চিন্তাসূত্রের নভেম্বর সংখ্যার বিশেষ আয়োজন ছোটগল্প। অর্থাৎ ছোটগল্প বিষয়ক প্রবন্ধ–নিবন্ধ, ছোটগল্প ও তরুণ গল্পকারদের ভাবনা। তরুণ গল্পকারদের ভাবনাপর্বে ছোটগল্পের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন কথাশিল্পী সাদাত হোসাইন।
চিন্তাসূত্র: আপনি কেন ছোটগল্প লিখছেন?
লেখালেখি কেন করছি, সেটির উত্তর হয়তো হতে পারে। কিন্তু ছোটগল্প কেন লিখছি, সেটির উত্তর দেওয়া বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি ছোটগল্প লিখব বা বড়গল্প লিখব, এভাবে ভেবে লিখি না। আমি স্রেফ লিখি। গল্প মাথায় আসলেই সেটি লিখি। আর সেই লেখার সময় ছোটগল্প বা বড়গল্পের বিষয়টি ভাবনায় থাকে না। আমি বরং ভাবি, আমি যা ভাবছি, আমি যা অনুভব করছি, যা বলতে চাইছি—তা তেমন যুৎসই করে প্রকাশ করতে পারছি কি না! এখানে গল্পের কলেবর কিংবা নিয়ম-কানুন নিয়ে আমি একদমই ভাবি না। আমি স্রেফ গল্পটা বলে যেতে চাই। এখন সেই বলে যাওয়া গল্পের ভেতর হয়তো কিছু কিছু গল্প প্রচলিত-প্রতিষ্ঠিত ছোটগল্পের কাঠামোতে বা সংজ্ঞায় পড়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ছোটগল্প কেন লিখছি—এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার জন্য কঠিন। খুব কঠিন। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি লিখি, আমার ভালো লাগে বলে। কিংবা আমার ভেতরের কোন তীব্র অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে উঠতে চায় বলে, অন্যকে স্পর্শ করতে চায় বলে।
চিন্তাসূত্র: আপনার গল্পের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত?
আমার মনে হয়, এই প্রশ্নটির উত্তরও আমার আগের প্রশ্নের উত্তরেই দেওয়া আছে। তবে বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করে বললে বলতে চাই, ‘বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিত’ সৃজনশীল যেকোনো মাধ্যম চর্চায় এই ধরনের বাক্য আমার কাছে কেমন সাফোকেটিং লাগে। মনে হয়, আমি ঢাকা ক্লাব বা এই ধরনের কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বা কঠিন মিলিটারি রুলস রেগুলেশনের কোনো প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করছি, যেখানে যেতে হলে আমার পায়ের জুতো থেকে শুরু করে মাথার চুল আঁচড়ানোর ধরন, আমার কথা বলার ভঙ্গি থেকে হাঁটার স্টাইল, ফুট স্টেপঅবধি সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। এর বাইরে গেলেই কিক আউট! ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে। এ জন্য আমি লেখালেখির ক্ষেত্রে ‘কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত’-এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবি যিনি লিখছেন, পার্টিকুলার মুহূর্তে তার ভাবনা ও অনুভূতিকে। তিনি তার ওই মুহূর্তের বাস্তবতায়, অনুভূতিতে-অনুধাবনে, কী ভাবছেন, সেটি তাকে কতটা গভীরভাবে স্পর্শ করছে এবং সেই স্পর্শময়তা তিনি কিভাবে প্রকাশ করছেন, তার ওপর। এখানে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম বা বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত বলে আমি মনে করি না।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে পাঠক কী কী পেতে পারে বা চায়?
একজন লেখকও যেহেতু সবার আগে একজন পাঠক, সেহেতু একজন পাঠক হিসেবে আমি আমার কথাই বলতে পারি। আমি গল্পে খুব সহজে, খুব দ্রুত ঢুকে যেতে পছন্দ করি। একদম প্রথম লাইন বা শব্দ থেকেই। গল্পের চৌম্বকত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। আর গল্প শেষ হয়ে গেলেও শেষটায় যেন এমন কিছু থাকে, যার একটা রেশ থেকে যায়। যা মাথার ভেতর, ভাবনার ভেতর রিনরিন করে বয়ে যেতে থাকে। এটা একজন পাঠক হিসেবে আমার চাওয়া।
চিন্তাসূত্র: একজন কবি যখন একজন গল্পকারও; তখন তার গল্পের প্রভাব কেমন হতে পারে?
আমার কাছে কবিতাও গল্পই। আমি মনে করি, পৃথিবীর সব সৃজনশীল মাধ্যমের কাজ গল্প বলা। তা সে সিনেমা হোক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিংবা ফটোগ্রাফি, স্কাল্পচার এমনকি পেইন্টিং, যা-ই হোক না কেন! প্রকাশের ধরন আলাদা হলেও এর সবই আসলে গল্পই বলে। এখন প্রশ্নটা যদি হয়, একজন কবি যখন গল্পকারও, তাহলে বলব, এর উত্তর আমার কাছে ধাঁধাই।
চিন্তাসূত্র: একটি ছোটগল্পে যৌনতাকে কিভাবে নান্দনিক করা যেতে পারে?
যৌনতাকে আলাদা করে নান্দনিক করার কী প্রয়োজন আমি জানি না। কারণ যৌনতা তো এমনিতেই নান্দনিক। কিন্তু এখানে একটা কথা থেকে যায়, ধরুন, ধর্ষণ, ধর্ষণও কিন্তু যৌনতা। এখন ধর্ষণ যৌনতা হলেও সেটি কী নান্দনিক? নিশ্চয়ই নয়। ফারাকটা এখানেই। গল্পে আপনি যৌনতার নামে ধর্ষণ দেখাবেন কি না সেটি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ধর্ষণ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেখানে কেবল একপক্ষীয় কাম থাকে। ভালোবাসাহীন কাম। যেখানে ভালোবাসা থাকে, সেখানে নান্দনিকতার জন্য আলাদা করে কি কিছুর প্রয়োজন আছে? নেই। জগতে ভালোবাসার চেয়ে শুদ্ধ নান্দনিকতা আর কী আছে? আশা করি, আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।
চিন্তাসূত্র: কোন শ্রেণীর ছোটগল্প সবচেয়ে বেশি পাঠকসমাদৃত হয় বলে মনে করেন?
সব পাঠকের রুচি, ভাবনা, বোঝাবুঝির ক্ষমতা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা তো এক নয়। ফলে এর সর্বজনীন কোনো উত্তর নেই। তবে এটি ঠিক, পাঠক গল্পের কোথাও না কোথাও তার নিজেকে খুঁজে পেতে চায়, নিজের গল্প খুঁজে পেতে চায় বলে একজন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়।
চিন্তাসূত্র: একটি কাহিনী বা গল্পকে ছোটগল্পে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কোন কোন শর্ত পূরণ করতে হয়?
দেখুন, এই যে ছোটগল্পে ‘উত্তীর্ণ হওয়া’, ‘নান্দনিক ও শিল্পশর্ত’ এই বিষয়গুলোকে আমার খুব ভারী মনে হয়। ভারী জিনিস আমি বহন করতে পারি না। সম্ভবত আমি নিজে এত ভারী ভারী বিষয় বহন করার মতো সবল নই। যে গল্প বলতে চায়, আমি তাকে স্রেফ গল্প বলে যেতে বলব। দিন শেষে গল্পটাই টিকে থাকে। সম্ভবত জগতের একমাত্র অবিনশ্বর বিষয় গল্প। সৃষ্টির শুরু থেকে গল্পের শুরু এবং এই গল্পের শেষ নেই। গল্প চলতেই থাকবে। কিন্তু এসব নিয়ম-কানুনের পরিবর্তন আছে, শেষ আছে, আছে নাকচ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। কেবল গল্পই অবিনশ্বর। সুতরাং গল্প বলাটাই আসল।
চিন্তাসূত্র: ছোটগল্প নিয়ে পরিকল্পনা কী?
আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। কারণ এখন আমি উপন্যাস লিখছি। আগামী বইমেলায় ভাষাচিত্র থেকে ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হবে।