তাপস রায়—রম্যলেখক। ‘এই বেশ আতঙ্কে আছি’ বইটির জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ লেখক সাহিত্য পুরস্কার’ পাচ্ছেন এই কবি। লেখালেখি, বেড়ে ওঠা, এসব বিষয় নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কবি পলিয়ার ওয়াহিদ।
পলিয়ার ওয়াহিদ: লেখালেখির শুরুর গল্প শুনতে চাই? কিভাবে লেখালেখিতে এলেন?
তাপস রায়: পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, আমার আসলে লেখক হওয়ার কথাই ছিল। যদিও একটা সময়পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। আমি ভালো আঁকতে পারতাম। কিন্তু কলেজে উঠে ইচ্ছেটা বদলে যায়। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, দুপুরবেলা বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত, আমি খাতা নিয়ে চুপিচুপি বাড়ির ছাদে উঠে যেতাম। পানির ট্যাংকির আড়ালে যে ছায়া পড়ত, সেখানে বসে লিখতাম। বলাবাহুল্য সেগুলো তেমন কিছু নয়। তখনো লেখক হবো, এমন চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। এই চিন্তাটা এসেছে অনেক পরে। অনেক পরে এই চিন্তাটা কেন আমার মনে এলো? একপর্যায়ে কেন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, লেখালেখি ছাড়া কিছু করব না—সত্যি এখন ভাবলে অবাক হতে হয়। আমার ছাদে বসে হিজিবিজি গল্প লেখার চেষ্টার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। আমার হাতে কে কলম তুলে দিয়েছিল? পরবর্তী সময়ে আমার হাতে কেইবা তুলি তুলে দিলো? কলেজে উঠে সেই মতটিই বা পাল্টে গেল কেন কে জানে!
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার লেখায় পাঠকরা আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষণীয় এবং মজা করতে করতে পড়া শেষ করতে পারেন। লেখালেখিতে এই রম্যধারাটি কেন বেছে নিলেন আপনি?
তাপস রায়: বেছে নেইনি। বলতে পারেন হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমি প্রেমে পড়িনি। প্রেম আমার ওপর পড়েছে। নইলে কাকতালীয় ঘটনাগুলো ঘটবে কেন? স্কুল লাইফের ঘটনা। আমাদের এক প্রতিবেশী, তিনি ফার্মের মুরগি পালতেন। তো, এক সময় খেয়াল করলাম, ফার্মের মুরগিগুলোকে ওই প্রতিবেশী ভিআইপিদের মতো সেবা-যত্ন করেন। অথচ দেশি মুরগিগুলোর প্রতি অবহেলার অন্ত ছিল না। আমার খারাপ লাগত। বিষয়টি নিয়ে একটা গল্প লিখে পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম। পরে সেটি প্রকাশিত হয় রম্যগল্প হিসেবে। আবার দেখুন আজকের কাগজে আমার জীবনের প্রথম চাকরি হয় ফান ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে। তবে সৈয়দ মুজতবা আলী ও শিবরাম চক্রবর্তীর প্রতি প্রেম—এসব ঘটনায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। ছেলেবেলা থেকেই নমস্য তারা দুজন।
পলিয়ার ওয়াহিদ: ‘এই বেশ আতঙ্কে আছি’ বইটির জন্য আপনি এবার ‘কালি ও কলম তরুণ লেখক সাহিত্য পুরস্কার’ পাচ্ছেন, এই পুরস্কারপ্রাপ্তি সম্পর্কে আপনার অনুভূতির কথা জানতে চাই।
তাপস রায়: আমি পুরস্কৃত হয়েছি কথাসাহিত্যে। ভালো-মন্দ মিলিয়ে বলতে পারেন, এই পুরস্কার আমার আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আরও ভালো লেখার তাড়না বোধ করছি। কিন্তু আমি সবসময় কম লিখতে চাই। ভাবতে চাই, আরও অনেক বেশি। এটি আমার লেখালেখির পরিকল্পনার অংশ। প্রবীণরা যখন পুরস্কৃত হন, তখন তাদের নিজেদের প্রমাণ করার খুব বেশি কিছু থাকে না। তারা বন্ধুর পথটুকু পাড়ি দিয়ে আসেন। নবীনদের কথাটা ভিন্ন। তাকে বিনয়ী হতেই হবে। কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
পলিয়ার ওয়াহিদ: এই বইয়ে আপনি মূলত কোন বিষয়গুলো তুলে এনেছেন? পাঠক কেন আপনার লেখা পড়বে?
তাপস রায়: মূল বিষয় হলো সমাজের মানুষ এবং সেই সমাজে বাসা বেঁধেছে এমন কিছু অসঙ্গতি। এসব নিয়ে ‘এই বেশ আতঙ্কে আছি।’ এগুলোকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে কয়েকটি রম্যরচনা। রয়েছে বিদ্রূপাত্মক রচনা। এছাড়া রম্যগল্প রয়েছে। তলোয়ারের চেয়ে কলম শক্তিশালী। আমার মনে হয়, রম্যলেখকদের কলমে সেই শক্তি প্রকাশের জায়গাটা আরও বড়। লেখক চাইলে তার কলম তীরন্দাজের তীরের মতো লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত করে। বিদ্রূপাত্মক রচনা যারা লেখেন, তারা সেই তীরে অনায়াসে বিষ মিশিয়ে নিতে পারেন। মূলত হাসতে হাসতে সামাজিক অসঙ্গতিগুলো উন্মুক্ত করতে, ধরিয়ে দিতে এই পদ্ধতি বেশ কাজের।
পলিয়ার ওয়াহিদ: পুরস্কার নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক কথা শোনা যায়, পুরস্কার আসলে লেখককে কতটুকু লেখক করতে পারে?
তাপস রায়: কোনো লেখকই কখনো পুরস্কারের আশায় লেখেন না। তিনি প্রথমত নিজের জন্যই লেখেন, যেখানে আপন ভাবনা লিপিবদ্ধ হতে থাকে। তারপরও পুরস্কার হলো কাজের স্বীকৃতি। স্বীকৃতি সবাই চায়। এতে দোষের কিছু নেই। বিপরীতে বলা যায়, পুরস্কৃত না হলে হতাশারও কিছু নেই। কেননা লেখকের বড় পুরস্কার পাঠক। ধরুন, কোনো এক সন্ধ্যায় মফস্বলের কোনো এক রেলস্টেশনে ট্রেন থামার পর, লেখক নামলেন। স্টেশনটি তার ভালো লাগল। তিনি কোণায় একটি চায়ের দোকানে বসলেন। কিছুক্ষণ পর একটি লোক তার পাশে এসে বসল। লেখক চা পান করছেন। মাঝপথে হঠাৎ লোকটি ভ্রূ কুঁচকে, কিছুটা কৌতূহলী ভঙ্গিতে, হাসি মুখে লেখকের মুখের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বাসে জানতে চাইলেন, আপনি অমুক না? আপনার এই বইটি পড়েছি। ভালো লেগেছে। ব্যস, আর কী চাই? এছাড়া আমি মনে করি, পুরস্কারের মাধ্যমে শুধু লেখক পরিচিতি বা সম্মানিত হন না। অনেক সময় সেই প্রতিষ্ঠানটিও সম্মানিত হয়। লেখকের উচিত পুরস্কারের কথা দ্রুত ভুলে যাওয়া। কেননা পুরস্কার কাউকে কখনো লেখক বানায় না। বরং লেখক তার যোগ্যতাবলেই পুরস্কৃত হন।
পলিয়ার ওয়াহিদ: এবার বইমেলায় আপনার নতুন কী কী বই আসছে?
তাপস রায়: প্রথমেই বলে রাখি, বইমেলায় বই প্রকাশিত হতেই হবে এমন কখনো আমার মনে হয়নি। আমি সেভাবে ভাবি না। কয়েক বছর হলো, একটি কিশোর উপন্যাসের কথা ভাবছিলাম—জারিফের স্কুল। জারিফ একটা জিরাফের নাম। উপন্যাসের সব চরিত্র বন্যপ্রাণী। সম্প্রতি লেখাটি শেষ হয়েছে। এটি বই আকারে এবারের মেলায় প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনি ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?
তাপস রায়: একেবারে ছেলেবেলায় কী হতে চেয়েছিলাম, এখন আর মনে নেই। তবে মা মাঝে মাঝে বলেন, আমি ট্রাক ড্রাইভার হতে চেয়েছিলাম। মজার বিষয় হলো—আমার পাঁচ বছরের ছেলেও তাই হতে চায়। তবে কলেজে ওঠার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, আমি অন্য কিছু করব না। শুধু লেখালেখি করব। কিন্তু মাস্টার্সে পড়ার সময় থেকেই বুঝতে পারলাম লেখালেখি পেশা হিসেবে নেওয়া কতটা কঠিন। কেননা এটি এখনো এদেশে পেশা হিসেবে দাঁড়ায়নি। তখন ভাবলাম, আমাকে এমন একটি পেশা বেছে নিতে হবে, যেখানে লেখালেখির সুযোগ অন্তত পাওয়া যায়। এমনকি সেটা যদি দলিল লেখকের পেশাও হয়, আমার আপত্তি ছিল না—ভেতরে ভেতরে আমি এতটাই সিরিয়াস ছিলাম। এ কারণেই সব ছেড়ে দিয়ে আমার সাংবাদিকতায় আসা।