরীরে গজিয়ে উঠছে ঊণ-নয়ন, ভবিষ্যে রক্তের ঋণ;ভেলকি-কৌশল, দেখতে দেখতে করোনা-করাতও পাড়ি দিচ্ছি
অপ্রকৃতিস্থের মতো দাঁড়িয়ে টন টন ব্যথা সহ্য করছি—তবুও আছি
প্রকৃতির খুব কাছাকাছি। শোরগোল করছি না—চুপটি করেই আছি;ভেলকি-সাম্রাজ্যে দর্শক সারিতে থাকাটাই সমীচীন, আমিও আছি
ফাটতে হলে ক্রমেই ছোট হতে হয়। এজন্য প্রতিদিন ছোট হচ্ছি;
তবুও আছি, থাকতে এসেছি বলেই—ভেলকির মাছিগুলো গুণছি…
সুতরাং, লেখালেখি সেভাবে দেখছেন না বলে লেখা থেমে গেছে এমনটি ভাবার কোনো সংগত কারণ নেই। তবে লেখা প্রকাশে আগ্রহ হারানোর পেছনে কারণ তো আছেই। লেখা প্রকাশের বেশিরভাগ ক্ষেত্রের কর্তাব্যক্তিরা যেখানে ভাঁড়ের দায়িত্ব পালন করছেন, সেখানে লেখা প্রকাশের যৌক্তিকতা কী? তবে যারা নির্মোহ, তাদের হাত দিয়ে তো লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। সংখ্যায় তা যতই কম হোক। তাছাড়া নতুনদেরও তো জায়গা করে দিতে হবে। লেখা প্রকাশ হোক না হোক খেদ নেই, কিন্তু আমি লিখতে লিখতে মরতে চাই।
পবন সন্ন্যাস: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাইবো। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আমরা কি সঠিক পথে রয়েছি বলে মনে করেন?
বীরেন মুখার্জী: ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ এটা মাথায় রেখেই বলি, বাংলা সাহিত্যের বর্তমান হযবরল আর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রথমত যোগ্যের মূল্যায়ন দরকার। পাশাপাশি সাহিত্যকর্মীদের মধ্যে রেষারেষি, ঠেলাঠেলি, পিঠ চুলকে দেওয়ার মতো নেতিবাচক প্রবণতাগুলো পরিহার করা জরুরি। ভালোকে প্রশংসা করার যোগ্যতা অর্জন এবং পাঠ না করেই খারিজ করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।এই নেতিবাচক প্রপঞ্চগুলো বিদ্যমান থাকলে কিভাবে বলবো যে আমরা সঠিক পথে আছি!
পবন সন্ন্যাস: পুরস্কার নিয়ে অনেক রকম কথা শোনা যায়, এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
বীরেন মুখার্জী পুরস্কার নিয়ে অনেক রকম কথার কারণও নিশ্চয় আছে। পুরস্কারের বিরুদ্ধে বলার পাশাপাশি অনেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। যদিও এই অভিমত সর্বজনীন নয়। কিন্তু বাংলা একাডেমিসহ কিছু পুরস্কার মাঝেমাঝে এমন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, মনে হয়, ওই ব্যক্তি নিজেও বিব্রত বোধ করেন পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় নিজের নাম দেখে। পুরস্কার ঘোষণা করে নাম প্রত্যাহারের ঘটনাও তো সাম্প্রতিককালে ঘটেছে।
পবন সন্ন্যাস: সমকালীন সাহিত্য জগতে নাকি এক ধরনের রাজনীতি চলছে। এই রাজনীতির বলি হচ্ছেন প্রকৃত সাহিত্যিকরা। সাহিত্যের এই রাজনীতি সম্পর্কে আপনার অভিমত শুনতে চাই।
বীরেন মুখার্জী: রাজনীতি সবখানেই আছে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ হলে রাজনীতি তার একটি অংশ মাত্র। রাজনীতি কোনো একটি লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া। লক্ষ করবেন, রাজনীতি পরিবর্তিত হলে সাহিত্যের গতি-প্রকৃতিতেও পরিবর্তন আসে। তবে রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব যদি কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে পড়ে, তাহলে তা পরিতাপের। আপনার কথা এক অর্থে ঠিক, রাজনীতির কারণে প্রকৃত কবি-লেখক বলি হয়ে থাকতে পারেন। অযোগ্য-অক্ষমরা সর্বেসর্বা হলে প্রকৃত কবি-লেখক নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন এটা স্বাভাবিক। এতে প্রকৃত সাহিত্য থেকে পাঠক-সমাজ বঞ্চিত হয়।
পবন সন্ন্যাস: চিন্তাসূত্রকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
বীরেন মুখার্জী: আপনাকেও।