[জাকির তালুকদার। স্বাধীনতা-উত্তরকালে যে কয়েকজন কথাসাহিত্যিক নিজের জাতিগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র বিবেচনা ও দায়িত্ববোধ থেকে রচনা করেছেন সাহিত্য, ভাষানির্মাণ করেছেন মানুষের প্রতি দরদ দিয়ে; সেই হাতেগোনা সিরিয়াস সাহিত্যিকদের একজন তিনি। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য ও সম্পাদনা মিলিয়ে ইতোমধ্যেই ২৫টি গ্রন্থের স্রষ্টা জাকির তালুকদার। ১৯৬৫ সালে ২০ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এ লেখকের বিশ্বাস মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে, সাধারণ মানুষের কথা লিখেই বাংলাদেশের সাহিত্য নির্মাণ সম্ভব। প্রায় ২০ বছরের সাহিত্যসাধনায় নিজেকে নিয়ে গেছেন বাংলা কথাসাহিত্যের অপরিহার্যদের তালিকায়। তৈরি করেছেন নিজস্ব গল্পভাষা। পুরস্কার পেয়েছেন বেশ কয়েকটি। ২০০১ সালে ‘কুরসিনামা’ উপন্যাসের জন্য ‘কাগজ কথাসাহিত্য পুরস্কার’, সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ‘ঘরোয়া সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৫’, নাটোর থেকে ‘মহারানী ভবানী সাহিত্য পদক -২০০৮’, ‘বগুড়া লেখকচক্র পুরস্কার-২০০৯’ এবং ‘মুসলমানমঙ্গল’ উপন্যাসের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্ন সম্মাননা ২০১১’।অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও। এই অপরিহার্যতা বিবেচনা করেই কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কথাশিল্পী ও সাংবাদিক সালমান তারেক শাকিল]
সালমান তারেক শাকিল: বাংলাদেশের ছোটগল্পের মৌলিকতা কোথায়, আপনার বিশ্লেষণ কী?
জাকির তালুকদার: তার আগে নির্ধারণ করে নিতে হবে বাংলাদেশের ছোটগল্প কখন থেকে শুরু হয়েছিল, কার বা কাদের হাতে শুরু হয়েছিল। মোটা দাগের হিসাবে, সাতচল্লিশের ভারত এবং বাংলাভাগের পর আজকের বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে যে গল্প লেখা হচ্ছিল, এবং আজ পর্যন্ত লেখা হচ্ছে, সেগুলোকেই আমরা বাংলাদেশের গল্প বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। কিন্তু সেগুলোকে আমরা ভারতীয় বাংলা গল্প থেকে পৃথক করব কিভাবে? শুধু এই ভূখণ্ডে বসে লেখা সেই কারণেই পৃথক? না কি ভারতীয় নাগরিকের বদলে বাংলাদেশ এবং তদানীন্তন পাকস্তানের নাগরিকের লেখা বলেই তারা পৃথক? না কি সেগুলো এই বঙ্গের মানুষদের নিয়ে লেখা বলেই পৃথক? কেবল প্রথম দু’টি বিষয়কে অবলম্বন করে পৃথকতা নির্ণয় করতে যাওয়া বালসুলভ। আর শেষোক্ত বিষয়টিকে যদি প্রধান বলে ধরা হয়, তাহলে তো বলতে হয় রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্পই হচ্ছে বাংলাদেশের গল্প। কারণ সেগুলো প্রধানত লেখা হয়েছে এই ভূখণ্ডের মানুষদের নিয়েই। আবার রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পগুলো প্রধানত লিখেছেন শিলাইদহ, শাহজাদপুর এবং পতিসরে বনে। সেই তিন জায়গাই এখন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সব সাহিত্যকীর্তির উত্তরাধিকারের মতো আমরা তাঁর ছোটগল্পের উত্তরাধিকার দাবি করলেও নিশ্চয়ই বাংলাদেশের ছোটগল্প বলতে আমরা রবীন্দ্রনাথের গল্পকে বুঝি না। প্রশ্নকারীও তা বোঝান না। তাহলে ধরে নিতে হবে, বাংলাদেশের গল্পে এমন একটি রচনাকৌশল, এমন বিষয়বস্তু, এমন বয়নশিল্প রয়েছে, যা ভারতীয় বাংলাগল্পের থেকে পৃথক সত্তা নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। বললে নিজের ঢোল নিজে বাজানো হয়ে যায়, তবু বলতেই হয় , আমি গল্প লেখা শুরুর সময় একটি স্পর্ধিত ঘোষণা দিয়েছিলাম যে, আমি বাংলাভাষায় প্রকৃত বাংলাদেশের গল্প লিখতে চাই। আমার একাধিক ছোটগল্পের বইয়ের ফ্ল্যাপে এই বাক্যটি পাওয়া যাবে। কারণ আমার সত্যিই মনে হয়েছিল যে, বাংলাদেশে বসে লেখা হলেও, বাংলাদেশের নাগরিক লেখকদের দ্বারা লিখিত হলেও সত্যিকারের বাংলাদেশের গল্প লিখিত হয়েছিল খুবই কম। বাংলাভাষায় ইংরেজি-ফরাসি গল্প লেখা হয়েছে অনেক, বাংলাভাষায় আরব-ইরান-তুরস্কের গল্প লেখা হয়েছে অনেক, এমনকি বাংলাদেশে বসে বাংলাভাষায় কলকেতীয় গল্পও লেখা হয়েছে অজস্র। নামে বাংলাদেশের গল্প হলেও আদতে সেগুলো বাংলাদেশের গল্প নয় মোটেই। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের সেইসব গল্পে মোটেও খুঁজে পায় না। কেন সেগুলো বাংলাদেশের বাংলাগল্প হয়নি? কারণ একাধিক। প্রধান কারণ অবশ্যই লেখকের মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা। যেহেতু পাকিস্তান আমলে শাসকশ্রেণী চেয়েছে সাহিত্যে একটু ইসলামি গন্ধ থাকুক, অতএব লেখাতে আরব-ইরানি-তুর্কি খুশবু আনতে হবে। যারা আবার নিজেদের আধুনিক মনে করতেন, তারা এসব দেখে নাক সিটকে নিজেদের লেখা গল্পতে ছিটিয়ে দিলেন ইংরেজি-ফরাসি পারফিউম। আরেকটি বড় এবং শক্তিশালী ধারা ছিল এবং আছে পশ্চিমবঙ্গের দাদানির্ভর। দাদারা স্বীকৃতি না দিলে তাদের চোখে কেউ লেখক পদবাচ্য হতে পারে না। অতএব, দাদাদের মতো লিখতে হবে। এই ত্রিমুখী মনস্তাত্ত্বিক সংকট পিছিয়ে রাখছিল বাংলাদেশের ছোটগল্পকে। এখনো অনেকটা রেখেছে। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের ছোটগল্প নামে একটি মৌলিক শিল্পপ্রপঞ্চ দাঁড়িয়ে গেছে। তার মৌলিকতা কোথায়? তার মৌলিকতা বাংলাদেশের মানুষের মতোই মৌলিক। বাঙালি হাজার বছরের মুক্তিযুদ্ধের পরে নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পেরেছে। সেই রাষ্ট্রের জন্ম কারা দিয়েছে? ইংরেজিশিক্ষিত বাবু বা তথাকথিত ব্রাক্ষ্মণ শ্রেণী নয়, দিয়েছে নমঃশূদ্র শ্রেণীর সন্তানরা। আশরাফ শ্রেণীর সাহেবরা নয়, বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে আতরাফ গোত্রের কাদায় পা পুঁতে ফসল-ফলানো কৃষকের সন্তানরা। তাই বাংলাদেশের বাংলাগল্পকে হতে হবে এইসব মানুষদের প্রতিনিধিত্বশীল। অন্য দেশে যেসব বাঙালি লেখক রয়েছেন, তাদের প্রতিভা এবং শক্তিমত্তার জন্য তারা নমস্য হতে পারেন, কিন্তু এই স্পিরিটের শক্তি তারা কোনোদিনই অনুভব করতে পারবেন না। এই স্পিরিটের উত্তরাধিকার তারা কোনোদিনই অর্জন করতে পারবেন না। বাংলাদেশের বাংলাগল্প এই স্পিরিটকে ধারণ করে। এখানেই তার মৌলিকতা।
সালমান তারেক শাকিল: সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?
জাকির তালুকদার: আসলে আমার মতে এখন আর এই বিষয়টি ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজনই রাখে না। মানুষের জীবনের কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়। তাহলে সাহিত্য রাজনীতিহীন হবে কীভাবে? রাজনীতি বলতে রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়া বোঝায় না। মানুষ এবং সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায়, যাকে বলা যায় প্রগতিমুখীনতা। পেছন দিকে গেলে তাকে বলা হয় প্রতিক্রিয়াশীলতা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের নাম রাজনীতি। এতে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ রয়েছে। সাহিত্য সেই অর্থে প্রচণ্ড সক্রিয় একটি রাজনীতি। একজন মানুষের একেবারের ভেতরের ‘আমি’কে যে তার মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে, নিজেকে একেবারে নিজের সামনে যে নিয়ে আসতে পারে, সে হচ্ছে সাহিত্য। তাহলে সাহিত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে রাজনীতির সবচাইতে সক্রিয় সহযোগী। দ্বিতীয়ত, লেখক নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে সবসময়ই রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশ্য সফল করতে হাত লাগান। তিনি মানুষকে যেদিকে ডাক দেন সেদিকের রাজনীতি লাভবান হয়। প্রগতির পক্ষে ডাকলে সেই পক্ষ, স্থবিরতার পক্ষে ডাকলে সেই পক্ষ, আর প্রতিক্রিয়ার পক্ষে ডাকলে সেই পক্ষ লাভবান হয়। এই তিনের বাইরে সাহিত্য হয় না। কোনোদিন হয়নি। তবে সেইসঙ্গে একটি কথাও মনে রাখতে হবে। মোটা দাগে যেসব স্লোগানধর্মী রচনাকে আমরা রাজনৈতিক সাহিত্য বলতে অভ্যস্ত, সেগুলো চিৎকার এবং আস্ফালন ছাড়া আর কিছুই নয়। সেগুলোতে শিল্পমূল্য না থাকায় তা না রাজনৈতিক, না সাহিত্য।
সালমান তারেক শাকিল: আপনি একসময় বাম-রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, এর থেকে সরে আসার কারণ বলবেন?
জাকির তালুকদার: আমি কখনোই রাজনীতি থেকে সরে আসিনি। হয়তো দলীয় সংস্রব ত্যাগ করেছি। আমি কখনোই মনে করি না যে রাজনীতি করা মানে কোনো-না-কোনো দল করা। দলহীনতাও একটি রাজনীতি হতে পারে। তা হচ্ছে, প্রচলিত বা বিদ্যমান দলগুলোর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের রাজনীতি। অবশ্য আগেও যে আমি খুব ঘনিষ্টভাবে সাংগঠনিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকেছি, তা নয়। আমি কখনোই সংগঠনের নিরংকুশ আনুগত্য মেনে নেইনি। আমার মন থেকে কখনোই সমস্ত প্রশ্ন উধাও হয়ে যায়নি। এবং আমি কখনোই নিজের এবং সংগঠনের অবস্থান বা কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকিনি। এখনো নই। তাই সোজাসুজি বলছি যে, আমি রাজনীতি থেকে দূরে নই। আর মার্কসবাদ থেকে দূরে তো নই-ই। আমার ভাবনা-চিন্তা, পঠন-পাঠন ও পর্যালোচনার একটি বড় অংশ জুড়ে আছে মার্কসবাদ। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো মতবাদ আসেনি, যা মানুষকে মার্কসবাদের তুলনায় বেশি মানবিক দৃষ্টিতে দেখেছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে মার্কসবাদের অনেকগুলো দিকেরই পর্যালোচনা করতে হবে নতুনভাবে। যে মার্কসবাদের চর্চা হয়েছে সোভিয়েতে, চীনে এবং পৃথিবীর দেশে-দেশে, তার অনেক কিছুই আমাদের বাদ দিতে হবে। অনেক কিছু সংযোজনও করতে হবে। এটাও তো সত্যি যে যদি জবাবদিহিতার ব্যাপার না থাকে, যদি অপসারণের সুযোগ না থাকে, যদি সর্বময় ক্ষমতা একটি দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে কমিউনিস্ট পার্টির মতো সবচেয়ে মানবিক পার্টিও একটি দানবে রূপ নিতে পারে।
____________________________________________
আমাদের দেশের একটি বিরাট অংশের লেখকদের মধ্যে সেই মুখ ফিরিয়ে রাখা বা মুখ বন্ধ করে রাখার কাজটি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, নিজেরাও নানারকম মুখোশ পরে তাদের সহযোগীর জায়গা দখলের জন্য নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা নামেন। আমাদের লেখকরা অবশ্যই জানেন যে, এদেশের মানুষের দুর্ভোগের মূলে আছে রাষ্ট্র। আর সেই রাষ্ট্র গঠিত কাদের নিয়ে, সেটাও তারা জানেন। তারা জানেন যে, সরকারি জোটবিরোধী জোট, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, এবং আমাদের দেশে যাদের শিল্পপতি বলা হয়, (যারা আসলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ফড়িয়া এজেন্ট) সেই বড় ব্যবসায়ীরা মিলিয়েই রাষ্ট্র। তাদের চরিত্র তুলে ধরার পরিবর্তে লেখকরা যখন নিজেরাই তাদের সাথে নানা প্রলোভনে ভুলে মিলে যেতে থাকেন, তখন তাদেরও নানা রকম মুখোশ পরিবর্তন করতে হয়, প্রভুদের সহযোগী হিসাবে তাদেরও রূপবদলের রিহার্সেল দিতে হয়।
________________________________________________________________________
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনে এটি পরীক্ষিত। এবং এটি করা হয়েছে মার্কসবাদের নামে। তাই মার্কসবাদকে এখন অনেকগুলো তাত্ত্বিক এবং জীবননির্ভর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতার সুযোগ সৃষ্টি করা, ভিন্নমত পোষণ এবং প্রচারণার সুযোগ দেওয়া, ধর্ম এবং বিভিন্ন জাতীয় ঐতিহ্যকে তাদের মতো করে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া—এইসব প্রশ্নে মার্কসবাদকে যুগোপযোগী করতে না পারলে এই মতবাদের মৃত্যু ঘটবে। তাই এখন মার্কসবাদকে পর্যালোচনা করার কাজটি একজন মার্কসবাদীর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই কাজ যে করে, তাকে কখনোই মার্কসবাদ থেকে সরে যাওয়া ব্যক্তি বলে চিহ্নিত করা উচিত নয়। আবার একই সঙ্গে উত্তরআধুনিকতা নামক ধূম্রজাল দিয়ে, দেরিদা-ফুকোর চিন্তার নামে, লালনের চিন্তার নামে যেসব জিনিসকে বিপ্লবী উপাদান বলে চালানোর অপচেষ্টা চলছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একজন মার্কসবাদীর অবশ্য করণীয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। আমি সেইসব কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছি।
সালমান তারেক শাকিল: বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে রাজনীতিবিমুখতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরাই হয়তো আবার কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা বা দলের লেজুড়বৃত্তি করে। এই বিপরীতমুখী আচরণ কেন?
জাকির তালুকদার: কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে সাহিত্য রচনা করা দোষের নয়। বরং কখনো কখনো তা জাতীয় কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হতে পারে। লেখক অনেককে শ্রদ্ধা করতে পারেন। তবে ব্যক্তিপূজা থেকে প্রকৃত লেখক অনেক দূরে থাকেন। কারণ একজন লেখক হিসাবে তিনি জানেন যে কোনো মানুষকে চিরকাল মনপ্রাণ ঢেলে পূজা করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই ব্যক্তিপূজার নামে প্রকৃতপক্ষে সেই ব্যক্তিকে ভাঙিয়ে ‘কিছু করে খাওয়া’ ছাড়া আর কিছুই হয় না।
সালমান তারেক শাকিল: সাহিত্যের উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে বাংলা কথাসাহিত্যের উত্তরাধিকার কোন সূত্রে ধারাবাহিক?
জাকির তালুকদার: অসাম্প্রদায়িক অথচ দেশপ্রেমিক ধারাটিরই তো মূলধারা হওয়ার কথা। সারা বিশ্বের উপরোক্ত ধারার সাথে সঙ্গতি রেখেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের উত্তরাধিকার সেভাবেই নির্ধারিত হয়ে আছে।
সালমান তারেক শাকিল: বাংলা সাহিত্যের গদ্য চর্চায় একটা বড় অংশের লেখক শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অবস্থা, বিশ্লেষণ বিভুঁইয়ে ব্যস্ত থাকেন। যেখানে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ খেটে খাওয়া, তাদের বিষয়ে লেখকদের এড়িয়ে যান কেন?
জাকির তালুকদার: মধ্যবিত্তকে নিয়ে লেখালেখি করলেই সেটা দোষাবহ হবে এমন তো নয়। যদি সৎভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে মধ্যবিত্তকে নিয়েও যে অনেক কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব তার অনেক উদাহরণ বিশ্বসাহিত্যে রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো লেখক যদি চান যে তিনি মধ্যবিত্ত নিয়েই লিখবেন, তার জন্য তাকে ধিক্কার জানানোর কোনো কারণ নেই। সেই অধিকারও কারো নেই। তবে এই প্রশ্নের মধ্যে যে ক্ষোভটি রয়েছে, তা নানা কারণে যৌক্তিক। সেগুলোর একটি হচ্ছে, লেখকরা সৎ নন। নিজের লেখার মাধ্যমে পাঠককে প্রশ্ন করার পরিবর্তে বা তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার পরিবর্তে কথিত মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকাররা মূলত মধ্যবিত্ততোষ কাহিনী রচনা করে থাকেন। যা পাঠকের রুচির অবনমন ঘটায়। দ্বিতীয়ত, যেহেতু আমাদের দেশের পাঠকরা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই প্রতিনিধি, তাই তাদেরকে মুরগি বানানোর প্রবণতা নিয়ে লিখতে বসেন কেউ কেউ। আর যেহেতু আমাদের দেশের লেখকরাও মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই আসছেন, তাই তাদের চৌহদ্দীও সেই মধ্যবিত্তই। ফলে দেশের বড় অংশের খেটে-খাওয়া মানুষকে চিনতে বা একাত্মতা প্রকাশ করতে গেলে যতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, ততখানি ত্যাগ স্বীকারের কণামাত্র ইচ্ছাও তাদের নেই।
সালমান তারেক শাকিল: ‘আপনার হাঁটতে থাকা মানুষের গান’ উপন্যাসটি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে অনন্য সংযোজন; এই অর্থে, সশস্ত্র বাম আন্দোলন নিয়ে এদেশের প্রধান দুটি দলের লোকদের চরিত্রের নানামাত্রিক চরিত্র, উদাহরণ তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে বিবৃত চরিত্রগুলোর মত আমাদের সাহিত্যের লেখকদের একটা বড় শ্রেণীর মাঝেও পরিলক্ষিত হয়। কেন?
জাকির তালুকদার: এই উপন্যাসে দেশের বড় দুটি দলের চরিত্র উন্মোচন করার অভিপ্রায় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ওটা এমনিতেই এসে গেছে। যেহেতু রাষ্ট্র এখন সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। কোনো ব্যক্তি এখন যত বিচ্ছিন্নভাবেই থাকতে চেষ্টা করুক না কেন, রাষ্ট্র তার দিকে তার বাঘ-নখ বাড়িয়ে দেবেই দেবে। আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতার প্রধান অংশীদার হিসাবে এই দুটি দল তাই রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। উপন্যাসে সশস্ত্র বাম আন্দোলনের মধ্যকার সবচেয়ে দূষিত অংশটিকে খেয়াল করুন। তারা শেল্টারের নামে আসলে শোষক শ্রেণীর হাতকেই শক্তিশালী করছে। বলা চলে, তারা রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতিভূ এই দুটি দলের হয়েই কাজ করছে। আর এদের বিপরীতে যে আদর্শবাদী ক্ষীণ ধারাটি টিমটিম করে জ্বলছে, তারা প্রকৃতপক্ষে না পারছে দলকে দূষণমুক্ত করতে, না পারছে সাধারণ মানুষের পাশে সেইভাবে দাঁড়াতে। ফলে সাধারণ মানুষও তাদের পাশ থেকে সরে যাচ্ছে। কারণ সাধারণ মানুষের তো নিজেদের সংগঠন নেই। ফলে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রশক্তির কাছে তারা পুরোপুরিই অসহায়। বিকৃত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের চেহারা বহুরূপী হবেই। তার কাছে মানুষকে মানুষ হিসাবে বাঁচতে না দেওয়াটাই হচ্ছে প্রধান কাজ। এই কাজ সে করে চলে। যতগুলো রূপ তার ধারণ করা প্রয়োজন, ততগুলো রূপ সে ধারণ করবে।
লেখক-সাহিত্যিকরা যখন রাষ্ট্রের চরিত্র চিনতে ভুল করে, বা রাষ্ট্রের বিকৃত রূপগুলোকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করে, তখন দেশের মানুষের বাঁচার আর কোনো রাস্তা থাকে না। কেননা, সবকিছু বিকিয়ে যাওয়ার এই সমাজে বিবেকের কাছে যৎসামান্য দায়বদ্ধতার শেষ সাহসটুকু ধারণ করে রাখেন লেখকরা। যখন কেউ সত্য উচ্চারণের সাহস করেন না, তখন সেই সত্য উচ্চারণের দায়টা এককভাবে লেখকসমাজের ওপরেই বর্তায়। পৃথিবীর ইতিহাস সে কথা বলে। কিন্তু সেই লেখকরাও যখন বিকিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন, তখন আসলে আর কিছুই করার থাকে না। যে মানুষটি চেনেন রাষ্ট্রের চেহারা, চেনেন হাজার মুখোশে ঢাকা মুখের আদলের আড়ালের সঠিক মুখের চেহারা কোনটি, সেই তিনিও যদি নিজেকে সরিয়ে নেন দায়িত্ব পালন করা থেকে, তখন সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রবেশ করে অন্ধকার যুগের অতলে। আমাদের দেশের একটি বিরাট অংশের লেখকদের মধ্যে সেই মুখ ফিরিয়ে রাখা বা মুখ বন্ধ করে রাখার কাজটি অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, নিজেরাও নানারকম মুখোশ পরে তাদের সহযোগীর জায়গা দখলের জন্য নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা নামেন। আমাদের লেখকরা অবশ্যই জানেন যে, এদেশের মানুষের দুর্ভোগের মূলে আছে রাষ্ট্র। আর সেই রাষ্ট্র গঠিত কাদের নিয়ে, সেটাও তারা জানেন। তারা জানেন যে, সরকারি জোটবিরোধী জোট, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, এবং আমাদের দেশে যাদের শিল্পপতি বলা হয়, (যারা আসলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ফড়িয়া এজেন্ট) সেই বড় ব্যবসায়ীরা মিলিয়েই রাষ্ট্র। তাদের চরিত্র তুলে ধরার পরিবর্তে লেখকরা যখন নিজেরাই তাদের সাথে নানা প্রলোভনে ভুলে মিলে যেতে থাকেন, তখন তাদেরও নানা রকম মুখোশ পরিবর্তন করতে হয়, প্রভুদের সহযোগী হিসাবে তাদেরও রূপবদলের রিহার্সেল দিতে হয়।
সালমান তারেক শাকিল: ২০০৯ সালে প্রকাশিত আপনার গবেষণাধর্মী আখ্যান বা উপন্যাস ‘মুসলমানমঙ্গল’ রচনার তাত্ত্বিক দাবিটা কী? এত বিশাল পরিসরে এই সময়ে বাঙালি-মুসলমানের ইতিহাসচর্চায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার কী কারণ?
জাকির তালুকদার: ‘মুসলমানমঙ্গল’ আসলে কেবল ইতিহাসচর্চা নয়, বর্তমানচর্চাও। কিছুটা ভবিষ্যতচর্চাও বলা যেতে পারে। আমি যে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছি, সেই বাঙালি মুসলমান সমাজকে আমাদের সাহিত্যে ঠিক বাঙালি মুসলমান হিসাবে অ্যাড্রেস করা হয়েছে খুবই কম। আমি এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কাজটি শুরু করলাম বলা চলে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ‘মুসলমানমঙ্গল’ কোনো একরৈখিক উপন্যাস নয়। বাঙালি মুসলমানকে বিভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। দেখার সুযোগ আছে। বলা চলে, বিভিন্নভাবে দেখাটাই হচ্ছে সত্যিকারের দেখা। শুধু একটি তরিকা বা মনোভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলে বাঙালি মুসলমানের সত্যিকারের চরিত্র কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটি হচ্ছে উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় বক্তব্য। দ্বিতীয় যে কারণ আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সেটিকে বলা যেতে পারে, আমাদের লেখকসমাজের পক্ষ থেকে একটি ভুলের অপনোদন ঘটানো। ষাটের দশক থেকে আমাদের দেশে সাহিত্যে মুসলমানত্বকে অবহেলা করে আসা হচ্ছে। কেউ আমাদের সাহিত্য পড়লে মনে করবে যে এদেশে সবাই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ। মুসলমানত্ব কেউ লালন করে না। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তার বিপরীত। সেই কারণেই আমাদের দেশের রাষ্ট্র যেমন সংখ্যালঘুর রাষ্ট্র, অর্থাৎ শতকরা মাত্র ৩ ভাগ মানুষ রাষ্ট্র চালায় এবং রাষ্ট্রের মাখনটুকু খেয়ে চলে, তেমনিভাবে আমাদের সাহিত্যও হয়ে পড়েছে সংখ্যালঘুর সাহিত্য। মানে, সেখানে সংখ্যাগুরু মুসলমানত্ব পুরোপুরি বয়কট হওয়া একটি জিনিস। রাষ্ট্রের ধারক তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা নিজেদের ছেলে-মেয়েদের জন্য ক্যাডেট কলেজ-কিন্ডারগার্টেন-বিদেশি কনভেন্টের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। আর দেশের বিপুল বিশাল জনগোষ্ঠী, যাদের তারা দরিদ্র এবং অশিক্ষিত করে রেখেছে, তাদের জন্য লেখাপড়ার সুযোগ নেই, অথবা তাদের শিক্ষার ভার ছেড়ে দেওয়া রয়েছে চাল-চামড়া চাঁদাতোলা মাদ্রাসাগুলোর হাতে। নিজেরা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা দিয়ে নিজেদের জীবন থেকে ইসলামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেবে, আর অবশিষ্ট মানুষের চিন্তাচর্চার জায়গাটি স্থায়ীভাবে ইজারা দিয়ে দেবে আধাশিক্ষিত অথবা যান্ত্রিক ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত মোল্লা-মওলানাদের হাতে। ফলে, সমাজ পেছনের দিকে হটতেই থাকবে প্রতিনিয়ত। সেটাই আমরা দেখে আসছি। সেই কথাটি মনে করিয়ে দেওয়াটাও ‘মুসলমানমঙ্গল’ রচনার একটি কারণ। একবাক্যে ‘বাঙালি মুসলমান’ বলা হলেও বাঙালিদের মধ্যে ইসলামচর্চা ও অনুসরণে অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। সব বাঙালির ইসলাম গ্রহণের ইতিহাস যেমন এক রকম নয়, তেমনি তা পালনও অনেক রকম। ইসলামের নামে বিভিন্ন ইস্যুতে সাড়া দেওয়ার ভঙ্গি এবং মাত্রাও একরকম নয়। কাজেই এই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সেটি বৈচিত্র্যময় হবে, এবং মহাকাব্যিক হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা ধারণ করবে। ‘মুসলমানমঙ্গল’-এর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে।
সালমান তারেক শাকিল: কারও কাছে ‘মুসলমানমঙ্গল’ শিল্পমণ্ডিত নয়। অনেকের অভিযোগ এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাঁতিয়ে দিয়েছেন। কেউ সরাসরি আপনাকে মৌলবাদীও বকেছেন?
জাকির তালুকদার: এই ধরনের কিছু কথা আমার কানে এসেছে। আমি তাদের যুক্তিগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কেউ কোনো যুক্তি তুলে ধরতে পারেননি। বাস্তবতা হচ্ছে, এমন জীবন্ত একটি বই বহু বৎসর বাংলাদেশে লেখা হয়নি। এবং আমি আমার এতদিনের সাহিত্য-সংশ্লিষ্টতা ও এদেশের মানুষের চিন্তাজগতের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে এই বই অনায়াসে আরো অন্তত ৫০ বৎসর জীবন্ত থাকবে। নতুন নতুন পাঠককে চিন্তার জগতে টেনে আনতে সাহায্য করবে। বইটি শিল্পমণ্ডিত নয়, এমন কথা শুনিনি। তবে এটিকে উপন্যাসের অভিধা দিতে অনেককে অস্বস্তিতে ভুগতে দেখেছি। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা পাশ্চাত্য-আঙ্গিকের উপন্যাসের বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসার কথা বলে আসছেন দশকের পর দশক ধরে। তাদের যখন ‘মুসলমানমঙ্গল’-এর আঙ্গিক নিয়ে এই রকম অস্বস্তিতে ভুগতে দেখি, তখন আমার হাসি পায় এই ভেবে যে মানুষ ব্যতিক্রম চায় বলে দাবি করে, কিন্তু সত্যিসত্যিই ব্যতিক্রম সামনে এসে উপস্থিত হলে অনেকেই হতভম্ব হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বাক্যটি একেবারেই মূল্যহীন। কারণ উপন্যাসে ইসলামের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকার প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে। শুধু তাই নয়—আমরা অনেকেই ইসলামকে একটি রাজনৈতিক ধর্ম বলে স্বীকার করতে চাই না। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করি এই বলে যে তারা ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে এনে ইসলামের মর্যাদার হানি ঘটাচ্ছে। আমি নিজেও ছাত্রজীবনে এমন ধারণাই পোষণ করেছি। ইসলামকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখার স্লোগান দিয়ে গলা ফাটিয়েছি। এই বইটিতে এসে আমি প্রত্যক্ষভাবেই স্বীকার করে নিয়েছি যে ইসলামের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এটি ইসলামের প্রতিপক্ষরা খুব ভালো করেই বোঝে। বোঝে বলেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে ইসলামকেই টার্গেট করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগীরা। আর হান্টিংটনের মতো বুদ্ধিজীবীরা তো সুস্পষ্টভাবেই বলে দিচ্ছেন যে এখনকার পৃথিবীর সংঘাত হচ্ছে পাশ্চাত্যের নামে ইহুদি-খ্রিস্টানের সাথে মুসলমানদের সংঘাত। আমার বলার বিষয় হচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় ইসলাম এগিয়ে এসেছে। বা সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামকে বাধ্য করছে সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে। কিন্তু সেই সংঘাত মোকাবেলার জন্য যে তাত্ত্বিক, প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত প্রস্তুতি দরকার—সেইসব ক্ষেত্রে মুসলিম জগত পিছিয়ে আছে বেদনাদায়কভাবে। সেই পিছিয়ে থাকার ক্ষেত্রে বাহিরের শত্রুদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনই আমাদের নিজেদের ভেতর এমন কিছু দুর্বলতা রয়েছে। সেই দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে পর্যন্ত আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। আবেগের কথাটি বাদ দিলে, বিশ্বে, বিশেষ করে আমাদের দেশের মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া সাংস্কৃতিক মান পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বড় বেশি অসম যুদ্ধে পরিণত করে ফেলেছে। এই সাংস্কৃতিক মান কিন্তু আমি পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ধরছি না। আমি ধরছি সেই স্ট্যান্ডার্ডটিকে, যা ইসলামি জগৎ ধারণ করেছিল তাদের পতন শুরুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। মৌলবাদী শব্দটি সরাসরি আমার কানে আসেনি। তবে এই অভিযোগ এসেছে যে আমি কেন নিজের মুসলমান পরিচয়কে সামনে তুলে এনেছি। এক্ষেত্রে আমার উত্তর দেওয়ার কোনও দরকারই পড়েনি। কারণ আমি যে মুসলমান, তা গোপন করার কোনো কারণ আমি দেখি না। বিশেষ করে যখন বলি যে আমি নির্যাতিতদের পক্ষে। আজকের পৃথিবীতে ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমানদের চেয়ে বেশি নির্যাতিত আর কে আছে? আসলে ‘মুসলমানমঙ্গল’ একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করে ফেলেছে। প্রথমত, এটি পাঠকের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। তারা এই বইতে উত্থাপিত বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে চিন্তা করছেন, এবং সেই চিন্তাতে অন্যদেরও সর্ম্পক্ত করার উদ্যোগ নিয়ে চলেছেন। দ্বিতীয়ত, এটি ইসলামকে কিছু গোষ্ঠীর একচেটিয়াকরণের প্রক্রিয়া থেকে বের করে আনার পাল্টা একটি প্রক্রিয়ার সূচনা করেছে। যে কোনো মুসলিম যে ইসলাম নিয়ে চিন্তা করার যোগ্যতা রাখেন বা চিন্তা করাটা উচিত—এই বই সেটি প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে সচেতন মানুষ নিজেদের পঠন-পাঠনের তালিকায় ইসলামী তত্ত্ব-ইতিহাসকে যুক্ত করতে চেষ্টা করছেন। এতে সেই গোষ্ঠীগুলোর সমস্যা আরও বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, মানুষ নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে সচেতন হলে, ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা-পাঠচক্র করলে তারা ইসলামের যে ব্যাখ্যা এককভাবে দিয়ে আসছেন, সেই একচেটিয়া অধিকারের জায়গাটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়বে। তৃতীয়ত, আমাদের দেশে কিছু বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়েছেন যারা ওপরে ওপরে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের বিরোধিতা করে যারা তলে তলে সাম্রাজ্যবাদীদের টাকাতেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চালান। তারা যেখানে যেমন দরকার, সেখানে তেমন পরিচয় প্রদান করে থাকেন। এককালীন বামপন্থী পরিচয়কেও তারা ত্যাগ করেন না। এতদিন জামায়াতের বাইরে একমাত্র ইসলাম-ব্যাখ্যাতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তারাই। চিন্তা করতে চায়, এমন তরুণদের বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রে এরা ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছেন। তাদের প্রকল্পগুলো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এইসব কারণে তারা ‘মুসলমানমঙ্গল’-এর বিরুদ্ধে বা লেখকের বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকা-ব্লগ-ফেসবুকে বেশ লেখালেখি করেছেন। কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে আসেনি। কারণ, মানুষ বইটি নিজেরাই পড়েছে এবং পড়ছে। আমাকে কোথাও তাদের প্রচারণার বিরুদ্ধে একটি বাক্যও বলতে বা লিখতে হয়নি। পাঠকরা নিজেদের পাঠ-সক্রিয়তা দিয়ে সেসবের উত্তর দিয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত।
সালমান তারেক শাকিল: এবারের বইমেলায় (২০১১, ফেব্রুয়ারি) বের হয়েছে ‘পিতৃগণ’ নামে বিশাল উপন্যাস। কৈবর্তদের নিয়ে তো এর আগে সত্যেন সেন, এবং সম্প্রতি হরিশংকর জলদাস এবং আরও অনেকে কাজ করেছেন। আপনার এই বিশাল কাজের অনুপ্রেরণা কী?
জাকির তালুকদার: তাদের কাজকে আমার কাছে অপ্রতুল মনে হয়েছে বলেই আমি একই বিষয় নিয়ে আরেকটি কাজ করেছি। এ বিষয়ে আমি উপন্যাসের ভূমিকাতে বিস্তারিত লিখেছি। আপনাদের পত্রিকার পাঠককে আমি সেটি পাঠ করার অনুরোধ জানাই।
সালমান তারেক শাকিল: পাহাড়বাসীদের নিয়ে আপনার গল্পে কাজ আছে। প্রবন্ধে কিংবা উপন্যাসে তাদের নিয়ে কোন কাজ করার ইচ্ছা আছে?
জাকির তালুকদার: আমি পার্বত্য অধিবাসীদের নিয়ে কয়েকটি গল্প লিখেছি। প্রবন্ধও কিছু লেখা হয়েছে। সত্যি বলতে কী, আমার নিজেরই কিছুদিন ধরে মনে হচ্ছে, তাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য খুব একটা পরিষ্কার নয়। তারা কি আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মতো রিজার্ভেশনে থাকতে চান? চিড়িয়াখানায় জন্তু-জানোয়ারদের যেভাবে রাখা হয়, রিজার্ভেশন অনেকটা সেই রকমই। তাহলে তারা কি কোনোভাবেই নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাংলাদেশের সকল মানুষের সাথে মূলধারায় একত্রিত হতে চান না? তাহলে কী হবে তাদের গন্তব্য?
আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করতে হবে। পাহাড়িদের নিয়ে বেশি মাতামাতি করতে গিয়ে সমতলের আদিবাসীদের বাঁচার দাবি চাপা পড়ে গিয়েছে। অথচ এই মাটির সত্যিকারের আদিবাসী বলতে হবে মুণ্ডা, ভূমিজ, রাজবংশী, কোচ, পোদ, কৈবর্তদের। সাঁওতাল এবং ওঁরাও-রা এদেশে এসেছে অল্পদিন আগে। চাকমা বা অন্য পার্বত্যরা তো সেই অর্থে একেবারেই অর্বাচীন|
_____________________________________________________
আঙ্গিক নিয়েছেন তিনি পুরোপুরি মধ্যযুগের বাংলাদেশের, কিন্তু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটিয়েছেন সংস্কৃতবাহুল্যের অথবা সংস্কৃতঘেঁষা বাংলার। সেই কারণেই আঙ্গিকের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড স্বদেশী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের পাঠক-দর্শক-শ্রোতা তাঁর রচনার সাথে একাত্ম হতে পারেনি। আবার দীর্ঘদিন ধারে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ইউরোপীয় আঙ্গিকের শিল্পের সাথে পরিচিত হয়েছে। তাদের এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলে দেখা যাবে, তারা কিছুতেই মানসিক সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না আমাদের সাহিত্যের আদি আঙ্গিকগুলোর সঙ্গে। সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, মধ্যযুগে পাঠ হতো কম। পাঠক থাকতেন একজন। আর অন্যেরা ছিলেন শ্রোতা। তাই রচনাগুলো লিখিত হতো কথনের ঢংয়ে। পেশাদারী কথকরা সেই শিল্প নিজেদের পাঠশিল্পের মাধ্যমে পৌঁছে দিতেন শ্রোতা-দর্শকের কানে এবং মনে-হৃদয়ে। এখনকার সময়ে লিখিত রচনার পাঠক নিজে। মধ্যবর্তী কথককে সে পাচ্ছে না। তাই হুবহু সেই আদি আঙ্গিকে প্রত্যাবর্তনও আমার কাছে ঠিক লাগসই বলে মনে হয় না। তবে ঔপনিবেশিক আঙ্গিক থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
_____________________________________________________________________________________________
সেইসাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে সমস্যা শুধু পাহাড়ি-বাঙালির নয়। পাহাড়িদের মধ্যেও শোষক-শোষিত আছে। আমরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছি যে তারা পাহাড়িদের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানছে। এই অভিযোগ একেবারে মিথ্যে, সেকথাও বলা যাবে না। কিন্তু পাহাড়িদের সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত হানা শুরু করেছে খ্রিস্টান মিশনারীরা। ধর্মকে যদি সংস্কৃতির একটি বড় উপাদান হিসাবে স্বীকার করা হয়, তাহলে ধর্মান্তরকরণকে কেন সংস্কৃতির উপর আঘাত হিসাবে বিবেচনা করা হবে না? এসব নিয়ে হয়তো ভবিষ্যতে লিখব। আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই।
সালমান তারেক শাকিল: এদেশের লেখকদের শেষ পর্যন্ত আদর্শের উপরে অটুট থাকার ইতিহাস খুব কম। কোন বিশেষ দলের লেজুড়বৃত্তি করার নোংরামি তাদের মধ্যে কাজ করে। কেন?
জাকির তালুকদার: আগে বোধহয় এ নিয়ে বেশ কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত হওয়ার অধিকার যে কোনো লেখক সংরক্ষণ করেন। তাই এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করারই প্রয়োজন পড়ে না। তা দোষের তো নয়ই, বরং গুণের। কিন্তু লেজুড়বৃত্তি করা হয় কোনো সুবিধা অর্জনের জন্য। আদর্শের জন্য নয়। লেজুড়বৃত্তি করা হয় পুরস্কারের জন্য, পদ পাওয়ার জন্য, বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পাওয়ার জন্য, বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসে নিয়োগ লাভের জন্য। সেই হিসেবে লেজুড়বৃত্তি ঘৃণ্য। লেজুড়বৃত্তি করেন কেন? প্রথমত মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারার জন্য। দ্বিতীয়ত তারা হয়তো লেজুড়বৃত্তি করবেন বলেই লেখালেখিটাকে বেছে নিয়েছিলেন। কারণ লেখালেখি করলে সম্ভবত চোখে পড়ার সুযোগ বেশি থাকে।
সালমান তারেক শাকিল: বইকে পণ্যায়নের নেতিবাচক প্রচেষ্টা আমরা গত কয়েকবছর বাংলা একাডেমি মেলায় দেখছি। হুমায়ুন আহমেদের বই বিকোনোর জন্য প্রকাশক, লেখকের উদ্যোগে ঢোল, তবলা, তারকা মেয়ে-ছেলে দিয়ে নাচানো হয়। এতে আপনার নীরব কেন?
জাকির তালুকদার: রুচির কারণে আমরা নীরব। এ বিষয়ে আমি ‘মুক্তবাণিজ্যের কালে আমাদের সাহিত্য’ নামে প্রবন্ধ লিখেছি। সেখানে বলতে চেয়েছি, সাহিত্যকে যারা পণ্য হিসাবে দেখেন, তারা তাদের পণ্য বিপণনের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে নামবেন এটাই স্বাভাবিক।
সালমান তারেক শাকিল: বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষায় আমাদের লেখক শ্রেণী নীরব কেন? দু-একজন ছাড়া অনেকেই বিষয়টি রাজনৈতিক বলে দূরে থাকতে চান?
জাকির তালুকদার: দেশপ্রেমের ঘাটতির কারণেই তারা নিরব। তারা জানেন না যে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করলেই দেশপ্রেমিকের পরীক্ষায় চিরস্থায়ী পাশ নম্বর পাওয়া যায় না। দেশপ্রেম হচ্ছে এমন একটি জিনিস, আমাদের মতো দেশে প্রতিমুহূর্তে সেই পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়, এবং পাশ করতে হয়। কিন্তু আমাদের বিপুল সংখ্যক লেখক ক্ষমতাসীন শ্রেণীর বিরাগভাজন হবার ভয়ে অন্য অজুহাত তুলে জাতীয় সম্পদ রক্ষার মতো জীবন-মরণ সমস্যার বিষয়টিকেও পাশ কাটিয়ে যেতে চান। ইতিহাস তাদের কোনোদিনই ক্ষমা করবে না।
সালমান তারেক শাকিল: লেখকের ব্যক্তিগত সততার সাথে সাহিত্যের কি সম্পর্ক? সাহিত্যের জন্য একজন লেখকের সততার প্রয়োজন আছে কি না?
জাকির তালুকদার: অসৎ মানুষ লেখালেখি করতে পারে। কিন্তু লেখক হতে পারে না কোনোদিন।
সালমান তারেক শাকিল: পুরো বাংলাসাহিত্যের আন্তর্জাতিক মান প্রসঙ্গে আপনার মুল্যায়ন কী?
জাকির তালুকদার: এই প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো যথেষ্ট জ্ঞান এবং তুলনামূলক পাঠ আমার নেই।
সালমান তারেক শাকিল: সম্প্রতি (২০১১ সালে) ইত্তেফাকে আপনি ‘বাংলাভাষায় বাংলাদেশের সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটকের বর্তমান আঙ্গিক এবং অবয়ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এর কারণ কী?
জাকির তালুকদার: আমি বলতে চেয়েছি যে সাহিত্যের যে আঙ্গিক আমরা দেখছি, তা ইউরোপীয় সাহিত্যের কাছ থেকে ধার করা। এই আঙ্গিক আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে এখনো অচেনা। কাজেই আঙ্গিকের বদল ঘটানো প্রয়োজন। যাতে দেশের মানুষ দেশের জিনিসকে চিনতে পারে। সেই চেষ্টা আমরা করতে দেখেছি সেলিম-আল-দীনকে। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সমস্যা ছিল কিছুটা। যেমন আঙ্গিক নিয়েছেন তিনি পুরোপুরি মধ্যযুগের বাংলাদেশের, কিন্তু ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঘটিয়েছেন সংস্কৃতবাহুল্যের অথবা সংস্কৃতঘেঁষা বাংলার। সেই কারণেই আঙ্গিকের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড স্বদেশী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের পাঠক-দর্শক-শ্রোতা তাঁর রচনার সাথে একাত্ম হতে পারেনি। আবার দীর্ঘদিন ধারে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ইউরোপীয় আঙ্গিকের শিল্পের সাথে পরিচিত হয়েছে। তাদের এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলে দেখা যাবে, তারা কিছুতেই মানসিক সংযোগ স্থাপন করতে পারছে না আমাদের সাহিত্যের আদি আঙ্গিকগুলোর সঙ্গে। সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, মধ্যযুগে পাঠ হতো কম। পাঠক থাকতেন একজন। আর অন্যেরা ছিলেন শ্রোতা। তাই রচনাগুলো লিখিত হতো কথনের ঢংয়ে। পেশাদারী কথকরা সেই শিল্প নিজেদের পাঠশিল্পের মাধ্যমে পৌঁছে দিতেন শ্রোতা-দর্শকের কানে এবং মনে-হৃদয়ে। এখনকার সময়ে লিখিত রচনার পাঠক নিজে। মধ্যবর্তী কথককে সে পাচ্ছে না। তাই হুবহু সেই আদি আঙ্গিকে প্রত্যাবর্তনও আমার কাছে ঠিক লাগসই বলে মনে হয় না। তবে ঔপনিবেশিক আঙ্গিক থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।
সালমান তারেক শাকিল: অনেকেই বলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাত ধরে বাংলা উপন্যাস বাংলাদেশের সাহিত্যে ফিরেছে। আপনার কী মনে হয়?
জাকির তালুকদার: এই বিষয় নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। সেগুলো একটু মনোযোগের সাথে পাঠ করা ছফা-ইলিয়াস পাঠশালার সবার জন্য অপরিহার্য। এই বিষয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নাই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিজেও ঔপনিবেশিক আঙ্গিক সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করেছেন নিরন্তর। তবে বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে তিনি যতখানি সফল, বিন্যাসের ক্ষেত্রে ঠিক ততখানি সাফল্য এসেছে বলে আমি মনে করি না। এই ক্ষেত্রে আমাদের আরো অনেক কাজ করার অবকাশ রয়ে গেছে। আর বাংলা উপন্যাসের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সূত্রপাত ঘটেছে আরো আগে। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র হাত ধরে।
সালমান তারেক শাকিল: ইলিয়াস মানুষের ভেতরকার মানুষকে ধরতে কাজ করেছেন নিরাবেগ মনে?
জাকির তালুকদার: এটি ইলিয়াসের প্রধান গুণগুলোর মধ্যে একটি। বড় শিল্পীকে কিছুটা নৈর্বক্তিক হতেই হয়। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের চরিত্র নির্মাণের সময় নিরাবেগী না হতে পারলে তা ইচ্ছাপূরণের কড়চায় পরিণত হয়। ইলিয়াসের মতো বড় শিল্পীর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলেই বরং তা বেদনাদায়ক হতো।
সালমান তারেক শাকিল: আপনি নিজে বিদেশি সাহিত্য কিছু অনুবাদ করেছেন। অনুবাদের বই বের করার ইচ্ছা আছে কি? বাংলাদেশে অনুবাদের বর্তমান হালত কিভাবে দেখেন?
জাকির তালুকদার: অনুবাদ দুই কারণে করেছি আমি। প্রথমত, মৌলিক লেখা লিখতে না পারলে সেই সময়টা নষ্ট না করে বা হতাশায় না ভুগে বিদেশি লেখার অনুবাদ করেছি। আর দ্বিতীয়ত, কোনো লেখা পড়ে যখন মনে হয়েছে যে এই রচনাটি গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের পাঠকদের কাছে সেটি পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন তখন অনুবাদ করেছি। আরো অনুবাদ করার ইচ্ছা আছে। কার্ল মার্কস-এর একটি নতুন জীবনী বেরিয়েছে। সেটির অনুবাদ করতে চাই। অনুবাদের বইও বের করার ইচ্ছা আছে। বেশ কয়েকটি বিদেশি ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ অনুবাদ করেছি ইতোমধ্যেই। সেগুলো নিয়ে বই হবে। বাংলাদেশে অনুবাদের বর্তমান হাল ভয়াবহ। অর্ধমনস্ক এবং অযোগ্য অনুবাদে বাজার ছেয়ে গেছে। আসলে অনুবাদের জন্য তো শুধু ইংরেজি জানলেই চলে না, বাংলা ভাষাটাও ভালো জানতে হয়। প্রথম ক্ষেত্রে তো সমস্যা রয়েইছে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সমস্যা প্রথমটির চাইতেও বেশি।
সালমান তারেক শাকিল: ছোটকাগজ আন্দোলন বলতে আপনি কী বলবেন? প্রাতিষ্ঠানিকতার ধারণাটি ব্যাখ্যা করবেন?
জাকির তালুকদার: এই বিষয়টি নিয়ে এত এত আলোচনা-বিতর্ক-পর্যালোচনা হয়েছে যে তা নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছা করে না। আলোচনা যত বেশি হচ্ছে, ছোটকাগজের নাম ভাঙিয়ে করে-খাওয়া লোকের সংখ্যা তত বাড়ছে। ছোট কাগজ আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে তখনোই সেভাবে হয়নি। এখন তো আদৌ নেই। ছোটকাগজ করার জন্য যে সাহিত্যিক-শৈল্পিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মান অর্জন করা দরকার, তা আমাদের দেশে কোনো তথাকথিত ছোট কাগজ সম্পাদকের মধ্যে আমি খুঁজে পাইনি। হয়তো আছে, কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। আর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা কী বলব! সবচেয়ে বড় যে প্রতিষ্ঠান তা হচ্ছে আমাদের জনশোষক ও বিকৃত রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেই প্রতিষ্ঠানকে না চিনে, বা তার বিরুদ্ধে না গিয়ে অন্য যাদের যাদের প্রতিষ্ঠান বলা হচ্ছে, তা এই কথকদের দৃষ্টিশক্তির বেদনাদায়ক ক্ষীণতার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
সালমান তারেক শাকিল: লেখকদের উপরে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের স্বরূপ কেমন?
জাকির তালুকদার: বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়টি নিয়ে একটি গ্রন্থ লেখার ইচ্ছা আমার আছে। তাছাড়া অন্যত্র ও আমরা আলোচনা করতে পারি। যেমন এই বিষয়ে সেমিনার বা মুক্ত আলোচনার ব্যবস্থা করা। সাক্ষাৎকার এই বিষয়ে আলোচনার জন্য ঠিক উপযুক্ত জায়গা নয়।