[মৃণাল বসুচৌধুরী। শ্রুতি আন্দোলনের পুরোধা। জন্ম তাঁর ১৯৪৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গে। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ২৪। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মগ্ন বেলাভূমি’। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত। ছড়ার বই ২টি। উপন্যাস ২টি। ছোটদের গল্পের বই রয়েছে ২টি। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এই কবি। এছাড়া, বাংলাদেশের ‘কবিতাবাংলা’ ও ‘অরণি’ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি চিন্তাসূত্র-এর পক্ষ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কবি শামীম হোসেন। ]
শামীম হোসেন: আপনি কবিতা ও গদ্য দুটোই লেখেন। এখন কী লিখছেন কিংবা বড় কোনো গদ্যের কাজ করার ইচ্ছে আছে কি?
মৃণাল বসুচৌধুরী: ঠিক বলেছেন, আমি কবিতা ও ছোটগল্প- দুটোই লিখি। গত বইমেলায় ঢাকার আশালতা প্রকাশনী থেকে আমারিএকটি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে—‘স্বপ্নপরস্পর’। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমার একটি প্রবন্ধগ্রন্থ ‘শব্দস্মৃতিঘর’ ও ছোটদের জন্য লেখা তিনটি বইও আছে। একটি গল্পের, অন্য দুটি ছড়ার। বর্তমানে স্মৃতিনির্ভর কিছু গদ্য লিখছি। ঢাকার আমাদের সময় এবং মানবকণ্ঠ ঈদসংখ্যায় তিনটি পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখাটি শেষ করার কাজে এখন একটু ব্যস্ত।
শামীম হোসেন: আপনার কবিজীবনের কিছু স্মৃতি জানতে চাই।
মৃণাল বসুচৌধুরী: প্রথম কবিতার বই ‘মগ্ন বেলাভূমি’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে—ঠিক ৫০ বছর আগে। লেখালেখি তারও আগে থেকেই। এই দীর্ঘ কাব্যজীবনের অনেক স্মৃতিই ঘোরাফেরা করে চারপাশে। ছোটছোট মধুর স্মৃতি মনে পড়ে প্রায়শই। যখন লিখতে শুরু করি, তখন অগ্রজ ও অনুজ কবিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সুন্দর ও সহজ। অগ্রজ কবি ও গল্পকারদের স্নেহের স্পর্শ পেয়েছি অফুরান। সবচেয়ে মধুর স্মৃতি, যা অম্লান হয়ে আছে এখনও, শুধু সে কথাটাই বলি। বেশ কিছুদিন লেখালেখি করলেও দেশ পত্রিকায় লেখা পাঠাইনি তখনো। অগ্রজ কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে ১৯৬৪ সালের ডাকযোগে একটি কবিতা পাঠিয়ে দেই, দেশপত্রিকার দপ্তরে। ধরেই নিয়েছিলাম, ছাপা হবে না। কিন্তু দিন পনেরোর মধ্যে একটি চিঠি এসেছিল ডাকে। সম্পাদক সাগরময় ঘোষের লেখা। জানিয়েছিলেন, কবিতাটি তাঁর পছন্দ হয়েছে, ছাপা হবে সময়মতো। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, কেমন যেন স্বপ্নের ঘোরেই কেটেছিল কয়েকটা দিন। দেশ-এ প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার অনেক পরে মুখোমুখি হয়েছিলাম সাগরদার। মনে আছে ইউএসআইএস-এর আয়োজনে একটি কবিতার ওয়ার্কসপ হয়েছিল দীঘায়। সাগর দা, নীরেন দা, সুনীল দা, নবনীতা দি ছাড়াও অনেক অগ্রজ কবি যোগ দিয়েছিলেন সে ওয়ার্কসপে। সেখানেই সাগরদাকে অনেক্ষণ কাছাকাছি দেখার সুযোগ পাই। অনেক কথা বলেছিলেন। মহান শব্দটির প্রকৃত অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন। সুনীল দা, শক্তি দা, কফিহাউজ ঘিরে হাজার হাজার স্মৃতির ওড়াউড়ি। আমাদের শ্রুতির বন্ধুরা, পবিত্র দা, রত্নেশ্বর—এরা তো আছেন সবসময় আমার স্মৃতিঘরে। আছে শান্তনু এবং সুরজিৎ। এবং পূর্ণেন্দু দা। স্মৃতিকথায় তাঁরা আছেন, এখানে আর নাই বা বললাম।
শামীম হোসেন: আমি যতদূর জানি তরুণ কবিদের লেখা আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়েন। তাদের কবিতার ভাষা-আঙ্গিক-চিত্রকল্প যাই-ই বলি না কেন কেমন লাগছে আপনার কাছে?
মৃণাল বসুচৌধুরী: হ্যাঁ, তরুণদের লেখা আমি খুব যত্ন নিয়ে পড়ি।তরুণ মানে বয়সে এবং মানসিকতায় তরুণ।তবে, বয়স্ক যাঁরা, সবে লেখা শুরু করেছেন, হিসাব করলে হয়তো তাঁরাও তরুণ। কিন্তু আমি তরতাজা তরুণদের লেখা খুব পড়ি—নতুন করে কিছু শিখব বলে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, বিষয় নির্বাচন, ভাষা, আঙ্গিক, চিত্রকল্প থেকে আমি জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি কবিতার গতিপথ। নিজেকে শিক্ষিত করে নেওয়ার প্রয়াস আমাকে তরুণদের কাছাকাছি রাখে হয়তো। মাঝেমধ্যে তাদের প্রকাশভঙ্গি আমাকে বিস্মিত করে, উদ্বুদ্ধ করে নতুন লেখায়।
শামীম হোসেন: শ্রুতি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আপনি। এখন কি দুবাংলাতেই এ ধরনের কোনো আন্দোলন চোখে পড়ছে?
মৃণাল বুসচৌধুরী: আমাদের শ্রুতি আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। ১৯৭১ এ তা বন্ধ হয়ে যায়। ষাটের দশকে দুতিনটি আন্দোলন হয়েছিল কবিতার। তারপর দুই একটি ছাড়া তেমনভাবে কিছু চোখে পড়ে না। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ-কেউ একেবারে একেবারে নতুনভাবে কিছু লেখার চেষ্টা করছেন হয়তো, কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে ঘোষিত কোনো আন্দোলন এখন আর চোখে পড়ছে না দুই বাংলায়। তবু যাঁরা সব কিছু পাল্টে দিয়ে প্রচলিত রচনারীতির বাইরে দাঁড়িয়ে বেছে নিতে চান নতুন প্রকাশভঙ্গি, ভাষা। অভিনবত্ব আনতে চান বিষয় নির্বাচনে, তাঁদের সবার প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল।
শামীম হোসেন: বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা কবিতায় কিছু মৌলিক পার্থক্য খুঁজে পান?
মৃণাল বসুচৌধুরী: দুই বাংলার কবিতার মৌলিক পার্থক্য নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আবহে যে সমস্ত কবিতা রেখা হয়েছিল বাংলাদেশে, তার সুর, পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক কবিদদের কবিতা থেকে একটু ভিন্নধর্মী হলেও তার মূল্য অপরিসীম। ওই সমস্ত কিবতা বাংলাভাষার সম্পদ এবং ইতিহাসেরও। তাঁদের হাত ধরেই পরবর্তীকালে বাংলা কবিতার জগতে এসেছে নতুন সুর। স্বদেশে, সমাজ, মানুষ নয়, ব্যক্তিই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে কবিতায়। পশ্চিম বঙ্গে যা অনেক আগে থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল কাব্যভাষায় ও বিষয় নির্বাচনে।
ঠিক এই সময়ে বাংলা ভাষায় যেসব কবিতা লেখা হচ্ছে, তা যে কোনো কবিতাপ্রেমীর কাছে গর্বের বিষয়। আমি কিন্তু দুই কারণে বাংলার কথাই বলছি। কবির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে গুণগত মান। বিষয়বৈচিত্র্যে ও কাব্যভাষায় পরিবর্তনও এসেছে অনেক। অনুভবী অথচ স্মার্ট প্রকাশভঙ্গিতে এসেছে নতুন জোয়ার। তবে এত কবি আর এত কবিতার মধ্যে ভালো কবিতা হারিয়ে যাচ্ছে নিয়তই। পাঠকের কাছে কষ্টকর হচ্ছে ভালো কবিতা খুঁজে নেওয়া। তবু আমি আশাবাদী। কারণ, জানি, এতকাল ধরে কুড়ি আর মিছরীকে আলাদা করার দায়িত্বপালন করে এসেছেন মনোযোগী পাঠকেরা। অক্ষমের ছায়া থেকে ক্ষমতাবানদের চিহ্নিত করবেন তাঁরাই।
শামীম হোসেন: মৃণাল দা, আপনি প্রায় এ দেশে আসেন। এ দেশের জল-আবহাওয়া, শিল্পসাহিত্য নিয়ে কিছু শুনতে চাই।
মৃণাল বসুচৌধুরী: ওপরের মানুষজন, জল হাওয়া, শিল্পসাহিত্য নিয়ে আলাদা করে কী আর বলি বলুন তো।কাঁটাতারের বেড়া পেরোলেই মনে হয় স্বদেশেই আছি। শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতিও দুই বাংলায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে যে কথাটা না বললেই নয়, তা হলো, অতিথিপরায়ণ মানুষজনের কথা। এত আন্তরিকতা, এত ভালোবাসা, এত উষ্ণতার ছোঁয়া পাইনি কোথাও। বাংলাদেশে বারংবার ছুটেছুটে যাই এই উষ্ণতার লোভেই।
শামীম হোসেন: প্রচারকাঙাল কবি-সাহিত্যিক সবসময়ই থাকে। তাদের ডামাডোলের আড়ালে হারিয়ে যান প্রকৃত লেখক। লেখক-পাঠকের দূরত্বের সূত্রপাত কি এ কারণেই?
মৃণাল বসুচৌধুরী: প্রচার কাঙালদের ডামাডোলে প্রকৃত লেখকরা আড়ালে থেকে যায়। জানতে চেয়েছেন, পাঠক ও লেখকের দূরত্বের সূত্রপাত কি এভাবেই হয়। ঠিক জানি না, তবে খ্যাতির লোভ সবারই থাকে। এমনকি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীও চান তাঁর ত্যাগ নিয়ে আলোচনা হোক। এটা অন্যায় নয়। কিন্তু এই লোভ যখন কাঙালিপনায় পর্যবসিত হয়, তখনই কষ্ট লাগে। যাঁরা কবিতা লেখেন, গল্প লেখেন, তাঁরা তো চাইবেনই, অন্যরা তাঁদের লেখা পড়ুক। আমরা সবাই তাই চাই।
কিন্তু প্রচারের জন্য দলবাজি করে নিজেকে অনন্য প্রমাণ করার চেষ্টা যাঁরা করছেন, তাঁদের অনেকেই সাহিত্যের ইতিহাস ও পরম্পরা জানেন না। তাই বোঝেনও না কী লিখছেন, এবং সে লেখার কোনো প্রয়োজন আছে কি না। তাঁদের অনেকের লেখার মধ্যে কারিগরি বিদ্যা আছে, ক্রিয়েটিভিটি নেই। তা সত্ত্বেও দলের মানুষদের কাছে তাঁরা প্রয়োজনী হয়ে ওঠেন। এসব চিরকাল ছিল, থাকবে। আমি এসব নিয়ে খুব ভাবি না। নিজের সঙ্গে একান্তে বসবাস করতে শেখেনি যে মানুষ, সাহিত্যকে সাধনা বলে ভাবতে পারেন না যে মানুষ, সেই শুধু কৃত্রিম খ্যাতির পেছনে দৌড়ে বেড়ায়। প্রাপ্য নয়, এমন কিছু হঠাৎ কেউ দিলে সেটা হয় ঘুষ, নয় বকশিস—এই বোধটাও তাঁদের নেই।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা মনে পড়ছে, ‘যথার্থ সৌন্দর্য সমাহিত পাঠকের কাছে প্রত্যক্ষ।’ কবি ও পাঠক দুজনকেই সমাহিত হতে হবে, তবেই প্রত্যক্ষ হবে সৌন্দর্য। কবিতার কাছে পার্থিব-অপার্থিব সৌন্দর্যের কাছে দ্বিধাহীন সমর্পণই আমাদের মুখোমুখি করি দেয় অন্তর্লীন সৌন্দর্যের সঙ্গে। কবিতার কাছে ঐতিহ্য, পরম্পরা, সংস্কৃতির কাছে সমর্পিত না হয়েই যারা কবিতার জগতে পাকাপাকি আসন দখল করতে চান, কোনো রকম মূল্য না দিয়েই যাঁরা পেতে চান মূর্খ হাততালি, তাঁদের সকলের জন্য রবীন্দ্রনাথের ঐকতান কবিতার সেই অমোঘ উচ্চারণটি স্মরণ করি—
সত্যমূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি
ভালো নয়, ভালো নয়, নকল সে সৌখিন মজদুরি।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমি সাহিত্য বা সংস্কৃতির অভিভাবক নই, যে ক্ষমতাও আমার নেই। পঞ্চাশ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানি, শেষপর্যন্ত দলনেতা থেকে যান, দল থাকে না, কবিতাই থাকে, খ্যাতি নয়। অগ্রজদের কাছে শিখেছি, যে কোনো কবির প্রথম ও শেষ কাজ কবিতা লেখা, ভালো কবিতা। পাঠকের কাজ, ভালো কবিতাকে চিহ্নিত করা, করতে শেখা। আর এভাবেই কবি ও পাঠকের অমলিন যোগাযোগসূত্র গড়ে ওঠে।
আপনার কথা মানছি, এই ডামাডোলে হারিয়ে যান প্রকৃত কবিরা। যেকোনো ছোটকাগজে ২৫০/৩০০ কবিতার মধ্যে ভালো লেখা বেছে নেওয়া পাঠকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কবিতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে যাওয়াও স্বাভাবিক। তবু, দেখবেন, পাঠক ও সমালোচকের চোখ এড়িয়ে প্রকৃত কবির মৃত্যু হবে না। কোনো দিন। ইতিহাসও এই কথা-ই প্রমাণ করেছে বারবার।
শামীম হোসেন: আপনি এত সময় দিলেন! এই কবিতাময় কথামালা স্মৃতি হয়ে রইল। চিন্তাসূত্র-এর পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
মৃণাল বসুচৌধুরী: আপনাকে ও চিন্তাসূত্রকেও আমার ধন্যবাদ, অভিবাদন!