[মনি হায়দার গল্পকার। বসবাস করেন গল্পের আখ্যান ও গল্পের চরিত্রের সঙ্গে। জীবনকে অজস্র কৌণিক বিন্দু থেকে দেখা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা তার সার্বভৌম। পরিবারে জন্মতারিখ লিখে রাখার প্রচলন ছিল না, সনদ অনুসারে জন্ম ১ মে ১৯৬৮ সালে, ভাণ্ডারিয়া, পিরোজপুরে। পিতা: তবিবুর রহমান, মাতা: ফজিলাতুন নেসা পুষ্প। স্কুলে পড়ার সময়, ১৯৮২ সালে মাত্র তিরানব্বই টাকা সম্বল নিয়ে তিনি চলে আসেন ঢাকায়। সঙ্গে ছিল দুটি শার্ট, একটি প্যান্ট। লেখক হওয়ার তুমুল সংগ্রামে কখনো তিনি রাজনৈতিক দলের অফিসের পিয়ন ছিলেন, কখনো বিজ্ঞাপন সংগ্রাহক কখনো বা বাংলাদেশ বেতারে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেছেন। বাদ যায়নি টিউশনিও।
এ কথাকার গল্প লিখছেন প্রায় তিন দশক যাবত। গল্প, উপন্যাস, শিশুতোষ, সম্পাদনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় একশ বই। প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ হচ্ছে: পঞ্চাশ গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, প্রকৃত নায়ক, এক ঝাঁক মানুষের মুখ, ইতিহাসের বেলিফুল, থৈ থৈ নোনাজল, আঠারো বছর পর একদিন, একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠকের পর, একজন নারী তিনজন পুরুষ ও একটি চুলের গল্প, ন্যাড়া একটি বৃক্ষ, ঘাসকন্যা, ইলিশের মাংস, জিহ্বার মিছিল, মনি হায়দারের গল্প, রক্তাক্ত গ্লাসের গল্প, ফ্যান্টাসি, গল্পগাথা।
বর্তমানে কাজ করছেন বাংলা একাডেমিতে। লেখালেখির পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি টেলিভিশন জিটিভিতে শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন নিয়মিত। টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে বেশ কয়েকটি নাটক।
লেখালেখির স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮, ২০১৯), শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (২০১৯), বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার (২০২১)। তবে মনি হায়দার মনে করেন পাঠকের ভালোবাসাই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শফিক হাসান।]
শফিক হাসান : আপনার গল্প লেখার শুরু কখন, কিভাবে?
মনি হায়দার : গল্প! আমার তো মনে হয়, আমি জন্ম নিয়েই গল্প লিখতে শুরু করেছি। আমি বলতে চাইছি, মানুষের জন্মটাই গল্পের ভেতর দিয়ে। নারী-পুরুষের ভালোবাসা বা প্রেম বা শরীরের সংগ্রাম সবই তো গল্পের বাসভূমি থেকে উৎসারিত। ওই সব ঘটনা অনানুষ্ঠানিক। যদি অনানুষ্ঠানিকভাবে বলি, আমি গল্প লিখতে শুরু করি প্রায় শৈশব থেকে। যতদূর মনে পড়ে এইটে বা নাইনে পড়ার সময় প্রথমে গল্প লিখি। অবশ্যই ছোটদের গল্প। কীভাবে গল্পের জগতে প্রবেশ করেছিলাম; তাও গল্পের আখ্যান। আমাদের বাড়িতে, সেই অজপাড়াগাঁয়ে, বলছি আমি আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ঘটনা। আমার বাবা তবিবুর রহমান, মা ফজিলাতুন নেসা পুষ্প বই পড়তেন। শরৎচন্দ্রের অনেক বই আমাদের বাড়িতে ছিল। ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসটি আমি সেই সময়েই পড়েছিলাম। আমার বড় ভাই রুহুল আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তারও পড়ার অভ্যাস ছিল। গানও লিখতেন। তো তিনি বাড়িতে এক ট্রাঙ্ক বই এনেছিলেন; গল্প, উপন্যাস। আমি দোতলার খাটের নিচে সেই বই আবিষ্কার করে পড়তে থাকি। সেই সময়েই আমি বড়দের অনেক বই পাঠ করেছি। সেই সব বই পাঠ করতে করতে আমার ভেতরে জেগে ওঠলো এক সৃজন সত্তা, সেই সত্তা আমাকে বলল, তুমিই লিখতে পারো। আমি একদিন রুল টানা লম্বা খাতা নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে; একটা প্রলেতারিয়েত মার্কা গল্প লিখেছিলাম। তো সেই শুরু; বরিশালের পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার পশ্চিমপ্রান্তে কচানদীর পাড়ে বোথলা গ্রামের এক নির্জন বাড়িতে আমার লেখার অঙ্কুর উদগম হয়েছিল… হয়তো সকালে, নয়তো বিকেলে, অথবা রোদজ্বলা দুপুরের কোনো এক সময়ে।
শফিক হাসান: গল্প লেখেন কেন?
মনি হায়দার : আগেও বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে আমাকে এই প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি উত্তর দিয়েছিলাম, গল্প না লিখে উপায় নেই আমার, তাই গল্প লিখি। একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে চারদিকে বিরামহীন গল্পের আসা-যাওয়া দেখি। গল্পেরা আমার সঙ্গে দিনরাত গল্প করে। চারপাশে এত এত গল্প দেখি, গল্পের জলে বাস করি, গল্পের নাচ দেখি, মগ্ন ঝগড়া দেখি, গল্পের মান অভিমান দেখি, ফলে আমার ভেতরে এক ধরনের সৃজন গীত তৈরি হয়। একটা নাড়া খাওয়া এক ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে নিপতিত হই, সেইসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া জন্য গল্প আমাকে বাধ্য হয়ে লিখতে হয়। গল্প না লিখলে আমি ঘুমুতে পারি না। গল্প না লিখলে গল্পেরা অভিমান করে আদুরে প্রেমিকার মতো। অনেক সময়ে আমাকে গলা টিপে হত্যা করতে আসে। এতকিছুর পরও যদি গল্প না লিখি গল্পেরা সাপের ফণা তুলে আমার দিকে ধেয়ে আসে, আমি বাধ্য হই লিখতে। গল্প লেখার পরই পাই মুক্তি। আহ কী আরাম, কী আনন্দ! কী সুখ। এইসব সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর সঙ্গে বাস করার জন্য আমি গল্প লিখি। গল্পের সঙ্গে আমার ঘর গৃহস্থালি।
গল্পের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়, মানুষের জীবন, গল্পেরই জীবন। গল্প ছাড়া মানুষের জীবন ভাবাই যায় না। প্রতিটি মানুষের জীবনে শত শত নয়, হাজার হাজার গল্প আছে। একজন মানুষ এক জীবনে তার গল্প লিখে শেষ করতে পারবে না। আমি, আমার এই সামান্য জীবনে যত গল্পের মালিক, সব গল্প তো পাঠকদের জন্য লিখে যেতে পারব না। সময় ও সুযোগ আমাকে আটকে রেখেছে। আমার মতো অন্য গল্পকারদেরও আটকে রাখছে। বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য গল্প লেখা জরুরি, খুব জরুরি।
শফিক হাসান : কী ধরনের বিষয় নিয়ে গল্প লিখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
মনি হায়দার : শফিক হাসান, আপনাকে পাল্টা প্রশ্ন করি, গল্পের কি নির্দিষ্ট ধরন থাকে? ধরুন, একটা ধরন আমাকে ধরিয়ে দিলেন, বললেন, আপনি কেঁচো নিয়ে গল্প লিখুন। বলেই কিন্তু আপনি একজন সৃজনশীল গল্পকারকে আটকে দিলেন সীমাবদ্ধ সীমায়। যখন একজন গল্পকার সীমার দেয়ালে আটকে যাবেন তিনি কি লিখতে পারবেন? আমি নিশ্চিত, লিখতে পারবেন না।
সতরাং ধরন-ধারণ বাদ দিন। বিষয়, গল্প লেখার বিষয়ের কি অভাব আছে অন্তত দারিদ্র্যপীড়িত, ক্ষমতালিপ্সায় তাড়িত একদল পঙ্গপাল মানুষের লম্ফঝম্ফ দেখে, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে যখন দেখি রক্ত, কাটা মুণ্ডু, হাসে বীভৎস, দেশের হাজার হাজার তরুণ বৃদ্ধ নর-নারী শিশু যখন ভিন দেশের সাগরের বুকে তড়পায়, আমার বোন ফেলানী যখন সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝোলে রক্তাক্ত; তখন কি একজন প্রকৃত গল্পকারের গল্পের বিষয়ের অভাব হয়?
ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষের মনের আয়নাটা ধরতে চাই। একজন মানুষ সুটেট বুটেট, যাচ্ছে হেঁটে চমৎকার। যে কেউ দেখলে ভাববে, মানুষটি দারুণ সুখী। আসলে কি সুখী? কিংবা বয়ে বেড়ায় টন-টন সুখ? আমি একজন লেখক বা গল্পকার হিসেবে ওই মানুষটিকে আমার গল্পের কলকব্জায় নিয়ে আসি, তাকে ব্যবচ্ছেদ করি, দেখতে ও দেখাতে চাই; আমরা সোজা চোখে যা দেখি, সেই দেখা ঠিক না। দেখার মধ্যেও প্রচুর অদেখা থেকে যায়। দেখা ও অদেখা, জানা ও অজানা, মন ও জানালা, পাথর ও ফুল, কাঁটা ও রক্ত আমার গল্পের বিষয়।
শফিক হাসান : পাঠকদের ওপর আপনার গল্পের প্রভাব কেমন?
মনি হায়দার : পাঠকরা পড়ে, দেখা হলে জানান দেয়, কিংবা ফোনে বলেন গল্প পাঠ শেষে তাদের প্রতিক্রিয়া। সব সময়ে পজিটিভ হয়, তাও না। তবে যখন কোনো কোনো পাঠক প্রশ্ন করেন, ওই গল্পটা ওভাবেও শেষ না করলে পারতেন। আরে বাবা, গল্প লিখি আমি, গল্পের আখ্যান ভাবি আমি, আমিই আমার গল্পকে কোথায় নিয়ে যাব নাকি রসগোল্লা খাইয়ে বাসে তুলে দেব সেটা আমার ব্যাপার। তুমি, দেখো গল্পটা শিল্পসম্মত হয়েছে কিনা? দেখো, এই তোমার জীবনের বারান্দায় দোল খায় কিনা!
তো এই সব ঘটনার মাঝে পাঠকদের উপর একটা প্রভাব তো পড়েই। নইলে লেখার জন্য প্রেরণা আসবে কোত্থেকে? সব কিছুর উপরে পাঠক সত্য তাহার উপরে নাই।
শফিক হাসান : গল্প লেখার সার্থকতা খুঁজে পান?
মনি হায়দার : গল্প লেখার সার্থকতা বলতে কী বোঝায়, আমাকে পরিষ্কার করে বলবেন? আপনি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যাবেন, যাওয়ার জন্য আপনাকে তো যাত্রা করতে হবে। যাত্রা না করেই যদি বলেন, আমি পৌঁছাতেই পারলাম না। নিট ফলাফল কী দাঁড়ায়? আপনি কখনই যেতে পারবেন না। একজন গল্পকার বা কথাসাহিত্যিকের কাছে লেখার সার্থকতা বহুমাত্রিক চৈতন্যের বসতবাড়ি।
গল্পকার যদি গল্প লেখার সার্থকতা নিজের মধ্যে না পান বা আবিষ্কার করতে না পারেন, তিনি লিখবেন কী করে? আর কেনইবা লিখবেন? মূলত একজন গল্পকারের গল্প লেখার ভেতরই সার্থকতা বহুলাংশে নির্ভর করে।
শফিক হাসান : আপনার প্রথম দিককার কয়েকটি গল্পবইয়ের নাম বলবেন!
মনি হায়দার : প্রথম থেকে আমার বারোটা গল্পের বইয়ের নাম বলি। বইগুলো হচ্ছে; এক ঝাঁক মানুষের মুখ, প্রকৃত নায়ক, ন্যাড়া একটি বৃক্ষ, একজন নারী তিনজন পুরুষ ও একটি চুলের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, থৈ থৈ নোনাজল, আঠারো বছর পর একদিন, একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠকের পর, ইতিহাসের বেলিফুল, ঘাসকন্যা, ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ ও অন্যান্য গল্প। এরপরও আরও কয়েকটি গল্পবই প্রকাশিত হয়েছে। কথাপ্রকাশ বের করেছে আমার ‘পঞ্চাশ গল্প’।
শফিক হাসান : বইগুলোর মধ্যে কোন বইটা আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য বা প্রিয়?
মনি হায়দার : প্রতিটি গল্পের বই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অনিবার্যভাবে প্রিয়। আবার প্রিয়’র মধ্যেও আরও প্রিয় কোনটি, এই প্রশ্নে আমি বলতে চাই, কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘ঘাসকন্যা’ ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত ‘থৈ থৈ নোনাজল’, নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘১০ জানুয়ারী ও ১৯৭২ ও অন্যান্য গল্প’ আমার প্রিয় থেকে প্রিয়তর গল্পগ্রন্থ। এ বইগুলোর অধিকাংশ গল্প, গল্পের আখ্যান খুব সংহত। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে পারি, আমি এ বইয়ের গল্পগুলো খুব চিন্তা ও পরিকল্পনা করে লিখেছি। ফলে যে কোনো পাঠক গল্পগুলো থেকে আমাকে খুব নিবিড়ভাবে আবিষ্কার করতে পারবে।
শফিক হাসান : সব গল্প কি আপনার প্রিয়?
মনি হায়দার : একজন গল্পকারের সব গল্প প্রিয় হয় না, নানা কারণেই হয় না। এক সময়ে যে গল্পটি গল্পকারের খুব প্রিয় হয়, সময় বা রুচির কারণে সেই গল্পটি পছন্দের তালিকায় নাও থাকতে পারে। মানুষের মন যেমন বিচিত্র পছন্দ, অপছন্দের তালিকা আরও বিচিত্র। আর লেখককের মন তো আরও অস্থির, স্থির থাকে না কোথাও ক্ষণকাল; সময়ের সঙ্গে, স্রোতের সঙ্গে বা বিপরীতে কেবল বহিয়া যায় অবিরাম।
এইসব দ্বৈত অদ্বৈত চেতনার কারণে; না, আমার লেখা সব গল্প আমার কাছে প্রিয় নয়। আবার আমার কাছে যেসব গল্প প্রিয়, দেখেছি অনেক পাঠকের কাছে সেটা প্রিয় নয়, আমার কাছে দুর্বল গল্পটাই তার কাছে অধিকতর প্রিয়। পাঠকদের নিজস্ব মতামত, রুচি, সৌন্দর্যবোধ, গল্প মন্থন করার আবেগ, ইন্দ্রিয় ঘ্রাণ, লেখাপড়ার দৌড়, জানার ইচ্ছের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমার কাছে আমার লেখা বেশ কয়েকটা গল্প প্রিয়। যেমন; ঘাসকন্যা, রক্ত মাংসের মানুষ, মন সংক্রান্তি, রক্ত ও রূপান্তরের গল্প, তিমিরেরও তিমির, স্পর্শ, পাখি, টস, কুলসুম ও একজন পাহারাদার, খেলা শেষে আইনুদ্দিন, এই তো নদীর খেলা, ইঁদুর মডেল, অপরাধবোধ, ভেতরের মানুষ, বারান্দায় দেখা আলো ও অন্ধকার, একজন নারী তিনজন পুরুষ ও একটি চুলের গল্প, ধিকিধিকি, পাশবিক পাশা খেলায়, আত্মঅবলোকন, পারুল বোনটি আমার, ১০ জানুযারী ১৯৭২, খেলা, খোয়াজ খিজির, একটি ভোরের গল্পসহ আরও কিছু গল্প, আমার কাছে প্রিয়। আবার দশ বছর পর এই তালিকা পরিবর্তনও হতে পারে।
এই গল্পগুলোর বাইরে আরও গল্প আছে, যে গল্পগুলোয় আমি বাংলার জল, জমিন, মানুষ; বিচিত্র মানুষের কাম ক্রোধ লোভ লালসা প্রেম-অপ্রেম উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
শফিক হাসান : এখন পর্যন্ত আপনার কতটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে?
মনি হায়দার : হিসাব করিনি। তারপরও আমার অনুমান আড়াইশ-টির মতো গল্প আমি লিখেছি।
শফিক হাসান : ছোটদের জন্য লেখা গল্প মিলিয়ে?
মনি হায়দার : ছোটদের জন্য লেখা গল্প এই হিসেবে আনিনি। কারণ, প্রশ্ন তো করছেন বড়দের গল্প সম্পর্কে। এই ফাঁকে একটা বিষয় জানিয়ে রাখি, শিশুসাহিত্য দিয়েই আমার লেখালেখির যাত্রা শুরু। আমার প্রথম গল্প ছাপা হয় ১৯৮৬ সালে সেই সময়ের দৈনিক বাংলার বাণীর ছোটদের পাতা ‘শাপলা কুঁড়ির আসর’-এর পাতায়। শুরুর পর থেকে ক্রমাগত তিন চা বা পাঁচ বছর কেবল ছোটদের জন্য লিখেছি, লিখে লিখে আমার আমাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি। কয়েক বছর পর যখন বুঝতে পারলাম, আমার পায়ের নিচের মাটি একটু শক্ত হয়েছে, বড়দের জন্য লিখতে শুরু করেছি। কিন্তু আমি ছোটদের জন্য লেখা এখনো ছাড়িনি। কখনো ছাড়বো না। ছোটদের জন্য লেখা কঠিন। কারণ ছোটদের জন্য লিখতে গেলে সময় ও পরিস্থিতিকে একজন লেখককে গভীর ধ্যানের সঙ্গে ধারণ করে লিখতে হয়। বাক্য, শব্দ ও আখ্যানকে মাথায় রাখতে হয়। ওই জগতের পুরোটাই আমার মননে গভীরভাবে প্রোথিত। ছোটদের জন্য লিখতে গেলে আমি আমার ফেলে আসা দিনরাত্রির কাছে ফিরে যাওয়ার একটা অনাবিল সুযোগ পাই। সেই সুন্দর সুযোগটা হারাতে চাই না। তাছাড়া, একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবে এই দেশের এবং পৃথিবীর তাবত শিশুর প্রতি আমার দায় রয়েছে। সেই দায় আমি লেখার মধ্যে দিয়ে পালন করতে চাই।
শফিক হাসান : খুবই পজিটিভ একটা দিক আপনার। আমাদের দেশে অধিকাংশ লেখক ছোটদের জন্য লিখতে চান না। অথচ আমরা জানি বিশ্বসাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকেরা ছোটদের জন্য লিখেছেন…।
মনি হায়দার : অনিবার্য সত্য বলছেন আপনি। ছোটদের মধ্যে দিয়েই তো আমি আপনি আমরা বেঁচে থাকব। অনাদিকালের দুনিয়ায় আমরা কী দেখছি? এক শতকের মানুষ চলে যায়, তাদের পায়ের উপর পা রেখে আর একদল মানুষ বা মানুষের উত্তরাধিকারী চলে আসে। মহামানবের ধারাবাহিতকতায় আমরা তাদের জন্য রেখে যেতে চাই কুসুমপথ। সেখানেই সৃজনশীল ও মননশীল মানুষ হিসেবে আমাদের দায়, ছোটদের জন্য লেখা। যেমন লিখেছেন পূর্বপুরুষেরা। তারা লিখেছেন আমাদের জন্য। আমরা লিখে রেখে যাব আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য। অনেকে কিন্তু ছোটদের জন্য লিখেছেন; শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, শওকত আলী, রাবেয়া খাতুন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, হাসান আজিজুল হক। এরা বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও প্রচুর লিখেছেন। এদের হাতে আমাদের শিশুসাহিত্য বিশেষ মাত্রা পেয়েছে।
শফিক হাসান : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনি অনেক গল্প লিখেছেন। ছোটদের জন্য যেমন বড়দের জন্যও। একজন মানুষকে নিয়ে এত গল্প লিখতে পুনরাবৃত্তি আসে না?
মনি হায়দার : আমি ছোটদের জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ পর্যন্ত গল্প লিখেছি প্রায় ত্রিশটি। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে ‘জনকের গল্প’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে বছর আটেক আগে। বইটিতে আটটি গল্প আছে, আপনি পাঠ করে দেখতে পারেন, পনারাবৃত্তি এসেছে কিনা! আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি; একটি গল্পের সঙ্গে অন্য গল্পের কোনো মিল পাবেন না। প্রতিটি গল্প আলাদা, অন্যরকম সত্তা নিয়ে গড়ে ওঠেছে। আর পুনরাবৃত্তি না হওয়ার কারণ, আমার এই গল্পের নায়ক কে? নায়ক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সেই শৈশব থেকে গাঙ্গেয় বদ্বীপের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করেছেন, একজন মানুষ থেকে রূপান্তরিত হয়েছেন হাজার, লক্ষ-কোটি মানুষে। একক সত্তা থেকে তিনি হয়েছেন বহুমাত্রিক। বিচিত্র তার জীবন, বিশ্ব^ রাজনীতিতে সাহসী মানুষের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ তিনি। বিশাল তাঁর কাজের পরিধি। তো, তাকে নিয়ে একটা নয়, একশ গল্প লিখলেও পুনরাবৃত্তি আসবে না, অন্তত আমার পক্ষে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেমন ছোটদের জন্য লিখেছি গল্প, তেমন লিখেছি বড়দের জন্যও। বড়দের জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছি আনুমানিক পাঁচটা গল্প। আপনি পাঠ করে দেখতে পারেন, প্রতিটি গল্প আলাদা, বিষয়বস্তু এমনকি প্রকরণেও। ২০১৫ সালের ১৫ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকের পাতায় আমার একটা গল্প ছাপা হয়েছে; ‘শেখ মুজিবের রক্ত’ নামে। আমার গল্প বলে বলছি না, অন্যরকম গল্প। এই গল্পটি নিয়ে চলচ্চিত্রকার মাসুদ পথিক চলচ্চিত্র বানাতে চেয়েছেন। জানি না, ব্যাটে-বলে কখনো সম্ভব হবে কিনা। কিন্তু আগ্রহ প্রকাশও তো একটা স্বীকৃতি।
শফিক হাসান : মুক্তিযুদ্ধ আপনার গল্পের বড় একটা উপাদান…।
মনি হায়দার : অনিবার্যভাবে। কারণ, আজ যে আপনি আমার সঙ্গে আমার গল্প, গল্পের কলকব্জা নিয়ে কথা বলছেন; যদি দেশটা স্বাধীন না হতো, আমি কি গল্প-উপন্যাস লিখতাম? আপনি কোথায় থাকতেন; আপনিও জানেন না। আমি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করি, বাঙালিরা এই প্রতিষ্ঠানের ডিজি, পাকিস্তান থাকলে এই প্রতিষ্ঠানের ডিজি হতো একজন পাকিস্তানি। আামদের শিখতে হতো উর্দু ভাষা। আর সব সময়ে পা চাটতে হতো ওই প্রভুদের ভয়ার্ত কুকুরের মতো। এইভাবে আপনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হতো। দেখুন না চব্বিশ বছরে, পাকিস্তানিরা আমাদের দেশের একজন ক্রিকেটারকে ক্রিকেট খেলতে দেয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র তিনজন বাঙালি সচিব ছিলেন। আর্মির অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। মেজরের উপরে কোনো বাঙালির পদ ছিল না। কারণ, ওরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতো, বাঙালিরা ভীতু। আরও ভয় পেত; বাঙালিদের বড় জায়গা পেলে দক্ষতা প্রকাশ করলে একদিন অধিকার চেয়ে বসবে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। আমার দেশে আমি আপনি স্বাধীন সত্তায় বুক ফুলিয়ে হাঁটি। কথা বলি। গল্প লিখি। নিজেকে শিল্পের আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছি; এই যে অর্জন এর সবটুকু একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতার অর্জন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো লিখতেই হবে, মাটির কাছে, নদীর কাছে, পাখির কাছে, ফসলের কাছে, আমার কাছে আমার এ অঙ্গীকার। ফলে, যখনই অনুরুদ্ধ হয়েছি কিংবা মনের কোণে কোনো আখ্যান এসেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছি; গল্প। সেইসব গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প নামে একটি গ্রন্থ, শোভা প্রকাশ থেকে।
শফিক হাসান : বইটিতে কতটি গল্প আছে?
মনি হায়দার : আমার এ মুহূর্তে যতদূর মনে পড়ছে, বাইশটি গল্প আছে বইটিতে।
শফিক হাসান : এই মুহূর্তে আপনার একটা গল্প নিয়ে গল্প করতে বলি, কোন গল্পটাকে বেছে নেবেন?
মনি হায়দার : ‘টস’ নামে আমার একটা গল্প আছে, সেই ‘টস’কে বেছে নেব। এই গল্পে তিনটি নারী চরিত্র আছে। প্রথম নারী চরিত্রটি আমার নিজের চোখে দেখা। সেই চরিত্রটাকে কেন্দ্র করে গল্পের আখ্যান বুনতে বুনতে আরও দুটি চরিত্র করোটিতে চলে আসে।
শফিক হাসান : ‘টস’ গল্পটা কোন বইয়ে আছে?
মনি হায়দার : ‘থৈ থৈ নোনাজল’ বইয়ে আছে। বইটা বের হয়েছিল ঐতিহ্য থেকে, ২০০৬ সালে। ওই বইটায় বেশ কয়েকটি গল্প আছে, যা খুবই ভালো। কিন্তু সমস্যা হলো; গল্প খুব কম মানুষই পাঠ করে। ফলে আলোচনায় আসে না।
শফিক হাসান : ‘টস’ গল্পের আখ্যান শুনতে চাই।
মনি হায়দার : আগেই বলেছি, গল্পটায় তিনটি নারী চরিত্র আছে। প্রথম চরিত্রটি আমি বছর দশ বা বারো বছর আগে এক বৃষ্টিমুখর দুপুরে আবিষ্কার করেছিলাম। তখন আমি শাহবাগের বেতারে চাকরি করি। বিকেলে, গল্পকার ও টিভি প্রযোজক ফরিদুর রহমানের সিদ্ধেশ্বরীর অফিসে বসি। বেশ বড় অফিস। বসে লেখা যেত, আড্ডা হতো। সেই অফিসটা এখন নেই। কালী মন্দির সোজা পার হয়ে এলে ছোট্ট চৌরাস্তার ডান পাশে ছিল অফিসটা। এখন বড় অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে। তো এক দুপুরে রাস্তার পাশে জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছি। তুমুল বৃষ্টি। আশপাশে ছোট দু একটা হোটেল ছিল। অফিসটা সামনে একটা মুদি দোকানও ছিল। হঠাৎ দেখলাম একটা মেয়ে, বয়স আনুমানিক ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হবে, দোহারা গড়নের, মাথায় একটা মাঝারি সাইজের পুটলি নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যাচ্ছে। মেয়েটি আমাদের অফিসের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় আমাদের বিল্ডিংয়ের বৃষ্টির পানি পাইপ দিয়ে রাস্তার মাঝখানে পড়ছিল প্রবল বেগে। মেয়েটি সেই পতনশীল পানির সামনে দাঁড়ায়। ঘাড় ঘুড়িয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে পুটলিমা রাস্তার উপর রেখে পানির নিচে দাঁড়ায়। আমি বাকিটা গল্প থেকে বলছি,
‘মেয়েটির পরনে ময়লা একটা শাড়ি। বুকের সঙ্গে আধ ছেঁড়া লাল রঙের ব্লাউজ লেপ্টে আছে। ব্লাউজের বাঁধন ছিঁড়ে স্বাস্থ্যবান স্তনজোড়া বেরিয়ে আসতে চায়। …শরীরে পাতলা শক্তিহীন কাপড় থাকতে চায় না। কিছুক্ষণ ভিজে সে বিপুল উৎসাহে গোসল করতে থাকে। বুকে বগলে স্তনে স্তনের নিচে পেটে তলপেটে নাভিতে নাভির নিচে শরীরের সব জায়গায় জাদুকরের মতো ঢলতে ঢলতে সে গোসল সারে। আমি পথচারীরা, দোকানের লোকেরা দেখতে থাকি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে। দেখতে দেখতে চোখের সামনে এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে বজ্রপাত হলো।
মেয়েটি হঠাৎ পানির প্রপাতের মধ্যে বসে পড়ে শরীর মুচড়িয়ে অদ্ভুত কৌশলে ব্লাউজটা এক টানে শিল্পিত ক্ষিপ্রতায় খুলে আনে এবং তার অমূল্য স্তন দুটিকে কৌশলে দু’হাঁটুর মাঝখানে লুকিয়ে ব্লাউজটাকে রাস্তার উপর কাচতে থাকে। পিঠের উপর গলা পর্যন্ত পরিষ্কার, ফকফকা পরিষ্কার। বৃষ্টির প্রপাতে পিঠটা সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চরের মতো জেগে ওঠে আমার চোখের সামনে। দেখে ভীষণ ভালো লাগে কিন্তু শরীরিক কোনো সংরাগ অনুভব করি না। কেবল মনে হয়, এতটুকু জীবনে দেখা একটি জীবন্ত শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম। বৃষ্টি রঙ, মেয়েটির সুঠাম শরীর; ক্যানভাস।
ব্লাউজটা কাচা শেষ হলে মেয়েটি বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতেই আগের মতো শরীর মুচড়িয়ে অদ্ভুত কৌশলে বসে বসেই শরীরে ঢুকিয়ে নেয়। উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। দাঁড়িয়েই পাশে রাখা পুটলিটা একটানে হাতে নিয়ে আগের মতো রাজহংসীর মতো গর্বিত গতিতে হেঁটে চলে যায়। আমি কেবল তাকিয়ে থাকি; তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে আরম্ভ করি; লাইজু, শূন্যতা এবং নামগোত্রহীন মেয়েটিকে। কে কত বড় শিল্পী? লাইজু ব্যক্তি জীবনে অভিনয় করে। শূন্যতাকে অনেক দিন দেখি না খোলা জানালায়। আজ হঠাৎ বৃষ্টিস্নাত দুপুরে রাস্তায় দেখলাম মেয়েটিকে। কে এই মেয়ে? কত বয়স ওর? ওকে কি মেয়ে বলা উচিত? মেয়েটি কি বিবাহিত? স্বামী সংসার নিয়ে কোনো বস্তিতে এক খুপড়ি ঘরে সাজিয়েছে বিরান সংসার? সুঠাম কলাবতী শরীরকে সে কি মেলে দেয় স্বামী নামক পুরুষের কাছে? নাকি এসব কিছুই না। কেবলই একজন নারী? যদি তাই হয়, তাহলে আমাকে, অন্যান্য বাড়ির বারান্দায়, দোকানের কার্নিশে অপেক্ষমাণ অজস্র পুরুষ নামক সারমেয়দের কাতর লালাঝরা চোখের সামনে পরম অবহেলায় নিজেকে মেলে ধরলো কোন সাহসে? এই সাহস কোথায় পেয়েছে? কী নাম এই সাহসের? মেয়েটি আমাদের উপেক্ষার ভেতর দিয়ে কি সমাজের গালে থাপ্পড় মারল?’
গল্পটার শেষ তিনটি লাইন পড়ে বলছি। কারণ, আমি এই মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই ভাবছি ওকে নিয়ে একটা গল্প লিখব। কিন্তু আখ্যান কীভাবে সাজাব? ভাবতে ভাবতে মাথায় এল পথে দেখা মেয়েটির সঙ্গে আরও দুটি চরিত্র যদি জুড়ে দিই, একটা গল্পের কাঠামো পেয়ে যাই। আখ্যানের ভূগোল অনুসারে উত্তম পুরুষে গল্পটি লিখতে শুরু করি। আমি একটি নাটক নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষকের কাজ করি। সেই অফিসের বসের কাছে আসে লাইজু। যে নাটকে অভিনয় করে। কিন্তু বাজার ভালো না লাইজুর। আমার বসের কাছে আসে সময় কাটাতে। যাওয়ার সময়ে বসের নির্দেশানুসারে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়। এক বৃষ্টির দিনে আটকা পড়ে লাইজু। খুলে দেয়, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার দুয়ার আমার কাছে। লাইজুর প্রতি আমার যে বিবমিষা ছিল, মুছে যায়, মানুষ যে কত কষ্টে বেঁচে থাকে! তৃতীয় নায়িকা শূন্যতা; যাকে আমি দেখি আমার অফিস থেকে সামনের বাড়ির জানালায়। তার সঙ্গে আমার দেখা হয় কালে ভদ্রে, সে নাচে রাগসঙ্গীত গানের তালে রাজকীয় পোশাক পরে নাচে। স্থান কাল ভুলে জানালা দিয়ে তার নাচ দেখি মাঝে মধ্যে। এখন নাচের সময়ে জানালা বন্ধ করে নাচে। জানি, আমি সামান্য মানুষ। এই রাজকীয় যৌগের সঙ্গে আমার যোগযোগ হবে না, কিন্তু মন থেকে মুছেও ফেলতে পারি না। মনে মনে আমি তার নাম দিয়েছি শূন্যতা। তিনজনকে তিন দিক থেকে গল্পে স্থাপন করে আমি গল্পকার হিসেবে যেভাবে ফিনিশিং দিয়েছি, সেটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখন গল্পের শেষ তিন লাইন;
‘প্রিয় পাঠক, আসলে এটি গল্প হয়ে উঠেছে কি না, প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন পুরুষশাসিত সমাজে এই গল্পে বর্ণিত তিনজন নারীর কোনজনের পক্ষে যাবেন আপনি?
আসুন, একটা টস ধরি! কে জিতবে; লাইজু? শূন্যতা নাকি…!’
গল্পটা লিখতে পেরে আমি ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
শফিক হাসান : দারুণ দারুণ এবং দারুণ, মনি ভাই। শাণিত গল্পকারের প্রথম কাজই হলো; শূন্য ক্যানভাসে গল্পের শরীর বুনে দেওয়া। ‘টস’ চমৎকার একটি গল্প। আপনার আর একটি গল্প ঘাসকন্যা, এ গল্পের নামে একটা বইও আছে…।
মনি হায়দার : হ্যাঁ, ২০১৩ সালে বইটা বের হয়েছে কথাপ্রকাশ থেকে। দশটি গল্প আছে বইটিতে। আর কথাপ্রকাশ বইটির প্রোডাকশনও দিয়েছে পরিপাটি করে।
শফিক হাসান : ঘাসকন্যা গল্পের পটভূমি কী?
মনি হায়দার : ঘাসকন্যা গল্পের আখ্যান খুবই চমৎকার। এটাও চোখে দেখা আখ্যানে গল্পটি লিখেছি। মনে আছে, আমি যখন বাংলা একাডেমিতে জয়েন করি, আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় টার্মে, ২০১০ সালের জুনে। তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘাস উপড়ে ফেলে নতুন করে ঘাস এনে লাগানো হচ্ছিল। আমি বরিশালের মানুষ। বাড়িতে মাঠে উঠোনে দেখেছি ঘাসের আস্তরণ। অবাক হয়ে সরকারের টাকা ধ্বংসের কাজ দেখছিলাম প্রতিদিন আসা যাওয়ার সময়ে। আর দেখছিলাম ট্রাক বোঝাই করে আনা ঘাস মাটিতে লাগাচ্ছে বেশ কয়েকজন নারী। যাদের ঘাস লাগানো কাজ পাহারা দিচ্ছে কন্ট্রাকটরের এক টিংটিংয়ে লোক। ওই লোকটাকে দেখে, আর অল্প বয়স্ক একটি মেয়ের দিকে তার লোলুপ চোখ দেখে, আমার মাথায় এই গল্পের আইডিয়া আসে। গল্পের ভেতরে বঙ্গবন্ধু বন্দনাও আছে। আছে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নামফলকের ইতিহাস। মেয়েটি, যে এই গল্পের নায়িকা, তার পেটের ভেতরে যে জোঁকের বাসা; সেটা নিয়েছি শৈশবের একটি বাস্তব ঘটনা থেকে। ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে মিষ্টি আলুর চাষ হতো উঠানে। ঠিক চাষ না, দু-একটা লতা রোপণ করলে, বেয়ে বেয়ে ভরে যেত গোটা উঠান। তো বাড়ির মেয়েরা তরকারির প্রয়োজন হলে আলুশাক তুলত। আমাদের বাড়ির এক মেয়ে, সঙ্গত কারণেই নাম বলব না, সে আলুশাক তুলতে গেলে তার যৌনদ্বার দিয়ে চিনা জোঁক ঢুকে পড়েছিল।
দুটো ঘটনাকে মিলিয়ে আমি ‘ঘাসকন্যা’ গল্পের খসড়া প্রস্তত করে লিখতে বসি। এবং ভাবনার সঙ্গে গল্পকাঠামোর ঐক্য অনেকটা রক্ষা করতে পেরে তৃপ্তি বোধ করেছিলাম। সাধারণত একটা গল্পের আখ্যান অনেকদিন ধরে মাথার ভেতরে কাজ করে। ধীরে ধীরে গল্পটার গোটা মানচিত্র করোটির ডেস্কে লিখতে থাকি। লিখতে লিখতে যখন বুঝতে পারি, আমার কল্পিত গল্পের ডানা এখন আকাশে উড়বার মতো সক্ষম হয়েছে, তখন লিখতে বসি। দেখা যায়, কোনো কোনো গল্প তিন বছর, পাঁচ বছর এমনকি আরও অধিক বছর ধরে করোটির ভেতরে ধীরে-সুস্থে বেড়ে উঠছে। পরিপক্ব হওয়ার পর যখন লিখতে বসি, লেখার পর মনে হয়, এত বছর ধরে যে গল্পটাকে লালনপালন করেছি, সেই গল্পটাই হয়তো লিখেছি কিন্তু একশ পারসেন্ট নিজের মতো করে লিখতে পারিনি।
শফিক হাসান : তখন কী করেন! বেদনাবোধে আক্রান্ত হন?
মনি হায়দার : বেদনাবোধে আক্রান্ত না হয়ে উপায় আছে? এক একটি গল্প কত দিনরাতের সাধনার পর দুনিয়ায় আসে, সেই গল্পটা যদি সফল না হয়, একজন শিল্পী হিসেবে কষ্ট হবে না? খুব কষ্ট হয়। কষ্ট এবং অতৃপ্তি একজন লেখকের বড় সম্পদও বটে।
শফিক হাসান : মনি ভাই, ‘ঘাসকন্যা’ গল্পের শেষটা তো ভয়ঙ্কর…।
মনি হায়দার : ভয়ঙ্কর? না, আমি মনে করি আমাদের জটিল ও সর্বনাশা সমাজে একটি মেয়ের শারীরিক-মানসিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য তার শরীরের কোষে কোষে প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের কোনো অর্গান থাকার দরকার ছিল। যেমন ধরুন, শুনেছি বনে এক ধরনের প্রাণী আছে, যাদের শত্রু আক্রমণ করলে মুখ থেকে এক ধরনের লালা নিক্ষেপ করে, যে লালায় থাকে তীব্র বিষ। শত্রুর শরীরে পড়লে বিষাক্রান্ত হয়। আবার বন্ধু বা প্রেমিক হলে সে অন্য ধরনের লালা নিক্ষেপ করে, যাতে থাকে আমন্ত্রণ। কেন এই প্রসঙ্গ আনলাম, মেয়েদের বিপদ হলো, প্রকৃতিগতভাবে যৌনাঙ্গের ভেতর দিয়ে পুরুষের কামরস ধারণের একটা প্রকৌশল আছে তাদের। কামতাড়িত বর্বর পুরুষেরা কামরস ছেড়ে দিয়ে চলে যায় কিন্তু বিপদে পড়ে মেয়েরা। আমার প্রশ্ন, কেন নিরপরাধ মেয়েরা এই বিপদের বা সর্বনাশের রস বহন করতে বাধ্য হবে, যদি না সে বা তারা নিজের আগ্রহে সঙ্গমে না আসে? সেই ধারণাবোধ থেকে, আমি মনে করি নারীর শরীরে কলকব্জার মধ্যে কোনো না কোনো প্রকারের প্রতিরোধ থাকা দরকার। প্রকৃতি, নারীর প্রতি এই ক্ষেত্রে চরম অন্যায় করেছে। অবিবেচকের পরিচয় দিয়েছে। আমি সামান্য মানুষ; প্রকৃতির বিরুদ্ধে তো দাঁড়াতে পারব না, তাই গল্পের ভেতর দিয়ে আমার চিন্তাকে প্রসারিত করেছি মাত্র। গল্পে ম্যাজিক রিয়ালিজমেরও একটা ব্যাপার আছে, আমার মনে হয়, ‘ঘাসকন্যা’ ম্যাজিক রিয়ালিজমের চরম প্রকাশও। অবশ্য পাপিষ্ঠ জ্ঞানীরা কী বলে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
শফিক হাসান : গল্পের শেষটা বলবেন?
মনি হায়দার : আগ্রহী হলে শোনাতে আপত্তি নেই। ‘ঘাসকন্যা’ গল্পের শেষটা বলার আগে গল্পের শুরুটা সামান্য বললে ভালো হবে। তো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভের কাজ চলছে। পুরোনো ঘাস তুলে নতুন ঘাস লাগানো হচ্ছে। অনেক মেয়ের সঙ্গে বরিশাল থেকে আসা এক মেয়ে জরিনা। যে জরিনা ছোটবেলায় আলুখেতে আলুশাক তুলেছিল এবং ওর ভেতরে চিনা জোঁক প্রবেশ করেছিল। জরিনা চাচাতো দুলাভাই কাদেরের হাত ধরে ঘাস লাগাতে আসে উদ্যানে। জরিনার শরীর কাঠামো বেশ আকর্ষণীয়। কন্ট্রাকটরের শ্যালক চিনটুর মনে ধরে। এবং চিনটু হাত করে কাদেরকে। কাদের টাকার লোভে নানাভাবে ফুসলিয়ে জরিনাকে একদিন পৌঁছে দেয় চিনটুর ফ্লাটে। এবং যা ঘটে, তা গল্পের শেষে;
‘বাঘের ক্ষিপ্রতায় চিনটু দুহাতে জাপটে ধরে জরিনাকে। সঙ্গে সঙ্গে জরিনা খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। জরিনার খিলখিল হাসিতে চিনটুর শরীরে ক্রোধ জেগে ওঠে। সে মুহূর্তে জরিনাকে বিছানায় ছড়িয়ে দেয় মেলা থেকে কেনা দুই পয়সার বাতাসার মতো। জরিনার কাপড় সরে গিয়ে জোঁকের প্রবেশ পথ বেরিয়ে গেছে। কিন্ত জরিনা নির্বিকার। শরীর দুলিয়ে হাসছে খলিসা মাছের মতো। দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে প্রস্তুত জরিনা। প্যান্ট খুলে প্রস্তুত চিনটু। অভুক্ত রাক্ষসের শরীর নিয়ে এগিয়ে যায় জরিনার দিকে। রাগে ক্রোধে চিনটু এখন অগ্নিসিন্ধু।
বলে কি মাগী! চিনটুকে ভয় পায় না? দ্যাখ মাগী ভয় কাকে বলে; পলকমাত্র, জরিনার ভেতরে চিনটু প্রবিষ্ট হতে না হতেই জরিনার জোঁক প্রবেশের সুড়ঙ্গ তীব্র ঝংকারে খুলে যায়। অসম্ভব ক্রোধে ট্যাপের নলের মতো বের হয়ে আসতে থাকে টাটকা রক্ত, টাটকা রক্তের সঙ্গে শত শত ছোট ছোট চিনা জোঁক আর সবুজ টুকরো টুকরো ঘাস। রক্তে, ঘাসে আর জোঁকে চিনটুর শরীর লেপটে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব চিনটু। বিস্মিত চিনটু। বিমূঢ় চিনটু। দ্রুত সরে আসে রুমের এক পাশে। কী হচ্ছে এসব? কোত্থেকে আসছে এতোসব জোঁক রক্ত আর সবুজ টাটকা ঘাস? জরিনার ছোট্ট চকমকে শরীরের কাঠামোয় এসব আসবে কোত্থেকে? জরিনা এইকইভাবে শুয়ে আছে বিছানার উপর। দুদিকে ছড়ানো দুটি নধর চকচকে থাই, দুই থাইয়ের মাঝখান থেকে বেরুচ্ছে প্রবলবেগে টাটকা রক্ত, জোঁক আর সবুজ ঘাস। ক্রমশ বাড়ছে গতি বাড়ছে ঘাস, রক্ত আর জোঁকের। ভয়াবহ দৃশ্য। পাশবিক দৃশ্য।
ভয়ে চিৎকার করে চিনটু, এসব কী হচ্ছে? থামাও এসব। আমার ঘর নষ্ট হচ্ছে।
ঘর নষ্ট হচ্ছে! জরিনা খিলখিল হাসছে। রক্ত ঘাস আর জোঁকে ঘরটা ভরে যাচ্ছে। টাটকা রক্তের ভেতরে জোঁকগুলো জরিনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাসছে আর কিলবিল করছে। রক্তে জোঁকে আর ঘাসে ঘরটা ইতিমধ্যে এক বিঘত ভরে উঠেছে। গা ঘিনঘিন করছে চিনটুর। বমি আসছে। ভয়ে বিহ্বলতায় দরজা খুলতে যায়, দরজা খুলছে না। দরজা বন্ধ। কে বন্ধ করেছে দরজা? চিনটু এবার প্রচণ্ড ভয় পায়। ত্রাসে তার কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। রক্তের ভেতর সন্তরণশীল জোঁকগুলো সারিবদ্ধভাবে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। চিনটু প্রাণপণে দরজা খুলতে চেষ্টা করছে। দরজা খুলছে না। ধীরে ধীরে ঘরটা রক্তে ঘাসে আর জোঁকে ভরে উঠছে। শ্বাস নেওয়ার জন্য হা করছে চিনটু। বাতাসেও রক্ত জোঁক আর ঘাস। ঘরের মধ্যে ছুটোছুটি করতে শুরু করে সে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁটু অবধি উঠে এসেছে রক্ত. ঘাস আর জোঁক। একটু হাওয়া একটু নির্মল বাতাস বড় দরকার চিনটুর। অসহ্য! চিৎকার করছে চিনটু; বাঁচাও বাঁচাও…।
ঘাসকন্যা জরিনা বিছানায় দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে পরম সুখে। মুখে বিদ্যুৎ হাসি। মনে হচ্ছে ওর শরীর শরীরের কোষে কোষে নেমে আসছে সুখের মধুর ঘ্রাণ। আপন মনে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে, নিজের সুড়ঙ্গ থেকে প্রবহমান রক্ত জোঁক আর পাষাণ ঘাসের রোদন। অমিত বিস্ফোরণ। কোমর পর্যন্ত রক্ত চিনটুর। দরজায় মাথা ঠুকতে ঠুকতে রক্তাক্ত হচ্ছে। রুমটার অর্ধেক ভরে গেছে রক্তে, জোঁকে আর ঘাসে। খুব দ্রুত গোটা রুমটা ভরে যাবে রক্তে, ঘাসে আর কিলবিল করা জোঁকে।
শফিক হাসান : ভয়াবহ বললেও কম বলা হবে আপনার ‘ঘাসকন্যা’ গল্প। শুরুতে আপনি যে প্রকৃতির প্রতিশোধের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তার সঙ্গে এই গল্পটি একেবারে মিলে যায়। শেষের চিত্রকল্প শুনে তো আমার শরীর শিউরে উঠেছে।
মনি হায়দার : কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কি জানেন? গল্প তেমন কেউ পাঠ করে না আজকাল। এমনকি আমাদের বন্ধুরাও পড়ে না। ফলে, অনেক ভালো গল্প পাঠকের অগোচরে থেকে যাচ্ছে।
শফিক হাসান : গল্প লেখা কি থেমে যাবে?
মনি হায়দার : প্রশ্নই আসে না। গল্প লেখা অবিরাম চলতে থাকবে। যতদিন মানুষ থাকবে, মানুষের গল্পও থাকবে। এবং গল্প লেখাও চলবে। গল্প ছাড়া কি মানবসভ্যতা চলে? সভ্যতার প্রথম চরিত্র; গল্প। গল্পের ভেতরে মানবযাত্রার ইতিহাস যেভাবে এসেছে, পৃথিবীর অন্য কোনো সাহিত্যে তেমনভাবে আসেনি। আমি বাংলা ভাষার গুটিকয়েক গল্প ও গল্পকারের নাম বলছি; রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ ও ‘মহানগর’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতসী মামী’, জগদীশ গুপ্তের ‘শঙ্কিত অভয়া’, সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’ ‘অযান্ত্রিক’; এসব গল্পের আখ্যানে যেমন মানুষের সর্বনাশ এসেছে, তেমন এসেছে লড়াইয়েরও ইতিহাস। সুতরাং সভ্যতা পাঠ মানে গল্প পাঠ। গল্পের বিকাশ মানে; গল্পের বিকাশ। গল্প ছাড়া অচল পৃথিবী।
শফিক হাসান : ২০১৫ সালের বইমেলায় আপনার আরেকটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে, নামটা একেবারেই অন্যরকম¬; ‘১০ জানুয়ারী ১৯৭২ ও অন্যান্য গল্প’। নামের পেছনে কি কোনো ইতিহাস আছে?
মনি হায়দার : অনিবার্যভাবে ইতিহাস আছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল; বাঙালির জীবনে আর একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৬ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করল, পাকিস্তানি ৯৩ হাজার হায়েনা সৈন্যদের প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে, ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, বাঙালির সেই স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ। কারণ, আমরা তখন পতাকা পেয়েছি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডও পেয়েছি, কিন্তু স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ, তার চির আরাধ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে নেই। তিনি বন্দি পাকিস্তানের কারাগারে, লায়ালপুরে। তিনি ছাড়া স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় কী করে? যদিও দেশের মানুষ সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বন্দিদশা থেকে মুক্ত, সারা দেশে উঠেছে লাল সবুজের পতাকা, কলকাতা থেকে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে এসেছেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যরা, দেশের মানুষ জয়বাংলা শ্লোগানে শ্লোগানে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল মুখরিত করে রাখছে, কিন্তু সবার একটাই প্রশ্ন তিনি কোথায় আছেন? বেঁচে আছেন তো? নাকি রক্তপিপাসু জেনালের ইয়াহিয়া তাকে হত্যা করেছে?
এই তিনি বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি জাতির মুক্তিদাতা, রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে ছাড়া এই স্বাধীনতা ফ্যাকাসে। রক্তহীন। দিকে দিকে একই চিন্তা তাকে নিয়ে। পৃথিবী তোলপাড় তাকে নিয়ে। পৃথিবীর নানা দেশের নেতাদের চাপে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানের অসামরিক কিন্তু সামরিক প্রেসিডেন্ট মি. ভুট্টো। অনেক টালবাহানার পর ভুট্টো ১৯৭২ সালের আট জানুয়ারি মধ্যে রাতে লন্ডনগামী একটি বিমানে উঠিয়ে দিলে, নয় জানুয়ারি সকালে তিনি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন মুক্ত মানুষ হিসেবে। নয় জানুয়ারি তিনি লন্ডনে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে পরের দিন, দশ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে দুপুরের পরে তাঁর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবতরণ করেন। বাংলার মাটিতে তাঁর পবিত্র পা দুখানি রাখার সঙ্গে সঙ্গে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অর্জিত স্বাধীনতা পায় পূর্ণতা। স্বাধীনতা পায় মহাকাব্যিক চরিত্র। বাঙালির ঠিকানা একজন শেখ মুজিব ধারণ করেছিলেন তাঁর নীলকণ্ঠে। নেতার আগমনের সংবাদে ছুটে আসে জনতা। চারদিকে মানুষ, মানুষ আর মানুষ। লাখ লাখ মানুষ। নেতা, প্রাণের নেতা ফিরে এসেছেন। তাঁর ফিরে আসার জন্য অনেক মা রোজাও রেখেছিলেন। নেতা খোলা একটি জিপে চড়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে লেগেছিল তিন ঘণ্টা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সামনে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, কান্নামাখা কণ্ঠে; ওরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। আমার চোখের সামনে আমার কবর খুঁড়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান; মরলে একবারই মরে, বারবার মরে না। আমি হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে যাব তবুও তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না। আমার বাঙালিকে ছোট করব না। শুধু একটাই অনুরোধ, আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে পৌঁছাইয়া দিও…। এমন ঘটনা, পৃথিবীর স্বাধীনতার ইতিহাসে বিরল। আমি দেখলাম; অনন্য ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে কোনো গল্প নেই, এমনকি আমাদের পত্রপত্রিকাও খুব একটা গুরুত্ব দেয় না দিনটিকে। আমি মনে করি; বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার দিনটি ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ, ৭ মার্চের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথচ সেভাবে কোনো আলেখ্য নেই সাহিত্যে। সেই চিন্তা থেকে আমি ‘১০ জানুয়ারী ১৯৭২’ গল্পটি ভাবলাম ও লিখলাম। আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার দিনটি নিয়ে আমিই প্রথম গল্প লিখলাম। সেই দিন ও গল্পটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বইটিরই নাম রাখলাম; ‘১০ জানুয়ারী ১৯৭২ ও অন্যান্য গল্প’।
শফিক হাসান : সাড়া কেমন পাচ্ছেন গল্পটির?
মনি হায়দার : এক কথায় অসাধারণ। ছোট্ট একটা ঘটনা বলি। নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে বইটি বের হয় বইমেলায়। আমার এক শুভানুধ্যায়ী পাঠক বইটি কিনে নিলেন। কয়েকদিন পরে তিনি আমাকে ফোনকল করলেন। আমাকে জানালেন, গল্পটি পড়তে পড়তে এক জায়গায় এসে তিনি থমকে যান। তার গলা ভারী হয়ে আসে। চোখে আসে জল। জায়গাটা গল্পের একটা চরিত্র খোকন, তরুণ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, যুদ্ধে যেতে চায়, কিন্তু পারছে না। কারণ, পাকিস্তানি আর্মি বাসায় এসে জানিয়ে গেছে, বাসায় এসে খোকনকে না পেলে ওর বাপ আলী আমজাদকে নিয়ে যাবে। পিতার জীবনের জন্য খোকনকে বাসায় থাকতে হয় দাঁত কামড়ে। সেই খোকন একদিন মসজিদ থেকে এসে জানায়;
“‘মা, আমি যুদ্ধে যাব। পাড়ার শামীম ভাই সোহেল ভাই, দীপঙ্করদা, মজনু ভাই সবাই চলে গেছে।’
‘কোথায় গেছে?’
ক্ষেপে ওঠে খোকন, ‘তুমি জানো না বাঙালি ছেলেরা এখন কোথায় যায়? সবাই যুদ্ধে গেছে।’
‘যুদ্ধটা হচ্ছে কোথায়?’ ঢোকেন আলী আমজাদ।
‘যুদ্ধ কোথায় হচ্ছে না এখন, যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দরকার। সেই ট্রেনিং নিতে সবাই ভারতে যাচ্ছে। ভারত সরকার বাংলাদেশের যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিচ্ছে। আসামে, পশ্চিমবঙ্গে, আগরতলায়, ত্রিপুরায়; সব জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প হয়েছে। হাজার হাজার তরুণ ট্রেনিং নিচ্ছে। দুই একদিনের মধ্যে আরও অনেকে যাবে।’ পা জড়িয়ে ধরে খোকন, ‘আমাকে যেতে দেবে, মা?’
‘তোকে এসব কে বলল?’
‘আমার ক্লাসমেট রফিক।’
‘বলল কখন?’
‘নামাজে আমরা যখন সেজদায় যাই, তখন আমাদের মধ্যে এইসব কথা হয়েছে। আমরা এক সারিতে ছিলাম। আমি কিসলু রফিক আর ফারুক। ওরা চলে যাবে দু-এক দিনের মধ্যে।’
বিস্মিত আফসানা খানম, ‘তোমরা সেজদায় গিয়ে যুদ্ধের কথা বলেছ?’
‘উপায় কী মা? চারদিকে পাকিস্তানি আর্মি নয়তো জামায়াতের চর। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে যদি ওরা সন্দেহ করে, তাই আমরা সেজদায় গিয়ে বলেছি। মা, আল্লাহ সব জানেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করাও ইবাদত। মা, এখন বলো, আমাকে যেতে দেবে?’”
তিনি এটুকু পাঠ করে বললেন, আপনি মুক্তিযুদ্ধকে কতখানি ধারণ করেন, সেজদায় গিয়ে যখন আপনার চরিত্র যুদ্ধে যাওয়ার প্রসঙ্গ আনে, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়। ভাই, আপনাকে লাল সালাম। একজন গল্পকার হিসেবে একজন পাঠকের কাছ থেকে পাওয়া এই অভিমত আমার এতদিনের অর্জন।
শফিক হাসান : মৃত্যকে কীভাবে প্রত্যাশা করেন?
মনি হায়দার : মৃত্যুর মতো। যেহেতু পৃথিবীতে প্রাণী হয়ে জন্মেছি, মৃত্য অনিবার্য। আমি মৃতুকে প্রিয়তমা প্রেমিকার মতো আলিঙ্গন করতে চাই চুম্বনের মতো। মৃত্যুর কাছে একটাই প্রার্থনা, মৃত্যু আপনি আসুন আমার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের কাছে যা পেয়েছি, তার তুলনা নেই। হয়তো আরও পাওয়ার ছিল, পাইনি, দুঃখবিলাস নেই। সুস্থ সবল দেহে যেন মৃত্যুবরণ করি। কারও করুণা, কারও কাঁধে হাত রেখে ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাই না… আমার মনে হয় না মহামান্য মৃত্যুর কাছে আমি বেশি কিছু চেয়েছি।
শফিক হাসান : মৃত্যুর পরের জীবন;
মনি হায়দার : ওই জীবন নিয়ে এক মুহূর্তও ভাবি না, কারণ, ওই জীবনে আমি বিশ্বাস করি না।
শফিক হাসান : মৃত্যুর আগে, অন্তিম ইচ্ছে?
মনি হায়দার : আমার কোনো অন্তিম ইচ্ছে নেই। যতদিন বাঁচব, লেখার সঙ্গে, গল্পের সঙ্গে যেন বাঁচি আর বাংলাদেশটা যেন রাজাকারমুক্ত হয়, এইটুকুই চাওয়া।