মহীবুল আজিজ। কবি-কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তার জন্ম: ১৯ এপ্রিল ১৯৬২, নড়াইল, যশোর। স্থায়ী নিবাস: চট্টগ্রাম। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রবন্ধ/গবেষণাগ্রন্থ: হাসান আজিজুল হক : রাঢ়বঙ্গের উত্তরাধিকার; কথাসাহিত্য ও অন্যান্য; বাংলাদেশের উপন্যাসে গ্রামীণ নিম্নবর্গ; সৃজনশীলতার সংকট ও অন্যান্য বিবেচনা; সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিত; ঔপনিবেশিক যুগের শিক্ষা-সাহিত্য; ইলিয়াস ও অন্যান্য নক্ষত্র; অস্তিত্বের সমস্যা ও লেখালেখি; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ও অন্যান্য প্রবন্ধ; উপনিবেশবিরোধিতার সাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ; সরকারি ও মিশনারি শিক্ষা এবং বৌদ্ধধর্ম ও বাঙালি জীবন-চেতনা।
ছোটগল্প: গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ; দুগ্ধগঞ্জ; মৎস্যপুরাণ; আয়নাপড়া; বুশম্যানের খোঁজে, নীলা মা হতে চেয়েছিল; মুক্তিযুদ্ধের গল্প; তপন শীল ও তার বিবাহ-প্রকল্প; এবং কর্নেলকে একটা মেয়ে পৌঁছে দিতে হবে।
কবিতাগ্রন্থ: সান্তিয়াগো’র মাছ; রৌদ্রছায়ার প্রবাস; হরপ্পা’র চাকা; পৃথিবীর সমস্ত সকাল; নিরানন্দপুর; বৈশ্য বিশ্বে এক শূদ্র; অসুস্থতা থেকে এই-মাত্র; এই নাও দিলাম সনদ; আমার যেরকম প্রস্তুতি; আমরা যারা স্যানাটরিয়মে; পালাবার কবিতা; দৃশ্য ছেড়ে যাই; ট্যারানটেলা; ওগো বরফের মেয়ে; হৃদয় বর্ণের কবিতাগুচ্ছ; ভরসানামা; কাব্যসমগ্র; শ্রেষ্ঠ কবিতা; হ্যাকার তুমি; প্রেমনামা ও লকডাউন ও অন্যান্য কবিতা।
উপন্যাস: বাড়ব; যোদ্ধাজোড়; বর্ণসন্তান এবং প্রশান্ত পরিত্যাগ।
গবেষণকর্মের জন্য সম্প্রতি পেয়েছেন চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার। এই উপলক্ষে প্রকাশিত হলো তার একটি সাক্ষাৎকার।
চিন্তাসূত্র
প্রবন্ধ-গবেষণার জন্য আপনি চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার-২০২৩ পাচ্ছেন। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
মহীবুল আজিজ
চিন্তাসূত্র ওয়েবম্যাগটি বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতি বৈদ্যুতিন যোগাযোগ তথা মননচর্চার ক্ষেত্রেই যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে চলেছে। এখন এই বৈশ্বিক ডিজিটালাইজড্ যুগে হয়তো কাগজকলম মুদ্রণ এইসবের পরিবর্তে ওয়েবজগত একটা বিকল্প বা সমান্তরাল ওয়েবসংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে যেটিকে আজ একদিক থেকে ওয়েব-বাস্তবতা হিসেবেই বিবেচনা করতে হয়। যে-পুরস্কারটি তাঁরা দিচ্ছেন সেটির পশ্চাতে একটা সুচিন্তা ও সুপরিকল্পনার ছাপ দেখতে পাই। যেমন এবছর তাঁরা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন সাহিত্যের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ শাখায়—প্রবন্ধ, কবিতা, ছোটগল্প, তারুণ্যখচিত কাব্যচর্চা এবং সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদনা। একটা বৈচিত্র্য প্রথমেই চোখে পড়বে, বিশেষ করে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে বেছে নেওয়ার বিবেচনায়। আবার, নবীন ও অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠদের নির্বাচন করা হয়েছে পুরস্কৃত করবার ক্ষেত্রে। মানে অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্য এই দুই বিভিন্ন মেরুকে একটি আয়তনে উপস্থাপন করা হয়েছে। নিজে একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে বলতে পারি, চিন্তাসূত্রের সচেতন বিবেচনাবোধটি প্রশংসনীয়। যাঁরা পুরস্কৃত হয়েছেন তাঁরা সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। পুরস্কারের ক্ষেত্রে চিন্তাসূত্র-র পরিসীমাগত প্রেক্ষাপটটি বেশ প্রশস্ত। তাঁরা সারা বাংলাদেশকেই পুরস্কারের ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য করেছেন এবং বাছাই করবার ক্ষেত্রে সারাদেশ থেকে তাঁরা যে সচেতন মনোনয়ন আহ্বান করেন সেটি প্রশংসার যোগ্য। নিজের অনুভূতির কথা জানতে চাওয়া হয়েছে প্রশ্নে। সে-সূত্রেই বলি, আমার প্রথম গ্রন্থ বেরোয় ১৯৮৮ সালে। একই বছরে দু’টো বই—গল্পগ্রন্থ ‘গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স ও নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’ এবং এম. এ. ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে রচিত গবেষণা-অভিসন্দর্ভ ‘হাসান আজিজুল হক : রাঢ়বঙ্গের উত্তরাধিকার’। সাহিত্যচর্চার বয়স আরও বেশি। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ষাট। পুরস্কার বিষয়ে আামার মধ্যে কোনো উত্তেজনা কাজ করে না। কোনো পুরস্কার ঘোষিত হলে আমি যেটা ভাবি যে, যোগ্যরা পুরস্কৃত হলেন কি না। হলে তাঁরা যে তাঁদের কাজের জন্য স্মরণযোগ্য হলেন সেটা ভেবে ভালো লাগে। কিন্তু যখন দেখি অন্তঃসারহীন বা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মোটেই নয় এমন ভূষিমালকেও সারবস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে তখন সেইসব অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে একটা করুণার বোধ জাগে। বিশেষ করে, যাঁরা পেলেন তাঁদের জন্য নয়। বরং সেইসব বিচারকদের জন্য যাঁদের অবিবেচনা এবং সমারূঢ়তার শিকার হলেন যোগ্যরা। পরিস্থিতি এমন নয় যে একেবারে খড়ের গাদার ভেতর থেকে সুঁই খুঁজে বের করতে হবে, যেহেতু সংগ্রহে আর কোনো সুঁই নেই। ভেবে দেখুন, আহমদ ছফা বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার পাননি, শহীদুল জহির পাননি, এরকম অনেকেই পাননি। এখন এইসব পুরস্কারের ক্ষেত্রে কী বোধ-বিবেচনা কাজ করে বলা মুশকিল। যথেষ্ট বুড়ো হলে তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হবে, নাকি বুড়ো হলে হবে না। কিংবা অল্প লিখলে তাঁদের পুরস্কার দেওয়া হবে, বেশি লিখলে হবে না। কিংবা সাহিত্যের নানা মাধ্যমে কাজ করলে আপনি পাবেন না—এটা সাফ কথা। তার চেয়ে আপনি যদি ২/৩টি একই ধরনের সাহিত্যগ্রন্থ রচনা করেন তাহলে আপনি গুরুত্বপূর্ণদের দলভুক্ত হবেন। একটিমাত্র গ্রন্থ লিখে বৃহৎ প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার পেয়েছেন এমন লেখকও আমাদের দেশে আছেন। কাজেই এইসব বিবেচনার মধ্যে যখন দেখি চিন্তাসূত্র কবিতার জন্যে সুদূরে বসে প্রায় নেপথ্যচারির মত হেনরী স্বপনকে বেছে কিংবা প্রায় সেরকমই কোলাহলবিমুখ হাসান অরিন্দমকে নেওয়া হয়েছে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তখন মনে হয় যে হ্যাঁ, তাঁরা ব্যক্তিকে নয় ব্যক্তির কর্মকেই প্রধান অন্বিষ্ট রূপে গ্রহণ করেছেন। একটু ব্যক্তিগত হয়ে যায় তা-ও বলি। বহুকাল আগে সেই আশির দশকে ঢাকা থেকে একটি পত্রিকা তার যাত্রা শুরু করে কবি সিকদার আমিনুল হকের সম্পাদনায়। সেটির বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো ‘লেখক নয় লেখাই বিবেচ্য”। তো চট্টগ্রাম থেকে আমি সেই বিজ্ঞাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাঠাই ছোটগল্প। তখন তো ফটোকপি ছিল না। হাতে লেখা গল্প কপি করে পাঠানো সে এক দুরূহ পথকাটার ব্যাপার। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সেই গল্প ছাপলেন সিকদার আমিনুল হক। তাঁর পত্রিকায় আমার ৫/৬টি গল্প ছাপা হয়। কথা সেটাই, যদি ব্যক্তি লেখককে এড়িয়ে তাঁর লেখালেখিকেই মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে সেইটিই হতে পারে লেখালেখির কাজে নিয়োজিত থাকা মানুষদের কৃত কাজের মূল্যায়ন। সবকিছুরই তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন হতে হবে তা বলি না কিন্তু অযোগ্যের অতিরিক্ত খাতির এবং যোগ্যের প্রতি অবহেলা অন্তত বৃহৎ অবস্থানে আসীনদের পক্ষে অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলেই মনে করি। চিন্তাসূত্র অন্তত সেদিক থেকে এক ধরনের দায়বোধের পরিচয় দিয়েছে। তবে আমি মনে করি, প্রবন্ধের ক্ষেত্রে আমার চাইতেও যোগ্য ব্যক্তি বর্তমানে আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রে বিদ্যমান আছেন। আমাকে বিচারকের দায়িত্ব দেওয়া হলে আমি হয়তো তাঁদের পুরস্কৃত করবার সুযোগ পেতাম।
চিন্তাসূত্র
দীর্ঘদিন ধরে প্রবন্ধ/গবেষণার পাশাপাশি কবিতা, কথাসাহিত্যেও আপনি সদর্পে বিচরণ করছেন। এই চলার পথের বিড়ম্বনা-সংকট ও সাফল্য নিয়ে কিছু বলুন।
মহীবুল আজিজ
সত্যি কথা বলতে কি, বিড়ম্বনা-সংকট বলে কিছু নেই আমার মানচিত্রে, সবটাই সাফল্য। মানে আমার লেখা সফল সেটা বলি না, আমি যে লিখে যাওয়ার কাজটা করে যেতে পারছি সেইটাই আমার সাফল্য। কি লিখবো সেটা কখনই আমি আগে থেকে ঠিকঠাক করে রাখি না। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমি ভাবি, আর সেই ভাবনাটা মূলত মস্তিষ্কের প্রকোষ্ঠেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেই ভাবনাটা কি আকারে বেরোবে বলা কঠিন। হয়তো ভাবছি একটা ঝাপসা আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যে, নানা প্রতীক চিত্র দৃশ্য শব্দের মধ্যে দিয়ে আকার হয়ে উঠবার আকুতি নিয়ে মনোজগতে স্পন্দন জাগিয়ে তুলছে। এই স্পন্দনটা আসলে একটা পূর্বপ্রেক্ষিত। দেখা গেল, কালক্রমে বিমূর্ত ধরা যায় না এমন সব অনুভূতি ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে একমাত্রিক শব্দেরই নানা কাঠামোর মধ্য দিয়ে। কখনও কবিতার আকারে কখনও গল্পের আকারে কখনওবা উপন্যাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমার চিন্তাকে। প্রবন্ধটাও সেরকম। পঠনপাঠন লেখালেখি পারস্পরিক কথাবার্তা এইসবের একটা সুসংগঠিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে সচেতন ভাবনা থেকে প্রবন্ধ লেখার উৎসাহ জাগে। মনে হয় যে হ্যাঁ, আমারও কিছু বক্তব্য রয়েছে, সেসব বক্তব্য আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা কিংবা দেখারই ফল। বিড়ম্বনা যদি বলি তা কিন্তু এই সাফল্যেরই আরেকটি পিঠ। ধরা যাক, মনে হচ্ছে যে হ্যাঁ, একটা গল্প লিখতে চাইছি সম্ভবত। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার মনের ভেতরকার কাঁচামাল সরবরাহকারী গল্পের বদলে আমাকে পাঠালো একটা কবিতা। মানে প্রকরণ বদলে গেল। আমি খেতে চাই গরম ভাত কিন্তু খাদ্যসরবরাহকারী বলছে, ভাত নেই, রুটি হবে। দুটোই তো খাদ্য। যাহোক, সেবেলা রুটিই খাই, পরের বেলা হয়তো পাওয়া গেল ভাত। এরকম হয়। ১৯৯১-৯২ সালে কয়েক বছরের জন্যে আমাকে ইংল্যান্ডে বসবাস করতে হয়। ওখানেই আমি ইংরেজি ভাষায় মৌলিক কবিতা লিখি যেসব কবিতা আমি কোথাও প্রকাশ করি না। কেননা, আমার মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, তাই সেসব কবিতার সাফল্য নিয়ে খানিকটা দ্বিধা ছিল আমার মনের মধ্যে। তবে সমান্তরালে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সান্তিয়াগোর মাছ’-এ অপ্রকাশিত সেইসব ইংরেজি কবিতার উপমা চিত্র দৃশ্য ঘটনা এসবের ঘাত-প্রক্ষেপণ ঘটে। কিন্তু করোনাকালীন অবরুদ্ধতার প্রেক্ষাপটে নানা ধরনের লেখার মধ্যে ইংরেজিতে কবিতা রচনার পুরনো উৎসাহ ফের আমার মধ্যে জেগে ওঠে। কেবল যে জেগে ওঠে তা-ই নয়, আমাকে দিয়ে প্রায় বিরতিহীনভাবে কবিতা লিখিয়ে নিতে থাকে আমার চেতনা। সেসব কবিতা নিয়ে তারপর আর আমার মধ্যে সংশয় থাকে না। মনে হয় যে হ্যাঁ, আমার মাতৃভাষা না হলেও ইংরেজিতে লেখা আমার কবিতা মার্কিন বা বৃটিশ পোয়েট্রি জার্নালে পাঠানো যায়। পাঠাতে লাগলাম এবং সেসব কবিতা ছাপাও হয়ে যেতে লাগলো। কাজেই, আমার কোনো বিড়ম্বনা নেই, সবটাই আনন্দপূর্ণ সৃষ্টিশীলতার উদযাপন। হ্যাঁ, আমার শুরুটা কথাসাহিত্য দিয়েই, অন্তত আমি দীর্ঘকাল কথাসাহিত্যেই মনোযোগী ছিলাম। সেই মনোযোগ সংহত হয় কিছু স্বীকৃতির কারণেও। তখন আশি-দশকের গোড়ার দিকটাতে বাংলাদেশ পরিষদ সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো। আমি ছোটগল্পে চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ গল্পকারের পুরষ্কার পেলাম। আবার ঢাকায় একটা দেশব্যাপী ছোটগল্পের প্রতিযোগিতা হলো যেখানে বিচারক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। আমি সমগ্র বাংলাদেশে প্রথম হই। এর ফলে একটা বাড়তি আগ্রহের সৃষ্টি হলো ছোটগল্পের প্রতি, যে-আগ্রহ বেশ খানিকটা সময় আমার মধ্যে জাগ্রত ছিল। পরে আমি গল্প কবিতা প্রবন্ধ অনুবাদ গবেষণা উপন্যাস এমনকি ইংরেজি ভাষায় কাব্যরচনা ইত্যাদি বিভিন্ন দিকে নিজেকে মেলে ধরতে লাগলাম। সে-প্রক্রিয়া বর্তমানেও চলমান রয়েছে।
চিন্তাসূত্র
আপনার প্রবন্ধে কোন বিষয়কে বেশি প্রাধান্য দেন?
মহীবুল আজিজ
আমার মূল মনোযোগের জায়গাটা হলো সাহিত্য এবং সাহিত্যসম্পর্কিত বিষয়াশয়। যদিও এ-সাহিত্য মানে বিশুদ্ধ স্বয়ম্ভূ পারম্পর্য বা ধারাবহিকতাবিবর্জিত সাহিত্য নয়, এ-সাহিত্য মানে একটা বিবর্তমান সুদীর্ঘ কালরেখার মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হওয়া ফলাফল। সাহিত্য বলতে কেবল আমাদের সাহিত্য নয়, যে-সাহিত্য সমগ্র পৃথিবী জুড়ে নানা ভাষায় নানাভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে সেটিকে যতটা সম্ভব নিজের অভিজ্ঞতার অন্তর্গত করে নেওয়া। সমগ্র বিশ্বের সাহিত্যের অভিজ্ঞতার জন্যে যে-বহুভাষিকতার প্রয়োজন সেটি একজীবনে অসম্ভব। কাজেই ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়েই বিশ্বসাহিত্যের স্বাদ নেওয়াটা একমাত্র উপায় ও অবলম্বন। সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে প্রবন্ধ লিখতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বোদলেয়ারের কবিতা মূল ফরাসিতে পাঠ করবার জন্য এককালে ফরাসি ভাষা শিখেছিলাম। শৈশবে বাবার উৎসাহে শেখা ফারসি’র পুঁজি খৈয়াম-রুমি-সাদী-সেপেহরি-ইউশিজ-ফরোখজাদের কবিতা মূল ভাষায় পড়বার কাজে লাগে। এখনও কানে বাজে আমাদের ফারসিশেখানো মওলানার রুমি-পাঠ—“বেশ্নো আজ নেয়ি চুন হেকায়াৎ মি’কুনাদ/ আজ জুদায়ি হ’শেকায়াৎ মিকুনাদ।” সাহিত্যের সমান্তরালে শিক্ষা বিষয়েও আমি প্রবন্ধ এমনকি গ্রন্থও রচনা করেছি। শিক্ষাবিষয়ক আমার দু’টো গ্রন্থ ‘ঔপনিবেশিক যুগের শিক্ষা সাহিত্য’ এবং ‘সরকারি ও মিশনারি শিক্ষা’ প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত সাহিত্য-পাঠের সমান্তরালে আমি যখন ইংল্যান্ডে বসবাসরত অবস্থায় ব্রিটিশ মিউজিয়ম ও ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করি তখন দেখতে পাই, ভারতবর্ষে তথা বাংলায় পাশ্চাত্য শিক্ষার বিবর্তন কিংবা ব্রিটিশ আমলে সরকারি ও মিশনারি শিক্ষার দ্বন্দ্ব বিষয়ে লেখার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সেই উৎসাহ থেকে সাহিত্যের পাশাপাশি শিক্ষা বিষয়ে আমি প্রবন্ধ লিখতে থাকি।
চিন্তাসূত্র
পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কবিতাচর্চার মতো কাজে ব্যস্ত থাকেন। এসব কাজের সমন্বয় করেন কিভাবে?
মহীবুল আজিজ
একথা ঠিক, কবিতা এমন একটি সাহিত্যমাধ্যম যেটি দাবি করে নিরবচ্ছিন্ন সম্পৃক্ততা, অখণ্ড মনোযোগ এবং নিমগ্নতা। সেদিক থেকে বলতে গেলে সংসারজীবনটা আসলে কবিদের জন্যে এক ধরনের বেদনার হেতু। কবিকেও বাজারে ছুটতে হয় থলে হাতে। তরিতরকরি মাছমাংসের দৈনন্দিনতার মধ্যে সাঁতরাতে হয় তাঁকেও। হ্যাঁ, সেসব অভিজ্ঞতার প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। একটা কবিতা ভ্রূণ আকারে জেগে উঠলে সঙেগ-সঙ্গেই আমি লিখতে বসে যাই না। সেটিকে নিয়ে ভাবি, মস্তিষ্কের মধ্যে একটা ছোট্ট প্রকোষ্ঠ তৈরি করি যেখানে কবিতাটিকে সংরক্ষিত রাখি। কিছু শাব্দিক রূপরেখাও কাগজেকলমে টুকে রাখি। তারপর ধীরেসুস্থে কবিতা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নিজেকে যুক্ত করি। কখনও কখনও এমনও হয়, কবিতা একেবারে প্রায় তৈরি হয়ে মাথায় আবির্ভুত হচ্ছে। এসব একজাতীয় অবসেশন, ঘোরলাগা অধ্যায়ে বসবাসের মত। তবে হ্যাঁ, সংসার-সামাজিকতা এসব কবিতার জন্য প্রায়শ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। পেশাগত দায়িত্বকে এড়ানোর উপায় নেই। কেননা, ক্ষুধার অন্ন যোগাড়ের চিন্তা ও পরিকল্পনা সর্বাগ্রে। একটি ফরাসি কথাই আছে, লেখালেখি এক ধরনের বুর্জোয়া কর্মতৎপরতা। পেশা এবং সেই সূত্রে অন্নের যোগান বন্ধ হয়ে গেলে কবির হাজারও সৃষ্টিশীলতাও একসময় মুখ থুবড়ে পড়ে। কাজটি কঠিন কিন্তু সমস্ত সংশ্লিষ্টতা ও সংযোগের মধ্যে কবিকে সৃষ্টি করে নিতে হয় স্বেচ্ছাবিয়োজন বা আত্মবিচ্ছিন্নতার বাস্তবতা, যেটি তাঁর কবিতা রচনার জন্য অনিবার্যভাবে প্রয়োজনীয়।
চিন্তাসূত্র
বাংলাদেশের সমসাময়িক কবিতাচর্চা ও ছোটকাগজের ভূমিকা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী বলে?
মহীবুল আজিজ
একসময়ে ছোটকাগজ কিংবা লিটল ম্যাগাজিন যাই বলি না কেন সেসবের যথেষ্ট অনুপ্রেরণাদায়ক ভূমিকা ছিল। ষাট-সত্তর-আশি-নব্বই এসব দশকওয়ারী বিবেচনায় ছোটকাগজ এবং কাব্যচর্চা উভয়ই সমানুপাতিক সম্পর্কের সূত্রে অগ্রসরমান ছিল। বর্তমানে কাব্যচর্চা নানা আঙ্গিক ও মাধ্যমে উপস্থাপিত হচ্ছে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বা ওয়েবম্যাগ বা ওয়েবজিন যাই নাম দিই না কেন কবিতাচার্চার ক্ষেত্রে বিস্তৃতি ঘটেছে। পত্রপত্রিকাগুলোর সাহিত্যবিভাগেও ছাপা হয় অনেক কবিতা। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থাপিত কবিতাও অনেকখানি মনোযোগ পাচ্ছে। এসবই কবিতাচর্চার জন্যে ফলদায়ক। কিছুকাল আগেও পাঠ করা কবিতা মনে পড়ছে যেগুলো আমাকে ভাবনাউদ্দীপ্ত করেছে। এই সামাজিক মাধ্যমেই আমি মাসুদ খান, জুয়েল মাজহার, হাফিজ রশিদ খান, মোহাম্মদ নূরুল হক, খালেদ হামিদী, ইমতিয়াজ মাহমুদ, জিললুর রহমান, খালেদ হোসাইন, বায়তুল্লাহ কাদেরী, ওবায়েদ আকাশ, মুহম্মদ ইমদাদ, জহির হাসান, হিজল জোবায়ের এরকম অনেকের কবিতা পড়েছি, যেগুলো ছোটকাগজে মুদ্রিত হলেও সমান ভালো লাগার কার্যকারণ ঘটতো। এর বাইরেও নাম করা যায় অনেকের। কিন্তু আমি এখানে নাম করতে বসি নি। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়লো, তাই দিলাম। দেশের দূর প্রান্তে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে অনেক পত্রপত্রিকা যেগুলোর কথা বলতে গেলে আমাকে তালিকা প্রস্তুত করতে হবে রীতিমত। রাজশাহী থেকে বেরোয় ‘চিহ্ন’, নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ পত্রিকাটি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এবং তরুণদের সৃষ্টিকর্মকে আশ্রয় করে প্রকাশিত হচ্ছে দীর্ঘদিন। ‘লিরিক’ ‘নিসর্গ’ ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’, ‘কার্পাস’ ‘রাঢ়বঙ্গ’ ‘দ্রষ্টব্য’ ‘তৃতীয় চোখ’ এরকম অনেক পত্রিকা বেরোচ্ছে এখন। ক’দিন আগেই আমি রাজশাহী গেলাম একটা একাডেমিক কাজে। সৈয়দ তৌফিক জুহরী সম্পাদিত ‘তপোবন’ নামের একটি ছোটকাগজ হাতে এলো। চমকে উঠি এর সামগ্রিক উপস্থাপনায়। একটা সংখ্যাই বেরিয়েছে। সম্পাদক বয়সে নিতান্ত নবীন কিন্তু এই আত্মপ্রকাশটি নিঃসন্দেহে আশার সঞ্চারক। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যে-পরিমাণ ছোটকাগজ প্রকাশিত হয় তাতে আমাদের সাহিত্য কিংবা আমাদের কাব্যচর্চার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী না হয়ে পারা যায় না।
চিন্তাসূত্র
আপনি একাধারে কবি-কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সেই হিসেবে বাংলা কবিতা-প্রবন্ধ-গবেষণা ও কথাসাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশার কথা বলুন।
মহীবুল আজিজ
প্রথম বইয়ের প্রকাশকালকে হিসেবে নিলে আমার লেখালেখির কালপরিধি ৩৫ বছর। এই দীর্ঘকালের লেখালেখি পঠনপাঠনের ক্রমাগতকর্মটি বহমান থেকে গেছে অতি অবশ্যই আহসান হাবীবের কবিতার বইয়ের শিরোনাম ধার করে বললে ‘আশায় বসতি’র কারণে। ইংরেজিতে বলে ‘হোপ ইজ দি হাফ অব লাইফ’। সে-আশাটা কিসের! আমরা যে-দেশটাকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বলে জানি, যে-দেশের জন্মের আমরা প্রত্যক্ষ সাক্ষী, যে-দেশের সামগ্রিক বিবর্তনের মধ্যে বিরাজমান উপাদান আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাও, সে-দেশের সৃজন ও মননের জগতে ঘটবে একটা দৃশ্যমান অগ্রগতি, যে-অগ্রগতি কেবল এগিয়ে যাওয়ারই স্মারক নয়, স্বাতন্ত্র্য ও সাফল্যেরও নির্ণায়কও বটে। এখন একটা বিষয় স্পষ্ট, বাংলা সাহিত্য বলতে বাংলাদেশের সাহিত্যকেই বোঝায় যেহেতু বাংলা একটা দেশের রাষ্ট্রভাষা। মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিও বাংলা সাহিত্যেরই যখন ভারত এবং বাংলা দুই-ই ছিল অবিভক্ত। ভারতবর্ষে বাংলা ভাষায় যে-সাহিত্য রচিত হয় কাজেই তা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য। হ্যাঁ, বাংলাদেশের সাহিত্য বলে একটা বিশেষ পরিচিতি আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের দ্বারা। আবার, এ-ও তো সত্যি কথা কি নামে আমরা বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যকে সনাক্ত করবো সে-ভাবনায় সৃজনশীল রচয়িতারা তত ভাবিত না হয়েই বাংলা ভাষাতেই রচনা করে চলেছেন সাহিত্য। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে এটা অন্তত বলা যেতে পারে, আমাদের সাহিত্য এর সব শাখাতেই যথেষ্ট সমৃদ্ধি লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তুলনার করলে হয়তোবা সব মাধ্যমেই তৃপ্তিকর ফল দেখতে পাওয়া যাবে না। তুলনাটাও কীভাবে করা যাবে! আপনি মো ইয়ানের কথা তুলবেন। বলবেন তিনি তো নোবেল পেয়েছেন কিন্তু আমাদের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের তুলনায় মো দ্বিতীয় শ্রেণির লেখক। কুন্ডেরা নোবেলই পান নি। কত বিখ্যাত লেখক নোবেল পান নি। জোসেফ স্কোরোভেকি পান নি কিন্তু তাঁর লেখা উচ্চাঙ্গের। আমরা আমাদের নিজস্ব অগ্রসরণ আমরা নিজেরাই অনুভব করতে পারি। আজকের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কথা না-ই বললাম, ধরুন, কুড়ি বছর আগেও এত অধিক সংখ্যক প্রতিশ্রুতিবান লেখকদের একসঙ্গে বিরাজমান দেখা যায় নি। সাহিত্যের আঙ্গিকগত সাফল্য চাইলে অনেকের পক্ষেই করায়ত্ত করা সম্ভব, এর কথাবস্তু বা বিষয় যাকে বলি সেটির ওজস্বিতা বা গুরুত্বও অনেকখানি এরিমধ্যে প্রতিফলিত দেখতে পাওয়া গেছে এবং তা অপেক্ষাকৃত কমবয়স্কদের রচনাসূত্রে। প্রতিষ্ঠিতদের এখন অবসিতির পক্ষ, ফলে যা কিছু আশা নিঃসন্দেহে তরুণ কিন্তু সম্ভাবনা-জায়মান রচয়িতাদের নিকটেই প্রত্যাশা। বয়স্ক হলেই বুড়ো হলেই তাঁর লেখা সোনা ফলাবে তা কিন্তু নয়, শহীদুল জহির যখন তাঁর ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাস রচনা করেন তখন তাঁর বয়স কত? এমনকি অনেক কম বয়সে লেখা এ-উপন্যাসটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ, শুধু তাঁর শ্রেষ্ঠই নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসও এটি। জুলফিকার মতিন যখন তাঁর রাজনৈতিক গল্প-উপন্যাসগুলো রচনা করেন তখন তাঁর বয়স কত? তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ধারার কথাসাহিত্য-রচয়িতা। মামুন হুসাইন কিংবা ইমতিয়ার শামীম পুরস্কৃত হওয়ার অনেক আগেই তাঁদের শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো রচনা করে ফেলেছিলেন। অল্প বয়সে ‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাস পড়ে ভাবতাম, তাহলে রিজিয়া রহমান একজন নারী লেখক! ভাবতাম, কারণ সেরকম ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মত বাস্তবতা সেসময়টায় ছিল। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। আজ আর সেকথা বলবার উপায় নেই। এখন কিন্তু মনিরা কায়েস, শাহীন আখতার, নাসরীন জাহান, অদিতি ফাল্গুনী, সালমা বাণী, নাসিমা আনিস, রাশিদা সুলতানা, তানজিনা হোসেন, সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম, কামরুন নাহার শীলা, নাহিদা আশরাফী, ইশরাত তানিয়া, এরকম আরও রয়েছেন যাঁরা এখন লিখছেন, এঁদেরকে নারী বলে কোটারিচিহ্নিত করা যাবে না। এই অগ্রগতিটা আমাদের হয়েছে। হয়েছে এই স্বাধীন দেশে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে বিকশিত হওয়া বাংলা ভাষায় চর্চা করা আমাদের লেখকদের রচনারই বদৌলতে। কাজেই আমাদের সাহিত্য অন্তত পিছিয়ে নেই কোনোভাবেই সেকথা নিশ্চিতভাবেই বলা সম্ভব। হ্যাঁ, উপন্যাসের মত সাহিত্যশিল্প কিংবা প্রবন্ধের মত মননগভীর প্রকাশ এখনও তত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আমাদের ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়েছে তা হয়তো ততটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে সে-দুঃখবোধ থাকবে বলেও মনে হয় না। গবেষণার কথা যদি বলি, আপনি যে গবেষণা করবেন সেই প্রণোদনা বা সহায়তা আপনাকে দিচ্ছেটা কে! গবেষণা ঘরে বসে আরামকেদারার আরামে করা সম্ভব নয়। আমি চাইবো ভালো গবেষণা হোক কিন্তু সে-গবেষণা তো আকাশ থেকে লাফিয়ে পড়বে না। যাঁরা গবেষক যতটা সম্ভব নিজের শ্রম-অর্থ বা সীমাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানিক আয়তনের সাধ্যের দ্বারা তা চালিয়ে যাচ্ছেন। ধরুন, অমিয়ভূষণ মজুমদার বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তাঁর সাহিত্য নিয়ে সফল গবেষণা আমাদের দেশে হয়েছে, সোহানা মাহবুব রচনা করেছেন। তাঁর সে অভিসন্দর্ভটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থ সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। শওকত ওসমানের সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম নিয়ে অনীক মাহমুদ রচনা করেন অভিসন্দর্ভ। সমরেশ বসুর বিশাল উপন্যাসজগত গবেষণায় নিয়ে আসেন খোরশেদ আলম। বনফুলের সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা করেছেন মিজানুর রহমান খান। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে উচ্চাঙ্গের গবেষণাকর্ম করেছেন শামসুদ্দিন চৌধুরী। সম্প্রতি শহীদুল জহিরের ছোটগল্প বিষয়ে খানিকটা ভিন্নাঙ্গিকের গবেষণা করেন নিপা জাহান। মোস্তফা তারিকুল আহসানের কথা মনে পড়ছে যিনি সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। অনুপম হাসানের কথা মনে পড়লো। একজন গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক ‘বারো ঘর এক উঠোন’-খ্যাত জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী দীর্ঘকাল ঢাকা পড়েছিলেন অমনোযোগের তন্দ্রাচ্ছন্নতায় কিন্তু তাঁকে নিয়েও আমাদের দেশেই গবেষণা হয়েছে। কামরুন নাহার তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে রচনা করেছেন অভিসন্দর্ভ। সুমনকুমার দাশ কিংবা মোহাম্মদ শেখ সাদীর কথা বলা যাবে যাঁরা লোকসাহিত্য বা আমাদের লোককবিদের সাহিত্যকর্ম বিষয়ে চমৎকার গবেষণা করেছেন। সাদী শাহ আবদুল করিম এবং মনোমোহন দত্ত সম্পর্কে নিবেদিত গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেছেন। পাংখোয়া নৃগোষ্ঠিদের ওপর গবেষণা করেছেন শাওন ফরিদ। তসলিম মুহম্মদ ভাষাবিজ্ঞান, লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে এরিমধ্যে বেশ প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রেখেছেন। কমলকুমার মজুমদার বাংলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ লেখক। কিন্তু অনেক কাল আগে তাঁর সাহিত্য নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন এদেশেরই লেখক—রফিক কায়সার। গবেষণা একটা দারুণ পরিশ্রমের কাজ। আপনি প্রণোদনা দিন, বায়বীয় অনুপ্রেরণার পরিবর্তে বাস্তবিক সুযোগ তৈরি করে দিন গবেষকেরা সফল হওয়ার জন্যে কিন্তু প্রস্তুয়মান।
চিন্তাসূত্র
সমকালীন বাংলা সাহিত্যে কোন কোন কবি-কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক-গবেষককে আপনার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়?
মহীবুল আজিজ
এই চিন্তাসূত্রটা এমন তীব্র তীরের মত যখন আমি হয়তোবা চক্রে আবদ্ধ এবং আমার হাতে সময় কিংবা পরিসংখ্যানের অনেকটা দালিলিক নমুনা হাতের নাগালে নেই। স্মৃতিই একমাত্র অবলম্বন। স্মৃতি দারুণ প্রতারকও বটে। নাম ধরে ধরে বললে অবিরাম বলে যাওয়া যাবে। কিন্তু কৃত কাজ এবং কাজের ধারাবাহিকতা কিংবা কাজের মধ্যকার নিরবচ্ছিন্ন ধ্যানমগ্নতা এইসব বিবেচনাকে সামগ্রিকভাবে আশ্রয় করে কিছু কথা বা কারও কারও নাম নেওয়াই যায়। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এটিকে সকলেই চূড়ান্ত বলবেন তা-ও না। কিছু নাম এরিমধ্যে উচ্চারিত হয়েছে যাঁদের নামের উচ্চারণ ঘটেছে তাঁদের কাজের সূত্রেই। হাতের কাছে নেই কিন্তু আবু হাসান শাহরিয়ারের কথা বলতে পারি। আজকাল তাঁর কম লেখাই চোখে পড়ে যেমনটা ফরিদ কবিরের ক্ষেত্রে বলা যায় না। ফরিদ কবির এখনও যথেষ্ট কর্মতৎপর। ফরিদ কবির, জুয়েল মাজহার, মজিদ মাহমুদ, সোহেল হাসান গালিব বা আগে যাদের নাম করা গেল এঁরা সকলেই আরও সৃষ্টিশীলতার দৃষ্টান্ত নির্মাণ করবেন সন্দেহ নেই। হ্যাঁ, বয়স একটা মানদণ্ড বটে। একটা নির্দিষ্ট বয়োগণ্ডী পেরিয়ে যাওয়ার পর, অনেকেরই ধারণা সৃষ্টিশীল লেখক আর মেধা-প্রতিভার ঝলসানি প্রদর্শনে সক্ষম হ’ন না। অধিকাংশ স্ফূরণ অপেক্ষাকৃত কম বয়সের প্রতিক্রিয়াজাত। বলা মুশকিল। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া বয়সের ভারকে পরিপূর্ণ অবহেলায় সরিয়ে রেখে যে-নিষ্ঠা-একাগ্রতার প্রমাণ রেখে গেলেন তা বয়সে তরুণদের জন্যও অনুকরণীয়। সাইমন জাকারিয়া ‘প্রাচীন বাংলার বুদ্ধ নাটক’ গবেষণাকর্মটি যখন করেন তখন বয়সে তিনি নিতান্ত তরুণ। কিন্তু তাঁর চাইতেও বয়সে অগ্রগামী ব্যক্তির পক্ষেও এমন গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করা দুরূহ। বিভূতিভূষণ, শহীদুল জহির, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, উপন্যাস, ছোটগল্প, কথাসাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে অল্প বয়সে অনেকগুলো গবেষণাকর্ম করেছেন তাশরিক হাবিব। অল্প বয়সে গুরুগম্ভীর বিষয়ে গদ্য লিখেছেন দেখতে পাই ফজলুল কবিরী—লেখকের বুদ্ধিবৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে’। আরব দেশ নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন খালেদ হামিদী—প্রথমে ভ্রমণ কাহিনী এবং পরে উপন্যাস। রায়হান রাইনের কথা বলতে পারি। তাঁর গল্প-প্রবন্ধও গুরুত্বপূর্ণ। যথেষ্ট কম বয়সে ভালো কাজের স্বাক্ষর দেখতে পাই সেলিম মোরশেদ, অদিতি ফাল্গুনী, স্বকৃত নোমান , মোজাফফর হোসেন, মুম রহমান, কাজী রাফি এবং আরও অনেকের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই কিছুকাল আগে স্ব-পিতা সম্পর্কে লেখা একটি গদ্য পড়েছিলাম মুম রহমানের। কী শক্তি সেই লেখার! এমন লেখা যিনি লিখতে পারেন তাঁর কাছ থেকে আগামী দিনের সংহত উপন্যাস আশা করাই যায়। মাশরুর আরেফিন রচনা করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতবর্ষেও অনুবাদকর্ম বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। তাঁরা সুচিন্তিত-সুপরিকল্পিতভাবে সাহিত্যের অনুবাদকে একটা সফল কর্মযজ্ঞে পরিণত করতে পেরেছেন। এখানে অনুবাদ হয় বিচ্ছিন্ন টুকরো-টুকরোভাবে। এমনটা কী শোনা গেছে, একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান একজন ভালো অনুবাদককে একটি বিখ্যাত উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ অনুবাদের জন্যে সম্মানজনক সম্মানী দিয়ে কাজে লাগিয়েছেন। অথচ জি এইচ হাবীব আজ পর্যন্ত একা যে-কাজগুলো করেছেন সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে সত্যি কথা বলতে কি একটি গোটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সেরকম কাজ করা হয়ে ওঠে নি। হাবীবকে আমি একমাত্র বিখ্যাত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই তুলনা করতে পারি। আমি বরং খানিকটা কাব্যাশ্রয়ে বলি, তিনি আমাদের কার্ল ম্যানহাইম কিংবা গ্রেগরি রাবাসা। মার্কেজের বিখ্যাত উপন্যাস বা উমবার্তো একো’র উপন্যাস অনুবাদ করে তিনি কী পেয়েছেন। চাকুরি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এবং দুই/তিন পাতা পাদটীকা সংবলিত তথাকথিত গবেষণাপ্রবন্ধ –সহায়ক পদোন্নতিবঞ্চনা। তো ক্রাচে হেঁটে দৌড়ে বিজয়ী হওয়া যায় না। আজ পর্যন্ত যাঁরাই অনুবাদ করেছেন, সবটাই আত্মানুপ্রেরণায়। সে আপনি প্রয়াত কবি হুমায়ুন কবিরের অনূদিত জে আইজাক্স-এর সমালোচনাগ্রন্থ কিংবা হারুন রশিদ, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, মেহবুব আহমেদ, আলম খোরশেদ, অদিতি ফাল্গুনী যাঁর কথাই বলুন। জ্যোতির্ময় নন্দী, সফিকুন্নবী সামাদী অনেকদিন ধরেই অনুবাদকর্মের সঙ্গে যুক্ত। অতি সাম্প্রতিক মাহিন হকের কথা বলা যায়। বয়সে নিতান্ত অনতি হলেও তাঁর মধ্যে খুব ভালো সম্ভাবনা দেখতে পাই। অনুবাদকর্ম আমাদের দেশে একটা বিরাট অবহেলার শিকার, যেজন্যে আফসোস ছাড়া আপাতত করণীয় আর কিছু নেই। তবে সারা দেশে, দেশের নানা প্রান্তে লেখালেখি পত্রপত্রিকা-প্রকাশনা মৌলিক সাহিত্য অনুবাদ কিন্তু নিয়মিত-অনিয়মিত হয়েই চলেছে। এর মধ্য দিয়ে মেধা-প্রতিভার ঝলকানি যথাসময়ে দেখা দেবে সন্দেহ নেই। নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্যকর্মীরা তাঁদের শ্রমনিষ্ঠানির্ভর সাহিত্যকর্ম রচনায় ব্যাপৃত রেখেছেন নিজেদের। বাংলা পৃথিবীর এক শক্তিশালী ও সক্ষম ভাষা যে-ভাষার সৌন্দর্য ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বিদেশিরাই বলেছেন। ফার্গুসন, গ্রিয়ার্সন, ম্যাক্সমুলাররা আগেকার মানুষ—পূর্ববর্তী হানা প্রানেলত্রোভা, ডেভিড কফ, ক্লিন্টন বি সিলি, ডিমক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের উইলিয়ম রাদিচে, ভেলাম ভ্যান স্যান্দেল সকলেই বাংলা ভাষার সৌকর্য ও শক্তির উল্লেখ করেছেন। এমনকি আমাদের উপভাষাও যে কম সাহিত্য-সম্ভাবনাবাহী নয় তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি আমাদের সাহিত্যিক ও অনুবাদকদের সূত্রে। বরিশালের উপভাষায় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্সপিয়রের নাটকের অনুবাদ সম্ভব সেটা আমাদের অনুবাদক করে দেখিয়েছেন। মুহম্মদ মহসিন অনুবাদ করেছেন শেক্সপিয়রের নাটক বরিশাল-উপভাষায়। কাজেই পৃথক-পৃথকভাবে হওয়া নানা কাজকে একসঙ্গে মেলালে যে-সম্মিলিত ফল সেটি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। আজকে পশ্চিমবঙ্গে শাহযাদ ফিরদাউস উপন্যাসের ক্ষেত্রে যে-খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি খুব বেশি দিন আগে সেখানে স্থিত হ’ন নি। শুনেছি তিনি এদেশের খুলনা অঞ্চলের মানুষ। কিন্তু অভিবাসী হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। হরিপদ দত্ত আর এদেশে থাকেন না। এখানে নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা একটা ভীষণ কঠিন কাজ। অন্নের সংস্থানেই মানুষের নিত্যদিনের শ্রম-শক্তি অপচিত হয়ে যায়, লেখালেখি আর কখন করা যাবে। কিন্তু যখন দেখি বিদেশে বসবাসরত বাঙালিরাও বাংলা ভাষায় লেখাটাকে দায়িত্ব মনে করে লিখে চলেছেন অবিশ্রান্ত তখন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে আসে মাথা। মাসুদ খান, সাদ কামালী, কামাল রাহমান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল এরকম অনেকেই রয়েছেন যাঁরা অভিবাসী হয়েও ভাষাকে অভিবাসিত করেন নি। সব মিলিয়ে বলতে পারা যায়, হ্যাঁ, বইবে সুবাতাস! সবচেয়ে বড় কথা। এই দেশ মুক্তিযুদ্ধের মত বিরাট অর্জনের মাধ্যমে নিজের স্বকীয়তা ও সমৃদ্ধিকে গড়েছে কাজেই শেষ পর্যন্ত নির্ভর করতে হয় তারুণ্যেরই ওপর। ধরুন আজ বয়োপ্রাপ্ত হয়েছেন এক সময়কার মিনার মনসুর। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যে-ভীতি ও সন্ত্রাসের বাস্তবতা গ্রাস করেছিল সারা দেশকে সেই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দৃঢ়তার পক্ষে কবিতা লিখেছেন তিনি এবং এর পরিণামে ১৯৮৩ সালে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’। নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন কবিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতার প্রতিবাদে যখন পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ বৈরী। কামাল চৌধুরী, আসাদ মান্নান, অজয় দাশগুপ্ত, প্রয়াত শাহিদ আনোয়ার এঁরা লিখেছেন সেই সময়। যাহোক, সেই তারুণ্যের উত্তরাধিকার আমাদেরই। তাই হতাশা নয় বরং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাই পোষণ করা যায়।
চিন্তাসূত্র
সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ সম্পর্কে আপনি কেমন ধারণা পোষণ করেন? ওয়েবম্যাগের গতিপ্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
মহীবুল আজিজ
একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম ১৯৯৯/২০০০ সালের দিকে। একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলাম বাংলাদেশের ছোটগল্প বিষয়ে, যেটি পরে ‘গণশক্তি’তে ছাপা হয়েছিল কয়েক কিস্তিতে। সেই সেমিনারে ছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জ্যোতির্ময় ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ, লোপামুদ্রা মিত্রসহ অনেকেই। সেখানে আলোচনা প্রসঙ্গে সুনীল বলেন, কাগজের বইপত্র আর থাকবে না, উঠে যাবে। বৈদ্যুতিন পাঠ-পঠন সেই জায়গা দখল করে নেবে। আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। পরে, ভোজন-বিরতিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, দেখুন কথাটা বলেছিলাম খানিকটা দুঃখবোধ থেকে। মুদ্রিত বইয়ের পাঠক আগের চাইতে কমে যাচ্ছে মানে, সিরিয়াস সাহিত্যের পাঠেই কমে যাচ্ছে। এখন সেই থেকে আজ ন্যূনপক্ষে দুই দশককাল পরে এসে দেখা যাচ্ছে ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন, অনলাইন পোর্টাল মানে বৈদ্যুতিন ভুবনের এক বিশাল আয়তন গড়ে উঠেছে সারা বিশ্বে এবং বাংলাদেশেও। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনা মুদ্রিত হওয়ার যথেষ্ট আগে পড়তে পারা যাচ্ছে ওয়েব-পৃষ্ঠায়। বিশেষ করে এটা বলা যায় সাম্প্রতিক করোনাবরুদ্ধ কালে ওয়েব জগতের জনপ্রিয়তা ও কার্যকারিতা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর ইতিবাচকতাই প্রমাণিত হয়েছে। কখন কাগজ হাতে এসে পৌঁছাবে আর আমরা সেটা পাঠ করবো সে-বিবেচনায় মানুষ আর অপেক্ষা করছে না। তার আগেই ওয়েবপৃথিবীতে ঘটে যাচ্ছে প্রভূত আলোড়ন। তাছাড়া ওয়েবে এক ধরনের স্বাধীনতা বা বন্ধনহীনতার আমেজ পাওয়া যায়। তবে ওয়েবের জগতে নৈরাজ্যের সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবকিছুরই ভালো-মন্দ দিক আছে। অবলম্বনকে কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে মূল ব্যাপার হলো সেটাই। ধরুন ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ‘থ্রাশ পোয়েট্রি জার্নাল’ ‘লোথলোরিয়েন পোয়েট্রি জার্নাল’ ‘সেতু বাইলিংগুয়্যাল জার্নাল’ ‘অগ্নি’ এরকম অসংখ্য ওয়েবম্যাগের কথা বলা যায়। এসব ওয়েবম্যাগের অনেকগুলোরই রয়েছে যুগপৎ বৈদ্যুতিন ও মুদ্রিত সংস্করণ। আবার কেবল ওয়েবম্যাগ হিসেবেও অনেকগুলো কেবল জনপ্রিয়ই নয়, বরং ট্রেন্ডসেটার হিসেবে স্বীকৃত। কাজেই আসল বিষয়টা হচ্ছে পাঠকের কাছে পৌঁছানোটা। ‘চিন্তাসূত্র’, আমার যতটা মনে পড়ে ২০১৫ সাল থেকে ওয়েবম্যাগ হিসেবে কাজ করে চলেছে। মূলত সাহিত্যের হলেও শিল্পসংস্কৃতি বিতর্ক-আলোচনা, অডিও-ভিডিও ইত্যাকার সমস্ত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ‘চিন্তাসূত্র’ একটি সৃজনভাবনাবান্ধব প্রতিবেশ সৃষ্টি করেছে। এটি যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন প্রকৃত ওয়েবম্যাগের সংখ্যা অপ্রতুলই ছিল যা এখন পরিমাণে বেড়েছে। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যাগত বাস্তবতার চাইতেও গুণগত বাস্তবতার ওপর মানুষ অধিক আস্থাশীল। এই আট বছরে ‘চিন্তাসূত্র’ সেই আস্থা অর্জন করেছে বলেই বিশ্বাস করি। একটা জিনিস ওয়েবম্যাগের মাধ্যমে প্রমাণ করা গেছে, ওয়েবে কোনো কেন্দ্রিকতা নেই আছে গোটা বৃত্ত। এখানে রাজধানির লেখক আর মফস্বলের লেখক বলে কিছু নেই। খানিকটা আত্মপ্রচারণা তবু বলি, সাহস করে জাঁদরেল কবি-সম্পাদক স্ট্রাইডার মার্কাস জোন্স-এর ‘লোথলোরিয়েন পোয়েট্রি জার্নাল-এ লেখা পাঠাই যেটি মুদ্রিত কাগজে হলে নানা ঝকমারির সম্মুখীন হতে হতো। লেখা ডাকে পাঠানো, তারপর দীর্ঘকালীন অপেক্ষাপর্ব এবং শেষে লেখা ছাপানো বা না-ছাপানো। এখন ওয়েবজার্নালে যোগ্য হলে দ্রুতই লেখা ছাপা হয় এবং সেই একই লেখাই মুদ্রিত হয় পুস্তকাকারে। আমার ১০/১২টি কবিতা মার্কিন দেশে মুদ্রিত হয়েছে ওয়েব পোয়েট্রি জার্নালে। আমাদের দেশে ওয়েবম্যাগে প্রচুর ভালো কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ পাঠ করবার সুযোগ পেয়েছি। বলতে পারি ওয়েবম্যাগের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
চিন্তাসূত্র
আমাদের দেশে পুরস্কার নিয়ে অনেক রকম কথা শোনা যায়। কেউ কেউ বলছেন, পুরস্কারের সঙ্গে নগদ অর্থ না থাকলে তার মূল্য নেই, আপনি কী মনে করেন?
মহীবুল আজিজ
একটা মজার ঘটনার কথা মনে পড়লো। আমার স্ত্রী ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করলে তাঁকে একটি স্বীকৃতি-সনদপত্র দেওয়া হয়। সেটা দেখতে এমনই নিরাভরণ যে আমাদের দেশের ভড়ংসর্বস্ব বকোয়াজরা মন্তব্য করবে, এ কেমন সার্টিফিকেট যে কোনো ঔজ্জ্বল্য-চাকচিক্য নেই, নেই চোখঝলসানো উদ্ভাসন। কিন্তু যে-আভিজাত্য আর গুরুত্ব সেই সাদামাঠা কাগজটিতে গাঁথা সেটিকে আপনি এড়াতে পারবেন না। অর্থাৎ বহিরঙ্গ চাকচিক্য নয়, অন্তর্গত মহিমাটাই মূল বিষয়। এখন কথা হলো, সাহিত্যের মূল্য-নিরূপণে সৃজনশীলতার স্বীকৃতিতে অর্থের অনিবার্য সম্পৃক্ততার কথা উঠছে কেন? পুরস্কার কে দিচ্ছে, বিচারের কাজটা কতটা গুরুত্ব সহকারে এবং কোন্ বিবেচনায় হচ্ছে সেটাই ধর্তব্য। ১৯৮১/৮২ সালে সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টুকিটাকি সাহিত্য সংসদ’ দেশব্যাপী একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। যতদূর মনে পড়ে, রেজানুর রহমান এবং তাঁর সঙ্গে আরও অনেকেই এটির পরিচালনায় ছিলেন। নাম শুনে মনে হতে পারে ‘টুকিটাকি’—এ আবার কেমনতরো নাম! কিন্তু দেখুন সেখানে ছোটগল্পের বিচারক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। আমি যখন দেশসেরা ছোটগল্পের বিচারকের পুরস্কার পেলাম (এবং তখন আমি সাহিত্যের স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছি।) সত্যি বলতে কি আমি ‘ওভার দ্য মুন’। জ্বরের প্রকোপ থাকায় পুরস্কার-অনুষ্ঠানে যেতে পারি নি আমি কিন্তু আমার অত্যন্ত ভালো লেগেছিল আয়োজকদের আন্তরিকতাকে। তাঁরা, রেজানুর রহমান এবং আরও দু’জন সম্ভবত ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আমার ২০৫ নং ঘাটফরহাদবেগস্থ বাসভবনে এসে পুরস্কারের সনদপত্র, বই (হয়তো প্রাইজবন্ড ছিল, ঠিক মেন পড়ে না) আমাকে অর্পণ করেন। এটা ভুলতে পারি না, সেই পুরস্কারের বইয়ে হাসান আজিজুল হকের গল্পগ্রন্থ, আহসান হাবীবের কাব্যগ্রন্থ কি সৈয়দ হকের উপন্যাস এইসব মূল্যবান বই ছিল যা আমার নিকটে প্রভূত অর্থের চাইতেও গুরুত্ববহ মনে হয়েছিল। পুরস্কারের কথা যখন উঠলোই তখন এটাও বলতে পারি, কোনো পুরস্কারের বিচারক যেমন মানের হবেন পুরস্কার-প্রাপ্তরাও তেমন মানেরই হ’ন। আহমদ ছফাকে এই দেশের বিচারকেরা পুরস্কারের যোগ্য ভাবেন নি কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে এমফিল পিইচডি প্রবন্ধ ইত্যাদি হয়েই চলেছে। এটাকে কী বলা যাবে, মকারি না! আবার, যেসব ব্যক্তি বৃহৎ বলে কথিত পুরস্কারে অলংকৃত হয়েছিলেন তাঁরা এমন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন যে তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। তাই কথা হচ্ছে, পুরস্কার যে-বিচারকেরা দিচ্ছেন তাঁদের গুরুত্বের ওপর পুরস্কারের গুরুত্ব নির্ভর করে। কখনও শুনেছেন বুকার পুরস্কার প্রাপ্তদের নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। সেখানে শর্টলিস্টে থাকা প্রত্যেককেই পুরস্কারের যোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ তালিকাটি যথেষ্ট পঠন-পাঠন ও অভিনিবেশ সহকারে প্রস্তুত করা হয়। বুকারের কথা যখন উঠলোই তখন খানিকটা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করি। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত আমি ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়াধীন অবস্থানে বসবাস করি। আমার স্ত্রী ছিলেন ক্লেয়ার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। আমরা যখন যাই হলেও প্রেসিডেন্ট ছিলেন এ্যান্থনি ল’। তাঁর পরে হলেন জিলিয়ান বিয়ার, ১৯৯৪ সালে। এখনও বেঁচে আছেন, ৮৮ বছর বয়স। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। ইন পরে ‘ডেইম’ উপাধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালের ক্রিসমাসে যখন অনেকেই ছুটি আর উৎসব কাটাতে বাড়ি চলে যায় তখন হল কেন গোটা কেম্ব্রিজটাই ফাঁকা হয়ে যায়। তো হল-কর্তৃপক্ষ বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্যে ক্রিসমাস পার্টির আয়োজন করে যাতে তারা ‘লেফ্ট্ আউট’ অনুভব না করে। সেখানেই আমার সুযোগ হয় হলের প্রেসিডেন্ট জিলিয়ানের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গল্প/আড্ডা এসবের। এ্যান্থনি ল’-এর সময় ক্লেয়ার হলের ‘ট্যানার এ্যান্ড এ্যাশবি লেকচারে’ এসেছিলেন নাইজেরিয়ার চিনুয়া এ্যাচেবে এবং ইতালির উমবার্তো একো। আমার পরম সৌভাগ্য, চিনুয়ার সঙ্গে অনেকটা সময় কাটানোর সুযোগ আমার হয়েছিল এবং সেসব নিয়ে আমার লেখালেখিও আছে। কথাপ্রসঙ্গে জিলিয়ান আমাকে বলেন, তোমার দৃষ্টিতে সামনের বছর কাকে আনা যায় ‘ট্যানার এ্যান্ড এ্যাশবে লেকচারের’ জন্যে। আমি বললাম, ডোরিস লেসিং কিংবা এ্যালিস মুনরো’কে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। সেটা ১৯৯৫ সাল মানে আজ থেকে ২৮ বছর আগেকার কথা। তারপর ১৯৯৭ সালে আমি ফিরে আসি দেশে। ক্লেয়ার হলের নিয়মিত প্রকাশনা থেকে দেখলাম ডোরিস এসেছিলেন তাঁদের আমন্ত্রণে বক্তা হয়ে। মজার কথা, ডোরিস এবং এ্যালিস দু’জনেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান পরে। জিলিয়ানের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধের আরও কারণ ছিল। তাঁর সঙ্গে আলাপকালে আমার ধারণা হয় তিনি একজন সর্বগ্রাসী ও গুরুত্বপূর্ণ পাঠক। ‘রিডারশিপ’ কথাটা তাঁর জন্যে শতভাগ প্রযোজ্য। একজন ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গী জিলিয়ান, সুন্দরীও বটে। সেই সুন্দর ছিল মননস্ফটিকে উদ্ভাসিত। আলাপকালে তিনি এনগুগি, চিনুয়া, আর কে নারায়ণ, টুটুওলা, বেন ওকরি এঁদের সহিত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলছিলেন। যাঁদের প্রশংসা করছিলেন তাঁরা একসময়কার ব্রিটিশ উপনিবেশিত জগতের প্রতিনিধি। কিন্তু জিলিয়ানের মধ্যে কোনো প্রিজুডিস লক্ষ করি নি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে গেল ১৯৯৭ সালের একটি ঘটনায়। সে-বছরই আমি চলে আসি দেশে। আসবার আগে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। আমাকে শুভ কামনা জানান তিনি। সে-বছরেই বুকার পুরস্কারের জুরি-কমিটির তিনি প্রধান হিসেবে নিযুক্তি পেলেন। মনে-মনে ভাবলাম নিঃসন্দেহে যোগ্য ব্যক্তিই পুরস্কৃত হবেন। হ্যাঁ, শর্টলিস্টের সকলেই সমান যোগ্যতাসম্পন্ন। বিজয়ী হলেন ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-রচয়িতা অরুন্ধতী রায়। পরে পুরস্কার এবং অরুন্ধতী ও অন্যদের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য শুনে বুঝতে পারি বিচারকের কাজটি কতটা সূক্ষ্ম ও দায়িত্বপূর্ণভাবে বিচারকেরা করে থাকেন। সেই সমান্তরালে আমাদের দেশের বৃহৎ পুরস্কারসমূহের বিচার-পদ্ধতি বা বিচারকদের নিয়ে মন্তব্য করবার রুচিই আমার হয় না। যে-পুরস্কার আহমদ ছফা পান না, যে-পুরস্কার শহীদুল জহির পান না, নে-পুরস্কারের মাহাত্ম্য নিয়ে আপনারা মুখে ফেণা তুলে ফেলতে পারেন কিন্তু আমি সেসব নিয়ে কথা বলতে ন্যক্কার বোধ করি। আপনি বিচারক মহোদয়কে বলুন, যাঁকে আপনি বা আপনারা পুরস্কৃত করছেন তাঁর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সন্দর্ভ লিখুন। তাঁর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিষয়ে আলোকপাত করে রচনা করুন আপনার/আপনাদের মেধা-মননের প্রতিফলনজাত মূল্যবান পর্যালোচনা। তাহলে যিনি পুরস্কৃত হলেন তিনিও সম্মানিত বোধ করবেন এবং পাঠকেরাও তাঁর গুরুত্ব-অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। যে-বিচারকেরা সক্রেটিসকে অভিযুক্ত করেছিলেন সে-বিচারকদেরই আসামী করে রায় দেন ইনভেস্টিগেশন জার্নালিস্ট আই এফ স্টোন। পড়ুন তাঁর বই ‘দ্য ট্রায়াল অব সক্রেটিস’। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয় গ্রন্থটি। গ্রিসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত আড়াই হাজার বছর আগেকার সেই বিচার-অধ্যায়টির পুনরায়োজন করেন স্টোন এবং তাতে সক্রেটিসকে দায়মুক্ত করা হয় দালিলিক প্রমাণ-সহযোগে। আর এর অর্থ হলো মহাকালের প্রেক্ষাপটে ঐ বিচারকেরাই পরিণত হলেন আসামীতে। কাজেই বিচারকের কাজটি সকল অর্থেই মূল্যবান দায়িত্বপূর্ণ এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি কাজ। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, এদেশের অনেক উচ্চাবস্থানের পুরস্কার সম্পর্কে এমন সব এ্যানিকডোটস্ আর কেচ্ছা কানে আসে যে, এসবকে এখন ‘মকারি’ বলেই মনে হয়। আমি আশা করবো, এসব এ্যানিকডোটস্ মিথ্যে হবে, অমূলক হবে। কথা হলো, এসব কেচ্ছা তৈরি হবে কেন? আর পুরস্কারের ক্ষেত্রে অর্থই বা এতটা গুরুত্বের হবে কেন? একটা দৃষ্টিনন্দন (রঙচঙে নয় অবশ্য) ক্রেস্ট, একটি প্রমাণপত্র আর অভিজ্ঞানপত্র হলেই তা যথার্থ বলে প্রতীয়মান হবে। প্রকৃত লেখক পুরস্কার নিয়ে ভাবেন না, সেটা ভাবেন পুরস্কারদাতারা। কাদের পুরস্কার দিলে যেটি যথার্থ বলে পরিগণিত হবে, কাদের দিলে তা যোগ্যের প্রাপ্য বলে বিবেচিত হবে সেটা ভাববার দায়িত্ব পুরস্কারদাতাদেরই।
চিন্তাসূত্র
কারও কারও মতে, পুরস্কার দেবে বড় বড় নামিদামি প্রতিষ্ঠান, ছোট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেওয়ার পুরস্কারকে তারা গুরুত্বহীন বলছেন। এই বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
মহীবুল আজিজ
পুরস্কার হলো অনারবোর্ডে একটা নাম থাকার মতন। সেই বোর্ডে অমিয়ভূষণের নাম থাকলেই কী, না থাকলেই কী। কমলকুমারের নাম থাকলেই কী, না থাকলেই কী! থাকলে সেই বোর্ডটার সম্মান বাড়ে। আমি যখন আমাদের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন নির্বাচিত হলাম আমি কী ভেবেছিলাম জানেন, আমি এটা ভাবিনি, আরেব্বাস, আমি যে মহাপণ্ডিত বা মহাধিকারিক হয়ে গেলাম! আমি ভাবলাম, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আনিসুজ্জামান স্যার, মোহাম্মদ আলী স্যার, মনিরুজ্জামান স্যার এ-অনুষদের ডিন হিসেবে এককালে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমার দায়িত্ব হযে পড়লো, সেই একই আসনে আমি যাতে আমার সেই মহান পূর্বসূরিদের মান-মর্যাদা বজায় রেখে চলতে পারি সেই লক্ষ্যে নিজেকে চালিত করা। বড় প্রতিষ্ঠান, ছোট প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি উদ্যোগ বলে কিছু নেই। নোবেল পুরস্কার তো বুকারের চেয়ে বড়, তাই না? কিন্তু দেখুন নোবেল নিয়েও নানা বিতর্ক হয়, কিন্তু বুকার নিয়ে হয় না। নোবেল-লরিয়েটদের নাম ধরেই বলা যাবে কত অযোগ্য সাহিত্যিককে বিশেষ বিবেচনায় নোবেল দেওয়া হয়েছিল। বুকার এক্ষেত্রে নোবেলের চেয়ে অগ্রবর্তী। কথা হচ্ছে পুরস্কারদাতা কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি সঠিকভাবে তাঁর/তাঁদের বিচারের কাজটি করতে পারলেন কি না। আর বিচারক কাকে করা হবে। যাঁর মেধা অত্যন্ত গড় মানের যাঁর তেমন কোনো সাহিত্যিক/সৃজন-মননশীল যোগ্যতা নেই, যিনি হয়তো বড় প্রতিষ্ঠানের আধিকারিক, তিনি কী করে উচ্চমান ও প্রতিভাসম্পন্ন রচয়িতার সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন বা বিচার করবেন! একটি ক্ষুদ্র (তর্কের খাতিরে ধরা যাক) প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যদি সর্বজনগ্রাহ্য সত্যিকারের যোগ্যকে পুরস্কৃত করতে সক্ষম হ’ন তাহলে বৃহৎ বলে কথিত প্রতিষ্ঠানের অন্যায্য বিচারের চেয়ে সেইটিই মানুষের কাছে আদরণীয় হয়ে উঠবে। যেটা একটু আগেই বললাম, নোবেল নিয়ে হৈচৈ যতই হোক, সাহিত্যের প্রকৃত পুরস্কারের বিবেচনায় বুকার এগিয়ে। এরকম পুরস্কার বিশ্বে আরও রয়েছে। তাই বড়ত্ব-ছোটত্ব এসব ছেঁদো কথা।