প্রফেসর আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী মননশীল সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে থেকে লিখে আসছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন এবং ২০১১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকট ও উত্তরণের পথ ও পাথেয় সম্পর্কে মূল্যবান অভিমত দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের সমকালীন জাতীয় সংকটে তাঁর চিন্তা ও মতের তাৎপর্য উপলব্ধির মধ্যে অনেক সমাধান নিহিত। সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন-নীতিবিদ্যা, রাষ্ট্রতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানশাখায় তিনি বিচরণ করেছেন। অমর একুশে ও স্বাধীনতার মর্ম ও সমকালীন সংকটে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি চলমান সময়ের বাঁক ও দিক-নির্ণয়ে মঙ্গলময় ভূমিকায় কার্যকর। ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’, ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও উত্তরকাল’, ‘উনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও বাংলাসাহিত্য’, ‘মুক্তি সংগ্রাম’সহ অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করে তিনি জাতির প্রগতি, উন্নতি ও কল্যাণের পথে বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপ রেখেছেন। সম্প্রতি ‘রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি’ ও ‘জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ বিশ্বায়ন ও ভবিষ্যৎ’ সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ দু’টি গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। ‘এক নতুন মাত্রা’র পক্ষ থেকে অমর একুশে ও স্বাধীনতাবিষয়ে সমসাময়িক বিষয়ে মত প্রকাশে তিনি সাহসী ভূমিকা রাখেন। সম্প্রতি তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কবি ফজলুল হক তুহিন।
_____________________________________________________________________________________________
একুশের মূল চেতনা বা মর্মকথা আসলে কী?
পাকিস্তানকালের একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের চেতনা আর আজকের মাসব্যাপী বইমেলার পেছনে মানসিকতা এক নয়। সেকালে মূল অনুষ্ঠান হতো শহীদ মিনারে এবং তার নেতৃত্বে থাকতো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। যার সভাপতি থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি। একদিনের ছোট অনুষ্ঠানের মূলে থাকত সংগ্রামী স্পৃহা। তখন একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানাদিতে থাকত সৃষ্টিশীলতা। প্রতি বছর চিন্তা-চেতনার নবায়ন ঘটতো। যেসব দাবি তখন উচ্চারিত হতো সেগুলোর মধ্যে থাকত—বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করা। সরকারি অফিসে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন, বাংলাভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনভিপ্রেত প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া ইত্যাদি। এখন ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অনুষ্ঠানাদি ও বইমেলার নেতৃত্বে থাকে বাংলা একাডেমি, তার পেছনে থাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও সরকার। এখন সরকারি স্বার্থে সরকারি নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয় বইমেলা, আলোচনা অনুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান। গত কয়েক বছর ধরে প্রতি ফেব্রুয়ারিতে চার হাজারের মতো নতুন বই প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে প্রগতিমূলক বই দশটির বেশি থাকে না। বিনোদনমূলক বই, চমকপ্রদ বই, উস্কানিমূলক বই, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রচিত বই, জনপ্রিয় বিনোদনমূলক সায়েন্স ফিকশন, শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় বই থাকে। কিছু লেখক বইমেলার লেখক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেন। উন্নত চিন্তা-চেতনা, সৃষ্টিশীলতা দুর্লভ। সব কিছুর মধ্যে থাকে উৎসবের আমেজ ও ভোগবাদী মানসিকতা। বাংলাদেশের রাজনীতি নিম্নগামী, গণতন্ত্রের আশা সুদূর পরাহত, আইনের শাসন কায়েম হচ্ছে না। খুন-খারাবি, হত্যা-আত্মহত্যা, সন্ত্রাস, জঙ্গি তৎপরতা, পুরাতন অপমৃত্যু, সংস্কার-বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন, আইনের শাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি—এ সবের প্রতিকারের চিন্তা লেখকদের মধ্যে এবং বইমেলার বইপত্রে কমই পাওয়া যায়। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। বইমেলার ও ফেব্রুয়ারি মাসের অনুষ্ঠানাদির একটা চাপ সরকারের ও শাসকশ্রেণীর ওপর আছে। তার ফলে সরকারি অফিসাদিতে এবং শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাভাষা এখনো আছে। এই চাপ না থাকলে সরকারি অফিস ও শিক্ষাব্যবস্থা এত দিনে বাংলা ছেড়ে ইংরেজিতে চলে যেত। বাংলাভাষা ও ইংরেজি ভাষার প্রতি বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর মনোভাবকে ভালো করে বুঝতে হবে। তাহলে আর্থ-সামাজিক, রাষ্ট্রের ও সাংস্কৃতিক সব কিছুই বোঝা যাবে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অর্জন ও বিসর্জন কী কী?
পাকিস্তানকালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের ফলে বাংলাভাষার অনেক উন্নতি হয়েছে, বাঙালি সংস্কৃতির চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়েছে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী বেপরোয়া গতিতে বিকশিত হয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর বাংলাভাষাকে বিকশিত করে চলার, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রগতিশীল সমৃদ্ধিমান রাখার এবং জনজীবনের সার্বিক উন্নতি সাধনের যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, ১৯৮০-র দশক শেষ হওয়ার পর ক্রমে সেই সম্ভাবনাকে বানচাল করা হয়েছে। এর জন্য মূলত দায়ী বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী। ১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণে ও রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ইত্যাদি নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। শাসকশ্রেণীর রাজনীতিকে করে তোলা হয়েছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস অভিমুখী এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট অভিমুখী। তাতে বাংলাভাষার বিকাশের এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন কেন শুধু মুখের বুলি হয়ে থাকল?
বাংলাভাষার উন্নতি ১৯৬০, ’৭০ ও ’৮০-র দশকে অনেকটুকু হয়েছে। ১৯৯০-এর দশক থেকে এতে ভাটা দেখা দিয়েছে। শাসকশ্রেণীর বাঙালিরা, এনজিও-পতিরা, সিভিল সোসাইটি অরগেনাইশনের বুদ্ধিজীবীরা বিদেশমুখী। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমের কোন দেশে গিয়ে নাগরিকত্ব নেওয়ার তৎপরতা বাড়ছে। সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মূলধারার শিক্ষাকে বিভক্ত করে ইংলিশ ভার্সন চালু করছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইংরেজি অবলম্বী। রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বিষয়গুলো বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দ্বারা পরিচালিত। এ অবস্থায় বাংলা অবহেলিত হচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থাও নিকৃষ্ট। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সঙ্গে কাজ করার জন্য যেটুকু ইংরেজি দরকার সেটুকু ইংরেজি শেখার দিকেই মনোযোগ। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও প্রগতিশীল সাহিত্য সৃষ্টির উদ্যোগ দেখা যায় না তরুণদের মধ্যে। বিদেশে গিয়ে নাগরিকত্ব নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এই বাস্তবতায় বাংলা প্রচলনে আগ্রহী সংগঠিত সামাজিক শক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না। ফেব্রুয়ারি মাসের আবেগের চাপে বাংলা এখনও আদি অবস্থায় আছে, শিক্ষাব্যবস্থায়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আছে।
ব্যক্তি ও রাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রে বাংলাভাষার বিকাশে কী কী করণীয়?
নতুন আইন ও বিধিব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এবং জনমত গঠনের জন্য সংগঠিত আন্দোলন দরকার। বাংলাভাষা শুদ্ধ করে লেখার ও জানার জন্য এবং ভাষাতত্ত্বের দিকগুলোর উন্নয়নের জন্য আন্দোলন দরকার। আন্দোলনের মধ্যে সমস্যাবলি দেখতে হবে এবং সমাধানের কর্মসূচি ও কার্যক্রম অবলম্বন করতে হবে।
দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মাতৃভাষার ওপর বাংলাভাষার প্রভাব ও প্রাধান্যকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখেন?
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহের সার্বিক উন্নতির জন্য জাতীয় কর্মসূচি দরকার। তাদের স্বাধীন আত্মবিকাশ দরকার। এনজিও ও সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশন যেভাবে তাদের পরিচালনা করছে, তাতে তাদের স্বাধীন আত্মবিকাশের সুযোগ থাকছে না। সরকার যেখানে দায়িত্ব পালনে পিছিয়ে থাকে সেখানে সরকারের ওপর দায়িত্ব পালনের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে। কেবল নিজেদের ভাষায় আবদ্ধ না থেকে বাংলা ও ইংরেজি শেখা তাদের জন্য কল্যাণকর হবে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা তাদের তাদের ভাষায় দেওয়ার চিন্তাকে আমার কাছে ভুল মনে হয়। বাংলা না শিখে তারা কেবল ইংরেজি শিখবে আর নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করবে, এটাও আমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় না। জাতিসংঘের আদিবাসী-নীতি ভুল। তাদের মানবজাতির মূলধারায় আসতে হবে। বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করা যাবে না। অনেক বিকাশমান মাতৃভাষাকেও বিলীয়মান মাতৃভাষায় পরিণত করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে বাংলাভাষার বিকৃতি, শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলার সঙ্কোচন কেন ঘটছে?উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এ সম্পর্কে সচেতনতা দরকার। সেই সঙ্গে সংগঠিত শক্তির কর্মসূচি, কার্যক্রম ও প্রচার আন্দোলন দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহের বাংলা বিভাগগুলো এ ব্যাপারে সক্রিয় হলে ভালো হবে।
মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্কল্প ও আকাঙ্ক্ষার রূপরেখা আসলে কী ছিল? বাস্তবে কী হলো?
সরকার কর্তৃক পনেরো খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রে এটা রয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে খুব প্রচারমুখর তাঁরা এই দলিলপত্রের বাইরে এমনসব কথা বলছেন, যেগুলো দ্বারা ইতিহাস বিকৃত হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা উচিত হচ্ছে না।
মুক্তিমুদ্ধের স্পিরিট কতটুকু ধারণ করে আছে আমাদের সাহিত্য?
আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের গণচেতনা ও জনকল্যাণবোধের প্রকাশ অত্যন্ত স্থূল ও আবেদনহীন। ব্যতিক্রম কিছু আছে। দরকার সত্যানিষ্ঠা।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অমর সাহিত্যের সম্ভাবনা কতটুকু?
মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অন্তরে গভীরভাবে অনুভব করে অমর সাহিত্য সৃষ্টির সুযোগ আছে। ব্যবসায়িক মন নিয়ে এটা করা যাবে না। দলাদলির সংকীর্ণতা দিয়েও হবে না।
একুশ ও স্বাধীনতার চেতনা সামগ্রিক সংকট মোকাবিলায় কী ভূমিকা রাখতে পারে?
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতাযুদ্ধ এখন ইতিহাসের বিষয়। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন কালের জন্য নতুন কর্মসূচি, কর্মনীতি ও কার্যক্রম দরকার। সেটা খুব কম রাজনীতিবিদ ও কম লেখকের মধ্যে আছে। অবস্থা এমন যে, কর্তৃত্বশীলদের কথাবার্তা শুনে মনে হয়, আমরা এখনো পাকিস্তানের অধীনে আছি। পাকিস্তান-ভীতি আমাদের উন্নতির দিকে যেতে দিচ্ছে না। আমাদের দরকার সম্মুখদৃষ্টি।