চিন্তাসূত্রের নভেম্বর সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছোটগল্প। অর্থাৎ ছোটগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, ছোটগল্প ও তরুণ গল্পকারদের ভাবনা। তরুণ গল্পকারদের ভাবনাপর্বে ছোটগল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন কথাশিল্পী মণিকা চক্রবর্তী।
চিন্তাসূত্র: আপনি কেন ছোটগল্প লিখছেন?
খুব সচেতনভাবে লেখার প্রক্রিয়া আসাটা আমার ক্ষেত্রে হয়নি। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে খুব ভালোবাসি। জীবন সংঘাতময়। তাই নানা সংঘাতের মধ্যে দিয়ে তীব্রভাবে যেতে হয়েছে। পৃথিবীর সঙ্গে ভেতরের ক্রমাগত সংঘর্ষই একসময় আমার লেখার জগতে বিস্তৃত হয়। অনুভবের অতলে পড়ে থাকা অনেক অস্তিত্ব, কিছু চিন্তা, চেতনার বিস্তার, সবরকমের অবদমন সবকিছুই যখন হৃদয়ের ধারণের সীমাকে অতিক্রম করে ফেলে, তখন তাকে ছোটগল্পের পাতায় রেখে দিয়ে একটু নির্ভার বোধ করা যায়। ছোটগল্প লিখতে গিয়ে এ রকম একটি স্পেসের কথা ভেবেছি। যেখানে খানিকটা সময় তন্ময় হয়ে থাকা যায়।
ছোটগল্পে অল্প শব্দের ভেতর দিয়ে নিজের ভাবনা ও রহস্যময়তাকে যেমন প্রকাশ করা যায়, তেমনভাবে পাঠকের কাছে অল্প সময়ে পৌঁছে যাওয়ার আয়োজন থাকে। লেখক ও পাঠকের ভুবন এখানে অনেকটাই কাছাকাছি। ছোটগল্পে জীবনের নানামুখী ইশারা, দ্বান্দ্বিকতা, অনুভূত সত্য, আত্মার আকুতিকে একই বিন্দুতে এনে মিলানোর একটি নির্মাণভাবনার চেষ্টা করা যায়। এছাড়া আজকের ব্যস্ত সময়ে যখন পাঠকের সময় স্বল্পতার সঙ্গে লেখকের লেখাকে বেঁচে থাকতে হয় এক কঠিন বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে।
চিন্তাসূত্র: আপনার গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
নিরন্তর সংকটময় এই পৃথিবীতে মানুষের নান্দনিক
অনুভুতি, মানবিক বোধ সবকিছুই আজ চিন্তাসূত্রবিদ্ধ। পরিপূর্ণ হৃদয় ও অনুভব নিয়ে বেঁচে থাকাটাই যেখানে কঠিন সেখানে আমার ছোটগল্পগুলোও এসব বিচিত্র অনুভবের মুখোমুখি। অদৃশ্য একটি চিন্তাসূত্রচিহ্ন রেখে যেতে চাই। কখনো চাই অবচেতনের নিবিড়ে পড়ে থাকা অপার নৈঃশব্দ্য আর নির্জনতাকে শব্দের তুলিতে এঁকে রাখতে। আবার কখনো বা আমার অনুভবের তীব্র সত্যকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে চাই। পাশাপাশি গল্পে জীবনদর্শনের বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেই। আমি বিশ্বাস করি, দর্শন ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য।
চিন্তাসূত্র:একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে পারে বা চায়?
পাঠকের চাওয়াকে একরৈখিকভাবে বলে দেওয়া সম্ভব নয়। পাঠক বিভিন্ন লক্ষ্যে বিভিন্ন দিকে বিভক্ত। পাঠকের চাওয়া অনেক ব্যপ্ত ও বহুমুখী। ছোটগল্পেরও আছে বিচিত্র ও বহুমুখী বিস্তার। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পগুলোর কথাই ধরা যাক। পড়ে ফেলার পর মুগ্ধতা আর বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটতে চায় না। ভেতরে ভেতরে একটা প্রচণ্ড তোলপাড় ঘটে যায়। পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়, সার্থক ছোটগল্প এরকম ঘূর্ণি তৈরি করে দিতে পারে । পাঠক তখন সেই মুহূর্তে গল্পের চরিত্রগুলোকে স্তব্ধভাবে ছুঁয়ে থাকে। জীবনের অর্থকে অন্যভাবে আবিষ্কার করতে পারে।
চিন্তাসূত্র: একজন কবি যখন একজন গল্পকারও, তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
আমার মনে হয়, একজন কবি যখন গল্পকার তার গল্পের এক আলাদা মাত্রা থাকে। কবি সৈয়দ শামসুল হকের গল্প নির্মাণের কারুকৌশল অন্যের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যায় না। সেখানে ভাষা ব্যবহারের বহুস্তর যেমন আছে, তেমন আছে কাহিনী ও বর্ণনার চমৎকারিত্ব। তার লেখায় যে জোরালো অবচেতনের উদ্ভাস দেখি বা কখনো কখনো তীব্র ইন্দ্রিয়ময়তায় পৌঁছে যেতে পারি, তার কারণ আমার মনে হয় তীব্র কবিসত্তা। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশের নামটিও উল্লেখযোগ্য। আল মাহমুদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দের ছোটগল্পগুলোর কথাও এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। ইংরেজি সাহিত্যে ডি এইচ লরেন্সের নামটি এই মুহূর্তে তাৎক্ষণিকভাবে মনের গভীর থেকে উঠে আসছে যার লেখা ছোটগল্প শিল্পতত্ত্বের জায়গা থেকে যথেষ্ট নান্দনিক। আমরা গ্যাটে, ভিক্টর হুগো কথাও বলতে পারি। কাব্যিক পর্যবেক্ষণ ও কাব্যের গভীর দীক্ষার ভেতর একটি সম্মিলিত শক্তি থাকে যা গল্পলেখার অনূভূতি ও দার্শনিক মাত্রাকে পাঠকের কাছে ভিন্ন সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থাপিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
যৌনতা আমাদের রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে কালিদাস ও পদাবলী সাহিত্যেও আছে। অর্থাৎ শিল্পে এর ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই। শরীরের ক্ষুধা-তৃষ্ণা বিষয়টি আহার ও নিদ্রার মতোই অতি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু যখন আমরা এক্ষেত্রে সৌর্ন্দযচেতনার কথা বলব, তখন এর সঙ্গে মিশে যাবে মানবমনের গভীরতম প্রেমের আকাঙ্ক্ষা। প্রেমের আকাঙ্ক্ষা যখন জাগ্রত থাকে তখন অসারও কুৎসিত যৌনতার আবরণ ভেদ করে সৌন্দর্য আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়ে যায়। প্রেমের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে লুকিয়ে থাকে শিল্প ও নান্দনিকতা।
লরেন্সের ছোট গল্পগুলোতে প্রেম-প্রকৃতি এবং নর-নারীর যৌন সম্পর্ক একই সরলরেখায় অবস্থান করে বলে সেখানে যৌনতা নান্দনিক। মন ও শরীর মিলিয়ে যে সুগভীর রোমান্টিক সৌন্দযর্, সেখানেই জীবনের কিছু গভীর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
জীবন প্রক্রিয়ার এই দিকটি ছোটগল্পে নানা ভাবেই নান্দনিক করা যেতে পারে। আবার অ্যাবসার্ডিটির তীব্র বিষাদময় অনুভব দিয়ে একে একটি সর্বগ্রাসী বিপণ্নতার দিকেও নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এই ডিজিটাল সময়ে যৌনতাও রোবটিক। লেখক তার হৃদয়ধর্ম ও লেখার কৌশল দিয়ে খুব শিল্পিতভাবেই ছোটগল্পে যৌনতাকে ব্যবহার করতে পারে।
চিন্তাসূত্র: কোন ধরনের ছোটগল্প সবচেয়ে বেশি পাঠকসমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
এ সময়ে আমাদের দেশের অনেক শক্তিমান গল্পকার রয়েছেন, যাঁদের লেখা ছোটগল্প খুবই জনপ্রিয়। শাহাদুজ্জামান, শহীদুল জহির, মইনুল আহসান সাবের, আহমাদ মোস্তফা কামাল, ইমতিয়ার শামীম, মনিরা কায়েস, শাহনাজ মুন্নী, জাকির তালুকদার এই নামগুলো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ থেকে সন্দীপন পর্যন্ত অনেক লেখকের লেখা ছোটগল্প দারুণভাবে পাঠক সমাদৃত। আর বিশ্ব সাহিত্যের দিকে তাকালে চেখভ, টলস্টয়, ও-হেনরী, কাফকা, জেমস জয়েস প্রমুখের নামগুলো ভেতর থেকে গুনগুনিয়ে ওঠে। তারা প্রত্যেকেই জীবনের সহস্রমুখী গতিধারাকে তাদের লেখায় সফলভাবে তুলে এনেছেন। পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছেন পাঠকের মনোজগতে এক মায়াময় জগৎ সৃষ্টি করে।
চিন্তাসূত্র: একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোন কোন শর্ত পূরণ করতে হয়?
এই প্রশ্নের উত্তর অনেক ব্যাপ্ত। লেখকের অবচেতনে যে নান্দনিক অনুভূতি রয়েছে তার সঙ্গে মিলে যায় মানবিক বোধ ও দর্শন। পাশাপাশি লেখকের অনুভব ও কল্পনার মিশেল যে গভীর সত্যটি আবিষ্কারের চেষ্টা করে ছোটগল্পের মধ্যে দিয়ে সেখানে এৗতিহ্য, রাজনীতি, আধুনিকতা, জীবনের ক্রাইসিস সবকিছুই থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে লেখকের নিষ্ঠা। নিরন্তর এই প্রয়াসের মাধ্যমে একটি ছোটগল্প সার্থক হয়ে উঠতে পারে।
চিন্তাসূত্র: ছোটগল্প নিয়ে আপনার নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ কেমন ফল দিতে পেরেছে?
আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরী’ এবং দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘হাওয়ার সংকেত ও অন্যান্য’ বইমেলা ২০১৩ ও বইমেলা ২০১৭ তে প্রকাশিত হয়। এই দুটি বইয়ে অর্ন্তভুক্ত গল্পগুলো ছাড়াও আরও কিছু গল্প বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে, কালি ও কলমের গল্প সংখ্যায়, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ও অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এখনো নিয়মিত লিখছি। আমার ছোটগল্পের কিছু গল্পে চারপাশের সমাজজীবনের নানারকম মানুষের জীবন ও মনস্তত্ত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আবার অন্য কিছু গল্পে উঠে এসেছে আমার আত্মিক বোঝাপড়ার বিষয়টি। এভাবে আমার গল্প লেখার সীমানাকে বড় করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। গল্প নির্মাণের চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে আমি স্মার্ট নাগরিক জীবন ও পাশাপাশি ফুটপাথে ও বস্তি জীবনকেও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। গল্পে চিরকালের সত্য অনুভবকে পাঠকের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি ব্যক্তি অনুভব থেকে সমগ্রতার অনুভবের দিকে গল্পকে মেলে ধরতে।
চিন্তাসূত্র : আপনার ছোটগল্প নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আমি কিছু গল্প লিখতে চাই যা সম্পূর্ণ ডায়লগনির্ভর হবে। আবার কিছু গল্প লিখতে চাই যা গল্পহীন কিন্তু সেই গল্পটি চূড়ান্ত জীবনভাবনাকে তুলে ধরতে পারে। ছোটগল্প নিয়ে কাজ করার অনেক জায়গা আছে। কখনো কখনো ভাবি কোনো যতিচিহ্ন ব্যবহার না করে বিরামহীন একটি গল্প লেখার কথা। কেবল শরীর ও যৌনতা নিয়েও গল্প নির্মাণের ভাবনা আছে।
চিন্তাসূত্র: মানুষের কল্যাণে আপনার ছোটগল্প কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?
গল্পে যদিও থাকবে ব্যক্তি মনের অবচেতনের অন্ধকার আর প্রবৃত্তির অর্ন্তগত উন্মোচন, তবু গল্প শেষ পর্যন্ত মানুষের কল্যাণেই একাত্ম হয়। মানুষের ভালোবাসা চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই বিশেষভাবে জরুরি। আমার গল্প সবসময়ই মানুষের শুভ চেতনার উৎসের দিকেই ।