হোসনে আরা জাহান—কবি ও কথাশিল্পী। কবিতার পাশাপাশি লিখে চলেছেন ছোটগল্পও। ২০১৭ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার প্রথম কবিতার বই ‘নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণ’। বইটির জন্য ‘কালি ও কলম তরুণ লেখক সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছেন এই কবি। লেখালেখি, বেড়ে ওঠা, এসব বিষয় নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কবি পলিয়ার ওয়াহিদ।
পলিয়ার ওয়াহিদ: লেখালেখির শুরুর গল্প শুনতে চাই?
হোসনে আরা জাহান: কখন যে লেখালেখি শুরু করেছি, তা ঠিক করে বলা মুশকিল। কবিতা ভালোবাসি। ঠিক, কখন থেকে এই ভালোবাসা জন্মালো, তাও জানি না। জীবনানন্দের একটা কবিতার বই হাতে এসেছিল সেই কিশোরীবেলায়। একই কবিতা বার বার পড়তাম। এরপর এলো হেলাল হাফিজ। আমি পুরোপুরি প্রেমে পড়ে গেলাম। কেমন একটা ঘোরলাগা। পাঠ্যবইয়ের ভেতর লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হতো। কারণ আউটবই পড়া বারণ ছিল।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার কবিতায় সাধারণত আঞ্চলিক শব্দ ও বিভিন্ন অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার থাকে। তো এই বিষয়গুলো কবিতায় নিয়ে আসেন কারণ কী?
হোসনে আরা জাহান: আমি তো গ্রামের মেয়ে। ময়মনসিংহের ফুলপুরের মেয়ে। আমার ভেতরের আমি তো শহুরে নই। হয়তো সে কারণেই আমার কবিতায় গ্রামীণ শব্দ চলে আসে। আর কবিতায় এসব আঞ্চলিক বা গ্রামীণ শব্দগুলোর এইরকমভাবে চলে আসাটাকে আমি খুশিমনে স্বাগত জানাই। শব্দগুলো নিয়ে খেলতে থাকি। লিখতে থাকি। আমার পূর্ববর্তী অনেকেই কবিতায় আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন: শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদসহ অনেকেই। আমি অবশ্য আমার মতো করে এসব শব্দ ব্যবহার করি। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।
পলিয়ার ওয়াহিদ: ‘নিশিন্দা পাতার ঘ্রাণ’ বইটির জন্য আপনি এবার ‘কালি ও কলম তরুণ লেখক সাহিত্য পুরস্কার’ পাচ্ছেন, এই পুরস্কার প্রাপ্তি সম্পর্কে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
হোসনে আরা জাহান: এটা অবশ্যই আমার জন্য বেশ উৎসাহের ব্যাপার। আমরা যারা লেখালেখি করি, তারা তো চারপাশ থেকে শুধু নেতিবাচক কথাই শুনি। কবিতা লিখে কী হবে, সময় নষ্ট ইত্যাদি ইত্যাদি। এ অবস্থায় এমন প্রাপ্তি একজন কবির কবিসত্তাকে সত্যিই প্রশান্তি এনে দেয়। একই সঙ্গে এমন পুরস্কার প্রাপ্তিতে নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়ার জায়গা, দায়বদ্ধতার জায়গাও নতুন মাত্রা পায়। যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
পলিয়ার ওয়াহিদ: এই বইয়ের কবিতাগুলোয় আপনি কোন বিষয়গুলো তুলে এনেছেন? পাঠক কেন আপনার কবিতা পড়বে?
হোসনে আরা জাহান: এই বইটিতে বিভিন্ন রকম কবিতা রয়েছে। এসব বিষয় আসলে আমাদেরই যাপিত জীবন থেকেই নেওয়া। জগতের সহজ সরল বিষয়গুলো আমাদের কাছে কখনো কখনো আর সহজ থাকে না। আমরা সেগুলোকে জটিল করে ফেলি। অথচ আমরা সবাই সহজ করে ভাবতে চাই। কিন্তু পারি না। মূলত বইটিতে মানুষের এই ইতিবাচকতারই প্রতিফলন আছে। জীবন তো আসলে সুন্দর, তাই না!
পলিয়ার ওয়াহিদ: তরুণদের মধ্যে ছন্দ না জেনে, ছন্দ উচ্ছেদের প্রতিযোগিতায় নামতে দেখা যাচ্ছে। আপনি কি মনে করেন, ছন্দ না জেনে কবিতা লেখা সম্ভব? ছন্দহীন রচনাকে কবিতা আখ্যা দেওয়া উচিত?
হোসনে আরা জাহান: ছন্দ জানা প্রয়োজন। ছন্দ ভাঙতে হলেও তো ছন্দ জানতে হবে। তবে ছন্দহীন রচনাও কবিতা হতে পারে।
পলিয়ার ওয়াহিদ: পুরস্কারের পক্ষে-বিপক্ষের কথা শোনা যায়, পুরস্কার আসলে লেখককে কতটুকু লেখক করতে পারে?
হোসনে আরা জাহান: একজন কবি তার কবিতায় বেঁচে থাকেন। পুরস্কারে নয়। আমি মনে করি পুরস্কার কাউকে কবি করতে পারে না। কবিতাই একজন কবিকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তবে যেকোনো প্রাপ্তিই আনন্দের। একজন কবির তার কবিতার জন্য যে প্রাপ্তি, তা অবশ্যই তার জন্য আনন্দ বয়ে আনে।
পলিয়ার ওয়াহিদ: এবার বইমেলায় আপনার নতুন কী বই আসছে?
হোসনে আরা জাহান: এবার বইমেলায় আমার একটি কবিতার বই আসছে। বইটির নাম ‘লেবুর গন্ধের মতো’। এই বইটিতে নানা রকম কবিতা থাকছে। বইটিতে ত্রিশটি কবিতা ও পঞ্চাশটি হাইকু থাকবে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। বইটি প্রকাশ করছে অনন্যা।
পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনি ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন?
হোসনে আরা জাহান: ছোটবেলায় আমি অনেককিছুই হতে চেয়েছিলাম। স্কুলশিক্ষক, নার্স, হাইস্কুলের শিক্ষক, কলেজ শিক্ষক, পুলিশ, ব্যবসায়ী আরও কত কী! অর্থাৎ আমি যা যা চিন্তা করতে পারতাম তাই হতে চাইতাম। তখন সত্যি ভাবিনি আমি কবি হবো। তখন তো আসলে বুঝতাম না জীবনটা কোন দিকে বইবে। ছোটবেলা থেকেই আমার জানতে ভালো লাগে। বই পড়তাম লুকিয়ে লুকিয়ে। তখন যারা বই পড়তো সবারই এমন লুকিয়ে লুকিয়ে আউটবই পড়তে হতো। প্রচুর গান শুনতাম। তাও লুকিয়ে। মনে পড়ে, সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ পড়ে কেমন একটা চমক অনুভব করেছিলাম। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। তখন থেকে মনে মনে দীপাবলি হতে চাইতাম। এই বইটা আমাকে, আমার ভেতরকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। সবাই জানি, মেয়েদের জীবনে কত রকম চড়াই-উতরাই পার হতে হয়। ভেতরে ভেতরে একটা তেমন সাহস না থাকলে স্রোতের বিপরীতে হাঁটা মুশকিল। তবে এটা ঠিক, আমি কিছু না কিছু হবো, এটা শৈশব থেকেই অনুভব করতাম।