[জিরোপয়েন্ট পত্রিকা-প্রদত্ত ‘নজরুল অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করতে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট তপন বাগচী গিয়েছিলেন বর্ধমান জেলার মেমারিতে। সেখানে ‘আলোকপাত’ মিডিয়ার পক্ষ থেকে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সেখ মনোয়ার হোসেন। ভিডিওগ্রাফিতে সহযোগিতা করেন মুর্শিদাবাদের কবি রোজিনা পারভিন। এই সময় উপস্থিত ছিলেন নজরুল ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম, নজরুলসংগীতের বিশিষ্ট গবেষক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নজরুল-নাতনি কাজী সোনালী ইসলাম, জিরোপয়েন্ট সম্পাদক আনোয়ার আলি প্রমুখ। সাক্ষাৎকারটি আলোকপাতের নিজস্ব চ্যানেলে প্রচারিত হয়। সেটি অনুলিখন করেছেন কবি রঞ্জনা বিশ্বাস। এবারের নজরুলজয়ন্তির উপহার হিসেবে সাক্ষাৎকারটি ঈষৎ সম্পাদিতরূপে চিন্তাসূত্রের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।]
মনোয়ার হোসেন: আমরা উপস্থিত হয়েছি বর্ধমান জেলার মেমারিতে ‘জিরোপয়েন্ট’ পত্রিকার উদ্যোগে নজরুল উৎসবে। আমরা এখানে মুখোমুখি হয়েছি বাংলাদেশি নজরুল-গবেষক এবং লোকসাহিত্যের ওপর যিনি বিশেষজ্ঞ ডক্টর তপন বাগচী, তিনি সুদূর বাংলাদেশ থেকে নজরুলের টানে আজকের এই প্রোগ্রামে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। ডক্টর বাগচী, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আলোকপাতের প্রোগ্রামে।
তপন বাগচী: আপনাকেও ধন্যবাদ ও আপনার মাধ্যমে যারা আলোকপাতের এই অনুষ্ঠান শুনছেন, যারা দেখছেন তাদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে একটু আপত্তি জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশ কিন্তু সুদূর নয়, একেবারেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র, আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র কিন্তু সুদূর বললে দূরত্বটা বাড়িয়ে বলা হয়। আমার মনে হয়, ভৌগোলিক দূরত্ব যেমন আমাদের কম তেমনি অন্তরের দূরত্বও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেক কাছের। আর আজকের এই নজরুল উৎসবে যোগ দেওয়ার কারণ হচ্ছে জিরোপয়েন্ট পত্রিকার সম্পাদক আনোয়ার আলির আমন্ত্রণ। তারা এবার আমাকে ‘নজরুল অ্যাওয়ার্ড’দেওয়ার জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন। এজন্য বিশিষ্ট নজরুলসংগীত-গবেষক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। গত ২৪ মে আমি এসেছিলাম নজরুলের জন্মগ্রাম চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমি-প্রদত্ত ‘নজরুল পদক’ গ্রহণ করতে। নজরুল-ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম ও নজরুল-নাতনি কাজী সোনালী ইসলাম এখানেও এসেছেন। আমি এদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।
মনোয়ার হোসেন: আমরা জানতে পেরেছি, আপনি নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং ডক্টরেট উপাধি পেয়েছেন সেই সম্পর্কে আমাদেরকে একটু জানান। এটা জেনে আমাদের গর্বে বুক ভরেছে। আপনার মুখ থেকে আমরা শুনতে চাই।
তপন বাগচী: আমি নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করেছি, এটা হয়তো ভুল জানেননি। কিন্তু আমার ডক্টরেট উপাধি নজরুল-গবেষণার জন্য নয়। আমি ডক্টরেট পেয়েছি বাংলাদেশের যাত্রাগানের ওপর গবেষণা করে। নজরুলকে নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ রচনা করি মূলত নজরুল জন্মশতবর্ষে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে নজরুল ইনস্টিটিউট আছে, সেই ইনস্টিটিউট একশটি গ্রন্থ প্রণয়নের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে নজরুলের একশ বছরকে উদযাপনের জন্য নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে। সেখানে আমি একটি গ্রন্থ রচনার দায়িত্ব পাই। তখন নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত নজরুল-গবেষক, এখন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর রফিকুল ইসলাম এবং নির্বাহী পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। তাদের আমন্ত্রণে আমি ‘নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার’ বলে একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করি। আমরা নজরুলকে রাজনৈতিকভাবে দেখেছি, সংগীতের মানুষ হিসেবে দেখেছি কিন্তু তার কবিতার অলঙ্কার-তাত্বিক বিশ্লেষণ খুব-একটা হয়নি। ওই দিকটাকে গুরুত্ব দিয়ে আমি নজরুলের কবিতার শব্দালঙ্কার অনুসন্ধান করে দেখিয়েছি যে, কাব্যতত্ত্ব বিচারেও বাংলাভাষার একজন প্রধান কবি হিসেবে নজরুল আমাদের কাছে সম্মানিত হতে পারেন। পরে নজরুল নিয়ে আমার আরও কিছু অনুসন্ধান অব্যাহত ছিল। এই একবার যখন তার ওপর গবেষণা করতে গিয়ে আমার বিচিত্রমুখী পাঠের সুযোগ হয়েছে, সেই পাঠপ্রতিক্রিয়াকে সম্বল করে পরে বিচ্ছিন্ন বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখি। সেটি সম্প্রতি ‘নজরুল সাহিত্যে কমালোচিত অধ্যায়’ নামে প্রকাশিত হয়। লক্ষ করবেন, আমি শব্দটি ব্যবহার করেছি ‘কমালোচিত অধ্যায়’, যে অধ্যায়গুলো বা যে প্রসঙ্গগুলো কম আলোচিত হয়েছে, মানে আলোচনার পাদপীঠে কম এসেছে, সে রকম কিছু বিষয় নিয়ে আমি নজরুলের ওপর একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করি, সেটি গতবছর প্রকাশিত হয়। আনন্দিত যে, এই বইটিকে সামনে রেখে আমাকে নজরুলের জন্মগ্রামে প্রতিষ্ঠিত নজরুল অ্যাকাডেমি আমাকে নজরুল পদক দিয়ে সম্মানিত করে। এইটা আমার জীবনের একটি বড় অর্জন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে বর্ধমানের আররেক শহর মেমারিতে যে নজরুল-উৎসব হয়, নজরুল প্রয়াণদিবসকে সামনে রেখে, সেখানে আমাকে জিরোপয়েন্ট পত্রিকার উদ্যোগে ‘নজরুল অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। আমি বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছি। এখানে কাজ করি বাংলা অ্যাকাডেমিতে। বাংলা অ্যাকাডেমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আর একটি প্রতিষ্ঠান যারা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে মূলত কাজ করে থাকে। সেখানে আমি গবেষণা উপবিভাগের উপপরিচালক হিসেবে কাজ করি। প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে বাইরে গিয়ে আমি নজরুলকে নিয়ে যে চর্চাটা করেছি, নজরুল বিষয়ক বেশ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছি, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমি একাধিকবার আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে গিয়েছি, ঢাকা শহরে অনেক সভা সেমিনারে আমি নজরুলকে নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আপনারা জানেন, ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহৃত বর্ধমান হাউজে কাজী মোতাহার হোসেন যে ঘরে থাকতেন, নজরুল ঢাকায় এলে সে ঘরে থাকতেন। আমি চাকরিসূত্রে যখন বাঙলা একাডেমিতে যোগদান করি, তখন আমার বসার জায়গা হয় ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ নামের ওই কক্ষে। আমি খুব গর্বিত যে, নজরুল কোলকাতা থেকে যখন ঢাকাতে যেতেন, যে কক্ষে তিনি রাত্রি যাপন করতেন সেই কক্ষে আমি অফিস করেছি প্রায় ৫ বছর। সেটি আমার জন্যে খুব আনন্দের অর্থাৎ নজরুলের স্মৃতিকক্ষ আমারও এখন একটি স্মৃতিকক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার স্মৃতির একটি বড় অংশ ওখানে। ওখানে গিয়ে আমি লক্ষ করেছি যে, নজরুলকে নিয়ে প্রথম গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেন কাজী আবদুল ওদুদ, তারপরে একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী এবং তৃতীয় গ্রন্থটি লেখেন কাজী মোতাহার হোসেন। এই বইটি নজরুল সাহিত্য-সমালোচনার একটি বড় মাইলফলক হয়ে আছে। এর বাইরেও কাজী মোতাহার হোসেন বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। তার স্মৃতিকথার মধ্যে নজরুল প্রসঙ্গ এসেছে, নজরুলের পুস্তক সমালোচনা করেছেন। এগুলো একক কোনো গ্রন্থে ছিল না তখন আমি ‘কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুলচর্চা’ নামে এই প্রবন্ধগুলো সংকলন করি। এর বাইরে কলকাতা থেকে আমার একটি বই বের হয়েছে ‘অদ্বিতীয় নজরুল’ নামে। আমরা যে মেমারিতে আছি, এর কাছাকাছি যে মানকর কলেজ আছে ওই কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. অরিজিৎ ভট্টাচার্য এবং আমার যৌথ সম্পাদনায় ওটি প্রকাশিত। অরিজিৎ তখন আসানসোল কাজী নজরুল বিশ^বিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক ড. মোনালিসা দাসের মাধ্যমে অরিজিৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দুই দেশে বাংলাভাষায় নজরুল বিষয়ক যত গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে তার থেকে নির্বাচিত অংশ নিয়ে আমরা গ্রন্থটি প্রকাশ করি যার নাম ‘অদ্বিতীয় নজরুল’। এই গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ও নজরুল ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক ডক্টর মনিরুজ্জামান। এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ছিলেন আামদের জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর পদ্মভূষণ ডক্টর আনিসুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আসানসোল কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর সাধন চক্রবর্তী এবং ময়মনসিংহ জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ডক্টর মোহীতউল আলম। নজরুল-বিষয়ক দুটি নিজস্ব গবেষণাগ্রন্থ এবং দুটি সম্পাদিত সংকলন গ্রন্থ-এই চারটি গ্রন্থ নিয়ে আমার নজরুলচর্চা অব্যাহত রেখেছি।
এর বাইরে বাংলাদেশের যাত্রাগান নিয়ে যে গবেষণা করেছিলাম কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, সেখানকার বাংলার অধ্যাপক প্রখ্যাত লালন-গবেষক প্রফেসর ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে ‘বাংলাদেশে যাত্রা গান-জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ এই নামে, সেখানেও নজরুল ও যাত্রাগান প্রসঙ্গ রয়েছে। এই গবেষণার সহ-তত্ত্বাধায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রফেসর ডক্টও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। অভিসন্দর্ভটি বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে আমি আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করি। আমার জন্মজেলা মাদারীপুর, আমাদের জাতির পিতার জন্মজেলা গোপালগঞ্জ এবং শরিয়তপুর; এই তিনটি জেলার ইতিহাস নিয়ে আমার তিনটি গ্রন্থ আছে। এর বাইরে বাংলাদেশের লোকসংগীত, বিশেষ করে বাংলাদেশের আঞ্চলিক পর্যায়ের কিছু সংগীত আছে, সেইগুলো নিয়ে আমার কিছু অনুসন্ধান আছে। সেইগুলো নিয়ে আমার একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আর গর্বের সঙ্গে বলতে চাই যে, নজরুলকে নিযে কাজ করার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, তাতে ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ আখ্যান’ এই বলে আমার একটি গবেষণা গ্রন্থ আছে। আর একটি গ্রন্থ আছে রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা ১০টি বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ, সেইগুলোর একটি সংকলন করেছি। এছাড়া ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ-আখ্যান’নামে আমার একটি গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে।
মনোয়ার হোসেন: বইগুলো কি আমাদের ভারতে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে এভেইলাবল?
তপন বাগচী: না। পশ্চিমবঙ্গে ‘অদ্বিতীয় নজরুল’টি এভেইলাবল। এটি প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার শী বুক এজেন্সি থেকে। অন্য বইগুলো পাওয়া যেতে পারে, কলকাতায় সেপ্টেম্বর মাসে যে বাংলাদেশ বইমেলা হয়, সেখানে। এছাড়া কিছু লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়, নজরুল একাডেমি চুরুলিয়া, ওই লাইব্রেরিতে আমার কিছু বই আছে। পশ্চি বঙ্গের রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বই আছে আমার। আর নদিয়ার কথাকৃতি প্রকাশন এবং কবিতাপাক্ষিক থেকেও আামর বই প্রকাশিত হয়েছে সেখানেও পাওয়া যেতে পারে।
মনোয়ার হোসেন: এবার যে প্রশ্নটি করবো, ভারত এবং বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে যে বইটি যে বইটি বানিয়েছেন বা তৈরি করেছেন ‘অদ্বিতীয় নজরুল’ সেটি আমাদের এখানে বা কোলকাতায় পাওয়া যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি নজরুলকে নিয়ে এত কিছু ভেবেছেন, কেন এই নজরুলপ্রীতি? কী পেলেন এই নজরুল-সাহিত্যে?
তপন বাগচী: নজরুলের সাথে আমার সম্পর্ক, আমাদের এক আঞ্চলিক ব্যাপারও বলতে পারি। সেটি হলো, আজকে আমরা যে নজরুলের ‘চল চল চল’ গানটি গাই, যেটি বাংলাদেশের ‘রণসঙ্গীত’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৮ সালের এপ্রিল-মে মাসে। তখন ফরিদপুর থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো ‘মোয়াজ্জিন’ নামে। ওই পত্রিকার উদ্বোধনী সংখ্যায় আশীর্বাদী কবিতা হিসেবে ‘মোয়াজ্জিন’ নামে ছাপা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এটিকে আমাদের ‘রণসংগীত’ হিসেবে গ্রহণ করেন। আমার বাড়ি ফরিদপুর থাকার কারণে ওই পত্রিকার একটি পুরোনো সংখ্যা দেখার সুযোগ হয়। আমি লক্ষ করলাম যে, একটি মফস্বলের পত্রিকা, একটি প্রান্তিক অবস্থানের পত্রিকা সেখানে নজরুলের ২৬টি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল। গান, ছড়া, কবিতা, পুস্তক সমালোচনা সব মিলিয়ে ২৬টি রচনা। তারপর থেকে নজরুলের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মালো। ওই পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ আবদুর রব। তিনি ‘নজরুলনামা’ বলে পদ্যে নজরুলের জীবনী লিখেছিলেন নজরুল জীবদ্দশাতেই। এগুলো আমাকে আকৃষ্ট করে, নজরুল সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হই এবং আপনারো জানেন যে, নজরুল যে নির্বাচন করেছিলেন, ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, সেটি আমার ফরিদপুর থেকে আমার জেলা থেকেই। হেরে গিয়েছিলেন কিন্তু নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছিলেন আমার জেলা থেকে। নজরুল আর একজনকে খুব পছন্দ করতেন, তার সঙ্গে বহরমপুর জেলে কাটিয়েছেন, তিনি হলেন ‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র’, ‘মাদারীপুরের মর্দবীর’ বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাস। তার একটি বিখ্যাত কবিতা আছে ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ নামে। ওই পূর্ণচন্দ্রের বাড়ি ও আমার বাড়ি একই জায়গায় মাদারীপুর। নজরুল যে ‘ধীবরদের গান’ লেখেন মাদরীপুরে ধীবর সম্মেলনে গিয়ে। অর্থাৎ আমার জন্মস্থানের কাছাকাছি নজরুল একাধিকবার গিয়েছেন এবং নজরুলের ওখানে রচনা নিদর্শন আছে। ওখানকার মানুষের সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। এই বিষয়গুলো আমাকে নজরুলের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করেছি যে, নজরুল এমনই একজন মানুষ যিনি জাতিধর্মবর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে একজন আন্তর্জাতিক মানব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজেকে। যার ভিতরে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ করা যাবে না, যাকে জাতিতে জাতিতে ভেদ করা যাবে না, দুই বাংলার সংস্কৃতির সেতু হিসেবে মনে করি নজরুলকে। এরকম আক্ষরিক অর্থে অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী চেতনার মানুষ নজরুলের বাইরে আমরা খুব বেশি দেখতে পাই না। তখন মনে হলো যে, এই লোকটির সাহিত্যকীর্তি, এই লোকটির সংগীতকীর্তি, এই লোকটির যত কর্মকাণ্ড সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, তার সবকিছু আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে উপস্থিত করা দরকার। তাহলে হয়তো আমাদের হানাহানি কমবে, মানুষে মানুষে ভাতৃত্ব বোধ তৈরি করবে, আমাদের সংস্কৃতির সেতু আরো দৃঢ় হবে। এই রকম একটি অভিপ্রায় থেকে আমি নজরুলচর্চায় মনোনিবেশ করেছি।
মনোয়ার হোসেন: আমরা শুনলাম ডক্টর বাগচীর কাছ থেকে কেন নজরুলপ্রীতি? তিনি খুব সুন্দরভাবে আমাদের একপ্লানেশন দিলেন যে, নজরুলের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং এটা আমার ভালো লাগলো যে, নজরুল বাংলাদেশে গিয়েও ইলেকশনে লড়েছেন। সেটা আর একটু আমি জানতে চাইছি, বেশ ইন্টারেস্টিং।
তপন বাগচী: এটা মোটামুটি অনেকেরই জানার কথা তখন যে নির্বাচনের ব্যাপারটা, নজরুল নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯২৬ সালের কথা। স্বরাজ দলের হয়ে এই কবি নির্বাচন করেছিলেন। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকা বিভাগের মুসলমানদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের একজন সদস্য পদে। ফরিদপুরে তখন বড় নেতা ছিলেন তমিজউদ্দিন খান, উনি জিতেছিলেন। নির্বাচনি প্রচারণায় নজরুলকে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। মুসলিম-আসনে ‘কাফের’কে কে ভোট দেয়? ময়মনসিংহ-ঢাকা-ফরিদপুর-বরিশাল অঞ্চলে নজরুল পেয়েছিলেন মাত্র ১০৬২ ভোট। কবি হুমায়ুন কবীর তখন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন, তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কবি জসীমউদ্দীন। উনি জসীমউদ্দীনের বাড়ি থেকে দিনভর গান করতেন। সবাই যখন বলছে যে, কাজীদা নির্বাচন হচ্ছে, ক্যাম্পিংএ যেতে হবে, জনসভায় যেতে হবে তিনি এগুলোর গুরুত্ব না দিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতেন। তিনি পাগলাটে ছিলেন, পাগলাটে আমি আদুরে অর্থে বলছি, খেয়ালি মনের ছিলেন। সে কারণে তিনি জানতেন যে সাধারণ মানুষ তাকে ভোটের রাজনীতিতে গ্রহণ করবে না কিন্তু যিনি ভোটে জিতে ছিলেন তার নাম মানুষ জানে না কিন্তু মানুষ জানে ওই ভোটে পরাজিত হলেও নজরুল মানুষের কাছে জয়ী হয়েছেন। মজার ব্যাপার হলো কবি নির্মলেন্দু গুণও (বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্লাসমেট ছিলেন), নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হলেন। নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা আছে ‘কবি নজরুল পরাজিত হলে ক্ষতি কার?’ নজরুল যে পরাজিত হয়েছিলেন তাতে যদি ক্ষতি হয়ে, তাতে মানুষেরই ক্ষতি হয়েছে। আমরা তাকে জিতিয়ে দিতে পারলে, তাকে বিজয়ী করলে মানুষই জয়ী হতো।
মনোয়ার হোসেন: আপনার কাছে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস জানতে পারলাম। সেই সময় নজরুল পরাজিত হয়েচিলেন কিন্তু যিনি জয়ী হয়েছে মানুষ তাকে মনে না রেখে পরাজিত নজরুলকেই মনে রেখেছে। এবার আমি আপনার কাছে একটা জিনিস জানতে চাইবো, বাংলাদেশে যে নজরুল অ্যাকাডেমি আছে এবং নজরুলকে নিয়ে অনেক চর্চা হয়, সেই চর্চার অগ্রগতি কি সত্যিই সন্তোষজনক?
এখানে হিন্দির প্রভাবে কিছুটা কথ্যভাষা বদলে গেছে বটে! এর থেকে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, আমরা ৫২-তে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি বাঙলাকে, সে কারণে আমাদের অন্য কোনো ভাষার আগ্রাসন নেই। এখানে অন্যভাষার আগ্রাসন থাকার কারণে পশ্চিমবঙ্গে ভাষায় কিছুটা বদলে যাচ্ছে।
তপন বাগচী: নজরুল অ্যাকাডেমি বলে যে প্রতিষ্ঠান আমরা বলছি, সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কবি তালিম হোসেন নামে একজন নজরুল-অনুসারীর তত্ত্বাবধানে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে তিনি এটি ভেবেছিলেন। ১৯৬৮ সালে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। সভাপতি হন কবি তালিম হোসেন আর সম্পাদক হন অ্যাডভোকেট একেএম নুরুল ইসলাম। এই নূরুল ইসলাম পরে বিচারপতি এবং স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের উপরাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। নজরুল অ্যাকাডেমি এখনো প্রচলিত আছে কিন্তু সেটি একসময়ে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ করলেও এখন আর তেমন তা চোখে পড়ে না। প্রধানত যে তিনটি লক্ষ্য সামনে রেখে নজরুল অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলি হলো: বাংলার মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রদূত হিসেবে নজরুলের ভূমিকাকে তুলে ধরা; পাকিস্তানি জীবনাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আধুনিক ও প্রগতিশীল ভাবধারার সকল উপাদানকে আত্মস্থ করা এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা। এই উদ্দেশ্য থেকেই বোঝা যায় যে, নজরুলকে তারা ধর্মীয় ও খণ্ডিত দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছেন। মূলত নজরুলচর্চায় যে প্রতিষ্ঠানটি কাজ করেছে, তার নাম নজরুল ইনস্টিটিউট। সেটি নজরুলকে বাংলাদেশে নেওয়ার পর থেকে যে ভবনে রাখা হয়েছেল, যে বাড়িটিতে রাখা হয়েছিল, তার নামে যে বাড়িটি সরকার বরাদ্দ করেছিল ওই বাড়িটিকে ‘কবিভবন’ বলা হয়। ওই ‘কবিভবন’কে পরে নজরুল-গবেষণা তথা নজরুলচর্চার জন্য নজরুল ইনস্টিটিউট করা হয়। এটি আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। আর নজরুল অ্যাকাডেমি যেটি, সেটি তালিম হোসেন করার পরে, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরোধী শক্তির দিকে। অর্থাৎ ওই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমে প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের হাতে চলে গেছে। ওই খান থেকে নজরুলের যে চর্চা হয়, সেটি প্রকৃত নজরুলচর্চা নয়। তাদের লক্ষ্যই তো ছিল ধর্মীয় বিবেচনায় খণ্ডিত নজরুলের উপস্থাপনা। সেই বিচারে তারা সফল। এর পাশাপাশি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছে এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাসাহিত্য ও সংগীত বিভাগে নজরুলকে নিয়ে কোর্স আছে, নজরুলকে নিয়ে আলাদাভাবে পড়ানো হয়। আমি গতবার এসে খেয়াল করলাম এখানে নজরুল জয়ন্তীতে কয়েকটি মাত্র অনুষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অথবা নজরুল নামাঙ্কিত কিছু প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিটি স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১১ই জৈষ্ঠ এবং ১২ ভাদ্র নজরুলজয়ন্তী এবং নজরুরের প্রয়াণদিবস স্বতঃস্ফূর্তভাবে উদ্যাপিত হয়। সরকারি নির্দেশনাও আছে যে, অন্তত এই দুটি দিন নজরুলের জন্য আমরা বরাদ্দ রাখবো। সেই দিন নজরুলের গান হয়, নজরুলের কবিতার আবৃত্তি হয়, নজরুল নিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা হয়, নজরুল নিয়ে বক্তৃতা হয়, শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে, শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করেন।
মনোয়ার হোসেন: এখন যেটা জানতে চাইছি, তাহলে কি আমরা বলতে পারি নজরুল এই নামটা বাংলাদেশ-ভারতের মিলনের একটা বন্ধন? নজরুলকে আমরা যদি একটা প্রতীক হিসেবে ভাবি এবং যে প্রতীকটাকে ভাবি শান্তির প্রতীক, তাহলে নজরুলের এই নামটাকে কি শান্তির প্রতীক হিসেবে ভাবতে পারি, বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশের মেলবন্ধনের জন্য?
তপন বাগচী: ভাবার অপেক্ষা নেই। ইতোমধ্যে সেটি প্রতিষ্ঠিত। নজরুল জন্মসূত্রে বর্ধমান জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী হলেও তার বড় সময়টি কেটেছে দুই বাংলায় ছোটাছুটি করে। তার রচনা যদি দেখি, প্রতিটি রচনায় তারিখ লেখা আছে সেখানে যতখানি না পশ্চিমবঙ্গ তার চেয়ে পূর্ববঙ্গ কম নয়। উনি কুমিল্লায় কাটিয়েছেন, উনি বিয়ে করেছেন মানিকগঞ্জে, ঢাকায় অনেকবার গিয়েছেন, থেকেছেন তার বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাড়িতে। বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুসহ অনেক সময় অভিজাত মানুষের বাড়ি গিয়ে গান শিখিয়েছেন। অর্থাৎ নজরুলের কর্মের একটি বড় অংশ কেটেছে বাংলাদেশে। আমরা আনন্দিত। আমরা জানি যে, নজরুল বেশি দিন সক্রিয় ছিলেন না, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলেও সক্রিয় ছিলেন না, সৃষ্টিতে সক্রিয় ছিলেন না। এই সময় আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে যান। মজার ব্যাপার আমাদের কোনো রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করা হয়নি, এ নিয়ে কোনো সরকারি আদেশ নেই তবু সাধারণ মানুষ তাকে ‘জাতীয় কবি’ হিসেবে বরণ করে নিযেছে। এখন জাতীয় কবি বললে আমরা নজরুলের নামই বলি। সরকারি কোনো নির্দেশের অপেক্ষা না করে এরকম একটি জাতীয় সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষ নিয়ে ফেলেছে। এর ভেতরেই বোঝা যায় যে নজরুল কতখানি সাধারণ মানুষের কাছের। এবং নজরুলের সাহিত্য সংগীতে আমরা যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা জানি, তাতে দেখি তিনি হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান আলাদা করে দেখেননি। সবাইকে দেখেছেন ‘মানুষ’ হিসেবে। এই যে মানুষ হিসেবে সবাইকে দেখা এবং সেটি শুধু মুখের কথা নয়, তিনি জীবদ্দশায়ও সেটি প্রমাণ করেছেন। তিনি ধর্মীয় আচরণের গণ্ডির মধ্যে থাকেননি, ধর্মীয় লোকাচারের ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করেছেন। মানুষকে ভালোবেসেছেন, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, যতটুকু ভালোবাসা দিয়েছেন, তার থেকে মানুষ তাকে কম ভালোবাসা দেয়নি।
মনোয়ার হোসেন: এটা আমরা জানতে পারলাম যে, কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে অঘোষিত জাতীয় কবি। বাংলাদেশের মানুষ এমনভাবে নজরুলকে বরণ করেছে যে মানুষের মুখে মুখে জাতীয় কবি জাতীয় কবি কথাটা ভেসে উঠেছে। এজন্য আমরা ভারতীয় হিসেবে, বাঙালি হিসেবে গর্বিত। ভারতে এসে আপনার কেমন লাগছে?
তপন বাগচী: ভারতে আসা বলতে, পশ্চিমবঙ্গে বেশি আসা হয়। এর বাইরে বেশি যাওয়া হয় না। একবার দিল্লিতে গিয়েছি সার্ক লিটেরেচার ফেস্টিভালে, দুবার জয়পুরে গিয়েছি সার্ক সুফি ফেস্টিভ্যালে প্রবন্ধ পড়তে। সাহিত্যানুষ্ঠনে, কবিতানুষ্ঠানে আমার বেশি আসা হয় পশ্চিমবঙ্গে। ঢাকা-কলকাতায় আমি তো কোনো পার্থক্য পাই না। শুধু ভিসা করতে হয়, কাঁটাতার পেরোতে হয়। এর বাইরে তো কোনো পার্থক্য নেই। একই মানুষ একই সংস্কৃতি একই ভূগোল একই কথাবর্তার ঢং। এখানে হিন্দির প্রভাবে কিছুটা কথ্যভাষা বদলে গেছে বটে! এর থেকে খুব বেশি পার্থক্য নেই। আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, আমরা ৫২-তে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছি বাঙলাকে, সে কারণে আমাদের অন্য কোনো ভাষার আগ্রাসন নেই। এখানে অন্যভাষার আগ্রাসন থাকার কারণে পশ্চিমবঙ্গে ভাষায় কিছুটা বদলে যাচ্ছে। যেমন আমরা নজরুল ইসলামকে উচ্চারণ করি ‘নজরুল ইছলাম’। এটি আরবিতে উচ্চারণে ‘স’ হলো ‘ছ’ -র কাছাকাছি। এখানে সবাই ‘ইশলাম’ উচ্চারণ করে। এই জায়গাটায় আমাদের কানে খুব খটকা লাগে। যে ভাষায় নজরুলের নামটি ছিল আমরা সেই ভাষার উচ্চারণকে গ্রহণ করেছি। এইরকম ছোটখাটো কিছু পার্থক্য ছাড়া খুববেশি পার্থক্য নেই। এখানে ভালো লাগে এই জন্য এখানকার মানুষ, এক একটি থানা গ্রাম পর্যয়ের একজন স্কুল শিক্ষকও সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। অজস্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়, লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে এটা আমরা করতে পারিনি। সেদিক থেকে এখানে এলে আমি অনেক কিছু নিয়ে যেতে পারি। এজন্য বারবার আসি।
মনোয়ার হোসেন: আমি অবারও বলছি আমার সঙ্গে আছেন তপন বাগচী, বাংলাদেশ থেকে। যিনি নজরুল গবেষক এবং নজরুলের ওপর বেশ কয়েকটি বই আছে। এই মুহূর্ত যে বইটা কলকাতাতে এভেইলাবল তার নাম হচ্ছে ‘অদ্বিতীয় নজরুল’। কলকাতায় পাওয়া যাচ্ছে। বইটা প্রকাশিত হয়েছে শী বুক এজেন্সি থেকে। কলকাতায় এটা এভেইলাবল। কলেজ স্ট্রিটে এটা পাওয়া যাবে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আলোকপাতের প্রোগ্রামে। আবার দেখা হলে আমরা আপনার কাছে অনেক কিছু শুনবো। নজরুল নিয়ে ভালো থাকুন। শুভ কামনা রইলো।
তপন বাগচী: এখানে ডাকার জন্য আপনার মাধ্যমেও আলোকপাতের সব শ্রোতা-দর্শককে শুভেচ্ছা জানাই। আমাকে এখানে বসে নজরুল-সম্পর্কে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে আপনার কর্তৃপক্ষকে আমার কৃতজ্ঞতা রইলো।