চিন্তাসূত্রের নভেম্বর সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছোটগল্প। অর্থাৎ ছোটগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, ছোটগল্প ও তরুণ গল্পকারদের ভাবনা। তরুণ গল্পকারদের ভাবনাপর্বে ছোটগল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন কথাশিল্পী কাজী মহম্মদ আশরাফ।
চিন্তাসূত্র: আপনি কেন ছোটগল্প লিখছেন?
আমি ছোটগল্প লিখি কেন, এ প্রশ্নের সহজ উত্তর, লিখতে পারি তাই লিখি। আসলে আমি গল্প বলি। আমার যদি লেখার সামর্থ্য না থাকত তাহলে যা করতাম, তাই আসলে মূল কারণ। আমি গল্প বলতাম। বলতে পারেন, ছোটবেলা থেকেই আমি পেশাদার গল্পকথক। প্রাইমারির ছাত্রকাল থেকেই পয়সা নিয়ে গল্প বলতাম। নদীর পারে, খেলার মাঠে সবাই খেলত আর আমি মাঠের পাশে বসে কয়েকজনকে গল্প শোনাতাম। জোছনারাতেও নদীর পারে বসে গল্প বলতাম। ঘরে বই ছিল বাবার, বড় ভাইদের, পড়তাম আর কয়েকটি গল্প ভেঙে নতুন গল্প বানিয়ে বলতাম। যে পয়সা দিতে না পারত, সে আসরের সবাইকে মুড়ি, গাট্টা, আখ ইত্যাদি খাওয়াতো। আমার কারণে কাছের অনেক ছেলে খাওয়ার সুযোগ পেত। আমাদের কৈশোরে খাওয়ার এত আইটেম ছিল না। ছোটবেলা মায়ের কাছে, বাবার কাছে, এক দাদি ছিলেন মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতেন তার কাছে গল্প শুনতাম। ক্লাস ফোরে পড়ার সময় মেজ ভাইয়ের বিয়ে হয়। ভাবী আমাকে কোনো কাজ করাতে চাইলে গল্প শোনাতেন। ধারাবাহিক গল্পও বলতেন। এই ধারাবাহিক গল্প বলার যোগ্যতা আমারও নাই। এটি এক বিশেষ গুণ। সপ্তাহ বা পনেরো দিন ধরে একটি গল্প বলা বিশেষ আর্ট। শুনতে শুনতেই আমার গল্প বলা। আর সেটাই এখন করছি।
চিন্তাসূত্র: আপনার গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
আমি কমলকুমার মজুমদার বা ফররুখ আহমদ নই। গল্পে নিজস্ব ভাষা সৃষ্টি করার ইচ্ছা আমার নাই। প্রতিদিন সাধারণ লোকের সাথে মিশি। তাদের ভেতর থেকে অনেক গল্প বেরিয়ে আসে। সেখান থেকে বাছাই করে আমার মগজ। লিখতে বসলে চরিত্র এবং পরিবেশ নির্ধারণ করে নেয় এর ভাষা। আমি বলতে চাই গল্পের বিষয়বস্তু, চরিত্র এবং পরিবেশ এর ভাষা এবং বর্ণনাভঙ্গি সৃষ্টি করে নেয়। আমি নিজে কিছু করি না। করা যে যায় না, তা না। আগে করতাম। তাতে কৃত্রিমতা ধরা যায়। আমি কারেন্ট জালের একজন শ্রমিককে নিয়ে গল্প লিখতে গিয়ে তাকে দিয়ে পশ্চিমের তত্ত্বপ্রচারের বাহন বানাতে রাজি না। তার মধ্য দিয়ে তার পরিবেশের কথা বলাতে পারব। প্রেমেন্দ্র মিত্র এক গল্প নাকি একাধিকবার একেক রকম করেও লিখতে পারতেন। সৈয়দ শামসুল হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য’ পড়ার পরে গল্প নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলাম। তাতে সব সময় যে নেতিবাচক ফল হয় তা না। অনেক সময় ভালো কিছুও বেরিয়ে আসে।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে পারে বা চায়?
সব পাঠককে তো এক পাল্লায় মাপা যায় না। কোন মানের, কোন বয়সের, কোন পেশার, কোন শ্রেণীর এমনকি এটাও মনে রাখতে হয় কোন দেশের। পশ্চিমবাংলার পত্রিকায় লেখা দিতে হলে সে গল্পের ভাষা ভিন্ন হয়। সেখানকার পাঠকের সম্প্রদায়ও মনে রাখতে হয়। গৌরকিশোর ঘোষ বা আবুল বাশারের লেখায় মুসলমান সমাজে ব্যবহৃত আরবি-ফারসি শব্দের পাশে বন্ধনিতে বাংলা শব্দ বসিয়ে দিতে হয়। যদি তারা বাংলাদেশে বাস করতেন তাহলে এটা করতে হতো না। ভাষার সাম্প্রদায়িকতা আমি বাংলাতেই দেখি। বাংলার মতো পাঞ্জাবওতো সাম্প্রদায়িকভাবে ভাগ হয়েছে। পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলমান লেখকরা উর্দু ভাষায় যে শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করেন তার সেই বইটি দিল্লি থেকে হিন্দিবর্ণমালায় যখন প্রকাশিত হয় শব্দভাণ্ডার তাই থাকে। ওখানে একই শব্দভাণ্ডারে দুটি ভিন্ন বর্ণমালায় লেখা হয়। আর বাংলায় একই বর্ণমালায় দুটি ভিন্ন শব্দভাণ্ডারে লেখা হয়। সেখানে দুটি সম্প্রদায় একই ভাষাভঙ্গি সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে পারেন। এতে করে লেখকের কাজ করার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়। কাজেই পাঠকের শ্রেণী এবং ভিন্নতা আছে। একেক ধরনের পাঠকের চাওয়া একেক রকম। তবে যদি সমকালের পাঠকের কথা অগ্রাহ্য করে দূর ভবিষ্যতের পাঠকের কথা ভেবে লিখি তাহলে চিরকালীন বা ধ্রুপদী ভঙ্গিতেই লিখতে হয়। আবার যদি মনে করি আমার গল্পটি ইংরেজি করে বিদেশি পাঠকদের জন্য কোনো ওয়েবে দেবো, তাহলে বৈশ্বিক অনুভবের বিষয়টা মাথায় চলে আসে। ওরহান পামুকও এ কথাটা স্বীকার করেছেন, আগে তিনি শুধু তুর্কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লিখতেন, এখন তিনি বৈশ্বিক পাঠকের কথাও মাথায় রাখেন।
চিন্তাসূত্র: একজন কবি যখন একজন গল্পকারও, তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
বাংলাসাহিত্যে তো এর বড় প্রমাণ তো রবীন্দ্রনাথ। আর পশ্চিমে এত ভাগ-বিভাগের উন্নাসিকতা আছে বলে মনে করি না। কথা-সাহিত্যিকেরা কবিতা লেখেন, কবিরাও গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখেন। আমাদের মতো দেশেই এ প্রশ্ন ওঠে। আফ্রিকার অনেক লেখক বহুমাত্রিক। কবিতা বা গল্প যাই লিখি না কেন, আমি সাহিত্যিকের নির্দিষ্ট কাঠামোতে বিশ্বাস করি। কাঠামোতে নতুনত্ব থাকতে পারে, পরিবর্তনশীলতা থাকতে পারে। এলিস মুনরো মনে করেন, ছোটগল্পই সব কিছু পারে, তাই তিনি উপন্যাসের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন। আমি মনে করি চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য উপন্যাসের বিকল্প নাই। সমাজচিত্রের জন্য উপন্যাস লাগে, এপিক উপন্যাসও লাগে। ছোটগল্প স্কেচ করতে পারে জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের স্কেচেরে মতো। কিন্তু ‘নবান্ন’, বা ‘মনপুরা’ উপন্যাস ছাড়া আর কিছু নয়। তাই আমি সাহিত্যের রূপতাত্ত্বিক কাঠামো ভেঙে দেওয়ার পক্ষে না। আমি কবিতা লিখি, গল্পও লিখি। আমি আগে গল্প লেখক, পরে কবিতায় এসেছি। প্রতিটি বিষয় ভিন্ন। বহিরঙ্গ এবং অন্তরঙ্গে পার্থক্য আছে। কবিতা বলার বিষয় না, অনুভব করার। শব্দ সমবায় কবিতার শরীর। কিন্তু গল্প ভিন্ন বিষয়। শব্দ ছাড়া কবিতা হয় না। কবিতা সার্থক হয় শব্দের শক্তির ওপর। কিন্তু গল্পের নিজের একটা শক্তি আছে। সে শক্তির জোরেই সে বেরিয়ে আসে। গল্প বলতে ভাষার অতিরিক্ত বিষয়ও লাগে। ভাষা ছাড়াও গল্প হয়। আমার এক আত্মীয় আছে বাকপ্রতিবন্ধী। সে তার মনের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা সব কিছু আমার কাছে বলে। সে সামান্য কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। তার বেশিরভাগই বাগযন্ত্রের সমস্যায় আকীর্ণ। আমি কিন্তু তার সব কথাই বুঝি। আর বুঝি বলেই সে আমার কাছে বলতে চলে আসে। তার অর্থনীতি-রাজনীতিভাবনা আছে, ধর্ম এমনকি দর্শনচিন্তাও আছে। সে যে গল্প বলে তা ভাষানির্ভর নয়। কিছুটা শারীরিক ইশারা আর কিছুটা আমার পূর্বাভিজ্ঞতা এবং পরিচয়সূত্র ধরে কাজ করে। এমন নানা ধরনের প্রতিবন্ধীরও গল্প থাকে। যারা বোবা কিংবা তোতলা তাদেরও গল্পবলার প্রবণতা আছে। সেগুলো অভিনব উপায়ে প্রকাশিত হয়।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
সেটি নির্ভর করে চরিত্রের ও পরিবেশের ওপরে। আর লেখকের ইচ্ছার মধ্যেও। আমি যদি চাই গল্পে কিছুটা যৌনতা দিয়ে দেবো কাজী আনোয়ার হোসেনের ভাষায় ‘চাটনির’ মতো, তাহলে দেওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টা পাঠকের কাছে ধরা পড়ে যায়। এখানে অভিজ্ঞতার ব্যাপার আছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নাকি কলকাতা এবং ঢাকায় থাকতে যত গল্প লিখেছেন সেগুলোতে যৌনদৃশ্য থাকলে তা আবু রুশদ লিখে দিতেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কি অভিজ্ঞতার অপেক্ষায় ছিলেন? আপনি বলেছেন নান্দনিকতার কথা, আমি বলব অভিজ্ঞতাভিত্তিক বাস্তবতার কথাও। পাবলো নেরুদা আত্মজীবনীতে উঠতি তরুণ বয়সের একটি যৌন অভিজ্ঞতার কথা সরলভাবে বর্ণনা করেছেন। এক কৃষাণীর সাথে সম্পর্ক। এটি যেভাবে বর্ণিত হয়েছে তা যদি তাঁর রাষ্ট্রদূতজীবনে ঘটত অবশ্যই ভিন্নভাবে লিখতে হতো। বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’তে মধ্যবিত্তের যে বর্ণনা তা কিন্তু ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবের-কপিলার সম্পর্কের মতো না। আবার ধরেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের যৌনতা এবং ‘চোর’ গল্পের যৌনতা এক রকমের নয়। এগুলো গল্পের বাস্তবতার ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। যৌনতার সামাজিক ভাষাটা আয়ত্তে নিতে পারলে সাহিত্যে যৌনতাকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করা যায়। তবে অনেক আধুনিক ভঙ্গিতেও নান্দনিক করে তোলা যায়। অনেক আগে মধ্যযুগের পটভূমিতে একটি কাব্যনাটিকা লিখেছিলাম, সেখানে আধুনিক ফটোগ্রাফিক স্টাইল প্রয়োগ করে যৌনতা এনেছিলাম। এখন দেখি ভালো লাগে না। চলচ্চিত্রিক, আলোকচিত্রিক এমনকি পেইন্টিংস বা স্কাল্পচারের স্টাইলও প্রয়োগ করা যায়। শিল্প অনেকটাই শিল্পীর দক্ষতার ওপর নির্ভর করে।
চিন্তাসূত্র: কোন শ্রেণীর ছোটগল্প সবচেয়ে বেশি পাঠকসমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
এটি বলা মুশকিল। আমি যখন ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে সিরিয়াসলি গল্প লেখা শুরু করি তখন ছিল ধ্রুপদী ভঙ্গি। সেখানে সৈয়দ শামসুল হক, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, হাসনাত আবদুল হাই, রশীদ করীম, কায়েস আহমেদ, তলস্তয়, চেখভ, বা ক্লাসিক পশ্চিমা গল্পের প্রভাব ছিল। এর পরে ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে গল্প বলার ধরন পাল্টাই। বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেবো, নতুন কিছু করে ফেলবো এমন কোনো উচ্চাশা নিয়ে না, শুধু একঘেয়েমি দূর করার জন্যে। এ সময় একটি বড় ঘটনা ঘটে যায় আমার ভেতরে, তা হলো ধারাবাহিকভাবে দৈনিক জনকণ্ঠে ‘খোয়াবনামা’ পড়া। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এ উপন্যাসের জাদুবাস্তবতা। এটি আমাকে এক দিকে মুগ্ধ করে, আরেক দিকে বিরক্ত করে। মুগ্ধতা ছিল আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের মিল দেখে। আর বিরক্তিও সেখান থেকেই আসে। এই উপন্যাসের ভূত-প্রেত, বিশ্বাস-অবিশ্বাস সব কিছুই কলম্বিয়া থেকে আমদানি করা। তখন আমি মানুষের মুখে মুখে ভূতের গল্প শোনা শুরু করি। মনোবিজ্ঞানের কিছু বইও পড়ি। তখন ঐ অতৃপ্তি থেকে নতুন ধারায় গল্প লিখি, সেগুলো পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি রীতিতে লিখি। এখানে এসে পাঠকের কথা শুরু করতে হয়। এই সময় এসে আমার একটি গল্প দূরের এক জেলায় একটি প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়। এ সময়ের আরেকটি গল্প—‘সুরুচি স্টোর’ পাপড়ি রহমান সম্পাদিত ‘ধূলিচিত্র’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে অনেকে প্রশংসা করেন। গল্পটি পরে চন্দন চৌধুরী সম্পাদিত ‘শূন্য দশকের গল্প’ সংকলনে স্থান পায়। আমার পরাবাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতা ছিল আমাদের দেশের লোকবিশ্বাস নির্ভর। এই ধারাটিতেও এক ঘেয়েমি চলে আসার পরে আবার ধ্রুপদী ধারায় ফিরে যাই। আমি কিন্তু পরের ভাষায় আমি গল্প লিখতে রাজি না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হাসান আজিজুল হকের ভাষা দিয়ে গল্প লিখতে চাই না। আমার গল্পের ভাষা মূলত চরিত্রদের শ্রেণিভাষা। কোন ধরনের গল্প পাঠকের কাছে বেশি ভালো লাগে তা বলা যায় না। তবে পাঠক নতুনত্ব চায়।
চিন্তাসূত্র: একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোন কোন শর্ত পূরণ করতে হয়?
যেহেতু আমি সাহিত্যের কাঠামোতে বিশ্বাস করি, তাই বলবো, প্রথমে গল্পটি গল্প হতে হবে। এটিকে কবিতা বানালে বা প্রবন্ধ বানিয়ে তুললে পাঠক গল্প হিসাবে নেবে না। পাঠকও দেখেন চরিত্রদের শ্রেণিগত বাস্তবতা আছে কিনা। আধুনিক ছোটগল্পের আগে রূপকথার যুগে রাজপুত্র আর রাখাল বালকের গল্প এক রকম ছিল না। এখনো শ্রেণিভিত্তিক চরিত্রের বাস্তবতাই আমি মনে করি প্রথম শর্ত। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর আশেপাশের চেনা লোকদেরকেই গল্পে ঢুকিয়ে দিতেন। মানে নিজের চারপাশ থেকেই চরিত্র সংগ্রহ করতেন। এতে কি অবিকল সমাজটি উঠে আসতো? অবশ্যই না। সৃষ্টি করতেন নিজের একটি সমাজ। যে চরিত্রটি তিনি সংগ্রহ করলেন তাকে নিজের জগতে প্রতিস্থাপন করে নতুন এক বাস্তবতা সৃষ্টি করতেন। এই বাস্তবতাই প্রথম শর্ত। সংলাপ বা ভাষা চরিত্রনির্ভর হওয়াকে আমি মনে করি পরের শর্ত। রবীন্দ্রনাথের লেখনির জোরে অনেক অসঙ্গতিও টিকে যায়। যে যুগে মেয়েদের নয়-দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যেত, মা হয়ে যেত, সেযুগে ‘পোস্টমাস্টারের’ সাথে এক ঘরে তেরো বছরের রতনের ঘুমানো অসঙ্গত। কিন্তু গল্পটি আমাদের যুগের হাজার হাজার গল্পের চেয়েও বেশি টেকসই।
চিন্তাসূত্র: ছোটগল্প নিয়ে পরিকল্পনা কী?
তেমন পরিকল্পনা নাই। এ পর্যন্ত আমার কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু এখনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় নাই। লেখায় ঘষামাজা করে অসঙ্গতি থাকলে দূর করে তারপরে ছাপাতে দেবো। গল্প লেখার ইচ্ছা সর্বদা। যদি কোনো কারণে লিখতে না পারি মুখে মুখে বলে যাবো। গল্পের ভেতর দিয়ে সমাজ পরিবর্তন করা যায় না, তবে পরোক্ষ শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। আমাদের এলাকার ব্যর্থ শ্রমিক আন্দোলনের নানা দিক নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে। জাতীয় জীবনের মুক্তিযুদ্ধ বা ভাষা আন্দোলনের অজানা, অচেনা দিকগুলোতে আলোকপাত করার অনেক সুযোগ আছে। স্থানীয় ছোট-খাট আন্দোলন নিয়েও লেখার ভালো সুযোগ। মঞ্জু সরকারের কিছু ভালো গল্প আছে স্থানীয়, ক্ষুদ্র পরিসরের আন্দোলন নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে রুশ লেখক নিকোলাই তিখনভ ছোট ছোট বিষয় নিয়ে, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক গল্প লিখেছেন। দুই বাংলার অনেক লেখকের লেখাতেই তিখনভের প্রভাব আছে বলে মনে হয়। মাহমুদুল হকের ‘কালো মাফলার’ গল্পটিও মনে হয় তেমন একটি। তবে ছোট পরিসরে গল্প বলার জন্য যেহেতু সাহিত্যের এই শক্তিশালী মাধ্যমটি বেশ সতেজ, তাই ছোটগল্পের সম্ভাবনা আমার কাছে মনে হয় বিরাট। যতদিন পারি, সেই সম্ভাবনাই কাজে লাগাতে চাই।